গোধূলি সন্ধ্যায়, খোলা আকাশের নিচে ছাদের উপর দাঁড়িয়ে থাকলে একটা অন্যরকম অনূভুতি হয়।বিশাল এই আকাশের দিকে তাকালে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হয়।মেঘমুক্ত আকাশের দৃষ্টির শেষ প্রান্তে লাল রঙের সূর্যটা মনে হয় এখনিই ডুব দিবে।হালকা বাতাসে নিস্তব্ধ ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে অনেক ভালো লাগে আমার।এই বাড়িতে উঠেছি প্রায় তিনবছরের একটু বেশী হবে।অনেক বুঝিয়ে বলার পরে বাড়ির মালিক এই বাড়ির ছাদের চিলেকোঠার ছোট্ট রুমটা ভাড়া দিতে রাজী হয়েছিলো। এই অচেনা শহরে নিজেকে বড় একা মনে হয়।মাঝেমাঝে মনে হয় ছুটে নিজের শহরে চলে যাই।মায়ের কথা এখানে থাকলে ভীষণ মনে পড়ে।বাবা সেই ছোট থাকতে যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি সেই সময় আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে।বাবার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে খুব।
এই বাড়ি থেকে একটু দূরে ঝুপড়ির মতো একটা চায়ের দোকান আছে।এই সন্ধ্যাবেলায় করিম চাচার হাতের এক কাপ চা না খেলে রাত পার হবে না।রুমে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে করিম চাচার দোকান থেকে ঘুরে আসি।হাতের অবস্থা ভালো না,বলতে গেলে ভালো কখনোই থাকে না।তারপরও এখন আবার মাসের শেষ।টিউশনি করে যে টাকা পায়,তা দিয়ে বাড়ি ভাড়া,মাকে কিছু পাঠানোর পরে হাতে যা অবশিষ্ট থাকে তা দিয়ে খুব টেনেটুনে মাস পার করা লাগে কোনোভাবে।আসলে এই নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান্দের প্রায় সময়িই এইভাবেই দিনকাটানো লাগে।অভিজাতভাবে তো দূরের কথা খুব হিসাব নিকাশ করে চলতে হয়।না হলে মাস শেষে খাওয়ার টাকা নিয়েই টানাটানি বেঁধে যায়।
চাচার দোকানে গিয়ে বসার পর চাচা বলছে,”কি গো বাবা আজ একটু তাড়াতাড়ি আইলে যে।”আমি বলছি হুম চাচা আজ বাড়ি থাকতে ভালো লাগছিলো না।তাই একটু তাড়াতাড়ি আসলাম।চাচা এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা দিলো।চায়ে চুমুক দিচ্ছি আর ভাবছি, “আগের দিনগুলো কত সুন্দর ছিলো।বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে কত মজা করতাম।একসাথে আড্ডা না দিলে দিনিই পার হতো না।” চিটাগাং এ ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পরে,এই অচেনা শহরে পাড়ি দিতে হয়েছে।ওহ পরিচয়টাই দেওয়া হলো না,আমার নাম “আরাফাত”।অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি।
চা খেয়ে করিম চাচাকে বিল দিয়ে, আবার চিলেকোঠার দিকে হাঁটা দিলাম।রুমে গিয়ে গিটারটা নিয়ে ছাদের এক কোণে রাখা চেয়ারটা টেনে বসলাম।গিটার বাজানোর শখ অনেক আগে থেকেই।অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে গিটারটা কিনেছিলাম।আকাশে অনেক তাঁরা আজ একফালি চাঁদ ও দেখা যাচ্ছে।মেঘমুক্ত আকাশ বলে আজ আকাশটাও অনেক সুন্দর লাগছে।আমি টুংটাং শব্দে আমার একটা প্রিয় গানের সুর তুলছি, “খোলা জানালা,দখিনের বাতাসে ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে, তখন তুমি,এসে হেঁসে বলে দাও আছি তোমার পাশে। বহুদূর পথ ভীষণ আকাঁবাঁকা,চলতে ভীষণ ভয়, তুমি এসে বলে দাও,আছি আমি পাশে করোনা কিছুতেই ভয়। কখনো ভাবিনি চলে যাবে তুমি আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে, কখনো বুঝিনি ফিরে আসবেনা আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।”
এই গানটা গাইলে পুরোনো স্মৃতিগুলো বুকের মাঝে বারবার খোঁচা দিয়ে উঠে।”অনুর,কথা ওর সাথে কাটানো প্রতিদিন,প্রতি মূহুর্ত বারবার মনে পড়ে।কলেজে পড়ার সময় ওর সাথে আমার পরিচয় হয়।অনু আমার ফ্রেন্ডসার্কেলেরও একজন ছিলো। একসাথে আড্ডা ইয়ার্কির মধ্য দিয়ে,একসময় ওর সাথে খুব ভালো একটা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়।ওকে আমার প্রথম থেকেই অনেক ভালো লাগে।ওকে যে আমার খুব ভালোলাগে ওকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতাম।
ওর সাথে চোখাচোখি হলে শুধু মুচকি হাঁসতো।ওর ওই হাঁসিটা আমার মনের মধ্যে ঝড় তুলতো।আমি বুঝতে পারতাম না ঠিক, আমার জন্যও কি ওর মনের মধ্যে কোনো অনূভুতি কাজ করে কিনা?ঈদের আগের দিন ওকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম কাল কি ফ্রি থাকবে দুইজন একসাথে ঘুরতে যেতাম।অনুও রাজী হয়েছিলো সেইদিন যে কি পরিমাণ খুশী হয়ছিলাম।সেদিন মনের মধ্যে অন্যরকম একটা অনূভুতি কাজ করছিলো।ঈদের দিন বিকেল বেলা ও যখন আসলো ওকে দেখে আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।হালকা সাজে ওকে ভয়ংকর সুন্দর লাগছিলো।মনে হচ্ছিলো ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকি।
ওর কানে গুজে রাখা গোলাপ ফুলটা ওর সৌন্দর্য আরোও বাড়িয়ে দিয়েছিলো।অনুকে বললাম পরীরাও আজ তোমার সৌন্দর্য দেখলে হিংসে করবে।অনুর গাল তখন লজ্জায় লাল হয়ে গেছিলো।আমি ভাবছিলাম যেভাবেই হোক ওকে আমার মনের কথা আজ জানাতেই হবে।না হলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো।সারাবিকেল দুইজন একসাথে ঘোরাঘুরি করলাম নদীর পারে,ব্রিজের উপরে।ফেরার পথে চটপটি খেলাম।অনু আইস্ক্রীম খেতে পছন্দ করে দুইটা আইস্ক্রিম নিলাম।ওকে বাড়ির পথে এগিয়ে দেওয়ার সময় পথ চলতে চলতে সাহস নিয়ে বলেছিলাম,তোমার সাথে সারাজীবন এইভাবে পথ চলতে চাইলে তুমি কি রাজী হবে?অনু তখন আমার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লাজুক হেঁসে বলেছিলো,মানা করেছে কে?যদি সারাজীবন এইভাবে চলতে পারো তাহলে আমিও রাজী।সেইদিন থেকেই ওর সাথে নতুন পথ চলা শুরু হয়।
কলেজে গিয়ে ক্লাস না করে সারাদিন দুইজন একসাথে ঘোরাঘুরি করতাম,একসাথে সবাই মিলে আড্ডা দেওয়ার সময় একভাবে ওর দিকে তাঁকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগতো।ও যখন দেখতো আমি ওর দিকে তাঁকিয়ে আছি,তখন রাগীভাব নিয়ে আমার দিকে তাঁকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করতো,আমি বুঝতে পারতাম ও বুজাচ্ছে,”কি দেখো?হুম”।ও রাগীভাব টা ধরে রাখতো পারতো না। ফিক করে হেঁসে দিতো।ওর হাঁসিটার মায়াতেও পড়েছিলাম ভীষণভাবে।মাঝেমাঝে পার্কে হাত ধরে কিছুক্ষণ একসাথে বসে থাকা সময় কাটানো।ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে, ফোনে কথা বলে রাত পার করে দেওয়া প্রায় প্রতিদিনের রুটিন হয়ে পড়েছিলো।এভাবেই রাগ,অভিমান, খুনসুটি নিয়ে ভালোই চলছিলো দুজনের পথ চলা।ওকে নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট সপ্নও দেখতাম।
এভাবেই প্রায় বছরখানিক সবকিছু ঠিকঠাকই ছিলো।তারপর কিছুদিন ধরে অনুর কথাবার্তা,আচরণ আমার কাছে কেমন জেনো অচেনা হয়ে উঠতে থাকলো।ফোন দিলে ফোন কেটে দেয়।রাতে ফোন ওয়েটিং থাকে।যদি জিজ্ঞেস করতাম কার সাথে কথা বলছো।বলতো ফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলছিলাম।আমার সাথে কথা বলার পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিলো।কলেজে আসাও কমিয়ে দিলো।সবাই একসাথে আড্ডা দেওয়ার সময় ও থাকতো না।কিছু বললে বলতো, ভালো লাগছে না বাসায় চলে যাবো।আমিও আর জোর করতাম না।এভাবেই কিছুদিম কেঁটে গেলো।একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখি,অনু একটা ছেলের বাইক থেকে নামলো,ওই ছেলে অনুর হাত ধরে রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। অনুকে দেখে বোঝা গেলো ও অনেক খুশীতে আছে।
এই ঘটনা নিজে দেখার পরেও আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল্লো।নিজেকে কেমন ভীষণ একা মনে হচ্ছিলো।এইজন্য অনু আমাকে এইভাবে এড়িয়ে চলছে?বাসায় ফিরে দরজা বন্ধ করে সারাদিন রুমে শুয়েছিলাম।ছেলেদের চোখ থেকে কখনো পানি পড়তে নেই,তারপরেও চোখ থেকে নোনা পানি গড়িয়ে পড়ছিলো।শুধু মনে হচ্ছিলো যা দেখেছি সব মিথ্যা,সব ভুল।ওইদিন রাতে অনুকে ফোন দিলাম,ফোন ধরলোনা।কিছুক্ষণ পর অনুর ফোন ওয়েটিং দেখাচ্ছিলো।বুকের বাম পাশে তখন চাপা ব্যাথা অনূভুত হচ্ছিলো।কিছুক্ষণ পর ফোন দিয়ে বলেছিলো,”দেখতেই পারছো ফোন ওয়েটিং আছে,তারপরেও বারবার কল দিয়ে বিরক্ত করছো ক্যান?”এই কথা বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।যার সাথে কথা বলতে বলতে রাত পার করে ফেলতাম,সে আজ বলে ফোন দিয়ে বিরক্ত করছো কেনো?
পরের দিন কলেজে গিয়ে দেখি অনু আসছে।আমি ওর সামনে গিয়ে সরাসরি বললাম কাল কার বাইকে করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে?অনু বল্ল ওহ সব যখন দেখেছো তখন এটা বুঝতে পারনি ওই ছেলেটা কে?ওর নাম রাকিব।আমার বয়ফ্রেন্ড। কিছুদিন আগেই আমার সাথে ওর পরিচয় হয়েছে।ও আমাকে প্রোপজ করেছিলো আমি এক্সেপ্ট করেছি।আর হ্যাঁ তোমার সাথে রিলেশন রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।অনুর মুখ থেকে এইকথা শুনতে হবে আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।আমার বুকের মধ্যে গিয়ে বিঁধলো কথাগুলো।আমি তখন বললাম আমার সাথে সারাজীবন একসাথে চলবে এই কথা কি মিথ্যা ছিলো? অনু বল্ল মিথ্যা না তবে তুমি কখনো ওর মতো আমাকে এত্ত সুখে রাখতে পারবেনা।বাইকে করে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারবেনা,ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে পারবে না।দামী গিফট দিতে পারবেনা।এই দেখো ও আমাকে ডায়মন্ড রিং দিয়ে প্রোপজ করেছে।তাই বলে ও ওর হাতের অনামিকা দেখালো,ডায়মন্ড রিং টা ওর হাতে চকচক করছে।ও বল্ল,”তুমি কখনো পারবেনা এইগুলো দিতে।
তাইতো আমি কখনো পারবোনা ওকে এগুলো দিতে।আমার সেই সামর্থ্য নেই।শুধু মনে হচ্ছিলো তখন,শুধু এইগুলোর জন্য অনু আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?অনু টাকার মধ্যে ওর সুখ খুঁজে নিতে পারলো?এতদিনে ওর সাথে যা ছিলো সবকিছু মিথ্যা ছিলো?আমার জন্য ওর ভালোবাসা বলতে কিছুই ছিলোনা?আমাকে অনু বল্ল,”যদি তুমি সত্যি আমাকে ভালোবাসো তাহলে কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করোও না।আর অন্য কাউকে খুঁজে নিও।ভালো থেকো”।এই বলে অনু কলেজের গেটে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই ছেলের বাইকে উঠে চলে গেলো।
কখনো ভাবিনি যে ও আমার সব সপ্ন চুরমার করে,একসাথে সারাজীবন পথ চলার ওয়াদা ভেঙে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।মাঝেমাঝে ওর কথা ভীষণভাবে মনে হতো।ভাবতাম নিজেই নিজেকে শেষ করে দিই।কিন্তু মায়ের কথা ভেবে এই কাজ আর করতে পারিনি।অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিই।পড়ালেখার দিকে মনোযোগ দিলাম।সামনে পরীক্ষা।পরীক্ষার পর এডমিশন দিলাম এই দূর শহরে।বলা যায়,ওর থেকে দূরে থাকার জন্য,ওর স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য এইটা আরেকটা চেষ্টা। আমিতো সত্যিই ওকে ভালোবেসেছিলাম।ওকে ছেড়ে থাকতে যে আমার ভীষণ কষ্ট হতো।ভাগ্যক্রমে আমার চান্স হয়ে গেলো এখানে।
তারপর থেকেই এই অচেনা শহরটাকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকি।ভার্সিটিতে গিয়েও নতুন আর তেমন কোনো বন্ধু হয়নি,দুই একজন ছাড়া।বলা যায়,ইচ্ছা করেই করিনি।মাঝেমধ্যে ভার্সিটিতে গিয়ে ক্লাস করে ফিরে আসি।আর বাইরে বলতে টিউশনি করতে যায় শুধু।যাক গিয়ে অনেক গভীরে চলে গেছি।পুরোনো স্মৃতিগুলো শুধু নিজেকে কষ্ট দেয়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হচ্ছিলাম।বাড়ির গেটে দেখি একটা ট্রাক থেকে আসবাপত্র নামাচ্ছে।বাড়ির দোতালার ভাড়াটিয়ারা কিছু দিন আগে চলে গেছে।মনে হয় নতুন ভাড়া আসছে।আমি আর সেদিকে খেয়াল না করে ভার্সিটিতে চলে আসলাম।
ক্যান্টিন থেকে হালকা নাস্তা করে,ক্লাসে গেলাম।ক্লাসে গিয়ে রিফাতের সাথে কথাবার্তা হলো।ভার্সিটিতে বন্ধু বলতে শুধু রিফাত,ও অনেক ভালো মনের একটা ছেলে।তিনটা ক্লাস করে বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম।বাড়িতে এসে ভাত রান্না,আলু ভর্তা,আর ডিম ভাজি করলাম।ব্যাচেলর লাইফে এর থেকে ভালো খাবার আর কিছুই হতে পারে না।এরপর গোসল করে এসে খেয়ে ঘুম দিলাম।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে ফ্রেস হয়ে প্রাইভেট পড়িয়ে বাসায় ফিরলাম।
সন্ধ্যেবেলায় গিটারটা নিয়ে গিয়ে আজ গাইতে শুরু করলাম “তুমি কি চাওনা সোনালী দিনে,সোনালী সুখেরিই ইশারা? কাঁটার আঘাত ভুলে তুমি ধরা দাও আমার কাছে, যেখানেই সীমান্ত তোমার,সেখানে বসন্ত আমার। ভালোবাসা হ্রদয়ে নিয়ে,আমি বারেবার আসি ফিরে,ডাকি তোমায় কাছে। হাজার ফুলে ছেয়েছে যে পথ,আমি চিনি চিনি সে ঠিকানা তোমার মনের নীরব ভাষা সেও তো আছে আমার জানা।” বাহ্ বেশ ভালো গান করেন তো।পিছনে ফিরে তাঁকাতে দেখি একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।শ্যামলা চেহারা,চোখে চশমা।কেমন একটা মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাঁকিয়ে আছে।এই সময় ছাদে অচেনা একটা মেয়েকে দেখে অবাক হলাম।
আমিঃ কে আপনি?
মেয়েঃআমার নাম চাঁদনী।এই বাসায় আজ উঠেছি।
আমিঃওহ। তো সন্ধ্যেবেলায় ছাদে ক্যান?
চাঁদনীঃ সন্ধ্যেবেলায় ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে ভীষণ ভালো লাগে তাই।
(মনে মনে ভাবছি এই সময় ছাদে কেউ আসলে চরম বিরক্তি লাগবে। এতদিন একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যেবেলার নিস্তব্ধ পরিবেশ উপভোগ করার অভ্যাস হয়ে উঠেছে।আমি চাইনা কেউ এই সময় এসে আমার একাকীত্ব সময় কাঁটাতে বাঁধা দিক।কিন্তু আমার তো নিজের বাড়ি না তাই কিছু বলতেও পারছি না।)
চাঁদনীঃ তো আপনার পরিচয় কি জানতে পারি?
আমিঃ আমার নাম আরাফাত। এই বাসায় উঠেছি প্রায় চারবছর মতো হতে চললো।
চাঁদনীঃওহ। আপনার গলাটা অনেক সুন্দর,গানটা ভীষণ ভালো লেগেছে।
আমিঃ ধন্যবাদ। আচ্ছা থাকেন একটু বাইরে যাবো।
চাঁদনীঃওহ,ঠিকাছে।
রুমে এসে গিটারটা রেখে,করিম চাচার দোকানের দিকে যাচ্ছি।কোথা থেকে যে আবার এই উটকো ঝামেলা এসে জুটলো আল্লাহ জানে। চা খেয়ে রুমে আসার সময় আর ছাদে দেখলাম না।যাক নিচে নেমেছে। পরেরদিন সন্ধ্যায় ছাদে এসে দেখি,সেই মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মেজাজটাই গরম হয়ে গেলো।
চাঁদনীঃ কেমন আছেন?
আমিঃএইতো ভালো। আপনি?
চাঁদনীঃ হুম ভালো।
আমিঃ তো ছাদে কি আকাশ দেখতে এসেছেন?
চাঁদনীঃহুম।আপনাকে কাল বলেছিলাম না,আমার বিকেলে ছাদে এসে আকাশ দেখতে ভালো লাগে।
আমিঃহুম।(ধ্যাত আর ভালো লাগে না মনে মনে বলছি)
চাঁদনীঃ আজ গান গাইবেন না?
আমিঃভালো লাগছে না আজ গান গাইতে।
চাঁদনীঃআপনি অনেক ভালো গান করেন।প্লিজ একটু শোনান।
আমিঃআজ গাইতে ইচ্ছা করছে না,ভালো লাগবে না আজ গাইলে।
চাঁদনীঃতবুও কয়েক লাইন শোনান না প্লিজ।
এত্ত অনুরোধ করার,পর আর মানা করতে পারলাম না। রুম থেকে গিটারটা নিয়ে এসে গাইতে শুরু করলাম। “তুমি যাকে ভালোবাসো,স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো,তার জীবনে ঝড়।তোমার কথার শব্দ দূষণ, তোমার গলার স্বর। আমার দরজায় খিল দিয়েছি, আমার দারুণ জ্বর, তুমি অন্য কারোও সঙ্গে বেঁধো ঘর। কথার উপর কেবল কথা সিলিং ছুঁতে চায়। নিজের মুখের আয়না আদল লাগছে আসহায়, তুমি অন্য কারোও ছন্দে বেঁধো গান”
চাঁদনীঃবাহ!অসাধারণ লাগলো।তো সেই মানুষটা কে?
আমিঃ কার কথা বলছেন?
চাঁদনীঃএইযে,যাকে অন্য মানুষের সাথে ঘর বাঁধতে বলছেন।
আমিঃওহ,এইটা তো গানের কথা।সেতো অলরেডি ঘর বেঁধে ফেলছে।
চাঁদনীঃকে ঘর বেঁধে ফেলছে?
আমিঃ না কেউ না।আচ্ছা থাকেন।বাইরে যাবো।
চাঁদনীঃআচ্ছা যান।
এইভাবে ভালোই যাচ্ছে দিনগুলো। এখন আর চাঁদনী ছাদে আসলে খারাপ লাগে না। বরং কথা বলতে ভালোই লাগে।ও আমার গান শুনতে খুব পছন্দ করে।ওর সম্পর্কেও অনেক কিছু জানলাম।ওর আম্মু ওর জন্মের সময় মারা গেছে।বাবা চিটাগং শহরে একটা অফিসে চাকরী করে।মূলত ওর বাবার ট্রান্সফারের জন্য এখানে আসছে।বাবার খুব আদরের একটাই মেয়ে।এইজন্যই ওর বাবা হয়তো দ্বিতীয় বিয়ে করেনি।এই অল্প কিছুদিনে ওর সাথে ভালোই মিল হয়ে গেছে।এখন দুইজনকে দুইজন তুমি বলেই সম্বোধন করি।হঠাৎ করে চাঁদনী কয়েকদিন ছাদে আসে না।আমি ভাবছি,কি এমন হলো হঠাৎ ছাদে আসা বন্ধ করে দিলো ক্যান?ওদের ফ্লাটে গিয়ে খোঁজও নিতে পারছি না।ওর আব্বু কি ভাববে।তাছাড়া আমি এইবাড়ি ভাড়া থাকি। পরেরদিন ছাদে দেখি চাঁদনী দাঁড়িয়ে আছে।
আমিঃকি হয়েছিলো?কয়দিন আসো না ক্যান?তোমাকে একটা কথা জানানোর ছিলো।
চাঁদনীঃআমি তোমাকে কিছু বলতে চায়।
আমিঃ হুম বলো।
চাঁদনীঃ আমি প্রতিদিন ছাদে আসি শুধু আকাশ দেখার জন্যই না,তোমার সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে।তোমার গান, আমার শুনতে শুনতে নেশা হয়ে গেছে।এই কয়দিন তোমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলাম।কিন্তু বিশ্বাস করো আমি পারছি না।আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।আমাকে প্লিজ ফিরিয়ে দিও না।
আমিঃ(কি বলবো খুঁজে পাচ্ছি না) দেখো চাঁদনী তুমি আমার অতীত জানো না।ওকে অনুর বিষয়ে সব খুলে বলার পর বললাম,আমার পক্ষে রিলেশন এ জড়ানো সম্ভব না।আর আমার অনার্স করা শেষ। রেজাল্ট এই সপ্তাহে দেবে।এই সপ্তাহে এইবাসা ছেড়ে নিজ শহরে ফিরে যাবো।এই কথাটা জানানোর ছিলো। ওর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমারও খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই।
চাঁদনীঃপ্লিজ আরাফাত আমাকে ছেড়ে যেও না।আমাকে সাথে করে নিয়ে যাও।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।
আমিঃ তা কখনো সম্ভব নয়। এই কথা বলে চলে আসলাম বাইরে।
আর কারোও জন্য মায়া বাড়াতে ভয় হয়।স্মৃতিগুলো শুধু কষ্ট দিতেই পারে।আমি চাইনা আর স্মৃতি জমাতে।
এইকয়দিন আর ওর সামনে না পড়ার চেষ্টা করতে থাকলাম।যাওয়ার আগের দিন প্রাইভেট পড়াতাম অর্নবকে, ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম।ওকে খুব মিস করবো,সেই ক্লাস থ্রী থেকে ওকে পড়ায়।ওর চোখে দেখি পানি টলমল করছে।ওর জন্য একটা ঘড়ি কিনে নিয়ে গেছিলাম।ওর হাতে পড়িয়ে দিলাম।আর বললাম এই ঘড়িটা আমার কথা তোমাকে মনে করিয়ে দেবে।এবার ও আর চোখের পানি ধরে রাখতো পারলো না।আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।আমার চোখ টাও ভিজে উঠছে বুঝতে পারলাম।ওকে বুঝিয়ে বললাম,ভালো করে পড়ালেখা করতে বললাম।ভাইয়া আপনি আর আসবেন না কখনো?অর্নব বললো।
আমিঃ হুম আসবো না ক্যান।খুব তাড়াতাড়ি আবার এসে দেখা করে যাবো।
আর্নবঃ সত্যি তো?
আমিঃ হুম পাগল ছেলে।
ওর আম্মুর কাছ থেকেও বিদায় নিলাম। করিম চাচার দোকানে গেলাম।আজিই হয়তো চাচার হাতের শেষ চা খাবো। করিম চাচা খুব ভালো মানুষ। চায়ের সাথে সাথে এই সাদাসিধে মানুষটাকেও খুব মিস করবো।চাচার কাছ থেকেও বিদায় নিলাম। আসলে “প্রতিটা মানুষের জীবনেই কিছু মানুষ থাকে যাদের সাথে রক্তের সম্পর্কের থেকেও গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।আত্নার সাথে মিশে থাকে মানুষগুলো।”তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া আসলেই খুব কষ্টের ব্যাপার।
বাড়িওয়ালা চাচার সাথে দেখা করে এইকয়দিনের ভাড়া দিতে গেলাম।চাচা ভাড়া নিলো না আর এই কয়দিনের।বাড়িওয়ালা চাচাও অনেক ভালো একজন মানুষ।রাতেই সব গুছিয়ে নিয়ে সকাল থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়লাম।পিছে ফিরে বাড়ির দিকে দেখলাম,ছাদের উপর চিলেকোঠার দিকে তাঁকাতেই কেমন যেনো মোচড় মেরে উঠলো বুকের মধ্যে। চার বছরের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে যে।কেনো জানি চাঁদনী কে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।বেশ কয়েকদিন দেখি না,ওই দিনের পর থেকে।আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি যখন জানবে মেয়েটার কি আবার চোখ ভিজে উঠবে? সন্ধ্যেবেলা কি ছাদে গিয়ে দাঁড়াবে আর?থাক আর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই।বড্ড খারাপ জিনিস মায়া।
নিজের শহরে ফেরার পর মোটামুটি একটা ভালো চাকরীও পেলাম।মাকে নিয়ে একটা ভালো ফ্লাটে উঠেছি।অনুর নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে।ওর হাজবেন্ড নাকি অন্য একটা বিয়ে করেছে।কথাটা যখন জানলাম, সেই দিনের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো,সুখের কথা ভেবে বড়লোকে ছেলের হাত ধরলো।টাকাকে আপন করে নিয়ে সুখী হতে পারলো না ক্যান?পুরোনো ঘৃণাটা আবারোও জেগে উঠলো।এই শহরে আসার পর থেকে কেনো জানি মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছি না।চাঁদনী কে ভীষণ মিস করছি।ও ভালো আছে তো?এই ফ্লাটের ছাদে গেলে ওকে খুব মনে পড়ে। মনে হয় আমার পাশেই আছে।মনে হয় আমাকে বলছে,একটা গান শোনাও না।কিছুতেই ওর কথা ভুলতে পারছি না।
সন্ধ্যেবেলা ওর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছা হয়।আচ্ছা ওর ও কি এমন হচ্ছে?কয়েকদিন পর হঠাৎ এক বিকেলে কলিংবেল বেজে উঠলো,দরজা খুলতে দেখি চাঁদনী আর চাঁদনীর বাবা দাঁড়িয়ে আছে, এ কি অবস্থা মেয়েটার চোখের নিচে কালি পড়ছে,অনেক শুখিয়ে গেছে।নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে।ও আমার দিকে শুধু চেয়ে আছে।তাড়াতাড়ি করে ভিতরে ডেকে বসতে দিলাম।ওর আব্বু আমাকে বলছে, যেদিন তুমি চলে এসেছো,সেদিন থেকেই আমার মেয়ের এই অবস্থা।ঠিকমতো খায় না। সারাদিন রুমে থাকে।সন্ধ্যেবেলা ছাদে গিয়ে বসে থাকে আর কান্নাকাটি করে।বাবা হয়ে এই দৃশ্য আর দেখতে পারছি না।ও আমাকে সব খুলে বলেছে।আমার মেয়েটা তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসে।তুমি আর ওকে ফিরিয়ে দিও না।অনেক খুঁজে তোমার ঠিকানা পেয়েছি।আমার আম্মু সব শুনে আমাকে বকাবকি শুরু করলো।ওর বাবাকে বল্ল মেয়ে আমার পছন্দ হয়ছে,এই মেয়েকেই আমার বৌমা করবো।চাঁদনী চুপ করে বসে আছে।আর আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে।আম্মু বললো ওকে নিয়ে রুমে যা।আমি ওর হাত ধরে ছাদে নিয়ে আসলাম।
আমিঃকেনো এত্ত পাগলামি করলে?
চাঁদনীঃ নিশ্চুপ।
আমিঃ কথা বলবেনা আমার সাথে?
চাঁদনীঃ নিশ্চুপ।
আমিঃ আচ্ছা না বললে কথা।আমি আম্মুকে গিয়ে বলে আসি,বোবা মেয়েকে আমি বিয়ে করবো না।
চাঁদনী আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্না করে উঠলো।আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।আমাকে আজ ফিরিয়ে দিও না আরাফাত।এই কয়দিন তোমাকে ছাড়া আমার এক একটা দিন কেমন করে কাঁটছে তোমাকে বোঝাতে পারবো না। আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আমিও তোমাকে ভালোবাসি। অনেক মিস করেছি তোমাকে। চাঁদনী বলে উঠলো আমাকে ছেড়ে আর কখনো যাবে নাতো? আমি ওর চোখের দিকে তাঁকিয়ে বললাম,কখনো না। সারাজীবন তোমার পাশে থাকবো।প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা দুইজন একসাথে আকাশ দেখবো।
ওর চোখে-মুখে কিছু একটা ফিরে পাওয়ার প্রশান্তি স্পষ্ট দেখতে পারছি।এই মেয়ে যে,আমাকে কখনো ঠকাতে পারবে না, কখনোই না। আজ নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হচ্ছে।আমার বাম পাঁজরের হার কে আমি যে পেয়ে গেছি।আজ আকাশটাও অনেক সুন্দর লাগছে।চাঁদনী আমার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। আমি গাইতে থাকলাম “যখন নিঝুম রাতে সবকিছু চুপ,নিষ্প্রাণ নগরীতে ঝিঁঝিরাও ঘুম। আমি চাঁদের আলো হয়ে, তোমার কালো ঘরে জেগে রয় সারা নিশি। হুমমম এতটা ভালোবাসি”