“বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েদের দেখতে একদম বাজে লাগে। তুই আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজবি না।” নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো উৎপল, সেঁজুতিকে বলছিলো। ওদিকে উৎপলের এই টাইপের কথা শুনে সেঁজুতি একপ্রকার রাগ আর লজ্জায় এই কথার কোন উত্তর না দিয়েই সেখান থেকে চলে গেলো। ঘরে এসে ভেজা কাপড় পাল্টে সেঁজুতি সরাসরি মাকে গিয়ে প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা মা,বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েদের দেখতে বাজে লাগে কেন?” সেঁজুতির মা ফরিদা বেগম সেঁজুতির প্রশ্নের উত্তর তো দিলোই না বরং ওকে আচ্ছা মতো বকে দিলো। মেয়েটার যা খালি বয়সীই বেড়েছে, বুদ্ধি হয়নি।”
সন্ধ্যার দিকে সেঁজুতির বাবা রহমত আলী মাঝারি একটা প্লাস্টিকের লাল বালতি ভরে অনেকগুলো তাজা মাছ নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে শোল,টাকি,কই,পুঁটি সহ অনেকরকমের মাছ ছিলো, সাথে ছিলো দুইটা বড় বোয়াল। মাছগুলো বারান্দায় রাখতে রাখতে রহমত আলী বললেন, “উজানের বিলে জাল পাতছিলাম,অনেকগুলো মাছ আটকা পড়ছে জালে। আর বাকি মাছগুলো ধরে নিয়ে আসছি।বুঝলা ফরিদা,নতুন পানিতে মাছগুলা খালি কিলবিল করতেছিলো।তুমি এই মাছগুলো সুন্দর করে রান্না করো। কথাগুলো বলেই রহমত মিয়া সেখান থেকে উধাও হলো। মাছগুলো কাটার দ্বায়িত্ব পড়লো সেঁজুতি আর ওর মায়ের।সেঁজুতির কাজ করতে একদম ভালো লাগে না। কিন্তু রেহাই নেই এখন মায়ের সাথে মাছ না কাটলে তার খুব বিপদ হবে।
রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই ঘরের এককোনায় জড়ো হয়ে বসে বিভিন্ন গল্পে মেতে উঠলো।এরমধ্যে কে যেনো হঠাৎ দরজায় কয়েকটা টোকা দিলো। এই ঝড়বৃষ্টির রাইতে আবার কে আইলো,কথাগুলো বলতে বলতে একরুম পেরিয়ে সামনের বসার ঘরে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সেঁজুতি। একটুপরে দেখা গেলো উৎপল আর মিজান এসেছে। উৎপলকে দেখে মুখ ভেংচি কাটে সেঁজুতি। উৎপল আজকাল কেমন দৃষ্টিতে যেনো তাকায় সেঁজুতির দিকে। এই দৃষ্টির মানে সেঁজুতি জানে না কিন্তু মনে মনে ঠিকই লজ্জা পায়। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর সেঁজুতির বড় ভাই সিরাজকে নিয়ে ওরা বেরিয়ে যায় বাহিরে সেঁজুতিদের নৌকা নিয়ে মাছ ধরার উদ্দেশ্য। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় উৎপল প্রায় কয়েকবার ঘরের দিকে উঁকি মারে। বিষয়টা চোখ এড়ালোনো সেঁজুতির।সে বেড়ার ফাঁক দিয়ে সব খেয়াল করেছে।ওর এই উৎসুক প্রখর চোখের দৃষ্টি সম্পর্কে কেউ কিছু বুঝতে না পারলেও ব্যাপারটা ঠিকই বুঝতে পারে সেঁজুতি। একটুপরে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়া হলো।
পুরো ঘরজুড়ে অন্ধকার। সেঁজুতি ওর রুমে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।বাহিরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে আর দূরে কয়েকটা ব্যাঙ একটানা ঘ্যাঙরঘ্যাঙ করে ডেকে যাচ্ছে।একটুপরে সেঁজুতি পৌঁছে যায় ঘুমের দেশে।রাতও কেবল বাড়তে থাকে এখন কেবল প্রভাতের অপেক্ষা। সাত-সকালে ঘুম ভাঙ্গলো সেঁজুতির।আকাশটা আজ একদম পরিষ্কার, কোনো মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। মা’য়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেঁজুতি এক দৌড়ে চলে গেলো মানিকের ঘরে। পুকুরপাড়ের খেজুর গাছটায় এবার অনেক খেজুর হয়েছে, ওগুলো পেরে এনে ঝাঁক দিতে হবে তাহলে পরেরদিন একেবারে পেঁকে যাবে।এই খেজুরগুলো সেঁজুতির খুব প্রিয় তাছাড়া এর বিচি দিয়ে ঘরে বসে খেলা করা যায়। অতঃপর সেঁজুতি দুইহাতে কয়েক ডাল ভর্তি সবুজ কাঁচা খেজুর নিয়ে ঘরে ফিরলো।
ফরিদা বেগম এইসব কাজ একেবারে অপছন্দ করেন,তাঁর মতে এইসব খাবারে পেটে সমস্যা হয় তাই সে এগুলো ধরে উঠোনের দিকে ছুঁড়ে মারলো।সেঁজুতি ছলছল দৃষ্টিতে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো।একটুপরে রহমত মিয়া মেয়ের মনের কথা বুঝতে পেরে ওগুলো এনে ঠিকঠাক ভাবে রেখে দিলো। অতঃপর তার আদরের মেয়ের মুখে হাসি ফুটলো। পাশের বাড়ির তুলি এসে সেঁজুতিতে ডাকতে লাগলো, আজ স্কুলে যাবে কি-না সেটা জানার জন্য। শিউলি দের বাড়ির পাশের রাস্তায় অনেক পানি জমেছে আজ।নৌকা ছাড়া হেঁটে যাওয়া যাবে না । এই খবরটা নিয়ে এলো সেঁজুতির ছোটো ভাই সবুজ। ওদের নাও এখন মাঠে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালের সেই শুঁকনো মাঠ, ক্ষেত এখন বর্ষার জলে টুইটুম্বর।এখন নাও নিয়ে ফেরা যাবে না তাই ওদের আজ স্কুলে যাওয়া হবে না।
একটুপরে সেঁজুতি, তুলিকে নিয়ে ঘরের পাটাতনে গিয়ে বসে।সমবয়সী দুই কিশোরী এক অদম্য গল্পে মেতে ওঠে।
একটুপরে তুলি ওর ওড়নার আঁচলের এক কোনা থেকে একটা গিট্টু খুলে এক জোড়া ছোটো কানের দুল বের করে সেঁজুতিকে দেখালো। সেঁজুতি দুল জোড়া হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলো।অনেক সুন্দর এক জোড়া কানের দুল।কে দিয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তুলি সেঁজুতির কানের কাছে এসে চুপিচুপি বললো রাসেলের কথা।রাসেলের নাম শুনতেই সেঁজুতি মুচকি হাসি দিলো সাথে তুলিও। একটুপরে সেই দুল জোড়া কানে পরে মুচকি হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরলো তুলি।আর সেঁজুতি ওদিকে তাকিয়ে রইলো,নরম কাঁদা পায়ে মেখে খালি পায়ে মেয়েটা কত সুন্দর হেঁটে যাচ্ছে। এ যেনো এক উচ্ছ্বল বালিকা,যার জন্মই হয়েছে এই পৃথিবীর সুখ উপলব্ধি করার জন্য।
বিকেলে শিকদার বাড়ির আবুলের বউ দৌঁড়ে আসলো সেঁজুতিদের বাড়ি।এসেই ফরিদাকে খুঁজতে লাগলো।ফরিদা বেগম এই মুহূর্তে ঘরে নেই হয়তো তার জায়ে’র ঘরে গেছে। তাকে খোঁজার কারণ জানতে চাইলে আবুলের বউ জোহরা বললো, “মোল্লা বাড়ির ইউনুসের বউয়ের লগে জ্বিন ভর করছে।ঐ মহিলা নাকি এক বসায় ৩ গামলা ভাত খেয়ে ফেলে।তার মাথার চুলে নাকি জট পড়েছে আর সে নাকি মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারে।” কথার মাঝে ফরিদা বেগম এসে কথাটা শুনে দৌঁড়ে তারা ইউসুফের বউ আমেনাকে দেখতে গেলো।সেঁজুতি তাদের সাথে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তারা নেয়নি বরং বলেছে সেঁজুতি গেলে নাকি ঐ খারাপ জ্বিন ওর উপর ভর করতে পারে। প্রায় সন্ধ্যা ঘোরঘোর তারা বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু বাড়িতে ফিরেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো কারণ তার ১০ টা হাঁসের মধ্যে ১টা হাঁস নিখোঁজ। এই সন্ধ্যাবেলা ফরিদা বেগম কোমরে কাপড় গুঁজে এক হাঁটু কাঁদার মধ্যে নেমে বাড়ির আনাচে কানাচে খুঁজতে লাগলো।কিন্তু কোথাও সন্ধান পাওয়া গেলো না।
একটুপরে সেঁজুতি চেঁচিয়ে বললো,
–“মা,তুমি এখনি আমেনা চাচির কাছে যাও।
সে নাকি সবকিছু বলতে পারে? তাহলে আমি নিশ্চিত সে তোমার হাঁসের খবরও দিতে পারবে।” ফরিদা মেয়ের কথা শুনে রাগে জ্বলতে লাগলো। সন্ধ্যার পর সেঁজুতির ভাই সিরাজ -উৎপল আর মিজানকে নিয়ে ঘরে এলো। ওরা ঘরের মধ্যে পশ্চিম পাশের রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো।সমবয়সী হলে যা হয় আরকি।
একটুপরে সিরাজ সেঁজুতিকে ঢেকে এক বাটি মুড়ি আর চা করে দিতে বললো। সেঁজুতি ভাইয়ের কথা মতো সবকিছু নিয়ে ওদের রুমে পৌঁছে গেলো।উৎপলকে দেখলেই কেন যেনো সেঁজুতির হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায় কোন কারণ ছাড়াই।উৎপল নামের ছেলেটা খুব ভদ্র। কথা কম বলে, কেউ ওকে হালকা বকে দিলেও মুচকি হাসে। সেঁজুতিদের বাড়ির পাশেই ওদের বাড়ি।ওর বাবা করিম মোল্লা খুবই ভালো মানুষ।বিশাল বড় ব্যবসা আছে ওদের তাই গ্রামের মধ্যে ওরা বেশ নাম করা।এই একটাই ছেলে তাদের। রুমে ঢুকেই উৎপলকে দেখে সেঁজুতি একটু আনইজি ফিল করলো কারণ উৎপল, সেঁজুতিকে দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
আজ যুথি ওর স্বামী আর এক মেয়ে নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। যুথি সেঁজুতির বড় বোন।গ্রামবাংলায় বিশেষ করে বর্ষাকালটা একটু বেশীই অবসরের সময়। তখন তেমন বেশী একটা কাজ থাকেনা।তাই যুথি আজ বাবার বাড়িতে এসেছে। যুথির মেয়েটার বয়স ৪বছর। তিতলীকে নিয়ে আজ সারাদিন সেঁজুতির ভালোই কাটলো।বিকেলে তিতলীকে নিয়ে একটু হাঁটতে বের হলো সেঁজুতি। তুলি দের বাড়িতে যাবে বলে বেরিয়েছে।সেঁজুতিদের বাড়ির পর উৎপলদের বাড়ি তারপর তুলিদের বাড়ি। ক্ষেত ভর্তি এখন পানি তাই রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।উৎপলদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতেই উৎপলের মা উঠোনে বসে সেঁজুতিকে ডাক দিলো।উৎপলের মা রেনু বেগম প্রায় অনেকক্ষণ সেঁজুতি সাথে কথা বললো।উৎপলের বিয়ের ব্যাপারটাও এড়ালোনা এই কথার মধ্যে থেকে।
রেনু বেগম ছেলেকে নিয়ে বেশ চিন্তিত।ভালো একটা মেয়ে খুঁজতেছে ছেলেকে বিয়ে করানোর জন্য। উৎপলের বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই, কোন কারন ছাড়াই সেঁজুতির মুখটা লাল হয়ে উঠলো।মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখের সামনে উৎপলের মুখটা ভেসে উঠলো। ওদের বাড়ি থেকে যেই বের হতে যাবে অমনি ঘরের মধ্যে থেকে উৎপলের কন্ঠ ভেসে আসলো। উৎপল সেঁজুতিকে ডাকছে। সেঁজুতি ঘরের মধ্যে যেতে চাইলো না তারপরেও যেতে হলো। ঘরে ঢুকতেই উৎপল বলে উঠলো, “কি ব্যাপার, তুই আমাকে দেখলে এমন করিস কেন?সমস্যা কি তোর?” সেঁজুতি কোনো উত্তর দিতে পারে না,ওর হাত পা কাঁপছে। সেজুতির এই অবস্থা দেখে উৎপল হাসতে লাগলো। একটুপরে উৎপল আবার বললো,
–“আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে। কোথায় বের হয়েছিস তুই এখন?”
–“তিতলীকে নিয়ে তুলিদের বাড়ি যাবো”।
–“এখন আর তুলিদের বাড়ি গিয়ে কাজ নেই।অনেক জোরে বৃষ্টি নামবে।বাসায় চলে যা।আর শোন তুই সারাদিন এতো এদিকসেদিক দৌড়াদৌড়ি করিস কেন? এখন থেকে প্রয়োজন ছাড়া কোথাও বের হবি না।
মনে থাকবে?”
–“সেঁজুতি মুখ দিয়ে কোন কথা বলতে পারলো না।কেবল মাথা নাড়ালো।”
একটুপরে উৎপলের মা ঘরের বারান্দায় পা রাখতেই,উৎপল তিতলীকে নিয়ে কোলে বসালো।খুব মিষ্টি একটা মেয়ে বলতে বলতে চুপিচুপি উৎপল সেঁজুতির হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলো। উৎপলের মা ওর রুমে এসেই বলতে লাগলো, “কবে যে আমার উৎপলকে বিয়ে করাবো আর ওর ও এমন মিষ্টি একটা মেয়ে হবে আর আমার হবে নাতি।কথাটা বলতে বলতে রেনু বেগম হাসতে লাগলেন।” সেঁজুতি একেবারে চুপচাপ এককোনায় দাঁড়িয়ে রইলো। উৎপল ওর মায়ের কথা শুনে আবারো সেঁজুতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগলো। এই মুহূর্তে সেঁজুতি লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে উঠলো।
তুলিদের বাড়িতে আর যাওয়া হলো না সেঁজুতির। এইমুহূর্তে সেঁজুতির বুকের হৃৎস্পন্দন ব্যাপক হারে বেড়ে গেলো।ও বাসায় এসেই আগে ঐ কাগজটা বইয়ের ভিতর লুকিয়ে রাখলো সবার অগোচরে। ঘর ভর্তি মেহমান।আজ ফুফুরা তাদের ছেলেমেয়ে সহ এসেছে। পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষ। আজ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত মনে একটুও শান্তি পায়নি সেঁজুতি। মনে বারবার একটাই প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে আর সেটা হলো “কি লেখা আছে চিঠিতে।” রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে ধীরেধীরে ঘরে মানুষের কোলাহল কমতে লাগলো।একটুপরে রাতও বাড়লো আর সবাই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লো। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে সাথে প্রচন্ড বাতাস।টিনের চাল থেকে অনবরত বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ভেসে আসছে,সাথে বুকের মধ্যে কাঁপনটাও খুব দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। সেঁজুতি কাঁপাকাপা হাতে চিঠি টা খুললো।
সেখানে লেখা ছিলো সেঁজুতি কাঁপাকাপা হাতে চিঠি টা খুললো।লজ্জা আর ভয়মিশ্রিত এক অনুভূতি কাজ করছে তার মনে।না জানি চিঠিতে কি লেখা আছে!কিন্তু চিঠিটা খুলে পড়া শেষ করার পর ও আবার আরেক আতঙ্কে পড়ে গেলো।কারন সেখানে লেখা ছিলো, “তুমি কি আমার বাদলা দিনে সদ্য ফোটা কদম হবে? বৃষ্টির জলে ধুয়ে মুছে যার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। তুমি কি আমার বর্ষাকালে শ্রাবণ মেঘের দিন হবে? যে বৃষ্টির জল হয়ে আমার অশ্রুটুকু ধুইয়ে দিবে। তুমি কি আমার সে হবে? যে হবে আমার বহমান নদী আর বিশাল নীল আকাশ। যে আকাশে আমরা মেঘ হয়ে ঘুরে বেড়াবো সারাজীবন উড়িয়ে দিয়ে মনের সকল দুঃখ আর অভিলাষ। তুমি কি আমার তেমনি একজন মানুষ হবে? যে সুখে দুঃখে চলার পথে সারাজীবনের সঙ্গী হবে?” লেখা টুকু পড়ে সাথে সাথে সেঁজুতি চোখ বন্ধ করে ফেললো।ওর বুকের হৃৎস্পন্দন ধীরে ধীরে বেড়ে যেতে লাগলো।সেঁজুতি জানে না এর উত্তর কি হবে। এ যেনো সেঁজুতি বিশ্বাসই করতে পারছেনা।
উৎপল যে সেঁজুতিকে পছন্দ করতো এটা সেঁজুতি আগে থেকেই একটু আধটু টের পেয়েছিলো। কিন্তু এর বহিঃপ্রকাশ যে উৎপল এভাবে করবে তা সেঁজুতি ভাবতেই পারেনি। ধীরেধীরে রাত বাড়তে লাগলো,চারিদিকে পিনপতন নীরবতা।বাহিরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে হঠাৎ জানালা দিয়ে কিছু দমকা হাওয়া এসে সেঁজুতির চুল গুলো উড়িয়ে দিয়ে গেলো। প্রিয় মানুষকে মনে মনে ভালবেসে তার স্মৃতিচারণ করার উপযুক্ত সময় আর কখন হতে পারে?
কাল সারারাত ঘুম হয়নি সেঁজুতির,ভোরবেলা একটু ঘুমিয়েছে এরমধ্যে হঠাৎ তিতলী এসে সেঁজুতির ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলো। ঘুম থেকে উঠে সেঁজুতি ঘরের বাইরে পা রাখতেই উৎপলকে দেখতে পেলো।উৎপল উঠানে দাঁড়িয়ে সিরাজের সাথে কথা বলছে। পুকুরপাড় থেকে ফরিদা বেগম সেঁজুতিকে কি কারণে যেন ডাকছে কিন্তু সেঁজুতি উঠান মাড়িয়ে সেখানে যেতে পারছেনা। কারণ কাল রাতে উৎপল চিঠিতে যা লিখেছে তা পড়ার পর থেকে উৎপলের কথা মনে পড়লেই সেঁজুতি লজ্জা পায়।
তারপরও এক প্রকার বাধ্য হয়েই সেঁজুতি উৎপলের সামনে দিয়ে পুকুরপাড়ে গেলো।উৎপল সেঁজুতিকে আজ আর কিছু বললো না কিন্তু আঁড়চোখে ঠিকই তাকিয়েছে সেঁজুতির দিকে। এদিকে যুথির স্বামী দুলাল মানে সেঁজুতির দুলাভাই সেঁজুতির বিয়ের জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ছেলে হাইস্কুলের মাস্টার।এর থেকে নাকি ভালো প্রস্তাব আর পাওয়া যাবেনা সেঁজুতির জন্য। কথাগুলো এইমাত্র যুথি আপার কাছ থেকে শুনেছে সেঁজুতি। কথাগুলো শোনার পর মনের অজান্তেই সেঁজুতির বুকটা কেঁপে উঠলো, তাহলে কি সেঁজুতি ও মনে মনে উৎপলের নয়তো ওর মুচকি হাসির প্রেমে পড়েছে? আজ মনটা ভালো নেই সেঁজুতির।তুলির কাছে কাল থেকে আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনা গুলো বলেই ওর মনটা হালকা হবে।
কালরাতে ফরিদা বেগম মেহমানদের জন্য পিঠা বানিয়েছিলেন তার থেকে কিছু পিঠা একটা বাটিতে ভরে সেঁজুতির হাতে দিলো ফরিদা বেগম।দিয়ে বললো এগুলো আবুলের বউ জোহরার কাছে দিয়ে আসতে। সেঁজুতি বাটিটা হাতে নিয়ে রওনা দিলো।কালকের রাতে উৎপলের কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো সেঁজুতি। হঠাৎ কাঁদার মধ্যে পা পিছলে পড়ে গেলো ও।লাফ দিয়ে সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ দেখেছে কিনা। নাহ্ ভাগ্য ভালো কেউ দেখেনি।এরপর আবার একমনে চুপিচুপি গান গাইতে গাইতে হাঁটতে লাগলো সেঁজুতি। একটুপরে কোথা থেকে যেনো উৎপল এসে সেঁজুতির পিছু নিয়ে বললো,
–“হাঁটতে গেলো এখনো বাচ্চাদের মতো পরে পরে আছাড় খাস কেন? কাঁদা মাটির রাস্তায় সাবধানে পা ফেলে হাঁটতে হয়।” সিরাজ বললো,
–“তোর দুলাভাই নাকি তোর জন্য প্রস্তাব নিয়ে এসেছে বিয়ের?
হুম,তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নে।বিয়ের কয়েকবছর পর দেখবি তোরও কয়েকটা বাচ্চা হবে।তোকে আর তখন দেখতে এমন বাচ্চা বাচ্চা লাগবে না।তখন তুই দেখতে একেবারে বুড়ির মতো হয়ে যাবি।” “আচ্ছা এই প্রসঙ্গ বাদ দিলাম। কাল রাতে যে আমি তোকে একটা চিঠি দিয়েছি তার উত্তর কই? “হ্যাঁ” বা “না” বলে দে।” সেঁজুতি কি বলবে ভেবে পায় না,ওর হাত পা সমানে কাঁপতে লাগলো।সেঁজুতি মনে মনে ঠিক করলো এক দৌঁড়ে উৎপলকে পিছনে ফেলে জোহরা চাচিদের ঘরে গিয়ে উঠবে।কিন্তু এ সাহস ও পেলো না পাছে যদি আবার আছাড় খেয়ে পরে যায়! সেঁজুতির নীরবতা দেখে উৎপল চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
–“আরে তুই কিভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর দিবি?
