নাভিদ দক্ষিণের বড় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোর হওয়া দেখছিলো। নিকশ কালো আধার রাত কীভাবে যেন ধীরে ধীরে রাঙা প্রভাতে রূপ নেয়। কখনোই তার ভোর এভাবে দেখা হয়নি। এতোটা মন খারাপ নিয়ে তো সে কোনোদিন থাকেনি। গত দুরাত ধরে তার ঘুম হচ্ছেনা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই কেটে যায়। আজ নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। যদি একটু ভালো লাগে!
মাথাটা পুরো ঝিম ধরে আছে। চোখের কোণায় পানি জমে শুকিয়ে গেছে। বুদ্ধি হবার পর এই প্রথম সে কেঁদেছে।
মা বলেন – ছেলেদের কাঁদতে নেই। কষ্টগুলো আর চেপে রাখতে পারছিলো না সে।
পুরোনো ঘটনাগুলো বারবার তাকে ভাবাচ্ছে।একসময়ের মধুর স্মৃতি গুলো এখন বিষের মতো লাগছে। ইউনিভার্সিটির ভর্তি যুদ্ধে তার ঠাই হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইচ্ছে ছিলো বুয়েট কিন্তু হলো না। সাব্জেক্ট টাও তার মনমতো ছিলোনা। হলে সিট পাওয়ার আগ পর্যন্ত দূর সম্পর্কের এক ফুফুর বাসায় ঠাই হলো। দোতলার ছাদের নোংরা এক ঘরে তার ঠাই হলো। পরিবার থেকে দূরে, অপছন্দের সাবজেক্টে পড়া, মফস্বল থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানের কেমন কাটে ইউনিভার্সিটির প্রথম দিন গুলো তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ফুফুর বাসায় ফুফুর ব্যবহার সহনীয় হলেও অন্যদের ব্যবহার তেমন ভালো ছিলোনা। এমন ভাবে কথা বলতো যেন সে ঐ বাড়ির চাকর।
কষ্ট গুলো দূর করার জন্য সারাদিন পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করতো কিন্তু কতক্ষণ আর পড়া যায়! ফেসবুকে এক মেয়ের সাথে তার বেশ চ্যাটিং হয়। মেয়েটা তার থেকে বয়সে বড়। তার সাথে চ্যাটিং করতে তার ভালো লাগে। এভাবে চ্যাটিং করার মাত্রাও বাড়তে লাগলো। একসময় তার মনে হলো মেয়েটাকে সে ভালোবাসে। কিন্তু মেয়েটা তাকে মেনে নিবে?
ভেবেছিলো চেপে যাবো ব্যাপারটা কিন্তু চেপে যেতে না পেরে একদিন বলেই বসলো
– রিন্তি, আমার মনে হয় তোমাকে আমি ভালোবাসি।
রিন্তি হেসে উত্তর দিলো
– জুনিয়র সাহেব, আমারো তাই মনে হয়। আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
সম্পর্কের শুরুটা অসাধারণ ছিলো নাভিদের কাছে। হঠাৎ তার ভেতরের গ্লানি, কষ্ট গুলো মুছে যেতে লাগলো।
সম্পর্কের বয়স যখন ৭ মাস তখন হলে শিফট হলো নাভিদ।
বেশ ভালোই চলছিলো, ইউনিভার্সিটির ক্লাস, পড়াশোনা, ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা, রিন্তির সাথে আদুরে, খুনসুটি তে দিন কাটিয়ে দেয়া।
রিন্তি প্রায়শই বলতো আচ্ছা একটু সময় করে দেখা করা যায়না?
নাভিদ হাসতে হাসতে বলতো
– তোমার সাথে দেখা করতে হলে একটু না প্রচুর সময় লাগবে। তুমি থাকো চট্টগ্রামে আর আমি ঢাকায়।
– প্রচুর সময় লাগবে লাগুক না। তোমাকে তো প্রতি সপ্তাহে আসতে বলছিনা।
– দেখা না করাই ভালো। দেখা করলে অনেক কিছু মাথায় আসবে। ঠিক হবেনা।
ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। পড়াশোনার বেশ চাপ। লাইব্রেরিতেই কাটে দিনের সিংহভাগ সময়।
গত পরশুদিন নাভিদ আর তার বন্ধু নেহাল লাইব্রেরিতে বসে নোট করছিলো। নেহাল বিরক্ত হয়ে বললো
– ধুর আর ভালো লাগেনা। তুই নোট কর।আমি একটু ফেসবুকে ঢুকি।
– তোর সারাদিন খালি ফেসবুক আর ফেসবুক।
– নিজে তো ঠিকই ফেসবুকে চুটিয়ে প্রেম করছো আর আমি একটু চ্যাটিং করলেই দোষ। তাও আবার বড় আপুর সাথে।
– হয়েছে চুপ থাক।
– জানিস সিয়াম টাও তোর মতো। বড় আপুর সাথে তারও চলে। দুদিন আগেই দেখা করতে চট্টগ্রাম পাড়ি জমিয়েছে। সব কিছু একেবারে কমপ্লিট করে এসেছে। তুই কবে করবি?
– আমি একেবারে বিয়ের পর। বিয়ের আগে ঠিক না।
– সাধু সাধু। আমাদের সাথেও তো তোমার রিন্তির পরিচয় করালে না।
– করাবো করাবো।
নেহাল একটু ঠাট্টার স্বরে বললো
– তোর পোস্টে সিয়ামের প্রেয়সীর কমেন্ট ক্যান রে?
নাভিদ অবাক হয়ে বললো
– কই দেখি তো?
নাভিদ হেসে বললো
– দোস্ত এতো আমার রিন্তি।
নেহাল বললো
– সিয়ামের প্রেমিকা দোস্ত। আমি ১০০% শিওর। গতকালও আমার সামনে এই আইডি দিয়ে সেক্স চ্যাট করেছে। এমনকি ভিডিও কলে এসেছিলো। আমার মিথ্যা বলে কী লাভ? কিন্তু ওর নাম যে রিন্তি তা তো জানতাম না।
নাভিদের তখন মনে হচ্ছিলো নেহাল মিথ্যা বলছে। লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে নাভিদ বললো
– দোস্ত, সিয়ামকে এখন এখানে ডেকে আনতে পারবি?
– দাঁড়া।
নেহাল ফোন করে সিয়ামকে ডেকে আনলো। নাভিদ ফোনের গ্যালারি থেকে রিন্তির ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো
– আপনি চিনেন একে?
সিয়াম হেসে বললো
– হ্যাঁ, আমার তিনি।
নাভিদ মনে মনে আশা করছিলো না বোধক উত্তরের৷ নাভিদের হাত পা কাঁপছিলো। কী করবে ভেবে না পেয়ে রিন্তিকে ফোন দিলো। রিন্তি ফোন রিসিভ করে বললো
– কী ব্যাপার? আজকে এই সময়ে ফোন?
– তুমি সিয়ামকে চিনো?
– কোন সিয়াম?
– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। চিনো কিনা বলো?
– না আমি চিনি না।
নাভিদ ফোন সিয়ামের হাতে দিয়ে বললো
– কথা বলুন।
সিয়াম ফোন ধরে বললো
– নাম্মি, তুমি আমাকে চিনো না?
তারপরের কথা নাভিদ মনে করতে চায়না। নাভিদের সাথে সম্পর্ক ১০ মাসের আর সিয়ামের সাথে ৬ মাসের।
দুদিন যাবত রিন্তি তার কোনো ফোন রিসিভ করছেনা। ফেসবুকে ব্লক দিয়ে রেখেছে। নেহালের কাছ থেকে জানালো রিন্তি নাকি সিয়ামকে চুজ করেছে।
সিয়ামের কাছে বলেছে
– তোকে সে ভালো ফ্রেন্ড ছাড়া কিছুই ভাবেনা।
নেহাল রাগত স্বরে বললো
– তোর কি ওই মেয়েকে ঘৃণা লাগছেনা? যে নাকি অন্য কারো সাথে বেডে পর্যন্ত গেছে। প্রায় প্রতিদিনই সেক্স চ্যাট করে তারে তুই এখনো চাস। কীভাবে?
আমি চেয়েছিলাম সে আমার লালসা থেকে দূরে থাক। তাকে আমি পবিত্র রাখি। আমাদের সম্পর্কটা ভালো থাকুক। আজে বাজে ব্যাপার গুলো না আসুক। আর সে কিনা……..
নাভিদের মনে হলো তার মা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে হয়তোবা। পেছন ঘুরে মাকে দেখে বললো
– এইসময়?
রাজিয়া আহমেদ বললেন
– পরীক্ষা এক সপ্তাহ বাকি। এইসময় বাসায় আসলি? শরীর খারাপ নাকি অন্যকিছু?
– তোমাদের কথা খুব মনে পড়ছিলো। তাই আর কী।
– তোর ড্রয়ারে ঘুমের ঔষধ পেলাম। তিন পাতায় মোট ৩০ টার মতো ট্যাবলেট আছে। বাবা তুই কিছু করতে চাচ্ছিস?
রাজিয়া আহমেদ ডুকরে কেঁদে উঠলেন আর বলতে লাগলেন
– বাপ তুই ছাড়া আমাদের আর কেউই নাই। তোর বিকল্পও নাই। আমরা কীভাবে কী করবো? এই দুইদিনে তোর এরকম অবস্থা দেখে তোর বাবাও অসুস্থ হয়ে গেছেন। বাপজান তুই খারাপ কিছু করিস না।
নাভিদ মাকে জড়িয়ে ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বললো
– না, মা। আমি খারাপ কিছুই করবো না।
একটি প্লাস্টিকের ফুলের জন্য নিজের মা বাবাকে কষ্ট দেয়ার কোনো কারণ নেই। নেই কোনো কারণ!