গত এক মাস ধরে আমি নিজেকে নিয়ে অনেক ভেবেছি। কেমন একটা পরিবর্তন কাজ করছে আমার মাঝে। আমার বার বার মনে হচ্ছে আমি কাজটা ঠিক করছি না। নিজেকে কেমন একটা অপরাধী মনে হয় যেটা আমার কাছে আগে কখনো মনে হয়নি। আমি অনেক কে ঠকিয়েছি কিন্তু রিমির সাথে পরিচয়ের পর একটা অন্যরকম চিন্তা ধারা বিরাজ করেছে। আমি চুপ হয়ে রিমির সামনে মাথা নিচু করে বসে আছি। আমার কাছ থেকে রিমি এই রকম আশা করবে হয়ত ভাবেনি। চেহারা কেমন হয়ে আছে ওর। চোখ গুলা কেমন লাল হয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে চোখটা মুছে আমায় বলতে লাগলো “কিছু খেয়েছো? আমি মাথাটা সোজা করে ওর দিকে তাকাঁলাম। এমন ভাবে কথাটা বললো যেন আমি ওর সাথে কিছুই করিনি বা আমার কোন দোষ নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বললো। আমি কিছু না বলে মাথাটা নিচু করে নিচের দিকে তাকালাম। নিচের দিকেই তাকিয়েই বললাম “হ্যাঁ খেয়ে এসেছি। “তুমি মিথ্যে বলছো।
আমি এবার মাথাটা সোজা করে ওর দিকে তাকালাম। সত্য বলতে দুপুরের খাবারটা এখনো খাইনি। পকেটে তেমন টাকাও নেই। যা ছিল সেটা গতকালকেই শেষ হয়ে গেছে। আর খুচরা পাঁচ দশ টাকা যা ছিল সেটা দিয়ে সকালে একটা কলা আর একটা বন খেয়েছিলাম। আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই রিমি কেমন করে যেন আমার এই ব্যাপারটা বুঝে ফেলে। আমার চুপ থাকা দেখে বললো “চলো “কোথায়? “কিছু খেয়ে নিবা চলো। “আমি তো খেয়ে এসেছি। “তুমি খেয়েছো কি খাওনি সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। এমনিতে মন মেজাজ ভালো না। কথা না বলে চলো। এইটা বলেই ও হাটতে লাগলো। এই মুহুর্তে আমার কী করা উচিৎ আমি কিছুই জানি না। চুপ করে ওর পিছন পিছন যেতে লাগলাম। কিছু দুর যাওয়ার পরই একটা বিরিয়ানী হাউসে নিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে চুপচাপ বসতেই আমার কেমন জানি লাগতে শুরু করলো। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, আমার সব কিছু জানার পরও রিমি আমার সাথে একদম স্বাভাবিক ভাবে আচরণ করছে। কিন্তু কেন?
বিরিয়ানী অর্ডার দেওয়ার পর আমি চুপচাপ খেতে লাগলাম আর রিমি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওর চোখ গুলা আরো লাল হয়ে গেছে যেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি এটাও বুঝতে পারছি ওর চোখের কোনায় পানি জমতে শুরু করেছে। আমি একটু খাওয়া বন্ধ করে তাকাতেই ও বললো “কি হলো খাও। আমার খুব অস্বস্হি লাগতে শুরু করলো। খাবার গুলা যেন আমার গলা দিয়ে নামছে না। আমি ঠিক অনুমান করতে পারছি এখন যদি কিছু বলি নিশ্চিত কান্না করে দিবে। তারপরও আমি অনেকটা ইতস্তত করে বললাম “আমার এই রকম করা একদম ঠিক হয় নি। সেটা তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছো। সত্যি সত্যি ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তারপর বাম হাতে গড়িয়ে পড়া পানি মুছতে মুছতে বললো “কথা বলিও না। খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই তুমি জানো না? আর তুমি যখন খাও তখন তোমার খাওয়া দেখতে আমার ভালো লাগে এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। এই কথার কি প্রত্যুত্তর দেওয়া আমি বুঝতে পারলাম না। খাবারের দিকে তাকিয়েই বললাম “আমি জানি আমি যা করেছি এটা ক্ষমা করার মত না।
রিমি অনেকক্ষন সময় নিয়ে আমার কথা এড়িয়ে বললো “আর খাবে না? আমি মাথা দিয়ে ইশারা দিলাম না। খাওয়ার পর কিছুক্ষন বসে ওখান থেকে বের হয়ে গেলাম। আসলে সত্য বলতে কি রিমির সাথে পরিচয়ের আগে আমি আরো অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করেছি তবে ওগুলা প্রেম ছিল না। আমি প্রেমের অভিনয় করেছিলাম। প্রেম করে ওদের পটিয়ে টাকা পয়সা যা পেতাম তা নিয়ে কেটে পড়তাম। তারপর ঐগুলা দিয়ে দিন চলত। ঐগুলা শেষ হওয়ার আগে কিভাবে যেন আরেকটাকে পটিয়ে ফেলতাম। আর মেয়ে গুলাও যেন পটে যেত। ফার্স্টে বন্ধু হতাম তারপর আস্তে আস্তে সম্পর্কটা আরো বহুদুর নিয়ে যেতাম। তারপর সুযোগ বুঝে পটিয়ে যা ধান্ধা করতে পারতাম তা নিয়ে কেটে পড়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতাম।
এক একজনের কাছে আমার নাম ছিল একেক রকম। কখনো মিরাজ , কখনো আলভী, আবার কখনো কখনো , শাওন, ফারাজ , জারিফ এই গুলা। আমি যার সাথেই বন্ধু করতাম তার মধ্যে একটা বিশ্বাসের জায়গা করে নিতাম প্রথমে। আমার একটা কারনে মেয়েরা খুব সহজে আমায় বিশ্বাস করতো। আমি যাদেরকে ঠকিয়েছি তাদের হাতে হাত রাখা ছাড়া শরীরের একটা জায়গায়ও টার্চ করিনি। এই ব্যাপারটা আমার কাছে একটা গুড পয়েন্ট ছিল। একেক জনের সাথে কথা বললে একেকটা নাম্বার ইউজ করতাম। যখন কাজ হয়ে যেত তখন সিম ভেঙ্গে ফেলে দিতাম। রিমির সাথে পরিচয় হওয়ার আগে ফাইজা নামের একটা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম। আমি ভালোভাবে খোঁজ খবর নিয়েই বন্ধুত্বে জড়াতাম এই যে মেয়ের পরিস্হিতি কেমন, টাকা পয়সা আছে কিনা। বড় লোক বাপের মেয়ে কিনা।
ফাইজার সাথে আমার পরিচয় হয় একটা শপিং কমপ্লেক্সে। আমি প্ল্যান মোতাবেক হাটছি যে, কখন একটা সুযোগ পাবো। ও যখন শপিং করে শপিং এর ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছিল তখন ইচ্ছে করে না দেখার ভান করে ধাক্কা খেয়েছিলাম। আমি সুযোগটা খুজছিলাম ওর হাত থেকে ব্যাগ পড়ে যাবে তো? আমি যা যা ভাবলাম তাই হয়েছিল। হাত থেকে ওর ব্যাগ পড়ে গেল। আর আমিও সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। এই ভাবে প্রথম ধাপটা শুরু করলাম। তারপর ব্যাগ তুলে স্যরি বলে চলে গেলাম।
ফাইজা কোথায় যায় কি করে সব নজর রাখতাম। ও কখন একা হয় তার অপেক্ষায় থাকতাম। এইভাবে চার পাঁচ দিন ওকে নজরে রেখেছিলাম। সময় পেয়েও গেলাম। রেস্টুরেন্টে বসে ছিল ওর বান্ধবীর অপেক্ষায়। আমি একটু দুর থেকে অন্য চেয়ারে বসে খেয়াল করতে লাগলাম। তবে ও যেন আমায় দেখতে না পায় তা লক্ষ্য রাখতাম। ও এদিক ওদিক তাকালে আমি মাথা নিচু করে ফেলতাম। যখন ওর বান্ধবীর ফোন আসল ওর মোবাইলে তখন ওর কথায় বুঝতে পারলাম ওর বান্ধবী আসবে না।
আমিও আর দেরি করলাম না, একটু পরেই ওর সামনে গিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে থেকে বললাম “এখানে বসতে পারি? ফাইজা আমার দিকে অবাক হওয়ার দৃষ্টিতে একটু তাকিয়ে থেকে বলে “হ্যাঁ বসুন। চেয়ারে বসে ওকে থ্যাংক্স জানিয়ে একটু ভাব ধরে বললাম “আপনাকে কোথাও যেন দেখেছি। ঠিক মনে করতে পারছি না। সে তার অবাক হওয়া চেহারা নিয়েই আস্তে করে বললো “আমারো তাই মনে হচ্ছে। “কোথায় দেখেছি বলেন তো? “আমার ঠিক মনে আসছে না। আমি মাথায় আঙ্গুল দিয়ে টুক টুক করে বললাম “শপিং কমপ্লেক্স এর আপনি সেই জন না? ঐ যে ব্যাগ পড়ে গিয়েছিল। এভাবেই ফাইজার সাথে পরিচয় হই। এরপর আরো কয়েকবার ওর সাথে আচমকা দেখা করলাম। আর সেগুলা প্ল্যানের মধ্যেই ছিল। ওকে হাবিজিবি কিনে দিতাম অবশ্য আমার টাকা খরচ হতো। একদম পোশাক আশাকে সব সময় পারফেক্ট হয়ে থাকতাম।
আস্তে আস্তে ওর সাথে ভালো বন্ধুত্ব করলাম। একদিন হুট করে ও আমায় বলে আমাকে নাকি ওর ভালো লাগে আমিও মনে মনে খুশি হলাম এই যে পথটা কতটা সহজ হয়ে যাচ্ছে। এতোটা সহজ হয়ে যাবে ব্যাপারটা ভাবিনি। এর কয়েক দিন পরে ওর সাথে মন খারাপের আভা নিয়ে দেখা করেছিলাম। যদিও আমার মন একদম ঠিক ছিল। আমার এমন মন খারাপ দেখে ও বলেছিল “কি হয়েছে তোমার? “না কিছু না। কি হবে? “কিছু তো একটা হয়েছে। তোমার মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন?
আমি আস্তে আস্তে সময় খুঁজতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম কথাটা কিভাবে বলা শুরু করি।ততদিনে ওর সাথে আপনি থেকে তুমিতে চলে আসছি। আমার চুপ থাকা দেখে ও আবার বললো”এই কি হয়েছে বলো না? “না আসলে আমি একটা ঝামেলায় পড়েছি। দুই লাখ টাকা লাগবে। খুব দরকার। কি করবো বুঝতে পারছি না। তোমার কাছে হবে? আমি দু এক দিনের ভিতরেই দিয়ে দিব। ” কি ঝামেলা? এত টাকা তো আমার কাছে নেই। আমি মনটা আরো খারাপ করে চুপ হয়ে গেলাম। আসলে এই মন খারাপ সবই অভিনয়। ফাইজা বললো “আমার কাছে ৭০/৮০ হাজারের মত টাকা আছে। এটা দিতে পারি। বাকি গুলা তুমি অন্য কারো কাছ থেকে যোগাড় করো। আমি একটু চুপ করে থেকে কান্নার ভাব ধরে ওর হাতটা ধরে বললাম “আমার খুব উপকার হবে। “মন খারাপ করো না তো। তোমার মন খারাপ হয়ে থাকলে আমারো ভালো লাগে না। সন্ধ্যার সময় আমার সাথে দেখা করো তখন আমি দিব। টাকা বাসায়। ঠিকাছে?
এরপর সন্ধ্যায় ওর সাথে দেখা করলাম। দেখা করার একটু পরেই আমাকে ৭৫ হাজার টাকা দেয়। আমি ওটা নিয়ে ফাইজাকে বাসায় পৌছে দিয়ে এই যে ওর থেকে বিদায় নিলাম আর যোগাযোগ নেই ওর সাথে। সিম ভেঙ্গে ফেলে দিলাম। জায়গা পাল্টে ফেললাম। অন্য অঞ্চলে চলে গেলাম। খুব সাবধান থাকতাম। কখনো কারো সাথে আমি ছবি তুলতাম না। ছবি তুলতে গেলেই ইনিয়ে বিনিয়ে নানা রকম বাহানা দেখাতাম। এই রকম আমি কমপক্ষে সাত আট জনের সাথে করেছি। এত জনের সাথে করার সময় একবারো আমার মন এই রকম হয়নি, যেমনটা রিমির সাথে হয়েছে। ওকেও আমার জালে আটকে ফেললাম। কিন্তু ওর সাথে এই গুলা করতে আমার মনটা কেমন করে যেন উঠত। প্রথম প্রথম ওর সাথে পরিচয়ের পর এসব কিছুই হয়নি, কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে নিজেকে খুব ছোট মনে হতো।
ফাইজা খুলনার মেয়ে ছিল। ফাইজার সাথে এরকম করে আমি ঢাকায় চলে আসি। দু এক মাস ভালোভাবেই চললাম। সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। রাস্তায় ফুটপাথের একটা দোকানের সামনে আশ্রয় নিয়েছিলাম বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য। একটু পরেই একটা কালো রঙ্গের গাড়ি রাস্তার ওপাশে থামে। গাড়ি থেকে একটা মেয়ে নেমে গাড়ির সামনে এসে হেলান দিয়ে দাড়াঁয়। তারপর সোজা হয়ে গাড়ির দরজাটা খুলে আরেকটা মেয়েকে হাত ধরে টেনে নামায়। আমার বেশ নজর কারলো দৃশ্যটা। আমি চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম। এই দুই মেয়ের মধ্যে লাল ড্রেস পড়া মেয়েটাকে টার্গেট করলাম। ফলো করে খোজ খবর নিলাম নাম রিমি।
বড় লোক বাবার মেয়ে। এক ভাই এক বোন। খুব ভদ্র স্বভাবের। মানুষকে যথেষ্ট সম্মান করে। কোথাও গেলে নিজে ড্রাইভ করে যায়। বেশ একটা বড় ধরনের ধান্ধা করতে পারবো বলে মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। আমিও অপেক্ষায় থাকতে লাগলাম কিভাবে ওর মন জয় করে ওর সাথে মিশতে পারবো সে রকম একটা পথ খুঁজতে লাগলাম। আমি এমন একটা মানুষ খুঁজছিলাম যে কিনা অসুস্হ। কয়েকটা এলাকার বস্তিতে ঘুরে একজনকে পেয়েও গেলাম। তবে এত অসুস্হ না। কিন্তু কাজ হবে এটা নিশ্চিত। আমি আগে থেকেই লোকটাকে ম্যানেজ করলাম। লোকটার কোন অসুখ ছিল না। অসুখ ছিল তার ছেলের। আমি লোকটার ঘরের দরজায় টোকা দিয়েছিলাম। লোকটা দরজা খুলা মাত্রই বললাম “আমি জড়িপ করতে আসছি।
ফ্যামিলির আয় কেমন, সদস্য সংখ্যা কত? সংসার কিভাবে চলে এই রকম। এনজিও থেকে আসছি। আমার দিকে একটু তাকালো তারপর বললো “ও আইচ্ছা। আহেন ঘরের ভিতরে আইয়া বহেন। কই যে বইতে দেই। আমি ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। তারপর একটা চেয়ারে বসে নাম, কি করে, সব কিছু একটা খাতায় লিখার নাটক করছিলাম।তারপর এক পর্যায়ে বললাম “আপনার ছেলে অসুস্হ নাকি? “হ স্যার।”ডাক্তার দেখান নি? ওকে দেখে তো মনে হচ্ছে অবস্হা খুব সিরিয়াস। “টাকা নাই স্যার। এমনে ফার্মেসির দোকানে কইয়া ঔষধ আইনা খাওয়াইছি। আমি ছেলেটার কাছে গেলাম। ওর চোখ গুলো ধরে দেখলাম তারপর বললাম অবস্হা ভালো না, ডাক্তার দেখাতে হবে এক কাজ করেন কাল বিকালে আমি এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। ঠিকাছে?
আসলে এইগুলা সবি আমার প্ল্যান আমি তিনদিন রিমিকে ফলো করার ফলে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হলাম ও প্রতিদিন একটা জায়গায় নিজে ড্রাইভ করে ফ্রেন্ডদের সাথে গল্প স্বল্প করে। আমি সব প্ল্যান মোতাবেক করতে লাগলাম। এরপরের দিনে লোকটা আর লোকটার অসুস্হ ছেলেকে নিয়ে একটা রাস্তার একপাশে আড়ালে দাড়িয়েছিলাম। লোকটা কে বললাম যে গাড়িতে নিয়ে যাবো হাসপাতালে গাড়িটা এই পথেই আসবে। লোকটা যেন কিছু বুঝতে না পারে সব কিছু কৌশলে করতে লাগলাম। আর আমার ঠিক মনে হচ্ছে রিমি এই ফাদে পা দিবেই। রিমির সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তা ভেবে তো হলফ করেই বলতে পারি রিমি সায় দিবে। আমি ফলো করার পর জেনেই গিয়েছিলাম এই রাস্তাটা দিয়ে রিমি প্রতিদিন আসে ।
যেই আমি ওর গাড়িটা দেখলাম অমনি ছেলেটাকে কোলে নিয়ে দাড়ালাম। ওর গাড়িটা আমার সামনে আসতেই ছেলেটাকে কোলে নিয়ে রিমির গাড়ির সামনে দাড়াঁলাম। রিমি গাড়িটা থামায়। তারপর আমি আয়নার গ্লাসটার দিকে এসে তাকাতেই রিমি আয়নার গ্লাসটা নামানোর সাথে সাথেই আমি বললাম “তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে। “কি হয়েছে? “এত কিছু বলার সময় নেই। এইটা বলেই পিছনের সিটে উঠে পড়লাম। হাসপাতালে এসে গাড়ি থেকে নেমে হাসপাতালের দিকে যেতে লাগলাম। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম রিমি যেন পিছন পিছন আসে। রিমি ঠিক ঠিক আসতে লাগল। ডাক্তার দেখিয়ে ছেলেটাকে হাসপাতালে এডমিট করে লোকটার হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিয়েছিলাম। লোকটা একটু কান্নার ভাব নিয়ে বললো”আপনি আমার কেউ না হইয়া ও আমার পোলার লাইগা এত কিছু করলেন। আমি ভদ্র মানুষের মত একটা হাসি দিয়ে বললাম। “মানুষ হিসেবে এটা আমার দায়ীত্ব। আমিও একজন মানুষ। আচ্ছা আসি।
এইটা বলে আমি বের হয়ে আসতে লাগলাম। রিমি পাশেই দাড়াঁনো ছিল। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল ও আমাকে ডাক দিবে। দিতেই হবে ডাক। যদিও ছেলেটাকে নিয়ে এই রকম না ও করতে পারতাম। কিন্তু এক হিসেবে ছেলেটার ও চিকিৎসা হবে আর আমারো কাজ হয়ে যাবে। একটু হাটার পরই রিমি ডাক দিল “এই যে শুনেনে। আমি পিছনে ফিরে তাকালাম। রিমি আমার সামনে হেটে আসলে আমি ওকে বললাম “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি পৌছে না দিলে “না না ধন্যবাদ তো পাওয়ার আপনি প্রাপ্য। এই যুগেও একটা মানুষ আরেকটা মানুষের বিপদে এগিয়ে আসে সেটা আপনাকে দেখেই বুঝলাম। জানেন আমিও এই কাজে সামিল হতে পেরে খুব ভালো লাগছে।
আমার পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই আমাকে থামিয়ে এই কথা গুলা বলে। আমি একটু মিচকা শয়তানের মত হাসি দিয়েছিলাম। তারপর দুজনে হাসপাতালের বাহিরে বের হয়ে আসতেই ও বললো “কোথায় যাবেন? আমার গাড়িতে বসেন। আমি পৌছে দিচ্ছি। “না না আমি হেটেই যেতে পারবো। যদিও অনেকটা দুর। “আপনি হেটে যাবেন, এই রিমি তা হতে দিবে না। বসেন বলছি। আমি জানতাম রিমি খুব মিশুক। খুব সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করে ফেলে। তারপর একটা হাসি দিয়ে বললাম “আপনি যখন এত করে বলছেন ঠিকাছে। বাই দ্যা ওয়ে আপনার নামটা কিন্তু সুন্দর।
রিমি একটু হাসলো। তারপর সামনের সিটেই বসলাম। টুকটাক কথা বার্তা হলো। আমি মনে মনে বললাম খুব সহজে কাজ হয়ে যাচ্ছে দেখতেছি। তারপর আমাকে নামিয়ে দিল আমি যেখানে থামাতে বললাম। নামার আগে ইচ্ছে করেই আমার মোবাইলটা ওর গাড়িতে ফেলে নেমে পড়লাম। রাতে আমার নাম্বারে ফোন দিলাম আরেকটা মোবাইল দিয়ে। এই প্ল্যান মোতাবেকে দুইটা সিম কিনেছিলাম। ওপাশ থেকে রিসিভ করে বললো “হ্যালো “আপনি কি রিমি বলছেন? “হ্যাঁ আপনি কি সেই জন? “হ্যাঁ সেই জন। “কেমন মানুষ আপনি? এত বেখেয়ালি হলে চলে? আর সিমে কোন নাম্বার ও এড নেই। “আসলে ঐ সিমে কারো নাম্বার এড করি নি আমি। আমার দুটো মোবাইল। এখন যেটা দিয়ে কথা বলছি এটা তে সব এড করা। “হুম। তো কখন মোবাইল নিবেন? “নিব এক সময়। কি করেন আপনি এখন? “এই তো আপনার সাথে কথা বলছি।
শুরু হয় এইভাবে ওর সাথে আমার কথা। এই ভাবে দুই দিন কথা বললাম খোজঁ খবর নিলাম। তখনো ওর নাম্বারটা ও আমায় দেয় নি। আমার নাম্বারেই ফোন করতাম। তিন দিনের বেলায় ওর সাথে দেখা করে আমার মোবাইলটা নিলাম। এরপর আরো দু দিন কেটে যায়। আমি ভাবলাম এবার অন্য ফাদ পাততে হবে। কিন্তু তা করতে হলো না। হঠাত্ একদিন ফোন করে বলতে লাগলো “কেমন আছেন? বলেন তো আমি কে? আমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। একটু চুপ করে থেকে বললাম “রিমি তাই তো? “চিনলেন কিভাবে? “যার এত মিষ্টি কণ্ঠসর তাকে না চিনার উপায় আছে বলেন? “কচু হি হি হি। জানেন আমার মনটা আজকে অনেক খারাপ। তাই আপনাকে কল দিলাম। “মনের আবার কি হলো? আমি কি মনের ডাক্তার? মন ভালো করার জন্য আমাকে স্মরন করলেন। “হি হি হি। সত্য বলছি আপনার কথা শুনে আমার এখন একটু ভালো লাগছে। কেন মন খারাপ ছিল জানি না। আচ্ছা আপনি কি সত্যিই মনের ডাক্তার?
আমি হাসলাম আর মনে মনে ভাবতে লাগলাম এই তো পাখি ধরা দিচ্ছে। অনেক কথা বলেছিলাম ফোনে। এরপর থেকেই প্রতিদিন ওর সাথে কথা হয় দেখা হয়। আস্তে আস্তে ওর প্রতি আমার একটা ভালো লাগা কাজ করে। ওর সাথে ফ্রি হলাম। শুধু বন্ধুত্ব। কেউ কখনো ভালো লাগার কথা বলিনি। আর এইভাবে একমাস হয়ে যায়। আমি রিমি ছাড়া কোন মেয়ের সাথে বিশ দিনের বেশি সময় পার করিনি। আমি যতই ওর সাথে মিশেছি আমার মাঝে এক অন্য রকম ভালো লাগার কাজ করত। তারপর আস্তে আস্তে নিজে নিজেই ভাবতে লাগলাম ওর সাথে যা করছি ঠিক হচ্ছে না। ওকে ঠকাতে পারবো না। ওকে ঠকাতে গেলে আমার মনটা কেমন করে উঠত। রাতে তেমন ঘুম আসতো না। একটা যন্ত্রনার মাঝে পড়ে গেলাম। সব সময় আমার মাথায় ঘুরপাক খেত এটা আমি ঠিক করছি না। আর এইসব চিন্তা থেকে মুক্ত হতে গত পরশু ওকে আমি সব সত্যি কথা বলে দেই।
হাসপাতালের ঘটনা থেকে সব। ও খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। একটা সময় কান্না করতে করতে আমার সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। তারপর সেদিন থেকে দু দিন আমার সাথে ফোনে কথা বা যোগাযোগ করে নি। ওর সাথে কথা না বলাতে আমার কেমন যেন খারাপ লাগতো। কিছুই ভালো লাগছিল না। তারপর কিছু না ভেবে আজ সকালে অনেকবার ফোন করার পর ও রিসিভ করে চুপ করে রইলো। আমি বললাম “আমি খুব খারাপ করেছি। তোমার সাথে আমি যতদিন মিশেছি ততদিন আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতো। আমি যদি চাইতাম তোমার কাছে সব কিছু লুকিয়ে রাখতে পারতাম। কিন্তু বিলিভ মি তোমার সাথে আমি এই রকম কিছুই করতে পারি নি। রিমি বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো “আর কিছু বলার আছে তোমার? “আমি কখনো তোমার সামনে আসবো না। কখনো ফোনও করবো না। শুধু আজকের বিকালটা আমাকে দাও। দিবে? প্রমিজ চুপ করে তোমার পাশে বসে থাকবো। গত পরশু থেকে আমি একটুও ভালো করে ঘুমাইনি।
রিমি অনেকটা সময় নিল। আমি আবার ওকে বলাতে ও রাজি হয়। আর আজকে তিনটার আগেই আমার সাথে দেখা করে। বিরিয়ানী খাওয়ার পর হাটতে লাগলাম। আজকে ও গাড়ি আনেনি। এত কিছু করার পরও আমার সাথে এইভাবে কথা বলছে আর সময় দিচ্ছে এটাই অনেক বেশি। আমি বললাম “তোমার সাথে রিকশায় চড়ার আমার অনেক ইচ্ছে। একটু রিকশায় ঘুরবে? আর তো কখনো সামনে আসবো না তাই বলছিলাম ওর চোখ গুলা কেমন ছলোছলো করছে। যা টাকা ছিল আমার কাছে সব শেষ। আমি একটা রিকশা ঠিক করলাম। রিকশায় উঠে আমি চুপ করে ওর পাশে বসে থাকলাম।
রিকশা চলছে। একটু পরেই ও আওয়াজ করে কান্না করতে লাগলো। আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ভাবলাম ওর হাতটা কি ধরবো? এই অধিকার কি আমার আছে। এসব ভাবতে ভাবতেই সাহস করে ওর হাতটা মুষ্টি ময় করে ধরলাম। রিমি আমার দিকে একটু তাকিয়ে কাদঁতে কাদঁতে বললো “কেন এমন করলে তুমি? একবারো বলেছো আর এমন করবে না? বলেছো একবারো? আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেল। আমার মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না। আমি বুঝতেও পারলাম এই মুহুর্তে আমার কি এখন কি বলা উচিৎ। রিমি আবার বললো “তুমি জানো তুমি আমার কতটা ভালো লাগার জায়গায় আছো? “হুম “হুম কি? বলো আর এমন করবে না। আমার সাথে যে ভালো মানুষটা হয়ে মিশেছো আমি সেই মানুষটাকেই দেখতে চাই। সেই মানুষটাকেই অনুভব করতে চাই। সেই মানুষটার মাঝে অন্য আর একটা মানুষের ছায়া কোন ভাবেই আমি চাই না।
আমি ওর কথার প্রত্যুত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলাম না। সব কথার জবাব দিতে নেই। আমি শুধু চুপ করে ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম “আর কখনো এমন করবো না কথা দিচ্ছি” আমি একেক সময় একেক রকম রুপ ধারন করে আয়নার সম্মুখে হতাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি এমন একটা আয়না পেয়েছি যা কিনা আমাকে পুরো পালটে দিল। এমন আয়নাকে হারানো কি আমার ঠিক হবে? একদমি না…