আমি তো তোকে বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। কাল আমি তোর হাতে যে চিঠিটা দিয়েছিলাম ওটা মূলত আমি তোকে দেইনি,মা চলে আসছে বিধায় কথাটা তোকে বলতে পারিনি। শোন তুই এই চিঠিটা গিয়ে এখনি তুলির কাছে পৌঁছে দিবি।তুলিকে আমি অনেকদিন যাবৎ পছন্দ করি কিন্তু কখনো বলতে পারিনি।
হঠাৎ মনে হলো তুই ওর বান্ধবী, তোর কাছে বললে বোধহয় সমস্যাটার সমাধান হবে তাই তোকে ধরা। তুই চিঠিটা ওকে দিবি এবং ওর উত্তরটা রাতের মধ্যে আমাকে জানাবি।মনে থাকবে তো?” এই বলে উৎপল সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো। এই কথা শোনার পর সেঁজুতির বুকটা ধক করে উঠলো। তাহলে কি তার সব এলোমেলো ভাবনাগুলো ভুল ছিলো? এই মুহূর্তে সেঁজুতির মনের মধ্যে এক ভয়ংকর ঝড় বয়ে যেতে লাগলো।কোন কারণ ছাড়াই সেঁজুতির চোখ থেকে টপটপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। যুথি আপু আজ চলে গেছে এবং বলে গেছে শুক্রবার সেঁজুতিকে দেখতে আসবে।সেঁজুতি মনে মনে ভালবেসে ফেলেছিলো উৎপলকে নয়তো ওর খুন শুঁটিকে। উৎপল যেমন ওর প্রিয় মানুষ তেমনি তুলিও ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ।প্রিয় মানুষগুলোর মিল হয়ে গেলে চমৎকার হবে।
কিন্তু তারপরও এক প্রকার অভিমান নিয়েই সেঁজুতি মনে মনে রাজি হয়ে গেলো বিয়ে করতে।সেঁজুতি মনে মনে বলতে লাগলো, “ভাগ্যিস উৎপলকে আগেভাগেই কিছু বলে দেইনি।আমার ভালবাসা আমার কাছেই গোপন থাকুক।সব ভালবাসা এবং পছন্দ প্রকাশ করতে নেই।” অন্য সব মেহমানরা ও চলে গেছে। পুরো ঘর জুড়ে আজ একপ্রকার শূন্যতা বিরাজ করছে যেমনটা শূন্যতা আজ সেঁজুতির মনে। ঘরে কেউ নেই।মা গেছে হয়তো কারো ঘরে, বাবা ক্ষেতে আর দুই ভাই কোথায় গেছে কে জানে। সেঁজুতি পাটাতনে উঠে সেই চিঠিটা হাতে নিলো এমনকি আরো একবার পড়লো।তারপর রওনা দিলো তুলিদের বাড়িতে। উৎপলদের বাড়ির রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় আবারো ছেলেটার দেখা মিললো।সেঁজুতি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, যেখানে উৎপল পিছু নিবে তুলির তা না নিয়ে আমার পিঁছু।আমি তো ঠেকেছি ওদের সম্পর্ক নিয়ে এই বলে সেঁজুতি মুখ ভেংচি কাটলো। উৎপল সেঁজুতিকে দেখে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে বললো,
–“কিরে আমার উত্তর কই?” সেঁজুতির নীরবতা দেখে উৎপল বললো,
–“বোবা দের মতো থাকিস কেন সবসময়?একটু কথা বললে কি হয়?”
সেঁজুতি প্রতিত্তোরে কিছু না বলে এবার উৎপলের সামনাসামনি মুখ ভেংচি কেটে তুলিদের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
পাছে উৎপল অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। সেঁজুতি মনে মনে ভাবে এই ছেলের সামনে আর পরা যাবে না।গ্রামের মানুষজন দেখলে বদনাম উঠিয়ে দেবে। জোহরাকে বাটিটা দিয়ে সেঁজুতি চলে গেলো মোল্লা বাড়িতে।ইউসুফ চাচার ছেলে রহিম বিয়ে করেছে কয়েকদিন আগে? সবাই বউ দেখতে আসলেও সেঁজুতির আসা হয়নি তাই আজ সেঁজুতি এসেছে বউ দেখতে। রহিমের বউটা দেখতে একেবারে মন্দ না।কি সুন্দর একটা লাল শাড়ি পরে বড় করে একটা ঘোমটা দিয়ে রেখেছে। লোকজনের সাথে অনেক আস্তে আস্তে কথা বলছে। তুলি বলেছিলো, নতুন বউদের নাকি একটু বেশী লজ্জা থাকে। একটুপরে এই বউয়ের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে সেঁজুতি। নাহ্ বেশিক্ষণ কল্পনা করতে পারে না সেঁজুতি, লজ্জায় ওর চোখ বুঁজে আসে। একটুপরে নতুন বউ এসে সেঁজুতির কাছে বসলো।এবং সবার অগোচরে সেঁজুতির কানে কানে বলতে লাগলো,
–“আমার স্বামী রহিমের লগে তোমার কোনো প্রেম,ভালোবাসা আছিলো নি?”
নতুন বউয়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যায় সেঁজুতি। তাহলে তুলি আর গ্রামের মানুষের কথাই ঠিক হলো।গ্রামের সবাই বলাবলি করছিলো নতুন বউ নিয়ে। নতুন বউ নাকি একটু পাগল টাইপের। মেয়েদের দেখলেই চুপিচুপি নাকি জিজ্ঞেস করে, “করিমের লগে তোমার কোনো প্রেম, ভালবাসা আছিলোনি?” আর ভাবতে পারেনা সেঁজুতি। নতুন বউয়ের কথা শুনে জোরে হেঁসে উঠলো সেঁজুতি। বউয়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়েই ও হাঁসতে হাঁসতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পিছনে নতুন বউ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। একটুপরে সেঁজুতি তুলিদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। পথে ওর বড় ভাই সিরাজের সাথে দেখা।ওরা ৩জন করিমের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সিরাজ সেঁজুতিকে দেখে ধমক দিলো বললো,
–“সারাদিন বাহিরে বাহিরে এখানে সেখানে ঘুরিস কেন?” উৎপল সিরাজের সামনেই সেঁজুতিকে প্রশ্ন করলো,
–“কিরে বউ দেখতে এসেছিস?” সেঁজুতি জবাব দিলো,
–“হুম।”
উৎপল আর কিছু না বলে সামনের দিকে পা বাড়ালো।একটু দূরে যাওয়ার পর উৎপল আবার পিছনে এলো ওদের সামনে রেখে। সেঁজুতির সামনে এসে উৎপল বললো, “তোকে বউ সাজলে অনেক সুন্দর লাগবে। বিয়ের দিন তোর খোঁপায় গুজে দেয়ার জন্য কয়েকটা তাজা গোলাপফুল এনে দিতে হবে।তোকে সেদিন এত সুন্দর লাগবে যে, তোর বর সেদিন সারারাত না ঘুমিয়ে তোর দিকে তাকিয়ে থাকবে।” উৎপল হাসতে লাগলো আর সেঁজুতি কথাগুলো শুনে কপাল কুঁচকে সেখান থেকে চলে যেতে লাগলো। পিছন থেকে উৎপলের কথা শোনা গেল।সে চিৎকার দিয়ে বলছে,
–“রাতের মধ্যে আমার উত্তর চাই।”
তুলিদের বাড়িতে গিয়ে তুলির কোনো সাড়াশব্দ মিললো না।একটুপরে দেখা গেল ও পাটাতনে শুয়ে আছে।চোখগুলো ফোলা আর লাল হয়ে আছে। সেঁজুতিকে দেখে তুলি ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো, যেনো এক আকাশ মেঘ নিয়ে তুলি বসে ছিলো সেঁজুতির আশায়। ও আসলেই চোখের জলগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরবে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তুলি বললো, আজ ৩ দিন হলো রাসেলের সাথে ওর কোনো যোগাযোগ নেই। রাসেলকে ও প্রচন্ড ভালোবাসে।এই রাসেলের সাথে নাকি ওর বাবা মা শিউলির বিয়ে ঠিক করেছে।এই ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা তুলি।তুলির মুখে এই কথাশুনে থমকে গেলো সেঁজুতি। কিভাবে সম্ভব এটা? এই রাসেল আর তুলির জন্য কত করেছে সেঁজুতি।
ওদের কথা বলতে দিয়ে অনেক ঝুঁকি নিয়ে পাহারা দিয়েছে সেঁজুতি, আরো কত কি! এই ছেলে এতো গভীর ভালোবাসা ভুলে অন্য মেয়েকে কিভাবে তার জীবনের সাথে জড়াবে? তুলি বারবার সেঁজুতিকে বলতে লাগলো, “আমি ভুলে থাকতে চাই রাসেলকে।কিন্তু কিছুতেই পারছিনা।” সেঁজুতি কোনো উত্তর না দিয়ে ওরদিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো। তুলি কাগজটা পড়ে অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।তুুলির চোখে ছিলো অবাক হওয়ার দৃষ্টি আর সেঁজুতির মনে ছিলো অভিমান।সেঁজুতি ভেবেই নিয়েছে আর কখনো উৎপলের সামনে পড়বে না,মরে গেলেও না। তুলি কাগজটা হাতে নিয়ে সেঁজুতিকে বললো সেঁজুতি ভেবেই নিয়েছে আর কখনো উৎপলের সামনে পড়বে না,মরে গেলেও না। তুলি কাগজটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে সেঁজুতিকে বললো, “কিরে এটা তোকে কে দিলো”?”এটা আমাকে কেউ দেইনি, এটা উৎপল তোকে দিয়েছে”।
তুলি সেঁজুতির কথা শুনে আর কিছু বললো না।চিঠিটা ভাজ করে বিছানার নিচে রাখলো। একটুপরে তুলি আবার বলে উঠলো, ” পরশু রাসেলের বিয়ে। আমাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছে।আমি কি যাবো নাকি রে!” কথাগুলো বলছিলো আর কাঁদছিলো তুলি। তুলির প্রতিত্তোরে সেঁজুতি বলেছিলো “না”।সেঁজুতি তুলিকে আরো বলেছিলো, একজনকে ভুলতে হলে তার মতো আরেকজনকে দরকার। আরেকজন তো তুই পেয়েই গেছিস।অতীত ভুলে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব,তাহলেই ভালো থাকবি। আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলো তুলি। পথে রমিজার সাথে দেখা হয়েছিলো সেঁজুতির।রমিজা মেয়েটা আগের চেয়ে অনেক শুকিয়ে গেছে। কারন জিজ্ঞেস করতেই রমিজা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “আমার স্বামী ঢাকাতে একটা মহিলারে বিয়া করছে।কোনো খরচাপাতি পাঠায় না গ্রামে। আচ্ছা সেঁজুতি, “একজনকে কষ্ট দিয়ে আরেকজনকে নিয়ে কি সত্যিই খুব সুখে থাকা যায়?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সেঁজুতি বাড়ি পৌঁছে গেলো। অবশেষে সেঁজুতি বুঝতে পারলো সুখ জিনিসটা একেক জনের কাছে এক এক রকম। সেদিনের পর থেকে প্রায় ১৭ দিন কেটে গেলো।তুলির সাথে আর সেঁজুতির দেখা হয়নি।সেঁজুতি কেন যেন ইচ্ছে করেই আর ওদের বাড়িতে যায়নি,তুলিও আর আসেনি। সেঁজুতি মনে মনে ভাবে ওদের দিনগুলো মনে হয় ভালোই কাটছে। আজকাল সেঁজুতি সবসময় ঘরে মধ্যে থাকে এবং মায়ের সব কাজে সাহায্য করে। ফরিদা বেগম সহ ঘরের লোকজন সবাই চমকে গেলো সেঁজুতির এই হঠাৎ পরিবর্তনের জন্য। যে মেয়ে এতদিন একদণ্ড ঘরে থাকতো না,এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতো, দুপুর হলেই নদীতে সাঁতার কাটতে যেতো, সে মেয়ের এখন একাকী জীবনের মোড়টা কারো চোখ এড়ালো না।
সেঁজুতির দুলাভাই সেদিন বলে গিয়েছিলো, “শুক্রবার সেঁজুতিকে দেখতে আসবে কিন্তু ছেলে পক্ষের কি যেনো কাজ ছিলো তাই তারা সেদিন আসতে পারেনি।” আজ শুক্রবার, সেঁজুতিকে আজ আবারো দেখতে আসার কথা।কিন্তু আজ ভোর থেকেই শুরু হয়েছে একটানা বৃষ্টি।মাঝে মাঝে বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে বাতাস তো আছেই। বৃষ্টির পানিতে পুকুর,নদীনালা ভরে গেছে। শিউলিদের বাড়ির পাশের রাস্তায় ও পানি জমে গেছে।শিউলির কথা মনে পড়তেই সেঁজুতির মনে প্রশ্ন জাগলো, আচ্ছা, শিউলি রাসেলকে নিয়ে ভালো আছে তো! সেঁজুতি ঘরের পাটাতনে বসে বৃষ্টি দেখছে আর ভাবছে, “আজ লোকগুলো কিভাবে আসবে সেঁজুতি কে দেখতে?রাস্তায় তো হাঁটুর উপরে পানি জমে গেছে। তাহলে কি বাবা তাদের আনতে নৌকা পাঠাবে”? নাহ্ সেঁজুতির এখন এগুলো ভাবতে মোটেও ভালো লাগছে না।সেঁজুতি এক দৃষ্টিতে দূরে তাকিয়ে আছে। সেদিনের পর থেকে উৎপল ও আর আসেনি সেঁজুতিদের বাড়িতে।
সিরাজ’দার সাথে মাঝেমধ্যে উৎপল আড্ডা দিতে আসতো কিন্তু এখন আর আসে না।সেঁজুতির ইচ্ছে করে সিরাজ’দার কাছে থেকে উৎপলের খোঁজ খবর নিতে।কিন্তু সেঁজুতি সাহস পায়না পাছে যদি ভাই ওকে বকে দেয়।
পাশের বাড়ির সুখন ভাই আর ভাবি বৃষ্টিতে ভিজছে।তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ২০ বছর কিন্তু এখনো তাদের মাঝে যে ভালবাসার বন্ধন খুঁজে পাওয়া যায় তা তাদের কিশোর বয়সের সেই দুরন্ত প্রেমকেও হার মানায়। সুখন ভাই একসময় কত কষ্ট করেছে,ঘরে বাজার পর্যন্ত করতে পারেনি কিন্তু কখনো তাদের ঘর থেকে কোনো ঝগড়ার আওয়াজ শোনা যায়নি।সেই অভাবের দিনগুলোতেও তিথি ভাবি ভাইয়ের পাশে ছিলো। তখন সবাই বলতো, শুধু শুধু কষ্ট করছো কেন?তোমার বাবার অবস্থা তো খুব ভালো।তার কাছে চলে যাও।সে নতুন করে তোমার আবার কোনো না কোনো ব্যবস্থা করে দিবে। ভাবির উত্তর ছিলো, “দুঃখ কষ্টের সময় যদি প্রিয়জনের পাশে না থাকতে পারি,তার কষ্টটা যদি আমার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি নাই করতে পারি,তাহলে আমি তাকে কেমন ভালবাসলাম ?
আজ আমি যদি তাকে ছেড়ে চলে যাই তাহলে এটা আমার ভালবাসা হবে না হবে স্বার্থপরতা।আমি আমার প্রিয়জনকে ছেড়ে কোথাও যাবো না বরং আমাদের ভালবাসার কাছে সবকিছুকে হার মানিয়ে দিবো। যদিও আজ তাদের কোনো কষ্ট নেই।সংসার,সন্তান নিয়ে খুব ভালো আছে তারা। একেই বুঝি বলে সত্যিকারের ভালবাসা! সেঁজুতি ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো মনেই নেই।ঘুম থেকে উঠেই একটা কথা ভাবতেই ওর বুকটা ধক করে উঠলো। কারণ সেঁজুতি একটু আগে স্বপ্নে দেখেছিলো। উৎপল আর সেঁজুতি একসাথে হাতে হাত রেখে বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে দূরে কোথাও হেঁটে যাচ্ছে! ফরিদা বেগম মেয়েকে ডাকতে লাগলেন, “বেলা ১২ টা বেজে গেছে। এখনো কি করিস তুই?নিচে নেমে আয়,সকালের খাবারও তো এখন পর্যন্ত খাসনি”। সেঁজুতি উৎপলের কথা ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এলো। এখনো বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে।
সেঁজুতি কাউকে কিছু না বলেই এক লাফে উঠোনে নেমে গেলো বৃষ্টিতে ভিজতে।কতদিন ধরে সেঁজুতি বৃষ্টিতে ভিজে না!পাশের ঘর থেকে দুই চাচাতো বোনকে পটিয়ে নিয়ে গেলো নদীর পাড়ে। আজ সেঁজুতি বৃষ্টিতে ভিজবে আর সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠবে। নদীর পাড় দিয়ে পানিতে নামতেই পিছন থেকে কে যেনো বলে উঠলো, “বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েদের দেখতে একদম বাজে লাগে তোকে বলেছিনা আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজবি না”? কন্ঠটা খুব পরিচিত মনে হলো সেঁজুতির। পিছনে ফিরে তাকাতেই ১৭দিন পর উৎপলের দেখা মিললো। উৎপলকে দেখে লজ্জায় আর নদী থেকে উঠতে পারেনা সেঁজুতি।কি করবে না করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা সেঁজুতি। কথা তো বলতেই পারছেনা বরং হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেলো।
ওদিকে উৎপল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেঁজুতির দিকে আর ভাবছে, নিষ্পাপ মেয়েটা দেখতে সত্যিই অনেক সুন্দর। বিশেষ করে যখন ও লজ্জা পায় তখন ওকে দেখতে আরো সুন্দর লাগে।এগুলো ভাবতে ভাবতে উৎপল মুচকি হাসতে লাগলো। এরমধ্যেহঠাৎ সেঁজুতি এক লাফ দিয়ে নদী থেকে উঠেই বাড়ির দিকে দৌড় শুরু করলো।কে আর পায় ওকে।পিছন থেকে সেঁজুতির ২ চাচাতো বোন চেচামেচি করে বলতে লাগলো, আপা,তোর ওড়না নিয়ে যায়! প্রচন্ড বৃষ্টির কারণে আজো সেঁজুতিকে দেখতে আসা হলো না ছেলে পক্ষের। বিকেলে আকাশটা একটু হালকা হলো।বৃষ্টি এখন নেই বললেই চলে কিন্তু বর্ষাকালের দিন কখন না কখন হুট করে বৃষ্টি চলে আসে বলা যায়না। বিকেলে সেঁজুতি বাড়ির পিছনে বিশাল বড় এক তেঁতুল গাছের নিচে বসে আছে।উৎপল একটুপরে কতগুলো টকটকে তাজা লাল গোলাপ নিয়ে হাজির হলো সেঁজুতির সামনে।
সেঁজুতি মনে মনে ভাবতে লাগলো উৎপল আসলেই কোনো মানুষ নাকি জ্বীন? যদি ও মানুষ হয়ে থাকে তাহলে যখন তখন হুটহাট করে কিভাবে খুঁজে পায় আমাকে?ও জানে কিভাবে আমি কখন কোথায় থাকি? সেঁজুতি উৎপলকে দেখে উঠে দাঁড়ালো এবং ওর পিছন বরাবর খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো।উৎপল সেঁজুতির এ আচরণ দেখে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো এই তেঁতুল গাছ থেকে সেঁজুতিকে কোনো পেত্নীতে ধরে নিতো আবার! উৎপল সেঁজুতিকে প্রশ্ন করলো, ” কি ব্যাপার,তুই এমন করছিস কেন? সেঁজুতি উৎপলের ছায়া দেখে নিশ্চিত হয়, নাহ্ ও অন্যকিছু না,ও আসলেই উৎপল। একটুপর হঠাৎ সেঁজুতি খেয়াল করলো উৎপলের হাতে অনেকগুলো লাল গোলাপ।এই গ্রামে তো এ ফুলগুলো খুঁজেই পাওয়া যায়না একমাত্র শহর ছাড়া।তাহলে উৎপল এই ফুলগুলো উৎপল কোথায় পেলো! দু’জনেই ৫ মিনিট নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।একটুপরে উৎপল সেঁজুতির হাতে ফুলগুলো দিয়েই বললো, “এগুলো আমার গাছের ফুল।তোর জন্য নিয়ে এসেছি”।
উৎপলের কথা শুনে সেঁজুতি প্রচন্ডভাবে রেগে গেলো এবং বললো, “আপনারা পুরুষ মানুষ অনন্ত পক্ষে আপনাদের দৃষ্টি আগে ঠিক করুন।যাকে তাকে না, শুধুমাত্র একজনকে ভালবাসুন। একটাই হৃদয়। এটা একজনকেই দেয়া যায়, ১০ জনকে না।একটা হৃদয় ১০জনকে দিতে গেলেই তখন ভালবাসা নামক জিনিসটা ঠুনকো হয়ে যায়”। আর কিছু না বলেই সেঁজুতি সেখান থেকে চলে এলো। আজ উৎপলকে সবচেয়ে খারাপ মানুষ হিসেব মনে হচ্ছে সেঁজুতির।খারাপ মানুষের প্রতি কখনো ভালবাসা জাগতে পারেনা ওর মনে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত।রাতের খাবারদাবার শেষে সবাই সবার রুমে ঘুমাতে গেলো।সেঁজুতির আজ একটুও ঘুম আসছে না।বিকেলের কথাটা বারবার মনে পড়ছে। সারাদিন শেষে রাতটা খুবই কষ্টদায়ক।
জীবনে ফেলে আসা অতীতের কথা মনে করিয়ে কেবল কষ্ট দেয়। একটুপরে টিনের ঘরের বাহিরে সেঁজুতি যেনো কার ফিসফিস কন্ঠে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পেলো।কে যেনো ফিসফিস কন্ঠে ওকে ডাকছে। সেঁজুতি বুকে একরাশ সাহস সঞ্চার করে আস্তে করে জানালাটা খুলতে লাগলো আর মনে মনে ভেবে নিলো ভূত-পেত্নী অথবা চোর ডাকাত হলে ও জোরে চিৎকার করে সবাইকে ডেকেই ওখান থেকে দৌড়ে পালাবে। কিন্তু দেখা গেলো উল্টোটা। জানালার ঐপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো তুলি।এতরাতে তুলিকে এখানে দেখে চমকে গেলো ও।সেঁজুতি আরো চমকে গেলো যখন পিছনে উৎপলকে দেখতে পেলো। সেঁজুতি মনে মনে বলতে লাগলো উৎপলকে, এতরাতে নষ্টামি করতে এসেছিস তাও আবার আমাকে দেখিয়ে। দেখ আজ তোর কি অবস্থা করি।
তুলিকে দাঁড়াতে বলে খাট থেকে নিচে নেমে দরজার দিকে পা বাড়ালো সেঁজুতি সেঁজুতি মনে মনে বলতে লাগলো উৎপলকে, “এতরাতে নষ্টামি করতে এসেছিস তাও আবার আমাকে দেখিয়ে। দেখ আজ তোর কি অবস্থা করি”। তুলিকে দাঁড়াতে বলে খাট থেকে নিচে নেমে দরজার দিকে পা বাড়ালো সেঁজুতি। চুপিচুপি দরজা খুলে বাহিরে পা রাখতেই সেঁজুতির চোখ চকচক করে উঠলো কারণ রাতের আকাশে ছিলো অজস্র জোৎস্নার ছড়াছড়ি। সেঁজুতি রুমের পিছনে গিয়ে উৎপলকে দেখে বললো, “এটাও দেখার বাকি ছিলো, তাই না? আপনার বাবা-মা তো আপনাকে নিয়ে খুব গর্ব করে এমনকি গ্রামের সবাই।এখন সবাইকে ডেকে এনে দেখাই? আপনি রাতের অন্ধকারে একটা মেয়েকে কোথায় নিয়ে এসেছেন”? সেঁজুতির কথা শুনে উৎপল “হা” করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
তুলি হঠাৎ সেঁজুতিকে বললো, “সেঁজুতি, তোর মাথা ঠিক আছে তো”? কথাটা বলতে বলতেই রাসেলের দেখা মিললো।রাসেল চুপিচুপি একটু দূর থেকে হেঁটে আসছে ওদের দিকে। সেঁজুতি রাসেলকে দেখে বললো, “এর মানে কি”? তুলি বললো, “আমরা চলে যাচ্ছি সেঁজুতি। তুই ভালো থাকিস।সেই ছোট্টবেলা থেকে আমরা একসাথে বড় হয়েছি। কত হইচই দুষ্টুমি করেছি।কষ্ট পেলে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি। কিন্তু আর থাকতে পারলাম না রে তোর সাথে।
আমার বাবা-মাকে বলিস আমার কথা।তোকে খুব ভালবাসতাম বলেই তোকে না বলে যেতে পারিনি।
চলে যাই রে! তোর সাথে আবার কোন একদিন দেখা হবে।তখন না হয় আমরা আবার মেতে উঠবো শৈশবের সেই খুন শুঁটিতে।
একটা কথা বলে গেলাম, উৎপল তোকে অনেক ভালবাসে।যে তোকে ভালবাসবে তাকে কখনো কষ্ট দিবিনা তাহলে দেখবি কোন একদিন তুই সত্যিকারের ভালবাসার অভাব বোধ করবি। সবার ভালবাসা মন কাঁড়তে পারেনা”। এই বলে তুলি রাসেলের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। সেঁজুতি রাতের অন্ধকারে বেশীদূর যেতে পারেনি।তুলির চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে সেঁজুতি হু হু করে কেঁদে উঠলো। আজ উৎপল সেঁজুতির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “আমি ১৫ দিনের জন্য ছোট মামার বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাই তোর সাথে দেখা হয়নি।আর তুই মনে মনে কি ভেবে নিয়েছিস আল্লাহ জানে।রাসেলের সাথে সেদিন শিউলির বিয়ে হয়নি।অনেক ঝড় তুফানের পর আজ ওদের মিলিয়ে দিলাম”।
–শোন সেঁজুতি।
–হুম,বলেন
“আমি কিন্তু তোকেই ভালবাসি।কথাটা বলে উৎপল আবারো মুচকি হাসি দিলো।যে হাসির প্রেমে অনেক আগেই পড়েছে সেঁজুতি”।
সেঁজুতি কিছু বললো না।আজ সেঁজুতি ও উৎপলের সাথে মুচকি হাসলো। সকাল সকাল পাশের বাড়ির মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গলো সেঁজুতির। সবাই রাসেল আর তুলিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে গ্রামের আনাচে-কানাচেতে। কিন্তু তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তুলি আর রাসেলের মায়েদের কান্না দেখে সেঁজুতির চোখের কোনে ও কয়েক ফোঁটা জলের জন্ম নিয়েছিলো। সেঁজুতি মনে মনে বলতে লাগলো, “আরো আগে যদি আপনারা ব্যাপারটা মেনে নিতেন তাহলে আজ এমনটা দেখতে হতো না”। সেঁজুতির বিয়ের সেই প্রস্তাবটা ভেঙে গিয়েছিল বারবার বাঁধা আসার কারণে। গ্রাম বাংলার মানুষ বড্ড কুসংস্কার বিশ্বাসী। সেঁজুতির আজ ইচ্ছে করছে নৌকায় করে নদীতে ঘুরতে যাবার। সেঁজুতি বৈঠা নিয়ে যেই নৌকায় বসলো অমনি উৎপলকে দেখা গেলো ওদের বাড়ির সামনে। সেঁজুতিকে নৌকায় বসে থাকতে দেখে উৎপল ও দৌঁড়ে নৌকায় এসে বসলো। নৌকা যখন মাঝ নদীতে চলে গেলো তখন উৎপল বললো,”সেদিনের প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিসনি”।
উৎওলের কথা শুনে সেঁজুতি পড়ে গেলো মহাবিপদে।এখন সেঁজুতি কিভাবে বলবে সেও উৎপলকে ভালবাসে! বলার আগেই তো চোখ মেলে তাকাতে পারছেনা সেঁজুতি। একটুপরে উৎপল সেঁজুতির হাত ধরে বললো, “বল,তুই কি আমাকে ভালবাসিস”? সেঁজুতি কেবল মাথা নাড়ে কিন্তু মুখে কিছু বলে না। উৎপল ও বুঝে নেয় সেঁজুতি ও তাকে ভালোবাসে। উৎপল সেঁজুতির হাত ধরে বলে, “কথা দে,কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবি না।আমি যদি কখনো নিখোঁজ ও হয়ে যাই অনেকদিনের জন্য তবুও আমায় ভুলে যাবি না।মনে রাখবি আমি যেখানেই থাকি না কেন তোকে ঠিকই মনে রাখবো।আমার কথাগুলো কি তুই রাখবি?
সেঁজুতি আবারো মাথা নাড়লো। সেঁজুতি সম্মতি উপলব্ধি করে, উৎপল অনেক জোরে গান গাইতে গাইতে নৌকা বাইতে লাগলো।
অতঃপর তাদের প্রেমটাও হয়ে গেলো। কত যে লুকিয়ে লুকিয়ে ওরা দেখা করেছে,কথা বলেছে তার কোনো হিসেব নেই।সেঁজুতি গুনেগুনে ১০ মুঠো কাঁচের চুড়ি জমিয়েছে যেগুলো উৎপল ওকে দিয়েছে। উৎপলের কাঁচের চুড়ি অনেক প্রিয়। এভাবে প্রায় অনেকদিন কেটে গেলো। আজ আবারো আকাশে মেঘের ছড়াছড়ি। যুথি আপা বেড়াতে এসেছে। সেই সুযোগে উৎপল ছোট তিতলীকে বলে দিয়েছে, সেঁজুতিকে যেন বলে তার সাথে দেখা করার জন্য। তিতলীর কথা শুনে সেঁজুতি দৌঁড়িয়ে উৎপলের কাছে চলে গেলো।এরমধ্যে শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি। সেদিনের সেঁজুতির স্বপ্নের মতো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে লাগলো ওরা। করিমদের বাড়ির পিছনের কদম গাছ থেকে উৎপল সেঁজুতিকে কদম ফুল পেড়ে দিলো।
সেঁজুতি মনে মনে বলতো লাগলো, “এই বৃষ্টি যদি আর কখনো শেষ না হতো তাহলে বোধহয় ভালোই হতো।কখনো আমাদের আলাদা হতে হতো না”। সেঁজুতি হঠাৎ উৎপলকে বললো, “আপনি না আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে মানা করেছিলেন”? উৎপল বললো, “আমার সাথে ভিজলে সমস্যা নেই কিন্তু অন্য কারো সামনে ভিজবি না”। উৎপল আবারো বললো, শোন সেঁজুতি, আমি আজ থেকে তোকে আর তুই করে বলবো না।তুমি করে বলবো। আর আজ থেকে তুমিও আমাকে তুমি করে বলবে।মনে থাকবে? সেঁজুতি বললো, “আমি আমার বর ছাড়া আর কাউকে তুমি করে বলব না”। উৎপল সেঁজুতির কথা শুনে জোরে হেঁসে উঠলো। উৎপলের হাসি দেখে সেঁজুতি লজ্জা পেল খুব। একটুপরে উৎপল সেঁজুতিকে বললো, “আমি তো তোমাকেই বিয়ে করবো।সুতরাং আমাকে তুমি করে বললে, কিছু হবে না।কি বলবে তো? তুলি,হ্যাঁ, না কিছু বলেনি কেবল মাথা নাড়িয়েছে।
ফরিদা বেগম তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বললেন, রমিজা গতকাল রাইতে গলায় দড়ি দিয়া মরছে,ওরে দেখতে যাইতাছি। রমিজার মৃত্যুর কথা শুনতেই সেঁজুতির বুকটা কেঁপে উঠলো।সেঁজুতি বিড়বিড় করে বলে উঠলো, মানুষ একটুখানি ভালবাসা পাওয়ার জন্য কতটা উতলা হয়ে উঠতে পারে তা রমিজাকে না দেখলে জানতাম না। আজ বিকেলে জোহরা চাচিদের বাড়িতে যাওয়ার সময় উৎপলের মা রেনু বেগম সেঁজুতিকে দেখে বললো, “জানিস সেঁজুতি,আমি উৎপলের জন্য মেয়ে দেখেছি”। কথাটা শুনেই সেঁজুতির বুকের ভিতর ছ্যাঁত করে উঠলো। একটুপরে আবার রেনু বেগম বললো, “মেয়েটার নাম শ্রাবণী। খুব সুন্দর মেয়ে।উৎপল ও সেদিন গিয়ে দেখে এসেছে। আমরা কয়েকদিন পরে গিয়ে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে আসবো”।
সেঁজুতি কিছু না বলে পথে পা রেখেই কান্না শুরু করে দিলো।এমনকি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেলো।ফরিদা বেগম মেয়ের এমন অবস্থা দেখে বারবার প্রশ্ন করতে লাগলো, “কি হয়েছে?কিন্তু সেঁজুতি কিছু না বলে কথা কাটিয়ে নিয়ে গেলো”। ৩দিন ধরে আবারো উৎপল নিখোঁজ হয়ে গেলো। তারপরের দিন উৎপলের দেখা মিললো।বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই উৎপল বললো, “আরে আমি তো তোমাকেই বিয়ে করবো।মাকে স্বান্তনা দেয়ার জন্য মেয়েটাকে দেখতে গিয়েছিলাম। মেয়েটাকে আমার মোটেও পছন্দ হয়নি তারচেয়ে আমার সেঁজুতিই আমার কাছে অনেক সুন্দর”। সেঁজুতি আর কিছু বলে না, লজ্জায় মুখ নিচু করে ফেলে। আজ উৎপল কয়েকদিনের জন্য শহরে যাচ্ছে। যাওয়ার আগেরদিন উৎপল বলে গিয়েছিলো এসেই বাবা-মাকে বলে সেঁজুতিকে বিয়ে করবে। উৎপল চলে গেলো। বিকেলে সেঁজুতি হাঁটতে হাঁটতে করিমদের বাড়ি গেলো। সেই বাড়ির আমেনা চাচির সাথে জ্বিন আছে। সে মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারে। আমেনা সেঁজুতিকে দেখেই বললো।
“তোর খুব কাছের একজন মানুষ তোকে ছেড়ে চলে যাবে অনেকদূরে,আর কখনো তাকে খুঁজে পাবিনা”। কথাটা শোনার পর সেঁজুতির বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। আজ সারাবিকেল সেঁজুতির ভালো কাটেনি।সারারাত ঘুম ও হয়নি। সকালে মানুষের চিৎকার চেচামেচিতে ওর ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম থেকে উঠেই শুনতে পেলো, উৎপল যে লঞ্চে উঠেছিল সেটা নাকি ডুবে গেছে। কথাটা শুনে সেঁজুতির বুকটা ফেটে যাওয়ার অতিক্রম হলো”। সেঁজুতি দৌড়ে উৎপলদের বাড়ি চলে গেলো।সেখানে সবার কান্নার আহাজারিতে আকাশ ভারী হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে ১ সপ্তাহ কেটে গেলো কিন্তু উৎপল আর ফিরলো না।সেদিন অনেকের লাশ পাওয়া গেলেও উৎপলের লাশ আর পাওয়া যায়নি।হয়তো ওর লাশ ভাসতে ভাসতে পাড়ি জমিয়েছে অচিনপুরে।
পুরো ব্যাপারটা ফরিদা বেগম বুঝতে পারলো।কিন্তু কি বলে মেয়েকে স্বান্তনা দিবে সে ভাষা খুঁজে পায়না। সেঁজুতির বারবার মনে হতে লাগলো, “উৎপলের কি বেশি কষ্ট হয়েছিলো পানিতে ডোবার সময়? যে মুখ দেখে সেঁজুতি একসময় একটা সুন্দর সংসার রচনার স্বপ্ন দেখেছিলো,শেষবারের মতো একবার দেখতেই পেলনা তার সেই চিরচেনা মুখটা! ইসস যদি উৎপলের লাশটাও পাওয়া যেতো তাহলেও না হয় ওর কবরটার সামনে গিয়ে মন উজাড় করে কাঁদা যেতো কিন্তু উৎপল ভালবাসার কোন শেষ চিহ্নই রেখে যায়নি”। তারপর অনেকবছর কেটে গেলো।গ্রামের বুক জুড়ে গ্রীষ্মের দাবদাহে ফসলের মাঠে ফাটল ধরলো,কত বর্ষা এলো আর গেলো।শরৎকালে কত কাশফুলই না সেই নদীর পাড়ে ফুটলো। কিন্তু আর কখনো বসন্তে লাল শিমুল ফুল কুড়ায়নি সেঁজুতি।
সেঁজুতির ভাগ্যক্রমে সেই হাই স্কুলের মাস্টারের সাথেই একদিন বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।সেঁজুতির আজ বড় একটা ছেলে আছে তার নাম রেখেছে উৎপল। করিমের বউ,জোহরা,আমেনা চাচি, রেনু বেগম সবাই আজ বৃদ্ধাদের কাতারে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এরমধ্যে কত মানুষেরই না মৃত্যু হলো। তুলি আর কখনো ফিরে আসেনি এই গ্রামে। ওরা কেমন আছে,কোথায় আছে আজ বড্ড জানতে ইচ্ছে করে সেঁজুতির। সেঁজুতির সেই শ্রাবণী নামের মেয়েটার কথাও জানতে ইচ্ছে করে খুব। আজ সেঁজুতির ও মাথার কালো চুল সাদা রং ধারণ করেছে। শৈশবের সেই উচ্ছ্বল বালিকা আজ বৃদ্ধাদের কাতারে পা রেখেছে।
উৎপল একদিন সেঁজুতির হাত ধরে বলেছিলো, “কথা দে,কোনদিন আমাকে ছেড়ে যাবি না।আমি যদি কখনো নিখোঁজ ও হয়ে যাই অনেকদিনের জন্য তবুও আমায় ভুলে যাবি না।মনে রাখবি আমি যেখানেই থাকি না কেন তোকে ঠিকই মনে রাখবো।আমার কথাগুলো কি তুই রাখবি? কথাগুলো কি সত্যিই রাখতে পেরেছে সেঁজুতি? একজীবনে কি আর সবকথা রাখা যায়?সেঁজুতি আর উৎপলের সেই দুরন্ত প্রেমের কথাই তো কেউ মনে রাখবে না সেঁজুতির মৃত্যুর পর।তখন কেউ জানবেই না, উৎপলের এক লজ্জাবতী ভালবাসা ছিলো আর সেঁজুতি ও একদিন এক ছেলের মুচকি হাসির প্রেমে পড়েছিলো এবং সেই প্রেমের একদিন মৃত্যু ও হয়েছিলো কোনো এক শ্রাবণ মেঘের দিনে।