নিশিথে এলো বৃষ্টি

নিশিথে এলো বৃষ্টি

রাত প্রায় পৌনে একটা বাজে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরছি। আমি হাঁটছি, আমার পেছন পেছন একটা কুকুরও হাঁটছে। তাকে একটা পাউরুটি খাইয়েছিলাম ব্যস, পিছু নিতে শুরু করেছে। আমি থামলে সেও থামছে। আমার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে। আমি হাঁটতে শুরু করলেও সেও আমার পেছন পেছন হাঁটছে।

শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছি। চাঁদের আলোয় চারিদিক ঝকঝক করছে। মিষ্টি বাতাস বইছে। আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে, রবীন্দ্রসংগীত শুনছি- আজি ঝরো ঝরো মুখরও বাদরও দিনে জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ঝরো ঝরো মুখরও বাদরও দিনে গান শুনতে শুনতে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় হুট করে কুঁচকুঁচে কালো রঙের কিছু একটা বাঁশঝাড় থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। এই দৃশ্য দেখে, আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল।

এই বাঁশঝাড় নিয়ে বহুল আদি-ভৌতিক গল্প মহল্লার মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে- “কোন একসময় বাঁশঝাড়টা প্রকাণ্ড রকমের বড় ছিল, বাঁশঝাড়ে নাকি পেতনী আছে। মহাল্লার নুরু পাগলা নাকি এই বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় পেতনী দেখে পাগল হয়েছে।” -আমি এসব ভূত-প্রেত বিশ্বাস করতাম না, কিন্ত আজ নিজ চোখে যা দেখছি, তা বিশ্বাস না করে আর উপায় নাই। আমি পেছনে তাকিয়ে কুকুরটাকে খুঁজলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! কুকুরটা নাই ভূত-প্রেত নাকি আগুন দেখে ভয় পায়। আমি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালাম,

-এতে পেতনীর কোন নড়াচড়া পরিলক্ষিত হলো না। আমি উলটোদিকে ফিরে জোর পায়ে হাঁটা দিলাম। ভূত হলে দৌড় দিতাম। পেতনী হচ্ছে ভূতের স্ত্রী লিঙ্গ -অর্থাৎ মেয়ে। মেয়ে মানুষের জাত-ই হোক অথবা পেতনীর জাত-ই হোক, তার সামনে থেকে ভয় পেয়ে দৌড় দেওয়া যায় না। দৌড় দিলে পুরুষ জাতির প্রেসটিজ থাকে না।

কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে দেখলাম- পেতনী আমার পিছু নিয়েছে। প্রেসটিজের কথা ভুলে গিয়ে এক ভোঁ-দৌড় দেবো বলে ঠিক করলাম। এমন সময়, পেছন থেকে কোমল গলায় পেতনী বলল- “ভাইয়া একটু শুনুন।” আমি থমকে দাঁড়ালাম। পেতনী দ্রুত আমার কাছে এসে বলল- “আমার খুব বিপদ। প্লীজ রাতটা আমাকে থাকার ব্যবস্থা করে দিন।” আরে সর্বনাশ! এই পেতনী বলে কী! আমি ভয়ে ভয়ে বললাম- “দয়া করে আমাকে ছেড়ে দেন। বহুদিন পর ছুটিতে বাড়ি আসছি। কালকেই চলে যাবো।”

পেতনী আমার একহাত সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল- “ভাইয়া এতো রাত করে কোথায় যাবো? একা মেয়ে মানুষ বুঝতেই তো পারছেন। প্লীজ ভাইয়া আমাকে রাত টা থাকার ব্যবস্থা করে দিন পেতনীর কথায় মনে হলো, এটা পেতনী না হয়ে মানুষও হতে পারে। পেতনীর পর দ্বিতীয় সন্দেহ হলো, বাজে মেয়ে। ভদ্র কোন মেয়ে এতো রাত করে বাইরে থাকবে কেন? নিশ্চয়ই আমাকে তার কাস্টমার ভেবেছে আমি বললাম- “আপনি অন্য কাউকে খুঁজুন, আমি এই লাইনের লোক না।” “মানে?” “মানে বুঝেন নাই, আমি আপনার কাস্টমার না। অন্য কাউকে ধরুন।” মেয়েটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল- “আপনি যা ভাবছেন আমি তা নই। আমি বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসছি।” “বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসলে কারও বাসায় না গিয়ে এইখানে আসছেন কেন?”

“আমি এখানে আসতাম না ভাইয়া। গাড়ি থেকে নেমে নদী পাড় হবার পর, তিনটা লোক আমার পিছু নিয়েছে। পরে এখানে লুকিয়ে পড়েছি।” মেয়েটার কথা আমি বিশ্বাস করে ফেললাম। সহজ স্বাভাবিক গলায় বললাম- “ঠিক আছে আসুন। শুধু রাতটাই তো?” “আমি সকালে উঠেই চলে যাবো।” আমি বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম, মেয়েটা আমার পিছু পিছু… হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করলাম- “বিয়ে বাড়ি থেকে পালালেন কেন?” “যার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছিল সে আমার ২৬বছরের বড়। তাঁর আগেও একটা বিয়ে হয়েছিল। আমার বয়সী দুইটা ছেলে-মেয়েও আছে।” “আপনার বয়স কতো?” “বিশ বছর।” “তাহলে পালিয়ে এসে খুব ভাল কাজ করেছেন।”

বাসায় এসে চুপ করে আমার ঘরের দরজা খুললাম। আমার ঘরের দুইটা দরজা, একটা সিঁড়ির সাথে আরেকটা ভেতরের ঘর গুলোর সাথে কানেকটেড। ঘরে ঢুকে ফিসফিস করে বললাম- “রাতে কিছু খেয়েছেন?” মেয়েটা কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে রইল রান্নাঘর থেকে প্লেটে করে খাবার নিয়ে এসে বললাম- খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন আমি ঘরের বাইরে গিয়ে সিঁড়িতে বসে- বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদা সমগ্র-২ পড়তে শুরু করলাম রাত সাড়ে তিনটা বাজে। কিছুক্ষণের মধ্যে আব্বা ঘুম থেকে উঠে মসজিদে যাবেন। আমাকে দেখে আব্বা যদি আমার ঘরে গিয়ে ওজু করতে চান? -সর্বনাশ হবে। নিঃশব্দে দরজার লক খুলে আমি ঘরে ঢুকে গেলাম। মেয়েটা বোরখা খুলে রেখে ঘুমিয়ে গেছে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। আমি আমার জীবনে এতো সুন্দর মেয়ে মানুষ দেখিনি। সৃষ্টিকর্তা বুঝি, পৃথিবীর সব সৌন্দর্য তাঁর মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন।

ঘরের মধ্যে পায়চারি করছি, ইতোমধ্যে আব্বা ঘুম থেকে উঠে গেছেন। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। মস্তিষ্কের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে- মেয়েটার কি কারও সাথে প্রেমের সম্পর্ক আছে? মেয়েটাকি আমাকে বিয়ে করবে? আব্বাকে কি বলব? আব্বা রাজী হবে তো? রাজি হবে না কেন? আমি তাঁর একমাত্র ছেলে সন্তান। -ধ্যাৎ তারিকার, কি সব ভাবছি আমি? মাথাটাকি নষ্ট হয়ে গেল?

মেয়েটার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম, আমি জানি না সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম- মেয়েটা ঘরে নাই, চলে গেছে। টেবিলের উপর ছোট একটা কাগজে লিখে গেছে- রুদ্র ভাইয়া, ভাবছেন নাম জানলাম কি করে? টেবিলের উপর আপনার ভোটার আইডি কার্ডে দেখেছি। ভাইয়া আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। আপনার উপকারের কথা আমি কোনদিন ভুলব না। সবসময় ভাল থাকবেন।

-ইতি, নিশি…

আমি দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে নিশিকে তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। প্রথমে গাড়ির স্ট্যান্ডে গেলাম। গাড়ির স্ট্যান্ডে গাড়িতে গাড়িতে উঠে উঠে খুঁজলাম। কোন গাড়িতে নিশিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ভাবলাম, নিশি এইদিকে না এসে যদি বাড়িতে ফিরে যায়? নিশি বলেছিল- সে নদী পেরিয়ে এসেছে। অর্থাৎ নিশির বাড়ি নদীর ওপারে হবার কথা। আমি স্ট্যান্ড থেকে নদীর ঘাটে এসে নৌকায় নৌকায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- কালো বোরখা পরা কাউকে তাঁরা নদী পাড় হতে দেখেছে কিনা। মাঝিরা বলল- “সকাল থেকে কালো বোরখা পরা কত মেয়েই তো নদী পাড় হলো।” মাঝিদের কথা ঠিক, কালো বোরখা তো কেবল নিশি পরে না। লাখ লাখ মেয়েরা পরে। মাঝিদের সাথে কথা বলা শেষ হতেই মনে হলো, নিশি হয়তো রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে। মহল্লার এমন কোন অলি-গলি খুঁজতে বাদ রাখলাম না। নিশিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। হতাশ মনে নদীর পাশে গিয়ে বসলাম।

মনটা ভীষণ খারাপ। মেয়েটা চিরকুট লিখেছে ফোন নম্বরটা লিখে দেবে না? নিজের উপর রাগও হচ্ছে- আমিও তো ফোন নম্বর চাইনি। রাতেই ফোন নম্বর নিয়ে রাখা দরকার ছিল। কেমন বেকুবি করলাম! বাকিটা জীবন নিশির কথা ভাবতে ভাবতেই জীবনটা আমার কেটে যাবে। মেয়েটার জন্য এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? তাঁর সম্পর্কে তো আমি কিছুই জানি না। শুধু জানি সে বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। নিশির কারও সাথে প্রেমের সম্পর্ক আছে কি না তাও তো জানি না। ধুর ছাই নিশি গোল্লায় যাক। একরাশ বিরক্তি নিয়ে দুপুর বেলা আমি বাড়ি ফিরলাম। ঘরে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে বের হয়ে আলনায় টাওয়েল নিতে গিয়ে দেখলাম- আলনায় কালো রঙের একটা বোরখা। ব্যাপারটা কি এই বোরখা এখানে এলো কোত্থেকে? এটা কি নিশির বোরখা? বোরখা রেখে নিশি চলে গেছে? নাকি আম্মার বোরখা?

ক্ষুধায় পেট চোচো করছে। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। ঘর থেকে বের হয়ে ডায়নিংয়ে যেতেই বৈদ্যুতিক শক খাবার উপক্রম হলো। নিশি আম্মার সাথে বসে হাসিমুখে গল্প করছে। যাকে খুঁজে খুঁজে দিশেহারা, সে বসে আছে আমাদেরই বাসার ডায়নিংয়ে! আমি হতবুদ্ধি হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- “আপনি এইখানে কেন?” আম্মা বললেন- “ও এইখানে কেন পরে জানা যাবে। খাবার প্রায় হয়ে আসছে। মেয়েটাকে শান্তিমতন চারটা খেতে দে।” আমি চট করে আবারও ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। নিশির উপরে মেজাজটা ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। সে যদি বাসাতেই আছে, এরুপ চিঠি লেখার কোন মানে হয়? একা পেয়ে নেই, ইচ্ছা মতন ঝারি যদি না দেই তাহলে আমার নামও শিমুল চৌধুরী না।

আম্মা খাবার টেবিল থেকে ডাকলেন। ইচ্ছা হচ্ছিল খাব না। মনে মনে একদিকে লজ্জা অন্যদিকে নিশির উপরে রাগ। খিধার কাছে তো আর রাগ লজ্জা কাজ করে না, না খেয়ে থাকা গেলে খুবই ভাল হতো।
ঘর থেকে বের হয়ে ডায়নিং টেবিলে গেলাম। আম্মা খাবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে নিশির সাথে খেতে গল্পে মগ্ন হলেন।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করার পরও তাদের গল্প থামছে না। টেবিলে আমার কোন গুরত্ব আছে বলে আমার মনে হলো না।
টেবিল থেকে উঠে ছাদে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। নিশির ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে নিশির সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনা আছে, -কি পরিকল্পনা তা বোঝা যাচ্ছে না। আবার মনে হচ্ছে, মেয়েটাকে পাওয়া গেছে এইতো বেশি। নিশির কি কারও সাথে প্রেমের সম্পর্ক আছে? -জানা দরকার। সব থেকে আগে তাঁর ফোন নম্বর টা নিতে হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত