দৃষ্টিকোণ

দৃষ্টিকোণ

মি.জামিল নামে একজন ভদ্রলোক, এই লোকটা ছোটবেলা থেকেও দেখতেছি আমার বাবার সাথে সবসময় আমার নামে তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথা বলেন। কিন্তু আমার বাবা সবসময় উনার তুচ্ছতাচ্ছিল্য কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন। ক্লাস এইটে যখন প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় দুই সাবজেক্ট ফেইল করছিলাম, ঠিক সেইদিন থেকে আমারদের বাসায় উনার চিঠি আসতো, সেই চিঠিতে লিখা ছিলো “জনাব, জামান সাহেব আপনার মেয়েটা যে এতো গাধা পড়াশোনায় আগে জানতাম না, এই মেয়েটা দিয়ে আপনার কিছু হবে না…”

বাবা আবার সুন্দর করে চিঠির উত্তর দিছিলেন.. “মোটেই না আমার মেয়ে মেধাবীও বটে, দুইটাই তো ফেল করছে পাঁচ টায় তো আর ফেল করে নি,, আর সবসময় যে পাস করা লাগবে সেটা তো আর কোনো জগৎ বইয়ে লিখা নেই,আপনাকে আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি সামনে জেএসসি পরীক্ষায় আমার মেয়ে হৃিদিতা ভালো রেজাল্ট করবেই…!

আমি বাবার উত্তর দেখে বেশ খুশীই হলাম, আর বাবাকে প্রমিস করলাম সামনের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে দেখাবোই। সেই অনুযায়ী পড়াশোনায় মন দিলাম। যথারীতি পরীক্ষায় ভালোই হলো। সেই থেকে আমি এতোই পড়াশোনায় ভালো হলাম যে, আর কোনো ক্লাসেই পিছিয় পড়িনি।

স্কুল অধ্যায় শেষ করে কলেজ জীবনে পা দিয়েছি। একদিন কলেজ থেকে বাসায় এসে দেখলাম বাবা গালে হাত দিয়ে মরমরা হয়ে বসে আছেন। বুঝতে বাকি রইলো না, মি.জামিল নামের ওই মানুষটার চিঠি আবার বাসায় আসছে, মনে মনে গালি দিয়া এই ব্যাটার গোষ্ঠী উদ্ধার করলাম। অবশেষে চিঠি পড়ে আমার মাথায় হাত, চিঠিতে লিখা ছিলো ” জামান সাহেব শোনেছি আপনার মেয়ে নাকি কলেজে যায়, কলেজে পড়িয়ে ভালোই বিদ্যান বানাচ্ছেন, কিন্তু আপনার মেয়ে নামাজের ধার তো নেয় না। আপনি যখন উপরে গিয়ে পটল তুলতে যাবেন, তখন কি আর আপনার মেয়ে দোয়া করবে কিনা সন্দেহ। যে মেয়ে ধর্ম কর্মে মন নাই সে মেয়ে কেমন বিদ্যাবান বুঝাই যায়…..!”

চিঠিটা পড়ে একটু রাগ হলেও, কথাগুলো ইগুতে লাগলো। ঠিকি তো কলেজে উঠার পর থেকে দ্বীন দুনিয়ার কথা ভুলেইগেছি, সারাদিন মেতে থাকি সিনেমা, গানবাজনায়। আগে তো নামাজ পড়তাম, কলেজে উঠার পর পড়িই না। বাবার দিকে চেয়ে দেখি তিনিও বড্ড মন খারাপ করে বসে আছেন। বাবার মন খারাপ দেখে নিজেরও মন খারাপ করে রুমে গেলাম, রুমে রাখা মিউজিক প্লেয়ার, ভিডিও প্লেয়ার এসব জিনিস স্টো রুমে ফেলে আসলাম। মনে মনে শপথ করলাম আর জীবনেই নামাজ বাদ দিবো না। সেই ভাবা সেই কাজ, নিয়মিত নামাজ আদায় করি, সবকিছু ঠিকঠাক মতই চলতেছে।

কয়েক মাস পর আবার চিঠি..! লিখা ছিলো” আমি নাকি রান্না-বান্না করতে জানি না, পুরাই অকর্মা”। চিঠি টা পড়ে বাবা এবার খুব ক্ষ্যাপে গেলেন, কত বড় সাহস আমার মেয়েকে অর্কমা বলে। আমিও বা কম কি ব্যাটা কে এবার এক হাত না দেখালেই নয় । সেই ভাবা সেই কাজ, মায়ের সাহায্য বেশ কয়েকদিনে রান্না শিখে ফেললাম। এখন আর আমি অকর্মা নই। একটু হাফ ছেড়ে বাঁচা গেলো।

আমি যখন অনার্স ২য় বর্ষের ৩ সেমিস্টার দিচ্ছি, তখন আমাদের বাসায় আবার একটা চিঠি এলো ফের মি.জামিল নামের এই মানুষটির। এবার এই চিঠিটা পড়ে মাথায় একদম খুন চেঁপে ধরার অবস্থা। মনের মধ্যে ভাবনা হাজির, এই লোকটা এতো কিছু জানলো কি করে।

চিঠিতে লিখা ছিলো এমন… ” এই যে জামান সাহেব! জানেন কি কিছু, খুব তো মেয়ে টা নিয়ে বড়াই করেন, আজকাল দেখতেছি আপনার মেয়ের আচরণ অন্য রকম ঠেকচ্ছে বটে! তা আজকাল মেয়েকি আপনাদের সাথে সময় কাটায়, এক টেবিলে বসে খাওয়া হয়কি? দেখি তো ছাদে বসে ফোনে মিন মিন করে কথা বলে, সারাক্ষণ ফোন চ্যাটিং তো আছেই, তা আজকাল কি প্রেমও করা হচ্ছে নাকি? তা ভালো মেয়েটা কে বুঝি সবকিছুতে এক্সপার্ট করাচ্ছেন, তা ছেলেটা ভালো তো?নাকি ছিটেফোটা গলদও রয়েছে। আপনার মেয়ের তো আবার অঢেল বুদ্ধি, সেই বুদ্ধির জোরে পালায় কিনা কে জানে”….!!

চিঠি পড়া শেষ করতে না করতেই, বাবার চিঠির উত্তর লিখাও শেষ। বাবা লিখছেন… ” আমার মেয়ে প্রেম করুক আর মহাভারত জয় করুক, তাতে আপনার কি হ্যা। প্রেম তো মানুষ গোপনেই করে, সবাই জেনে গেলে প্রেম করার মজা কোথায় বলুন। আর হ্যা আমার মেয়ে মাকাল ফল নয় যে নিজের দুর্বলতা কারো কাছে প্রকাশ করবে, সে যা করবে ঠিক বুঝে শুনেই করবে..!!

বাবার এমন উত্তর যথার্থ হয়েছে বলে আনন্দ লাগলেও, আমার মনে একটা চিন্তা রয়েই গেলো, সত্যই তো আমার যার সাথে প্রেম তাকে কোনোদিন যাচাই করা হয়নি, শোভন নামের এই ছেলেটির সাথে আমার সম্পর্ক হয় ভার্সিটি শুরু হওয়ার পর থেকেই। প্রচুর স্মার্ট ছেলে হওয়ায় ক্রাস খাই, পরে একদিন শোভনই ভার্সিটিতে প্রপোজ করে, ব্যাস আমিও হাবলার মতো হ্যা করে দেই। সেই থেকেই শুরু হয় প্রেম যাত্রা, সারাদিন ফোন আলাপ আর চ্যাটিং যেন প্রেম করা শেষই হয় না। মা -বাবা দিকে একদম খেয়ালই নেই, আমি যেনো শোভনের মত্ত। নিয়মিত বাবার সাথে খেতে বসি না, এমনিকি কথাও তেমন হয়না। প্রায় একবছর রিলেশন চললেও কোনোদিন জানা হয়নি শোভন কি আমায় আধো ভালোবাসে কিনা? নাকি শুধু টাইমপাস। চিঠি টা পড়ে মনে শোভন কে নিয়ে সন্দেহ তৈরী হলো। তাই সন্দেহ মিটানোর জন্য, আমার দুইটা বান্ধবী শোভনের পিছনে লাগালাম। দুদিন অপেক্ষা করলাম শেষ ফলাফল টা কি হয়।

