বিরিয়ানির নলা মুখে পোরে প্লেট থেকে মুখ তুলতেই দেখি সামনে প্রাক্তন দাঁড়িয়ে আছে৷ আগের থেকে বেশ সুন্দরী হয়ে গেছে। শুনেছি মেয়েরা বিয়ের পর কিছুটা মোটা হয়ে যায়। কিন্তু তার বেলা কথাটা খাটেনি। মোটা তো হয়নি। বরং আগের থেকে কিছুটা স্লিম হয়েছে৷ চেহারার জৌলসও বেড়ে গেছে৷ আমি তার দিকে তাকাতেই সে বলে উঠলো, ‘তুই তো আর চেঞ্জ হইলি না। এখনো বিরিয়ানি দেখলে হুশ থাকে না। গরুর মতো খেতে থাকিস!’ আমি মুখের খাবারটা আরেকটু চিবিয়ে গিলে উত্তর দিলাম, ‘ তুই একটু দাঁড়া। খাবারটা শেষ করে তোর সাথে কথা বলছি৷’
‘তুই তো আজব পাব্লিক! প্রাক্তনের সাথে এতোদিন পর দেখা আর তুই কি না খাবার নিয়ে পড়ে আছিস৷’ আমি উত্তরে মুচকি হেঁসে আরেক নলা বিরিয়ানি মুখে পোরে দিলাম। ‘অবশ্য যে প্রেমিকার বিয়েতে গিয়ে খপ খপ করে খেয়ে ফিরে আসতে পারে, তার কাছে এটা আর তেমন বড় কি!’ খাবার শেষ করে চেয়ার পিছে ঠেলে দিয়ে উঠতে উঠতে বললাম। ‘এভাবে বলিস না। রিবার আম্মু শুনলে আমি ঘরে ঢুকতে পারবো না।’
প্রাক্তণের চেহারা কেমন কালো হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগে ঠোটের কোণে লেগে থাকা হাসিটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো৷ তাতে আমি কোনো ভ্রুক্ষেপ করলাম না। হাত ধুতে চলে গেলাম। ত্রিশ বয়সী বন্ধুর বিয়েতে যে প্রাক্তনের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি৷ ও আমাকে বলেওনি যে প্রাক্তনকেও দাওয়াত দিয়েছে৷ অবশ্য দাওয়াত দেয়াটা স্বাভাবিক। এক সময় তো আমরা তিনজন-ই ভালো বন্ধু ছিলাম। আর প্রাক্তন বন্ধু কাম প্রেমিকা ছিলো। তার বিয়ের সপ্তাহ খানেক আগ পর্যন্ত সে প্রেমিকা হিসেবে যথেষ্ট সৎ ছিলো।
প্রেমিকার দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করেছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত নিষ্ঠাবান থাকতে পারেনি৷ আরো আট-দশটা এভারেজ লেবেলের মেয়ের মতো-ই ওয়েল স্যাটেল্ড বরের লোভ সামলাতে পারেনি৷ সে চাইলেই তার বিয়ে আটকে দিতে পারতো। কিন্তু সে তা করেনি৷ তার মা-বাবা ওয়েল স্যাটেল্ড ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে আর সে রাজি হয়ে গেছে। একবারো প্রতিবাদ করেনি৷ একবারো বলেনি যে সে কাউকে ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করতে চায়। বরং আমি যখন বলতে বলেছি তখন আমাকে উত্তরে বলেছে, ‘দেখ! তোর না আছে কোনো ইনকাম না আছে কোনো ক্যারিয়ারের নিশ্চয়তা! কোন মুখে তোর কথা আমি ফ্যামিলিকে বলবো!’
এরপর আমার তাকে কনভেন্স করার মন মানসিকতা ছিলো না। যাই হোক তার কয়েক দিন পর বিয়ের কার্ড দিয়ে গিয়েছিলো৷ আমিও বিয়েতে গিয়ে ভরপেটে খেয়ে এসেছি৷ তার হাজবেন্ডকেও দেখেছি। শুনেছি যে মেয়েরা ওয়েল স্যাটেল্ড বর দেখে বিয়ে কিরে তাদের বেশীরভাগের বর-ই পেট মোটা টাকলু হয়। তবে তার বর পেট মোটা না হলেও টাকলু ছিলো। তার সাথে প্রেমের খেলায় আমার একটা লাভ অবশ্য হয়েছে, তা হলো তাকে বিয়ে করার জন্য নিজেকে তৈরি করতে গিয়ে একটা ছোট-খাটো ব্যবসা শুরু করেছিলাম৷ এখন তা বিরাট ব্যবসায় পরিণত হয়েছে৷ থাকগে পুরানো কথা।
হাত ধুয়ে এসে প্রাক্তনের সাথে কথা বলছিলাম। তার দিনকাল কেমন যাচ্ছে, আমার কেমন যাচ্ছে ইত্যাদি বিষয়্যাদি নিয়ে। হঠাৎ রিবার আম্মু রিবাকে কোলে করে নিয়ে এসে আমাকে বলল, ‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো! আর আমি তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। ”কেনো কি হয়েছে?’ রিবাকে আমার কোলে দিয়ে ‘ওরে রাখো তোমার কাছে।’ বলে চলে গেলো। বন্ধুর বোনের সাথে রিবার আম্মুর আগে থেকেই ভালো খাতির। তারা এক সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ‘এটা তোর মেয়ে? কত কিউট হয়েছে! তোর মেয়েটাকে আমাকে দিয়ে দিবি?’ আমার কোল থেকে রিবাকে নিতে নিতে বলল, ‘কি নাম রেখেচিসরে?’
‘একটু আগে না বললাম।’ ‘ভুলে গেছি আবার বল!’ ‘রিবা!’ প্রাক্তনের চেহারায় আবার কালো ছায়া নেমে আসলো। হয়তো কোনো কিছু ভেবে মন খারাপ হয়ে গেছে৷ খারাপ হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। ওর তো একটা মেয়ের খুব শখ ছিলো। আমাদের সম্পর্কে আরো আট-দশটা সম্পর্কের মতো ছেলে-মেয়ের নামও ঠিক করে ফেলেছিলাম। ও বলতো, ‘আমাদের প্রথম সন্তান হবে মেয়ে৷ আর মেয়ের নাম রাখবো রিবা।’ তুলি আমার মেয়েকে আদর করে দিচ্ছে। আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবছি, এই মেয়েটা তো তোর ই হওয়ার কথা ছিলো।
কয়েক মিনিটের নিরবতা ভেঙ্গে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে তোর বর-বাচ্চা আসেনি?’ তুলি স্তব্ধ হয়ে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। প্রথমে তার ঠোটে, ঠোট থেকে চেহারায়, চেহারা থেকে সারা শরীরে কেমন এক আচ্ছন্নতা ছড়িয়ে পরলো। ‘ও অফিস নিয়ে একটু ব্যস্ত আছে। তাই আসতে পারেনি।’ বলে রিবাকে আমার হাতে দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো। আমি ইচ্ছা করেই এমন প্রশ্ন করেছি৷ হয়তো আঘাতের পরিবর্তে একটু আঘাত দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছি৷
মানুষ কি সব কিছু এক সাথে পায়! কিছু পেতে হলে কিছু হাত ছাড়া করতে হয়৷ সে ভালোবাসা, টাকা-পয়সা পেয়েছে৷ সে ওয়েল স্যাটেল্ড বরের জন্য আমাকে ছেড়ে পয়ত্রিশ বছর বয়সী টাকলু লোকটাকে বিয়ে করেছিলো৷ শুনেছি তার বর তাকে অনেক ভালোবাসে৷ তার সব ইচ্ছেই পূরণ করে। শুধু একটা ইচ্ছাই পূরণ করতে পারে না। একটা সন্তান৷ তা দেয়ার ক্ষমতা তার বরের নেই৷ বিধাতার খেল এমনি। কাউকে এক সাথে সব কিছু দেয় না৷
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার জন্য রিবার আম্মুকে নিয়ে গাড়িতে উঠেছি৷ হঠাৎ কোথা থেকে তুলি এসে গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে রিবার আম্মুকে বলল, ‘ভাবি জানেন! আপনি খুব ভাগ্যবতি।’ সে উত্তর অপেক্ষা না করে চলে গেলো। রিবার আম্মু আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,’কে ও?’ ‘আমার পুরানো বন্ধু৷ নাম তুলি।’ ‘যার কথা বলেছিলে! আর ও এ কথা কেনো বলল?’ আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘সব-ই বিধাতার লীলাখেলা।’