একটি নিঃসঙ্গ রাত

একটি নিঃসঙ্গ রাত

আমার স্ত্রীর নাম লোপা।আমাদের বিয়ে হয়েছে ৩ বছর।এই তিন বছরে ও আমার সাথে অভিমান করে বাবার বাড়িতে চলে গেছে ৭ বার। এটা নতুন কিছু নয়।এই তো গত ২ দিন আগেও আমার সাথে রাগ করে ও আবার ওর বাবার বাড়িতে চলে গেছে।তবে মাঝে মাঝে ঝগড়া হয় বলে এমনটা না যে,আমি ওকে ভালোবাসি না বা ও আমাকে ভালোবাসে না।তবে এবারের ব্যপারটা মনে হয় একটু বেশিই হয়ে গেছে।আমিই একটু বেশি রাগারাগি করে ফেলেছিলাম।এমনকি ওকে হালকা করে একটা চড়ও মেরেছিলাম।এবার ওর রাগ ভাঙাতে বেশ বেগ পেতে হবে মনে হচ্ছে।তবে যেভাবেই হোক ওকে খুব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে আনতে হবে।খুব ভালোবাসি যে।এই মূহূর্তে খুব মিস করছি ওকে।বাড়িটা একদম খালি খালি লাগছে।

আসলেই খালি।আমি ছাড়া এখন এই বাড়িতে আপাতত কেউ নেই এই বাড়িতে।আমি আর লোপাই শুধু থাকি ২ রুমের ছোট্ট এই বাড়িটাতে।আর ও তো চলেই গেছে।

এখন সময় কত হবে,প্রায় রাত ৮ টা বাজতে চলল বোধ হয়।ঘর পুরোপুরি অন্ধকার।আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওর কথাই ভাবছি।আজ সারাদিনই শরীরটা কেমন যেন লাগছিল।তাই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসি।তাতেও কি শান্তি!!নিজের খাবার ব্যবস্থাও নিজেকেই করতে হয়েছে।বেশি কিছু না।ভাত আর ডিম ভাজি।ছাত্রজীবনে কয়েক বছর মেস এ কাটাতে হয়েছিল।তাই সামান্য অভ্যাস আছে।তবুও অনেক ঝামেলা।অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এরকমই আরো নানা সাত পাচ চিন্তা ভাবনা করতে লাগলাম।আজকে অফিস থেকে আসার সময় ভেবেছিলাম সন্ধ্যার সময়ই রাতের খাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ব।নাহ,তার কিছুই হলো না।রাতের খাওয়াও হয় নি এখনো।রান্না শেষ করার পর থেকেই এভাবে শুয়ে শুয়ে সাত আকাশ পাতাল চিন্তা করছি।নাহ,এখন কিছুতেই ঘুম আসবে না মনে হচ্ছে।মাথায় শুধুই লোপার কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে।নাহ,এভাবে আর হবে না।কালকেই ওকে গিয়ে নিয়ে আসতে হবে।

উহূ,ঘুম তো এখন কিছুতেই আসবে না মনে হচ্ছে।কি করা যায়,কি করা যায়?আচ্ছা লোপার বুক শেলফ থেকে একটা বই নিয়ে পড়ব কি?আসলে এইসব বই নিয়ে আমার মোটেই আগ্রহ নেই।কিন্তু লোপার এইসব গল্প,উপন্যাসের বই নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ।ওর এই আগ্রহের জন্যই আমার ঘর ভর্তি গল্প উপন্যাসের বই।মাঝে মাঝে আমিও ওকে বই কিনে এনে দেই।হুমায়ূন আহমেদের কোন বই এনে দিলে ও যেন ঈদের চাঁদ হাতে পায়।আমারও খুব ভালো লাগে তখন।হূমায়ূন আহমেদ কীরকম লেখেন আমি জানি না।ওনার কোন বই পড়ি নি আমি কখনো।কিন্তু লোপার কাছে ওনার সুনাম শুনতে শুনতে আমার কান ঝালাপালা।আচ্ছা বুক শেলফ থেকে হুমায়ূন আহমেদের একটা বই নিয়ে পড়লে কেমন হয়?হয়তো এক ঢিলে তিন পাখিও মারা যেতে পারে।এক তো একাকীত্ব কাটানো হবে।আবার লোপা কি নিয়ে এত লাফায় সেটাও কিছুটা বুঝতে পারব।আর কপাল খুব ভালো হলে হয়ত বই পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়তে পারি।হ্যা।তাই করব।বই-ই পড়ব।