কিন্তু! একি সেটা যে এতো গলদ জানতাম না। শোভন নাকি আমার সাথে সম্পর্কে থাকার মাঝেও আরোও দুটো মেয়ের সাথে প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যপারটা প্রথমে বিশ্বাস না হলেও হাতেনাতে কিছু প্রমাণ পেয়ে রাগে দুঃখে মাথাটা গরম হয়ে গেলো। পরেরদিন ভার্সিটিতে গিয়ে শোভেনের দুই গালে দুই চড় থাপ্পড় দিয়ে ফাইনালি ব্রেকআপ করে আসলাম। সেই সাথে আমার কিছু গুন্ডা বন্ধুদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আসলাম, যাতে করে ভবিষ্যৎ এ আর কোনো মেয়ের সাথে এমন ফ্লোটিং না করে ।

অতঃপর বাসায় এসে স্বীন্ধান্ত নিলাম, আর প্রেম- টেম করবো না। মা বাবা যেখানে বিয়ে দিবে সেখানেই বিয়ে করবো। এসব বাদ দিয়ে নিয়মিত পড়াশোনায় মনযোগী হলাম। সবকিছু আগের মতো ঠিকঠাক হয়েগেলো। পড়াশোনা পাশাপাশি একটা পার্টটাইম জব হলো। বেশ কাটছে দিন। এখন আর মি. জামিল নামের মানুষটির চিঠি আসে না। প্রায় অনেক দিন হলো আমাদের বাসায় চিঠি আসেনা। ব্যপারটা জানার জন্য বাবাকে জিজ্ঞেস করবো করবো করে আরা হয় না। একদিন বাবা কে দেখলাম অফিস থেকে এসে বসে আছেন। তখন বাবা কে গিয়ে বললাম..

~ এই মাসে কোনো চিঠি এসেছে, বাবা?
~ আমার কথা শুনে বাবা মৃদু হেসে হেসে বলেন, চিঠি আশা কি খুব দরকার না কিরে? আমি যেকোনো একটা উত্তর দিয়ার আগেই, মা চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে বলেন,
~তোর প্রতি তো কোনো অভিযোগ নাই, কি লিখবো চিঠিতে!!
~মানে? অভিযোগ লিখবা মানে কি? আমি অস্ফুটে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
~ বাবা পাশে বসে উত্তর দিলেন হ্যা এতো দিন যে মি. জামিল নামে যে লোকটির চিঠি আসতো, সে অন্য কেও না তোর মা ই লিখতো।
~মা চায়ের কাপ বাবার হাতে দিয়ে,

আমায় শুধালেন, জানিস, তুই যখন ভুল করতি সেসবগুলা আমি চিঠিতে লিখে দিতাম, আর তোর বাবা তোর পক্ষ নিয়ে তোকে উভয় দিতেন। আমরা যদি তোর ভুলগুলি রাগ করে শাসন করতাম, তুই হয়তো এসব মানতি না বরং আমাদের প্রতি তোর খারাপ মনোভাব তৈরী হত। তোর বাবা সব অভিযোগ এ তোকে সাপোর্ট দিয়েগেছেন যাতে তোর মনে দুর্বলতা বাসা না বাঁধে। এখন বল তোর পঁচা মা বাবার দোষ হলো কেমন?
আমি তখন নির্বাক আর বিস্ময় চোখে তাদের দিকে চেয়ে আছি।

~বাবা আমার একহাত উনার হাতের মুঠোতে রেখে বলেন, আমরা সকল বাবা -মা রা সব সন্তানদের মঙ্গল চাই, কিন্তু সেটা আমাদের মনোভাব থেকে, সন্তানদের দৃষ্টি হতে হয়তো না। এবার না হয় আমরাই তোর মঙ্গল টা তোর মনোভাব দিয়েই দেখলাম..!!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত