বসে আছি আদিবাদের বাসাতে। আমার সামনের সোফাতেই আদিবার বাবা বসে আছে আর আদিবা দরজাতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর আদিবার বাবা বললেন,
–মামনি, তুমি একটু ভিতরে যাও তো। চুপচাপ আদিবা নিজের ঘরে চলে গেল।
— তুমি কিসে যেন পড় ?
–জ্বী , অনার্স ৩য় বর্ষ।
— ওহ, তার মানে পড়াশোনা করতেই আরো দুটো বছর লাগবে?
— জ্বী ।
— তোমার বাবা কি করেন?
— ছোটখাট একটা ব্যবসা।
— ছোটখাট ব্যবসা। আমি যে সরকারি চাকরি করি এটা অবশ্যই তুমি জানো?
— জ্বী জানি ।
— আর এটাও জানো যে, আদিবার যে ছেলেটার সাথে বিয়ে ঠিক করেছি সে তোমার চাইতে খুব ভালো দেখতে আর বেতন ও এক লাখের উপরে। এখন আমি কী করে তোমার মত একটা বেকার ছেলের সাথে আমার মেয়েকে বিয়ে দিই বলো? তোমার বাবার ও তো কিছু নেই, আছে কি বলো?
— আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি।
— হাহাহা , শোন অভাব যখন আসে ভালোবাসা তখন পালায়। আবেগ দিয়ে সংসার চলে না বুঝলে তো?
আজকাল টাকাই সব। আর আমি বাবা হয়ে তো আর একমাত্র মেয়েকে একটা বেকারের হাতে তুলে দিতে পারি না তাই না? আশা করি আমার কথা বুঝেছো। এমন কথা শোনার পর কারও মুখে আর কোন কথা থাকে না। তাই শুধু মাথাটা নাড়ালাম।
–বুঝেছো তো এখানে বসে আছো কেন? আদিবা আসার আগেই এখান থেকে চলে যাও। একটু রাগি সূরেই আদিবার বাবা কথাটা বললো।
— জ্বী আংকেল ভালো থাকবেন,
আস্সালামু আলাইকুম। বলেই ঘরে থেকে বেড়িয়ে এলাম। আদিবাদের বাসার গেটের কাছে এসে ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেখি আদিবা ওর রুমের বেলকুনি থেকে আমার দিকে চেয়ে আছে। ঘাড়টা আবার ঘুরিয়ে মেসের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম। রাত ১১টা। বসে বসে ভাবছি আদিবার কথা। তিন বছরের রিলেশন আমাদের।গরিব বলে ভার্সিটিতে একাই চলতাম, কোন বন্ধু ছিলো না। হঠাৎই একদিন আদিবা এসে বন্ধুত্বের হাতটা বাড়ায়। অনেকবার না করে দিই তবুও পিছু ছাড়ে না। এক পর্যায়ে হ্যাঁ বলে দেই। তারপর থেকেই একসাথে পথ চলা শুরু।আদিবা আমাকে অনেক ভাবে সাহায্য করতো। আর কয়েকমাস পরই প্রপোজ করে বসে। আমিও আদিবার মায়ায় জড়িয়ে গেছিলাম তাইতো আর না করতে পারিনি। এরপর থেকেই একসাথে পথচলা শুরু। কালকে বিকেলে বসেছিলাম লেকের পাড়ে তখনই আদিবা বললো,
— অভ্র, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, ছেলেটাও অনেক ভালো তবে আমি যে তোমাকে ছাড়া কাউকে জীবন সঙ্গী করতে পারবো না। মারা যাবো আমি। প্লিইইইইইজ কিছু করো।
তাই আদিবার জোড়াজুড়িতেই আজ ভালোবাসাকে সম্বল করে ছুটে গেছিলাম আদিবার বাবার কাছে।
তবে লাভ হলো না৷ বাকিটা আপনাদের জানা। ভাঙা বাটন ফোনটা সেই কখন থেকে বেজেই চলেছে। আদিবার ফোন এটাও জানা। মনটা শক্ত করে ফোনটা ধরলাম,
–এই অভ্র বাবা কি বললো? আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলে কেন?
— কিছু বলেনি তো। আর ভালো লাগছে না ফোনটা রাখো।
— অভ্র কি হয়েছে এভাবে কেন কথা বলছো?