বিছানা থেকে নেমে ঘরের বাতিটা জ্বালালাম।আলো কিছুটা চোখ সয়ে এলে উঠে বুক শেলফের কাছে গিয়ে সবার উপরের বইটাই হাতে নিলাম।বইটার নাম দেখে আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম।আশ্চর্য তো,লোপা কি জানত,আমি এখন একাকী বোধ করায় বই পড়ব,তাই এই বইটাই সবার উপরে রেখে গেছে?বইটার নাম ” কোথাও কেউ নেই”।অবাক কান্ড,আমিও তো একাই এখন।একটু মুচকি হাসলাম আমি।কাকতালীয় ব্যাপারগুলো খুব বেশি ঘটে না আমাদের জীবনে।যাক,বই পেলাম।এখন এটাই পড়তে হবে।বইটা নিয়ে আমি দক্ষিনের খোলা জানালার পাশে রাখা চেয়ারটায় গিয়ে বসব এখন।এই চেয়ারটা আমার আর লোপা দুই জনেরই খুব প্রিয়।লোপা প্রায়ই এখানে বসে বই পড়ে।ও যখন এখানে বসে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে আর জানালা দিয়ে আলো এসে ওর গালে পড়ে তখন ওকে দেখতে যে কি সুন্দর লাগে!!ও তাকিয়ে থাকে বইয়ের দিকে,আমি তাকিয়ে থাকি ওর দিকে।হ্যা,যা বলছিলাম,এই চেয়ারটা আমারও খুব প্রিয়।তবে আমি মাঝে মাঝে বিকালে এখানে বসি শুধু দখিনা হাওয়া খাওয়ার জন্য।মাঝে মাঝে হয়ত দুই একটা পাখিও দেখা যায় জানালা দিয়ে।খুবই ভালো লাগে তখন।

“কোথাও কেউ নেই” বইটা নিয়ে চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম আমি।যদিও রাতের বেলা বলে বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না কিন্তু গ্রীষ্মের রাত্রিতে চমৎকার হাওয়া আসছে।যাক,এখন আপাতত লোপার কথা চিন্তা না করে বইটা পড়া যাক।

এক বসায় বইটা পড়ে শেষ করে ফেললাম।খুবই চমৎকার বই।শেষটায় খুবই কষ্ট পেলাম বইটা পড়ে।এখন যদি সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলি দেখার জন্য কেউ নেই।কেউ বলবে না,”ওমা বই পড়ে দেখি কাঁদছে,হিহিহি”।তবে শেষ পর্যন্ত একটাই আফসোস রইল,তিন নাম্বার পাখিটা মারা হলো না।নাহ,এর মধ্যে একবারের জন্যও ঘুম ধারে কাছেও ঘেষে নি।বইটা চেয়ারেরই এক কোনায় রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ঘন্টার কাটা প্রায় ১ টা ছুই ছুই।এই যাহ,বই পড়তে পড়তে রাতের খাওয়ার কথাই ভূলে গেলাম।এত কষ্ট করে রান্না করে কি লাভ হলো তবে।কিন্তু এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।থাক,রান্না করেছি করেছিই।খাব না।একা থাকার অনেক ঝামেলা থাকলেও একটা সুবিধা আছে।নিজের ইচ্ছামতো সব করা যায়।ও থাকলে এখন ইচ্ছা না থাকলেও আমাকে খেতে হতো এখন।আচ্ছা নাহয় রাতে খেলামই না,কিন্তু ঘুমের কি হবে?এখনো তো এক ফোটা ঘুম আসছে না।রাত যত বাড়ছে ঘুম ছুটে পালাচ্ছে।নাকি আজ রাতটা না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেব?এক রাত না ঘুমালে নিশ্চয়ই এমন কিছু ক্ষতি হবে না।কিন্তু না ঘুমিয়েই কি করব?কি করা যায়?লোপাকে কি একটা ফোন করব?নাহ,এত রাতে ফোন করে রাগ ভাঙানোর চিন্তা করা নেহায়েত বোকামি হবে।তবে কি করা যায়?ছাঁদে গিয়ে বসে থাকব চুপচাপ?হ্যা তাই নাহয় করি।আজ রাতে ঘুমাবই না যখন তখন একা একা যা খুশি করব।দেখার তো কেউ নেই।আজ আসলেই আমার চারপাশে কোথাও কেউ নেই।

মোবাইলটা হাতে নিয়ে আমাদের একতলা বাড়িটার ছাঁদে উঠে এলাম।মোবাইলটার যদিও কোন প্রয়োজন নেই এখন,তবুও অনেকটা অভ্যাসবসত হাতে করে নিয়ে এসেছি।আরে,আজ দেখি আকাশে চমৎকার পূর্নিমা।জানালার কাছে বসে গাছের ছায়ায় তখন খেয়াল করি নি।যাক ভালোই হয়েছে চাঁদের আলোয় চুপচাপ বসে থাকি কিছুক্ষন।আহ,চমৎকার পরিবেশ।চাঁদের আলো,তার সাথে ঠাণ্ডা বাতাস।আর কি চাই?তবে এরকম সুন্দর আবহাওয়াও আমার কেমন যেন সূক্ষ্ণ একটা অস্বস্তি হচ্ছে।কি জন্য,উম্ম ঠিক বুঝতে পারছি না ঠিক।আরো কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থাকার পর অস্বস্তির কারনটা বুঝতে পারলাম।আমার আশেপাশে অনেকগুলো শব্দ হচ্ছে।দুপ-দুপ-দুপ শব্দ।এই তো ছাঁদের ডান পাশের আম গাছের ডাল থেকেও একটা শব্দ আসছে।দুপ-দুপ-দুপ……
তবে শব্দটা খুবই চাপা ও ক্ষ্ণীন।খুব মনযোগ না দিলে হয়তো বুঝা যাবে না।ওই তো আরেকটা আসছে নিচে মাটি থেকে।এরকমই দুপ-দুপ শব্দ।তবে আম গাছেরটা আর এটা এক নয়।এটা আরেকটু তীক্ষ্ণ আর দ্রুততর।এরকমই আরো অনেকগুলো শব্দ হচ্ছে আশেপাশে।তবে একটার সাথে আরেকটা আলাদা।কোনটা দ্রুত দুপ-দুপ শব্দ করছে,কোনটা কিছুটা আস্তে।তবে কোন শব্দই অসহনীয় পর্যায়েরও নয়।তবুও আমার কেমন যেন ভয় করছে।

অনেক্ষন চিন্তা করেও বের করতে পারলাম না ওগুলো কিসের শব্দ হচ্ছে।সত্যি বলতে আমি খানিকটা ভীতূ।এখনো ছোটবেলার ভূতের ভয় কিছু কিছু রয়ে গেছে।এটা নিয়ে লোপা প্রায়ই হাসাহাসি করে।কিন্তু আমার একটুও খারাপ লাগে না।বরং ওর হাসি দেখতেই আমার ভালো লাগে।কারন যাই হোক,তবুও তো ওর হাসিটা দেখতে পাই।না,না,এখন লোপার কথা বাদ দিয়ে বরং শব্দটার কথা ভাবা যাক।কিসের শব্দ ওগুলো?এখন ২ টা কাজ করা যায়।এক হচ্ছে শব্দগুলো আরো মনোযোগ দিয়ে শুনে কিসের হতে পারে তা বুঝতে চেষ্টা করা,আর নাহয় সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করা।ভেবে দেখলাম ওগুলো নিয়ে আর না ঘাটানোই ভালো।এতে শুধু শুধু ভয় আর অস্বস্তি দুটোই বাড়বে।তার চেয়ে ওগুলো হচ্ছে হোক,আমার কি?

কোন কিছু একবার মাথার ঢুকে বসলে তা মাথা থেকে সরানো যে কত কঠিন তা চাঁদের আলোয় ছাঁদে সবে বুঝতে পারলাম।ওই শব্দগুলোর ব্যাপারে চিন্তা না করে কিছুতেই থাকতে পারছি না।খালি ওগুলোই মাথাতে ঘুরছে।বুঝেছি ওগুলো মাথা থেকে সরাতে হলে অন্য কিছুতে মনযোগ দিতে হবে।আচ্ছা এই চমৎকার চাঁদের আলোতে একটা গান গাইলে কেমন হয়?না,না,কবিতা।লোপাকে নিয়ে একটা সুন্দর কবিতা বানাই বরং।এবার চোখ বন্ধ করে খানিক্ষন বসে রইলাম।চমৎকার কিছু লাইন মাথায় এসেছে।এক্ষুনি এগুলো লিখে ফেলতে হবে।কিন্তু সাথে তো খাতা কলম নেই।মোবাইলে নোট করে রাখব?না,না বরং মোবাইলেই ভয়েস রেকর্ড করে রাখি।পরে এটাকে ইচ্ছা হলে বলব কবিতা,ইচ্ছা হলে গান।দুইটাই হবে।যাক মোবাইলটা সাথে এনে ভালোই হয়েছে।ওরে বাবা,রাত দেখি প্রায় ২ টা বাজে।যাক,আমার কি আমি তো আজকে ঘুমাবই না।এবার মোবাইল এ রেকর্ডার অন করে কবিতা বা গানটা রেকর্ড করে নিলাম।আমার গলা যদিও বেশি ভালো না তবে লোপা খুব খুশি হবে মনে হয়।তবে এটা রেকর্ড করার সময় একটা কান্ড হলো,শেষ হওয়ার প্রায় সেকেন্ডখানেক আগে একটা টিকটিকি টিক টিক টিক করে উঠল।আমি একটু মুচকি হাসলাম কোথায় যেন শুনেছিলাম,কারও কথার শেষে টিকটিকি যদি টিক টিক করে,তার মানে ও ঠিক ঠিক ঠিক করে সমর্থন জানিয়েছে।কে জানে হয়ত আমার বেসুরো কবিতাগুলো টিকিটিকিটার পছন্দ হয়েছে।

আবার অদ্ভূত শব্দগুলো মাথায় ঘুরছে।কিসের শব্দ ওগুলো!!আরে,আরে,,আরেকটা নতুন ধরনের দপ-দপ-দপ শব্দ যুক্ত হয়েছে মনে হচ্ছে।এটা অনেক জোরালো।আর মোটামোটি ভালোই দ্রুতগতির।হ্যা,এইতো,পাশের বাসার একতলা বাড়িটার ছাদ থেকেই শব্দটা আসছে মনে হচ্ছে।দপ-দপ-দপ-দপ-…………
মনে হচ্ছে এই শব্দগুলোর কোন বিরাম নেই।অন্য ছোটখাটো শব্দগুলো যদিও এতক্ষন একটু গভীরভাবে অন্য কিছু চিন্তা করে এড়ানো যাচ্ছিল এটা এড়ানো যাবে না।একবার ভাবলাম যাই নাহয়,ওই ছাঁদে গিয়ে দেখে আসি কিসের শব্দ।আমাদের আর পাশের ছাদের মাঝখানে ফাঁক খুব বেশি না।হালকা একটা লাফ দিয়ে চলে যেতে পারব।কিন্তু শেষমেষ আমার সাহসে কুলোল না।ধুর ছাই,কি যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।তার চেয়ে বরং ঘরেই ফিরে যাই।নাহয় আরেকটা বই পড়ে শেষ করে ফেলি।এছাড়া আর কিই বা করতে পারি।কিংবা একটু ঘুমানোর চেষ্টাও করে দেখা যেতে পারে আবার।

সিড়ি বেয়ে আবার ঘরেই ফিরে চললাম।ঘরে ফিরেই চমকে উঠলাম,ঘরের সব বাতি বন্ধ।এমনকি দক্ষিনের জানালাও বন্ধ।কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি জানালা খুলে রেখে গিয়েছিলাম।তবে এগুলোর একটার জন্যও আমি ঘাবড়ে যাই নি।আমার ঘাবড়ানোর কারনটা হলো দুপ-দুপ শব্দ।হ্যা।পাশের ঘর থেকে জোরালো দুপ-দুপ শব্দ আসছে।ঠিক যেরকমটা একটু আগে শুনে আসলাম পাশের বাড়ির ছাদের দিক থেকে।আমি প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে গেলাম।না,না,মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।কি করা যায় এখন?আরে আরে ২ ঘরের সবগুলো বাতি নিভানো,কিন্তু পাশের ঘরে সামান্য আলো দেখা যাচ্ছে।আমি চুপি চুপি কাপা পায়ে পাশের ঘরের দড়জার কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম পাশের ঘরে কি হচ্ছে?

আমাদের ২ ঘরের বাড়িটাতে আমাদের শোবার ঘর ভেতরের টা।বাইরে থেকে কেউ আসলে আগে পাশের ঘরে আসতে হবে,তারপর ওই ঘর থেকে এই ঘরে।আমি পাশের ঘরের দড়জার কাছে দাঁড়িয়ে দেখলাম বাড়িতে ঢুকার মেইন দড়জা সম্পূর্ন খোলা।সেখান দিয়েই বারান্দার পরে গেইটের কাছে যে বাতিটা আছে সেটার ক্ষ্ণীন আলো আসছে।সেই আবছা আলোতেই দেখলাম ঘরের ডানদিকের অন্ধকার কোনায় কেউ একজন আছে।সেই কেউ একজন পুরূষ নয়,মহিলা।কারন ও শাড়ি পরে আছে।আর ওই অন্ধকার কোনা থেকেই দুপ-দুপ শব্দটা আসছে।আরে ও উবু হয়ে কি করছে?আর যদি চুরি করাই ওর উদ্দেশ্য হয় তাহলে ওখানে কি করছে?ও যেখানে উবু হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে সেখানে তো রয়েছে কেবল আমাদের ডিপ ফ্রীজ টা।আলমারি-টাকা পয়সা সব তো রয়েছে এই ঘরে।এবার আরেকটা মৃদু শব্দ শুনে আমার মাথায় জট পাকিয়ে গেল।চুরির টুং টাং শব্দ।এবার হঠাৎ করে আমি এই মহিলাটিকে চিনতে পারলাম।

এই অন্ধকারে উবু হয়ে মহিলাটি হচ্ছে,…এটা…
লোপা!!আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।লোপা এত রাতে এখানে কি করে?আচ্ছা নাহয় ও রাতেই এসে পড়েছে,কিন্তু ঘরের সব লাইট নিভিয়ে ফ্রিজের কাছে কি করছে?আর অদ্ভূত শব্দটাই বা কিসের?ও আমাকে ডাকে নি কেন?এবার আর আমি থাকতে পারলাম না।ঘরে ঢুকে পড়লাম,ওকে নাম ধরে ডাক দিলাম।আশ্চর্য ও কি আমার ডাক শুনতে পায় নি?এবার আমি ঘরের লাইট জ্বালানোর জন্য সুইচ চাপলাম।কিন্তু কিছুই হলো না।কিন্তু বাইরের লাইটটা যে জ্বলছে।তবে কি এই ঘরের লাইটটা নষ্ট হয়ে গেল।যাক গে,এইবার আমি ওর কাছে গিয়ে ওর হাতে টান দিতে গেলাম।আশ্চর্য,এটা কি হলো,ওর শরীরে স্পর্শ লাগল না কেন আমার?আমার কি কিছু হয়েছে?নাকি লোপার কিছু হয়েছে?এবার আমি পাগলের মত ওকে ডাকতে লাগলাম ধাক্কাতে লাগলাম কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।যেন ও জানেই না ও ছাড়া এই ঘরে আরো কেউ আছে।এবার আমি সত্যিই পাগলের মত আচরন শুরু করলাম।ওকে ডাকছি,লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করছি।কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।একবার এই ঘরে যাচ্ছি আবার ওই ঘরে যাচ্ছি।আর লোপা এইদিকে ফ্রিজ থেকে বস্তামতো কিছু একটা বের করার জন্য প্রানপন চেষ্টা করছে।আমি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করলাম?এসব কি হচ্ছে আমার সাথে?তবে কি,তবে কি আমি….
না,না,না।
হ্যা পেয়েছি।এক্ষুনি প্রমান হয়ে যাবে।আমি আমার মোবাইলটা বের করে তখনকার ছাঁদে রেকর্ড করা কবিতাটা প্লে করে দিলাম।না,কোন শব্দ হচ্ছে না।
না কবিতা,না দপ-দপ শব্দগুলো।অথচ রেকর্ড ঠিকই প্লে হচ্ছে।আর রেকর্ডটা শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে একটাই কেবল শব্দ হল।টিক টিক টিক।

এখন সব রহস্য আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার।আমি আসলে মারা গেছি।আর হত্যাকারী আর কেউ নয়…
আর ওই শব্দগুলো,,উম্ম… নিশ্চয়ই হৃদপিন্ডের স্পন্দন।তাই তো একেকটার স্পন্দন একেক রকম।কোনটা হয়ত পাখির,বিড়ালের বা পাশের বাসার ছাঁদের জোড়ালোটা হয়ত কোন মানুষের।কিন্তু আমি আমার নিজের হৃদপিন্ডের শব্দ শুনতে পাচ্ছি না।আমি আবার বুকে হাত রাখলাম।একদম শান্ত,কোনরকম স্পন্দনহীন।
আমি নিশ্চিচভাবে মৃত।মৃতরা কি হৃদপিন্ডের শব্দ শুনতে পায়?কে জানে।

আমি মোবাইলটা রেখে শান্তভাবে হেটে পাশের ঘরে চলে এলাম।লোপা অবশেষে ফ্রিজ থেকে ভারী বস্তাটা বের করতে পেরেছে।আমি জানি ওটাতে কি আছে।ও ওটাকে দড়জার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।আমি ওকে প্রানপনে ডাকতে লাগলাম,আমাকে ফেলে রেখে যেও না প্লীজ…
আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।
হঠাৎ করে লোপা দড়জার কাছে বস্তাটা রেখে থেমে দাড়াল।বস্তাটা রাখতেই ওটার মুখ সামান্য খুলে গেল আর আমি ভিতরে একটু দেখতে পেলাম।হ্যা,আমি নিজেকেই দেখতে পেলাম।ওটার ভিতরে আছি আমি।
কিন্তু লোপা থেমে দাড়াল কেন?ও কি আমার ডাক শুনতে পেল?
না,ও আমার ডাকের জন্য থামে নি।ও আমাকে পাশ কাটিয়ে আমাদের শোবার ঘরে চলে গেল।আমিও গেলাম ওর পিছু পিছু দেখার জন্য ও কি করে।ও ঘরে এসে টেবিলের উপর থেকে একটা বই হাতে নিয়ে আবার চলে যাচ্ছে।সেই বই,যেটা আজকেই আমি পড়ে শেষ করেছি।আশ্চর্য,বইটা তো আমি চেয়ারের উপর রেখেছিলাম।হয়ত জানালাটা বন্ধ করার সময় ও বইটা টেবিলে রেখেছে।

লোপা আবার মূল দড়জার কাছে চলে এসেছে।আমিও এলাম ওর পিছু পিছু।কোন শব্দই করছি না।জানি করলেও কোন লাভ নেই।ও শুনতে পাবে না।দড়জার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরেও খানিকটা দেখতে পাচ্ছি।গেটের বাইরে রাস্তায় একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।ওটাতে করেই হয়ত আমার মৃতদেহ নিয়ে যাবে।ও গেটের বাইরে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে।আর আমি প্রানপনে চিৎকার করে কাঁদছি।চলে যাওয়ার আগে ওকে পেছন থেকে শেষবারের মত ভেজা চোখে দেখতে পেলাম।আমি জানি এখন ওর চোখেও আমার মত পানি।ডান হাতে রয়েছে আমাকে বহনকারী বস্তাটা আর বাম হাতে রয়েছে বইটা,যার নাম “কোথাও কেউ নেই”।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত