আমাদের ৪বছরের ভালবাসার সম্পর্ক তারপর ২ বছরের সংসার সব আজ ভাঙতে চলেছে। আমার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ডস ও বৌ রিমি আজ আমাকে ডিভোর্স দিতে চলেছে। কেন জানেন? কারণ আমি পারি না আমার বৌ যখন কস্ট করে সবার জন্য রান্না করে তখন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে। পারি না বৌয়ের কোন কাজে সাহায্য করতে। পারি না চাঁদনী রাতে বৌকে নিয়ে চাঁদ দেখতে।
পারি না বৃষ্টির দিনে বৌকে ”চলোনা দুজনে বৃষ্টিতে ভিজি” কথাটা বলতে। আমি পারি না কাজ থেকে ফেরার সময় বৌয়ের জন্য একগোছা গোলাপ অথবা চকলেট আনতে। পারি না কোন একটা রাত বৌয়ের সাথে গল্প করতে। পারি না দিনের বেলাই বৌকে নিয়ে একটু রোমান্স করতে। কোন এক বিশেষ দিনে বৌকে নিয়ে ঘুরতে যেতেও পারি না। কেন জানেন? কারণটা আমার মা। আমাদের বসবাস গ্রামে।আমি শহরে লেখাপড়া করতে এসে রিমির সাথে হয় আমার মনের বিনিময়।
এরপর আমরা বিয়েও করে ফেলি। বিয়ের আগে আমরা কত রোমান্স করতাম, বিশেষ দিনে ঘুরতে যেতাম,আমরা গল্প শুরু করলে সময়ের কথা মাথায়ই থাকতো না। কিন্তু বিয়ের পর এগুলোর কিছুই হয় না। আমি বিয়ের পর রিমিকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। আমাদের বাড়িটা মাটির দুইটা ঘরের সাথে একটা বারান্দা। একটা ঘর আমার আর একটা বোনের আর মা থাকে বারান্দায়। আমরা ঘরে একটু গল্প করলেই মা তার রিয়্যাক্ট করে। বাসর রাত সবার জীবনের একটা স্বপ্নের রাত। আমরা সেদিন একটু গল্প করছিলাম।রিমি একটু হেসে ওঠে।তখনই মা বলে ওঠে ও বৌ মাঝ রাত্রি এতো ঢং কিসের?তাড়াতাড়ি ঘুমাও সকালে উঠন লাগবো। আমরা কিছুই বলিনি।রিমির অবশ্য রাগই হয়েছিল।
তারপর একদিন পহেলা বৈশাখে মেলা হচ্ছিলো আমাদের গ্রামে।রিমি আমার সাথে যেতে চেয়েছিল। আমি মাকে বলতে বললাম।ও মাকে বললো। কিন্তু মা বললো—না।ওখানে যাওন যাইবো না।তুমি মাইয়া মানুষ ঐখানে তোমার কাম কি? আপনারাই বলেন এখনকার যুগের ছেলে মেয়েরা এসব সহ্য করে? কিন্তু তবু্ও রিমি কিছুই বলেনি।আর আমিতো আছি দোটানায়। একদিকে মা অন্যদিকে স্ত্রী।আমি মাকে কিছুই বলতে পারতাম না।শুধুই রিমিকে বোঝাতাম। আবার একদিন মা বাড়িতে ছিল না। রিমি রান্না করছিলো আমি ওর পাশে বসে একটু গল্প করছিলাম। আর মা কোথা থেকে এসে বলে উঠলো—বৌ তোমার কি কান্ডজ্ঞান কিছু আছে নি। ছেলেটা আমার কাম থেকে ফিরছে ওকে একটু সুতে না দিয়া তুমি এইখানে বসাইয়া রাখছো?
আমি:মা এখানে থাকি না কিছুক্ষণ।
মা:না তুই এইখানে থাইকা কি করবি ঘরে যেয়ে আরাম কর। আর ছেলে মানষ বৌয়ের এখানে বসে থাকলে মানষে বৌ পাগল কইবো। আমি কিছুই বলিনি বাধ্য ছেলের মতো মায়ের আদেশই মাথা পেতে নেই। সেদিন দুপুরে আমি সুয়ে ছিলাম। রিমিকে দেখে আমার প্রেম জেগে ওঠে। আমি ওর হাতটা টেনে ধরে বুকি জড়িয়ে নিতে চাইলাম। তখন রিমি বললো–ছাড়ো মা বকবে বাইরে কাজ আছে।
আমি : থাকোনা কিছুক্ষণ। ও থাকতেই চাইছিল কিন্তু তখনই মায়ের ডাক।
মা : ও বৌ।ঘরে এতক্ষণ কি সুনি?বাইরে কত কাম পইড়া রইছে। এছাড়াও বিভিন্ন ছোট খাটো কারণে মা রিমির সাথে বকা ঝকা করে। এসবের কারণে আমাদের ভালবাসা ছুটে গিয়েছে।দিন দিন দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন সম্ভব। রিমি আমার মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলতেও পারে না। এদানিং এক খাটে ঘুমানো ছাড়া আমাদের আর তেমন কথা হয় না। যেই আমরা একে অপরের সাথে কথা না বলে থাকতে পারতাম না তাদের আজ এই অবস্থা । গতকাল আমি বাড়ি ছিলাম না। বাড়ি এসে সুনি মায়ের সাথে রিমির ঝগড়া হয়েছে। রিমির হাত থেকে জগ নাকি পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। মা সেটা সহ্য করতে পারে নি।কারণ ওটা মায়ের নিজের হাতে কিনেছিল। আর তাতেই নাকি মা অনেক বকেছে। আসলে এটা করা মায়ের হয়তো উচিৎ হয় নি। ঘরে গিয়ে দেখি রিমি কাঁদছে। আমি বললাম কাঁদছো কেন?
রিমি: কাঁদবো না তো কি হাসবো? তোমাকে আজ একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। (মনে হচ্ছে ওর ধৈর্যের আজ শেষ হয়েছে)
আমি:কি সিদ্ধান্ত?
রিমি:তুমি তোমার মাকে চাও না আমাকে চাও?
আমি:আমি দুজনকেই চাই।
রিমি:না তা হবে না। আমি আর তোমার মায়ের সাথে এক বাড়ীতে থাকতে পারবোনা।আমি আর ধৈর্য ধরে পারছি না। তোমাকে যেকোন একজনকে বেছে নিতে হবে।
আমি:তাহলে আমাকে মাকেই বেছে নিতে হবে।যে মা আমাকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে,মানুষের বাড়ীতে কাজ করে আমাকে আর বোনকে বড় করেছে সে মাকে আমি দূর করে দিতে পারি না।
রিমি:ঠিক আছে। তুমি তোমার মাকে নিয়েই থাকো।আমার পক্ষে আর সম্ভব না।কালকেই আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাবো। মা এসবের কিছুই জানে না। আমি মাকে জানতেও দেয় নি।কারণ মা যদি জানে তার জন্য রিমি আমাকে ডিভোর্স দিচ্ছে তাহলে মা সহ্য করতে পারবে না। তারপর আজ রিমির বাবা মা এসেছে। রিমি ফোন করেছিল। রিমির মা বাবা ওকে অনেক বুঝিয়েছে।কিন্তু কাজ হয় নি। রিমি আজই আমাকে ডিভোর্স দেবে। রিমি তার জিনিস পত্র গোছাচ্ছে। মা এসে তা দেখলো।
মা:ও বৌ জিনিস পত্র গোছাও কেন।
রিমি:আমি চলে যাচ্ছি।
মা:কোথায় যাচ্ছ?
রিমি:বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি আর আসবো না।আর আপনার ছেলেকে আজই ডিভোর্স দিবো।
মা:কিন্তু ক্যান?
রিমি:আপনি কিছু বুঝেন না।আমি আপনাকে আর সহ্য করে পারছি না।আপনি আমার মুখের হাসি কেড়ে নিছেন।আপনার জন্য আমি আমার স্বামীর সাথেও ঠিকমত কথা বলতে পারি না। আর প্রতি কাজে কাজে আপনার বকাবকি আর সহ্য হয় না।
মা:আমাকে তুমি ক্ষমা কইরা দিও। আসলে আমিতো বিয়ের পর থাইকা শাশুড়ির মার খেতে খেতে আশছি এই জন্য আমার মনে হয় আমি আমার শাশুড়ির মতো হই।তুমি এই গুলান সহ্য করতে পারনো না।আর আমার শাউড়ি আমাকে সব কাজে মাইর ধর করতো।একদিন তো খুন্তির ছ্যাক ও দিলো।আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ছিলো ১২ কি ১৩।সেই বয়সে আইসা আমার সব কাম করতে হয়তো।তখন ১৫জন মানষের ভাত রানতাম আমি।একটু বসার সময় পাইতাম না।
সকালে ভোরে উইঠা সকলের ভাত রান্দা করতে হইতো তারপর তাদের ময়লা বাসোন কোসন মাজা, উঠান ঝাড় দেওয়া।আবার রাইতে রান্দোনের পর বাসোন কোসন মাইজা মাজ রাত্রি সুইতে জাইতাম। তারপর কোন কাজে ভুল হলেই শাউড়ির মাইর।একদিন আমার জ্বর আইছিলো সুয়ে ছিলাম।তখন আমার শাউড়ি গিয়া চুলের মুটি ধইরা টাইনা ঘর থাইকা বার করছিল।আর বলছিল ও নবাবের বেটি সুইয়া রইছোস রান্বো ক্যাডা?আমাকে সেই অবস্থায় রান্ধোন লাগিল।তারপর একদিন ঝুটা ভাত গরুরে দিছিলাম আমার শাউড়ি আমারে এই কামের জন্য ঝাটা পিটা করছিলো।আর সে নান্দা থাইকা ভাত নিয়া আমারে খাওয়াইছিল।(মা কাদছে আর বলছে, রিমিও কেদে দিয়েছে মায়ের কথা সুনে, আমিও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি)আর একদিন রান্ধোনের সময় একটু তেল বেশি দিয়া ফেলছিলাম তাই আমার শাউড়ি গরম খুন্তি দিয়া ছ্যাক দিছিলো।
তুমি কও বৌ এরকম কড়া শাশনে থাকলে কেউ ভালা থাকতে পারে?আমি পারি নি।আর এর কিছুদিন পর আমাদের আলাদা করে দেয়।তার বছর খানেক পর তোমার শউর মারা যায়।তখন রবি(আমি) আর আসমা(বোন) খুব ছোট।ওগোর খাওন জুটানোর লাইগা আমি মাইনষের বাড়িতে কাম করতাম। তারাও বকা ঝকা করতো।আচ্ছা বৌ তুমিই কউ যে মানুষটা তার জীবনের বেশির ভাগ সময় মাইনষের লাথি ঝাটা খাইছে সে ক্যামনে ভাল মানুষ হয়?আমি তেমনটাই হইছি।আমিও আমর শাউড়ির মতো হইয়া গেছি।আমার মনেছিল এতে তোমার আমার মতো কস্ট লাগে।তুমি আমারে মাফ কইরা দিও মা।আর আমি থাকলে যদি তুমার কস্ট হয় তই আমি যাইবানি। তুমি যাইও না মা তুমি যে বাড়ীর লক্ষী।
রিমি:না মা। আপনি যাবেন কেন?আপনি থাকবেন।আমাদের সাথেই থাকবেন।(মাকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে) আর আপনি আমারে ক্ষমা করে দিবেন। আমি না জেনে আপনার উপর রাগ করেছি। এরপর দুই শাশুড়ি বউ গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আমিও কাঁদছি তবে এটা দুঃখের কান্না নয় এটা যে সুখের কান্না।