–যেভাবে বলার সেভাবেই বলছি আর এত ন্যাকামো করোনা তো। ফোনটা রাখো। বলেই আমি ফোনটা কেটে দিলাম।
অপর পাশে আদিবা অভ্রর এমন আচরণে খুব কষ্ট পেল। এত বছরে এই প্রথম অভ্র ওর সাথে এমন করে কথা বললো। কেন এমন করছে ভেবে পায় না আদিবা। এদিকে আমি ফোনটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। মাথার উপরে ফ্যানটা খটখট শব্দে ঘুড়ছে। টুপ করে দু’ফোঁটা জল গাল বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ল। নাহ্ , মনটা শক্ত করতে হবে। নিজেকে অভিনেতা বানাতে হবে যে। পরদিন মেসের ছোট ভাইয়ের থেকে একটা ফোন ধার নেই। তারপর একটা নতুন সিম কিনে সব সময় আমার ফোনে ফোন দিয়ে রাখি । অপরদিকে আদিবা দুপুর থেকে বারবার অভ্রকে ফোন দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু ফোন ওয়েটিং। আদিবার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। অভ্র তো এমন ছিলো না! হঠাৎ এমন কেন হয়ে গেল? সারাটা দিন একটু পরপরই আদিবা অভ্রকে ফোন দেয় তবে ওয়েটিং পায়। রাতে আবার ফোন দেয়। ফোনটা বাজছে একবার, দু’বার,ছয় বারের বার ফোনটা ধরি।
— কি হয়েছে? এতো বারবার ফোন কেন দিচ্ছো? রাগের সুরে বলি আমি।
–এই অভ্র ওভাবে কেন বলছো? সারাটা দিন ধরে তোমাকে ফোন দিচ্ছি তুমি কার সাথে কথা বলছিলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো আদিবা।
— যার সাথেই কথা বলি এতে তোমার কি? কি বলবে তাড়াতাড়ি বলো।
— এই, এভাবে বলো না খুব কষ্ট লাগে। কাল থেকে আমার সাথে কেন এমন করছো বলো না প্লিজ।
— কেমন করছি? জরুরি ফোন আসছে রাখছি বাই।
— এই অভ্র শু****
টুট টুট টুট খুব কান্না করছে আদিবা। অভ্রর এমন অবহেলা কিছুতেই সহ্য করতেই পারছে না। আর আমি নিজের ফোনে ফোন দিয়ে দুটো ফোন এক করে রেখে বসে আছি। আজ প্রায় ৫টা দিন ধরে অভআদিবাকে অবহেলা করছি যা আদিবার সহ্যের বাইরে। খুব কষ্ট লাগছে আদিবার। অভ্রকে ফোন দিলেই ওয়েটিং আর ওয়েটিং আগে তো এটা হতো না। দেখা করতে চাইলেও বলে টাইম নাই, পারবো না আরো নানা অজুহাত। এদিকে বিয়ের দিন একটা একটা করে এগিয়েই যাচ্ছে কিন্তু আদিবা যে অভ্রকে ছাড়া কারো হতে পারবে না। সারাটা রাত কেঁদে কেঁদে বালিশ ভেজায় আদিবা । পরদিন বিকেল ৪টা। আমি আদিবার বাবার নাম্বারে ফোন দিই।
–হ্যালো কে? আদিবার বাবা বললো।
— আংকেল আমি অভ্র।
— ও, আমার কাছে কি চাই? যা বলার সেদিনই তো বলে দিয়েছি। রাগের সূরে আদিবার বাবা বললো।
–একটা সাহায্য লাগবে।
— কি সাহায্য বলো? টাকা লাগবে?
— হা হা হা। এসব কিছুই না। আপনি শুধু বাইরে এসে আদিবাকে ফোন করে (********)এগুলো বলবেন।
— এতে কি হবে?
— সেটা না হয় পরে জেনে নিলেন। ফোনটা কেটে দিলে চলে গেলাম লেকের পাড়ে। আদিবা বসে বসে অভ্রর কথা ভাবছে তখনই ওর বাবার ফোন,
— হ্যাঁ বাবা বলো। আদিবা চোখটা মুছতে মুছতে বললো।
— মামনি এ তুমি কোন ছেলেকে ভালোবাসতে ছিঁ
— কেন কি হয়েছে?
— এইমাত্র দেখলাম অভ্র একটা মেয়ের সাথে লেকের পাড়ে বসে**** আমি আর বলতে পারছি না মামনি।
— না আব্বু আমার অভ্র এমন হতেই পারে না। অভ্র আমাকে খুব ভালোবাসে খুব।
— আমি কেন তোমাকে মিথ্যা বলবো মামনি?
বিশ্বাস না হলে নিজেই এসে দেখে যাও। ফোনটা কেটে তাড়াতাড়ি আদিবা লেকের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। শুধু মাথায় একটাই চিন্তা বাবার দেখা ছেলেটা যেন অভ্র না হয়। লেকের পাড়ে এসে এদিকে ওদিকে অভ্রকে খুঁজছে আদিবা। হঠাৎই চোখ গেল বামপাশের ঝোপের মত গাছটার ওপাশে কারা যেন বসে আছে। দূর থেকে ছেলেটাকে অভ্রর মতই লাগছে। তবুও আদিবা নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করছে যেন ছেলেটা অভ্র না হয়। একপা একপা করে কাছে এগিয়ে যাচ্ছে আদিবা। ছেলেটার সামনে গিয়েই আদিবার পুরো পৃথিবীটা ঘুড়ে যায়।
–অভ্র! চিৎকার করে আদিবা।
— আ আরে আদিবা তুত তুমি এখানে কক কখন আসলে?
— নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছি না অভ্র যে, এটা তুমি! তোমাকে দেখার আগে আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল আদিবা কান্না করতে করতে বললো।
–এই শুনো তুমি যা ভাবছো তা না।
— কি না, হ্যাঁ, কি না?এই কি তোমার ভালোবাসা!
–আমি তোমাকে ভালোবা********
— ঠাসসসস খুব জোরে আদিবা আমার গালে চড়টা দেয়।
–খবরদার তোর ঐ নোংরা মুখে আমাকে ভালোবাসিস বলবি না। ছিঁ
আমার ভাবতেই ঘৃণা লাগছে এই আমি তোকে এতটা ভালোবেসেছি।আমার ভালোবাসার এই দাম দিলি তুই! এতোটা দিন কেন আমার সাথে নাটক করলি তুই?
— আদি********
–খবরদার তোর ঐ মুখে আমার নামটাও নিবি না। আমার ভুল হয়েছে তোকে ভালোবাসা।
বাবার কথা না শোনা। বাবা ঠিকই বলেছিল তোর মত ছোটলোকের সাথে প্রেম করাটা আমার বড় ভুলই হয়েছে। তুই একটা নির্লজ্জ, বেহায়া।
–আদিবা আমাকে ভু*********
— চুপ কর তুই কুত্তা, ছোটলোক।এই আমি তোকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম?
আর তুই অন্য একটা মেয়ের সাথে ছিঁ। তোর মত ছেলেকে ভালোবেসে অনেক বড় ভূল করেছি আর না। তোকে দেখতেও আমার ঘৃণা লাগছে।বলেই আদিবা হনহন করতে করতে চলে গেল। কখন যে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে টেরই পাইনি। চোখটা শার্টের হাতা দিয়ে মুছে নিলাম। তারপর মেয়েটাকে বললাম,
–আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ অভিনয় টুকু করার জন্য।
তাকিয়ে দেখি মেয়েটার চোখেও জল। মুচকি একটা হাসি উপহার দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। নিজের অভিনয়ে আজ নিজেকে নিজেই বাহবা দিতে ইচ্ছা করছে। আমি পেরেছি,হ্যাঁ আমি পেরেছি। আজকের পর থেকে হয়তো আদিবার কাছে আমি পৃথিবীর সব থেকে খারাপ মানুষ হয়েই থাকবো।
তাতে কি? আমার এই ছোট্ট অভিনয়টুকুর জন্যই হয়তো আদিবা অনেক অনেক সুখে থাকবে। আর আমি তো এটাই চাই যে, আদিবা সুখে থাকুক। হয়তো রাত গুলো নির্ঘুম কাটবে আমার। তাতে কি? আমার ঘুম টুকু না হয় আদিবার জন্যই তোলা থাক। পথের পথিক গুলো অবাক চোখে একটা ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার চোখে জল আর ঠোঁটের কোণে না পাওয়ার অপূর্ণ হাসি। সোডিয়াম লাইটের আলো শেষ হতেই ছেলেটাও আঁধারের বুকে মিলিয়ে গেল।