সিগারেট

সিগারেট

হসপিটাল আব্বাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ইসিজি করানোর জন্যে। রিসিপশন থেকে বারবার ডাকছে, “জয়নাল আবেদীন আছেন, জয়নাল আবেদীন।” কিন্তু আব্বার কোন সাড়া শব্দ নেই। আমি উঠে সামনের বেঞ্চে গিয়ে দেখি আব্বা বাইশ কিংবা তেইশ বছর বয়েসী এক তরুণীর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আমি আব্বার কানের কাছে গিয়ে “জয়নাল আবেদীন আছেন, জয়নাল আবেদীন।” আব্বা হুড়মুড় করে গা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলেন।

ইসিজি করানো শেষে আমি আর আব্বা রিপোর্টে জন্যে অপেক্ষায় আছি। আব্বা আমার কাছ থেকে একটু দূরে যেয়ে ঠিক সেই তরুণীর পাশের সীটে বসলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে শার্টের বুতাম ঠিক করে নিয়ে নিজে নিজেই বলে উঠলেন, “রিপোর্টটা দিতে তারা এতদেরি কেন করছে বুঝলাম না।” তারপর তরুণীর দিকে লক্ষ্য করে, “আপনিও বোধ হয় রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছেন, তাইনা?”

-“জ্বি আংকেল, রিপোর্টের জন্যে।”

আব্বা আবার শার্টের শেষ বুতামটা টানতে টানতে আমার পাশের সীটে এসে বসলেন। সেদিন আব্বার মোবাইল চ্যাক করে দেখি রাত ২টা বাজে শিউলি আন্টির সাথে ৪৭ মিনিট কথা বলেছেন।
আমি তো পুরা টাস্কি। এইটা কিভাবে সম্ভব! মা তাহলে কি আব্বার এসব দেখে না! আব্বা ইদানীং রুমের বদলে শুধু বাথরুমে এসি লাগানোর কথা ভাবছেন। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে রাতে মা যখন ঘুমিয়ে যায় তখন কমডে বসে আব্বা শিউলি আন্টির সাথে কথা বলে।

সকালে আব্বা দাত ব্রাশ করতে করতে আমার রুমে এসে চাদরটা আমার শরীরের উপর টেনে দিয়ে বলে, “মানুষের ছেলেরা কত প্রেম টেম করে, আর আমারটা শুধু ঘুমায়। এরকম ল্যাদা মার্কা পুলাপাইন আমি কোথাও দেখিনি।”
আমি চোখ বন্ধ রেখে কোলবালিশটা আরেকটু জোরে ধরে বলি, “রাত দুইটায় ডিউটি থাকার পরেও এত সকালে কিভাবে উঠো?” আব্বা মুখের ভেতরে ব্রাশ ঢুকিয়ে কি যেন আবল-তাবল বলতে বলতে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলেন। চুপিচুপি বললেন, “রাত ২টায় ডিউটি মানে?” আমি চাদরের ভেতর মুখ রেখে হাসতে হাসতে বললাম, “ওইযে, শিউলি আন্টির সাথে তোমার যে ডিউটিটা” আব্বা পকেট থেকে ৫০০টাকার একটা নতুন নোট আমার টেবিলের উপর গ্লাস চাপা দিয়ে রেখে রুম থেকে যেতে যেতে বললেন, “তোর মা যেন না জানে, কল্লা আলাদা করে ফেলবে কিন্তু।”

-বাজারটা করে দিয়ে যেও। আমি আজ একটু বেলা করে ঘুমাবো।
-ওকে, তুই ঘুমা সমস্যা নাই। বাজার আমিই করে দিয়ে যাচ্ছি।

গতকাল বিকেলে বাসায় ঢুকতেই মা আচ্ছামত কাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করলেন। “সিগারেট খাওয়া! আজকে সিগারেট খাওয়া বের করবো তোর।” বলে বলে প্রায় আধা ঘন্টা পেটালেন। সেই সাথে বাবাও উষ্ণ জ্বলে আগুন দিলেন, “ছেলে বড় ফাজিল হইছে, ওর বাপ কোনদিন সিগারেট ধরে দেখে নাই। অথচ সে সিগারেট খায়। কত বড় বেয়াদব হইছে চিন্তা করো তো একবার।”

শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় ক্ষত হয়ে গেছে। আমি এই ক্ষত নিয়ে বিছানায় মন খারাপ করে শুয়ে আছি। ভাবছি,”মা কিভাবে জানলো আমি সিগারেট খেয়েছি?” আব্বা রুমে ঢুকে মুচকি মুচকি হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করে “কেমন লাগে বাবা? খুব জ্বলে, তাইনা?” আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, এই সিগারেট খাওয়ার সংবাদটা আব্বাই মাকে দিয়েছে।

কিছুদিন আগে আব্বার সিগারেট খাওয়ার কথা মা’কে বলে দেয়ার পর মা আব্বার দিকে কাঠি নিয়ে তেড়ে আসছিলো। আব্বা হঠাৎ করে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় এবং সেদিন সারাদিন আর বাথরুম থেকে বের হয়নি। মা বাহির থেকে, “বের হও আজকে,বের হও শুধু। সিগারেট খাওয়াইয়া ছাড়বো আমি” বলে সারাক্ষণ দরজার সামনে কাঠি নিয়ে দাড়িয়ে ছিলেন। আমি দরজা নক করে, “আব্বা, ভেতরে গরম লাগে না তোমার? চার্জার ফ্যান দিয়ে দিবো?” বলে বলে হাসছিলাম।

সেদিনের পেদানি খেয়ে বেশ কিছুদিন আর সিগারেট খাইনি। কিন্তু আব্বার উপর খুব রাগ হলো। শিউলি আন্টির সাথে রাত ২টায় আব্বার ডিউটির কথা মা’কে বলে দিবো ভাবছি। কিন্তু আব্বার মোবাইল চ্যাক করে দেখি মোবাইলের কল লিস্ট ডিলেট করা। শুধু মা আর বড় আপুর নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার নেই লিস্টে। সেদিন যদি স্ক্রীন শর্ট নিয়ে আমার মোবাইলে রেখে দিতাম তাহলে ভালো ছিলো।

মোবাইলটা রেখে দিয়ে বারান্দায় বসে আছি। আব্বা পেছন থেকে খিল খিল করে হাসছেন। “বাজারটা করে নিয়ে আসিস। মাছ অবশ্যই কাটিয়ে আনবি। তোর মায়ের কষ্ট হয় মাছ কাটতে। আর তোর মায়ের জন্যে বিকেলে আলুপুরী নিয়ে আসিস, নিজের রুম নিজে গোছিয়ে রাখবি, সব মায়ের উপর ছেড়ে দিবিনা। একটা মানুষ এতদিকে খেয়াল রাখতে পারে নাকি?” বলতে বলতে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন।

পরের দিন ফিরোজ আংকেলের সাথে আব্বা জগিং করতে যাবে বলে খুব ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। কিন্তু আব্বার হঠাৎ জগিংয়ে যাওয়া আমার কাছে সন্দেহ মনে হলো।আব্বা বের হওয়ার প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমিও ওয়াকিং ক্যাডস জোড়া বের করে চন্দ্রিমা উদ্যানের দিকে চলে গেলাম।

যে সন্দেহ ছিলো ঠিক তাই ঘটলো। বাবা শিউলি আন্টির সাথে ডেটিং করতে আসছেন। দূরে একটা গাছের নীচে শিউলি আন্টি আর আব্বা বসে আছে। আব্বার হাতে একটা ব্যানসন। আব্বা সিনেমার নায়কদের মত মুঠ করে ব্যানসন ধরে আছে। একটু পর পর ধোঁয়া ছাড়ে। সেই ধোঁয়া শিউলি আন্টির নাকে যেয়ে লাগে। আন্টি হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করে। আহ! কি দৃশ্য!

আমি সুযোগের সঠিক ব্যবহারটা করলাম। দূর থেকে মোবাইল ক্যামেরা ঝুম করে বেশ কতগুলো ছবি তুলে বাসায় চলে এলাম। আব্বা আমার রুমে ঢুকেই মুচকি মুচকি হাসি দিলেন। শিউলি আন্টির সাথে ডেটিং করে এসে আব্বার মনটা আজকে ফুরফুরে। আয়নায় চুল ঠিক করতে করতে আমাকে বলেন “সিগারেট খাবিনা, ঠিকাছে? তোর আম্মু জানলে কিন্তু ওইদিনের মত পেদানি খাবি। তার চেয়ে ভালো আমার মত সকালে জগিং করবি, শরীর ফিট থাকবে। ইয়াং থাকবি আজীবন। বুঝলি?”

আমি ফুরৎ করে মোবাইলটা বের করে একের পর এক ছবি গুলো বের করে আব্বাকে দেখাতে লাগলাম। আব্বা তো পুরা টাস্কি! “এইগুলা কি করে রে, কিভাবে তুললি?” “ম্যাজিক আছে বাবু। ম্যাজিক।” বলেই মা’কে ডাকতে যাবো, এমন সময় আব্বা আমার মুখ চেপে ধরলেন। অফিস ব্যাগ থেকে একটা ব্যানসন এনে দিয়ে বললেন, “নে ধরা”।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত