হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা গায়ের জোর খাটিয়ে রিকশার প্যাডেল মারছে। তিনজন মেয়ের ওজন ভাঙ্গা রিক্সায় চাপিয়ে নেওয়াটা বেশ কষ্টের। তার মধ্যে ঝলসে যাওয়া রৌদ্র উত্তাপ চলার পথকে কঠিন করে তুলেছে। তবু ছেলেটা থেমে নেই। পূর্ণ গতিতে এগিয়ে চলছে গন্তব্যের পথে। দুপুর যত ঘনিয়ে আসছে ছেলেটার ঘাম ততো ঝরছে।
এ ঘামতো রোজ ঝরাতে হয় তবে আজ কপালের ঘাম যেন একটু বেশিই গা গলিয়ে নামছে। ছেলেটা দ্বিতীয়বারের মতো মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করছে.. “আপা এখন কয়টা বাজে?” মাঝে বসা মেয়েটি অনেকটা বিরক্ত নিয়ে বলে উঠলো বারবার সময় জানার কি দরকার? একটু আগেই তো বললাম। পাশে বসা মেয়েটা মোবাইলের সুইচ চেপে উত্তর দিল “আড়াইটা বাজে” ছেলেটা মলিন মুখে অন্যমনস্ক হয়ে যায়, রিকশার গতি কমে আসে। অসতর্কতাবশত আরেক রিকশার সাথে সামান্য লেগে যায়। বিনিময় অপর রিকশা থেকে ছুঁড়ে আসে অকথ্য গালিগালাজ। ছেলেটা ভুল স্বীকার করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, রিকশায় তিনটা মেয়ে থাকায় বেশি দেরি না করিয়ে তাকে যেতে দেয়। মেয়েগুলোও তার উপর এখন চরম বিরক্ত। তুমি কি নতুন রিকশা চালাও নাকি? আরেকটু হলেই তো পড়ে যেতাম, এত তাড়াহুড়া লাগছে কেন..? বারে বারে ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে রাস্তা দেইখ্যা চালাও কে কি বলল সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।
সে মলিন মুখে রিক্সা টেনে যাচ্ছে। শুধু একটাই সমস্যা হচ্ছে, টেনসনে তার হাত কাঁপছে। কিছু দূর এগিয়ে যাওয়ার পর তারা জ্যামে আটকা পড়ে যায়। এবার আর ছেলেটির তর সইছে না। মুখ ফসকে বলে দেয় আপা আপনারা অন্য রিকশায় চলে যান। আমি আর পারতেছিনা, একটু তাড়া আছে। ধমকের স্বরে উত্তর আসে… “যেতে পারবে না মানে? এতো তাড়া আছে তাহলে উঠাইলে কেন?” আরেকজন বলে উঠলো “সেই শুরু থেকে দেখতেছি এলোমেলোভাবে রিকশা চালাচ্ছে। যাইতে পারবে না দূরের যাত্রী উঠালে কেন? মাঝপথে যাবনা বললেই হলো!” তাদের মধ্যে চুপচাপ মেয়েটা বাকি দুজনকে থামিয়ে বলল উফ চুপ কর তো। আচ্ছা ভাই এখানে তো কোনো রিক্সা পাবনা আপনি সামনে মোড় পর্যন্ত যান এরপর অন্য রিকশা নিয়ে নেব। অনেকটা বাধ্য হয়েই জ্যামে তাদের নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। ছেলেটা একটু পরপর পকেট থেকে ভাঙ্গা একটি সাদাকালো মোবাইল বের করে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখছে। বারবার চালু করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। বারবার মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর মোবাইল টিপছে। চুপচাপ মেয়েটির চোখে ছেলেটার কর্মকান্ড নজরে আসে। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে
— আপনি আমাদের নামিয়ে যাবেন কোথায়?
— আপা একটু কম্পিউটার দোকানে যামু।
— সেখানে গিয়ে কি করবেন..?!
কিছুটা সাপোর্ট পেয়ে ছেলেটার মুখ খুলে যায় “আপা আইজ দুইটার দিকে আমার ইন্টার রেজাল্ট বের হইছে, ভাবছি আপনাগো নামায় দিয়া দোকানে যামু। এত সময় হই গেছে বুঝি নাই, মোবাইলটাও বন্ধ হইয়া রইছে তাই সময় আন্দাজ করতে পারি নাই” মেয়ে তিনজন কিছুটা থমকে যায়, এই ছেলেটাও পরীক্ষার্থী ছিল বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তারা ছেলেটার বর্তমান অবস্থা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে কারণ তারাও এবারের পরীক্ষার্থী ছিল। মাত্রই রেজাল্ট নিয়ে কলেজ থেকে ফিরছে। একটু আগে ঢোল পিটিয়ে রং লাগিয়ে উল্লাস করে এসেছে। আর ছেলেটা আজকের দিনে এত টেনশন নিয়েও উত্তপ্ত রোদে রিকশা চালাচ্ছে! তারা তো সকাল থেকে এক লোকমা ভাত গিলতে পারেনি, আপন মানুষরা মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস দিয়েছে, আর সে রেজাল্ট বের হয়েছে সেটা শুনেও এখনো জানার ভাগ্য হয়নি। মেয়েগুলোর মন গলে যায়।
— তোমার রোল কত? সাথে আছে? তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে কুচকানো কাগজের টুকরা বের করে মেলে ধরে।
— আচ্ছা দোকানে যেতে হবে না,
আমরাই দেখে দিচ্ছি চুপচাপ মেয়েটা মোবাইল হাতে নিয়ে ওয়েবসাইটে গিয়ে রোলনং টাইপ করতে থাকে। অপেক্ষারত ছেলেটা মেয়েগুলোর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল জড়ো হচ্ছে, জল গুলো আজ খুশি হয়ে ঝরবে নাকি দুঃখ হয়ে.. সেই অপেক্ষায় মুখিয়ে আছে। মেয়েটা শুষ্ক মুখ নিয়ে একে অপরের দিকে তাকায়, ছেলেটির দিকে তাকিয়ে নরম সুরে উত্তর দেয়.. রেজাল্ট তো মোটামুটি ভালই করেছিলে কিন্তু… ইংলিশে ফেল আসছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। পানি গুলোর আজ খুশি হয়ে ঝরার ভাগ্য হল না।
— চিন্তা করো না, পরেরবার ভাল করে পরীক্ষা দিবে।
— আপা, সবার ভাগ্যে দুইবার করে সুযোগ থাকে না।
একবার কইরা আসে, একবারেই ভাগ্যের লিখন হইয়া যায়। মাঝে বসা মেয়েটি আঙ্গুলের কড়গুনে বলে উঠে ইংরেজিতে পাস আনতে পারলে ৩.৭৫ পেতে। অনেক ভাল চেষ্টা করেছো, মন খারাপ করো না। কথাটা শুনে ছেলেটির মন আরো ভেঙে যায়। স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলো না। মাত্র ৩.৭৫, এতটাও বাজে পরীক্ষা হয়নি তার। আরেক মেয়ে বলে উঠে ভাই মন খারাপ করো না, এইবার রেজাল্টের অবস্থা সারা দেশেই খারাপ। ভাবছিলাম গোল্ডেন আসবে, আসলো না। টেনেটুনে প্লাস আসছে দুজনের। আর ওরতো ৪.৯০ ,এ প্লাস মিস করে বসছে। আমাদের কারোরই মন মত রেজাল্ট আসে নাই। ছেলেটা মন ভারি করে রাস্তার জ্যাম ছুটার অপেক্ষায় বসে আছে। চুপচাপ মেয়েটার ছেলেটার প্রতি মায়া হচ্ছে। তার মন ঘোরানোর জন্য এটা সেটা জিজ্ঞেস শুরু করে দেয়। বাবা কি করে ? বাড়িতে কে কে? ইত্যাদি ইত্যাদি। এক পর্যায়ে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করা হলে উত্তর আসে “বরিশাল” মেয়েটা নড়েচড়ে উঠে।
— তোমার কলেজ কোথায় ছিল ঢাকা নাকি বরিশাল?
— এলাকার কলেজেই পড়ছি
— মানে তুমি আগে থেকে ঢাকায় থাকো না?
— না, আগে এলাকাতে কাম করতাম পরীক্ষার পর থেকে ঢাকাতে কামে লাগছি। মেয়েটা জিভে কামড় দিয়ে দ্রুত মোবাইলে ঢুকে যায়। কিছুক্ষন মোবাইল ঘাটাঘাটি করে চোখ কপালে উঠে যায়!
— ভাই একটু প্রব্লেম হয়ে গেছে
— কী আপা?
— আপনার নাম তরিকুল?
— জ্বী
— বাবার নাম মোজাম্মেল?
— জ্বী আপা।
— ওরে..তুমিতো এ প্লাস পাইছো!
— কি বলেন? কেমনে?! লাফদিয়ে রিকশা থেকে নেমে পড়ে
— আমি তখন ঢাকাবোর্ড ভেবে অন্য জনের রেজাল্ট এনেছিলাম।
ভাবছি তুমি ঢাকার। মাঝে বসা মেমেটি এক ঝটকায় মোবাইল কেড়ে নেয়। হাতে নিয়ে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ও মাই গড! ঢোক চেপে পাশের মেয়ের কাছে মোবাইলটা দেয়। মেয়েটার মুখ হা হয়ে যায়, জোরালো কন্ঠে বলে উঠে “কনগ্রাচুলেশন্স” ভাই তোমার তো গোল্ডেন আসছে!। ছেলেটা কনফিউজড হয়ে যায়, তারা তাকে স্বচোক্ষে রেজাল্ট জুম করে দেখিয়ে দেয়। ছেলেটি হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। একটু আগে যে রেজাল্ট শুনে ছেলেটা বিশ্বাস করতে পারছিলো না এখন এই রেজাল্ট শুনে মেয়েগুলো বিশ্বাস করতে পারছে না। তারা হতভম্ব হয়ে আছে, একেকজন আকাশ থেকে পড়েছে। এতদিন এমন সাফল্যের গল্প শুধু পেপার পত্রিকায় শুনতে পেত। আজ বাস্তবে এমন এক নক্ষত্রের দেখা পেয়ে গেল। আপা অনেক উপকার করলেন, আপনাদের যেখানে যাওয়া লাগে রাইখা দিয়া আসবো, কষ্ট করে একটা নাম্বারে কল করতে দিবেন? আমার এক টাকাও ভারা লাগবো না, শুধু এই মুহূর্তে একটা কল দিয়া দিবেন? আরে হ্যা অবশ্যই দিবো.. নাম্বার বলো।
ছেলেটা মোবাইল কানে কিছুটা দূর সরে যায়। কি কথা বলছিলো শোনা যাচ্ছিলো না। শুধু দেখা যাচ্ছে ছেলেটা কথা বলছে আর সেকেন্ডে দুবার করে চোখের পানি মুছছে। ফোনের ওপাশটায় বিশেষ কেউ ছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই। হতে পারে তার মা অথবা বাবা। প্রিয় মানুষের কানে খুশির বার্তাটুকু তৎক্ষণাৎ পৌঁছাতে কি আকুতিই না করলো! ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটিকে দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু অনুভূতি গুলো চোখের সামনে ভেঁসে উঠছিল। এমন কষ্টে বড় হওয়া ছেলের সাফল্যের কথা শুনে নিশ্চয়ই তারা অঝোরে কাঁদছে। মেয়েগুলোর চোখে জল জমে আসে। এটা এক ভিন্ন আনন্দের অনুভূতি। অতি সাধারণ মানুষগুলোর সাফল্যের আনন্দ অতি অসাধারন হয়। হৈ-হুল্লোড় নেই চিৎকার নেই রয়েছে শুধু অক্লান্ত পরিশ্রমের অশ্রু মাখা হাসি। আধঘন্টা ঢোল পেটানো বিজয় উল্লাস গুলো এমন বিজয়ী আনন্দের কাছে হার মেনে বসে।
রিকশা চলছে… পূর্ণ গতিতে। সকল ক্লান্তি ভুলে স্বপ্ন গুলো নতুন উদ্যমে আলো ছড়াচ্ছে। ছেলেটির জানা নেই এই আলো কতদিন পর্যন্ত তাকে কিরণ দিবে, নাকি একদিন পথেরমানুষদের মত পথেই পিষে যাবে মেধাবীর স্বপ্নগুলো! সে কি নিজের মেধাকে টেনে নিয়ে লক্ষে পৌঁছাতে পারবে?? নাকি পথে- ঘাটে এভাবেই বাকি মেধাবীর বোঝাটানতে হবে?! বাস্তব চিত্রে এদের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত বলতে কোন শব্দ নেই, আচমকা ঝড়ে ধপ করে স্বপ্ন প্রদীপ নিভে যায়। খেটে খাওয়া এমন মেধাবীদের ভবিষ্যৎ সর্বদা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়।