শ্রাবন বাথরুমের লাইট জ্বালাতে সবকয়টি সুইচ একসাথে চাপ দিল। সে খুব কম ভাবতে চায়। চব্বিশ বছর এই বাসায় হলো এখনো কোন সুইচ কিসের’ সেটা ভালভাবে তার নলেজে নেয়নি। আজ বাথরুমে মোবাইল নেয়নি। নতুন মোবাইলটা বাথরুমে পড়ে গেছে,সেটা স্বপ্নে দেখেই ঘুম ভেঙ্গেছে তার। খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসলো।
লাইট অফ করতে তার মনে থাকে না। রুমে এসে ফ্যান বন্ধ করলো। আজ খুব শীত শীত লাগছে। কাল রাতে একটা বাংলা নাটক দেখেছে। নাটকে নায়িকা চা এনে ঘুম ভাঙ্গালো নায়কের। নায়িকার ভিজে চুল, টুপটুপ করে পানি ঝড়ছে। চুলগুলো সামনে এনে আলতো করে মুছছে একহাতে, অন্যহাতে পর্দাটা সরিয়ে আলো করে দিচ্ছে ঘর। সেই আলোতে নায়ক একদৃষ্টিতে নায়িকার দিকে তাকিয়ে না ধোয়া মুখে চা খাচ্ছে। শ্রাবনের কোন নায়িকা নেই। সামনের রাস্তার মোড়ে একটা মেয়েকে গত দুইদিনে তিন বার দেখেছে শ্রাবন, খুব মনে ধরেছে মেয়েটাকে। গতকাল পর্যন্ত ব্যপারটা অনিচ্ছাকৃত ছিল। আজ তার খুব ইচ্ছে না ধোয়া মুখে চা খেতে খেতে মেয়েটাকে দেখবে।
কাল দেখেছে নয়টায়, এখন আটটা পঁয়ত্রিশ বাজছে। শ্রাবনের ঘড়িতে আটটা চল্লিশ। শ্রাবনের মা নেই। মারা যাওয়ার আগ পযন্ত ছেলেকে নিয়ে অসয্য চিন্তে হতো তার মায়ের। মায়ের কাছে শ্রাবন খুব অবুঝ। কিছু নিয়েই সিরিয়াস না।খুব ধীরে ধীরে ভাবতে চায় সবকিছু। তাই মা তার ঘড়িতে পাঁচ মিনিট বাড়িয়ে রাখতো। বাড়ানো আছে এখনো। মা শ্রাবনকে জোর করে সিঁতি করাতো। আজ আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজে নিজে সিঁতি করছে শ্রাবন। পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেল। আরিশের ঘড়িতে নয়টা দশ বাজছে। বের হওয়ার জন্য দরজা খুলছে, কলিং বেলটা ও একই সাথে বাজছে। পাঁচটা মেয়ে একসাথে। গত দু,দিন একটানা দেখা ঐ মেয়েটা সবার পিছনে।
কথা বলছে পিছন থেকে! স্যার কি বাসায়?
শ্রাবন- বাবা? আরেকটা মেয়ে বলল, স্যার কি আপনার বাবা?
শ্রাবন- হ্যাঁ, ভিতরে এসে বসুন। আপনারা কি বাবার নতুন ব্যাচ? মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, পরশু থেকে শুরু করেছি।
শ্রাবন- হ্যাঁ, বাবা চলে আসবে। ডায়াবেটিস পরিক্ষা করতে বের হয়েছে সকাল সকাল।
মেয়েটি – বাসায় আর কেউ নেই?
শ্রাবন -না,আপু ছিল! তার বিয়ের পর আমি আর শুধু বাবা। মা’ নেই, আর কেউ নেই।
মেয়েটি- আপনি কি কোন কাজে বের হচ্ছিলেন? আরেকটি মেয়ে বলতে লাগলো, আপনি চলে গেলে আজ তো আর আমাদের পড়াই হতো না। ভিজে ভিজে এত করে আসছিলাম আমরা।
শ্রাবন- না, নিচে যাচ্ছিলাম। চা খেতে!
মেয়েটি- তাই বলে এই বৃষ্টিতে? বাসার চা তো বেশি ভাল। আপনাদের বাসাটায় ঢুকলে আমার খুব চা খেতে ইচ্ছে করে। পুরো বাসার পরিবেশটা কেমন জানি চা খাওয়ার।
শ্রাবন- বাবার চা ভাল হয় না, মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবা রঙ চা বানিয়ে খায়। আমার রঙ চা পছন্দ না। মায়ের চা পছন্দ। মায়ের চা ছিল অমৃত! পুরো ঘর মায়ের হাতেই সাজানো। একটি মেয়ে জোরে বলে উঠলো, নিরালা চা খাবো! ভাইয়্যা, নিরালা খুব ভাল চা বানায়। প্লিজ, নিরালা! বানাবি বল।
শ্রাবন- হ্যাঁ, এই বৃষ্টি মুখর দিনে চা খেলে খুব ভাল হয়। নিরালা কি তুমি?
নিরালা- হ্যাঁ ভাইয়া।আমিই নিরালা! আমি একা পারবো না চা বানাতে, ‘অন্তি’কে ও লাগবে। আমি একা কিছু পারি না।
শ্রাবন- আচ্ছা আমিও আসছি, চলো। ভাল একটা চা শিখা লাগবে যেভাবে বর্ষা এসে পড়ছে,অফিসের চা ও ভাল না।
চা চুলা থেকে নেমে কাপে পড়ছে। কলিং বেল বাজছে! শ্রাবন দরজা খুলল। কিরে বাবা! এত জুতো,মেয়েগুলো কি এই বৃষ্টিতে আসছে? হ্যাঁ, বাবা! অপেক্ষা করছে ওরা! তুমি তো ভেজে গেলে বাবা। বৃষ্টি তো অনেক, ভিজেছি তো অল্প! তোমরা কিভাবে এসে পড়লা? স্যার, ভিজে ভিজে। ভাবছি আসবো না, কিন্তু কালকের গল্পটা তো অর্ধেক বাকি, বাকিটা শুনার জন্যে ঘুম আসেনি আমাদের কারোই।
স্যার- হা হা হা,হোম ওয়ার্ক না হলে তো গল্প আগাবে না। এই নিরালা কি করছো ওখানে?
নিরালা- স্যার, চা! ভাইয়্যা আমাদের জন্য চা খেতে যেতে পারেনি বাহিরে। তাই আমাকে সবাই জোর করলো।
স্যার- বাহ,মাশাল্লাহ। কি সুন্দর রঙ হয়েছে। আমার জন্য হবে তো?
শ্রাবন- বাবা, ডাক্তার কি বললো তা আগে বলো।
বাবা- ডায়াবেটিস বেড়েছে, মিষ্টি খাওয়ায় আবারো জোরালো বারন! এই চা খেয়ে আর কোন মিষ্টি ছুবো না, এখন আবার তুই খেতে না করিস না আমাকে। নিরালা খুব হাসছে। কি অভিমানী মুখ বাবার,ছেলের সামনে। শ্রাবন বাবার হাতে চা দিল, সবচেয়ে কমটা। যেটা নিরালা নিজের জন্য রেখেছিল।
স্যার- মাশাল্লাহ, কতদিন পর একটা চায়ের মত চা খাচ্ছি! শুন নিরালা! তোদের এই ইঞ্জেনিয়ার ভাইয়্যার জন্য পরশু সন্ধায় একটা মেয়ে দেখতে গেলাম। ওরা অনেক কিছু দিলো খেতে।
চা ও দিয়েছিল! মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম চা কি তুমি বানিয়েছিলে মা? মেয়ে মাথা নেড়ে বলছে না! মেয়ের মা জোর দিয়ে বলছে, হ্যাঁ। তাদের সব কথাবার্তাই এমন ‘হ্যাঁ আর না’ এর মত ছিল। তাই ভাল লাগে নাই। হা হা হা। আচ্ছা, পিজিক্স বই খুলো তোমরা। আর নিরালা জানালার পর্দাটা একটু সরিয়ে দেখো তো বৃষ্টি থামলো কিনা! বৃষ্টি তো নেই স্যার। নিরালা পর্দা সরাতেই আলো সব ঘরে ঢুকে আসলো। শ্রাবন না ধোয়া মুখে নিরালার দিকে তাকিয়ে পুরোটা চা খেয়ে নিলো। খানিক পর আবার বৃষ্টি নামলো।