একটি মায়ের গল্প

একটি মায়ের গল্প

ঢাকা থেকে মাত্র নরসিংদীর বাসে উঠলাম। একটু আগেই মাকে নিয়ে এসে ছিলাম এখানের একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যেতে। ওনাকে রেখে সকল ফর্মে স্বাক্ষর করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যাক এখন একটা শান্তি লাগছে। মাথা থেকে অনেক বড় বোঝা লাগছে। গত কয়েকটা দিন নিত্তিয়া মানে আমার বউ আমার সাথে মাকে নিয়ে ঝগড়া করতো। এখন আর ঝগড়া করবে না। মায়ের বয়স হয়েছে তাই বলে সব সময় সব কাছে বাধা দেওয়ার মানে তো হয় না। যা করেছি বেশ করেছি। এখন আর রাতে কারো কাশির শব্দে ঘুম ভাঙ্গবে না। প্রতি মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দিবো, আশ্রমের স্টাফরা সব দেখাশোনা করবে।

বাসে জানালার পাশে সিট পাই নি তাই বাধ্য হয়েই একটা বৃদ্ধ মহিলার পাশে বসেছি। বাস ছেড়ে দিয়েছে প্রায় ২০ মিনিট হবে। হঠাৎ পাশে থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি বৃদ্ধ মহিলাটি কান্না করছে। ওনার বয়স মোটামোটি আমার মায়ের বয়সের মতই হবে। কিন্তু ওনি অযথা এখানে কান্না করছে কেন? মনে এক প্রকার কৌতুহল নিয়ে ওনাকে প্রশ্ন করলাম…

— আন্টি আপনি কান্না করছেন কেন?
— ছেলের কারনে।
— মানে?
— আমার ছেলে আমাকে গত ৩ মাস আগে নরসিংদীর একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছিল। আজ আমার ছেলেকে দেখতে অনেক ইচ্ছা হচ্ছিল তাই চলে আসলাম ঢাকা। কিন্তু আমার ছেলে আমাকে দেখে খুশি হওয়ার বদলে রেগে গেছে। আর সহানুভূতি অনুযায়ী দুপুরের খাবারটা খেতে দিয়ে একটু আগে বাসে তুলে দিয়ে গেছে। ওনার কথাটা শুনে নিজের বিবেকটা একটু নেড়ে উঠলো। তাই আমি বললাম…

— আপনার ছেলে আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে চায় কেন?
— সেটা বাবা অনেক বড় গল্প।
— বলুননা আন্টি, শুনতে অনেক ইচ্ছা হচ্ছে।

তখন আন্টি বলতে শুরু করলো তখন আমি ৭ মাসের অন্তঃস্বত্তা। ডাক্তার বলে দিয়েছে একদম বেশি কাজ না করতে তবে বিকেলে হালকা হাটাহাটি করতে। আমার স্বামী আমার অনেক খেয়াল রাখতো। আমাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল তাই আমার স্বামী কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমায় নিয়মিত হাঁটাতো। আমার বাচ্চাটার যেন কোন ক্ষতি না হয় তাই আমাকে কোন কাজ করতেই দিতো না। শুধু বসে বসে খাওয়া দাওয়া ছাড়া আমার হাতে কোন কাজ ছিল না। আর আমার শ্বাশুড়ি মা বড্ড ভাল ছিল। ওনিও আমার অনেক কেয়ার করতেন।

যখন আমার নয় মাস তখন মাঝে মাঝেই পেটে ব্যাথা অনুভব করতাম। তাই সব সময় মাকে বা স্বামীকে পাশে রাখতাম। আর পেটে ছোট খোটো লাথি মেরে বুঝিয়ে দিতো যে সে এখন পৃথিবীর আলো দেখার মত যোগ্য। ওর লাথি গুলো অনেক কষ্টে হজম করতাম তবে বলতে পারতাম না ওর লাথি খেয়েও কেন যেন চোখে জল আসলেও মুখে হাসি ফোটে উঠতো । আমার স্বামী আমার পেটের সামনে কান নিয়ে বলতো “দেখো গো খোকার মা তোমার বাচ্চা তো খুব পাজি। দেখো বড় হয়ে ও ঠিক আমাদের মনের মত হবে। ”

দশ মাস পূরনের কিছুদিন পর আমার প্রসব ব্যাথা উঠে যায় আর তখন আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্তান প্রসব মুহূর্তের ব্যথাটা শুধু একটা মা নিজেই সহ্য করতে পারে। অনেক কষ্ট পেয়ে ছিলাম। ওর জন্মের সময় অনেক রক্তক্ষরণ হয় তাই আমার ভাই আমাকে রক্ত দিয়েছিল। নয়ত ওই দিন হয়ত আমি পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিতাম। এরপর সব ব্যথার অবশান শেষে আসলো একটা রাজকুমার। তখন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার ব্যথা করছে। আমি হাসতে হাসতে সব কিছু নিমিষে ভুলেই গেলাম। এরপর আমায় বেডে দেওয়া হয়। আমাকে আর আমাদের রাজকুমারকে দেখতে পরিবারের সবার ভীড় বাড়তে থাকে।

সবাই যে যার মত আমাদের রাজকুমারের নাম রাখতে লাগলো তবে আমার স্বামী ওকে খোকা বলেই ডাকলো তাই আমিও খোকা বলেই ডাকতাম। তবে খোকা শুধু কান্না করতো কিন্তু আমার আর ওর বাবার কোলেই চুপ থাকতো।এভাবে কিছুদিন হাসপাতালে রাখার পর আমার বাসায় যাওয়ার টিকেট মিলে। ওইদিন আমি অনেক খুশি ছিলাম কারন আমার ছেলে আজ প্রথম আমাদের বাসায় পা রাখবে। পা রাখবে বললে ভুল হবে তবে বলা যায় প্রথম প্রবেশ করবে। সেই কারনে বাসাটাকে সবাই অনেক সুন্দর করে সাজালো।

খোকার বয়স তখন ৪ মাস। মায়ের দুধ খাওয়া ছাড়া ওর কোন খাবারই নেই তবে ওর চোখ গুলো মনে হতো যা পাবে তাই খাবে। এক সময় আমি বৃষ্টিতে ভিজার কারনে ঠান্ডা লাগে আর সেই থেকে আমাদের খোকাটারও ঠান্ডা লাগে। ঠিক ৪ দিন যেন আমি রাতে ঘুমাতে পারি নি। চোখ ঘুমে পড়ে গেলেও খোকার কান্নার আওয়াজে আমি আর ঘুমাতাম না। ওর ঠান্ডাটা নিউমোনিয়া হয়ে যায়। যার ফলে বাসার সবাই আমাকে বকতে থাকে। সেই দিন থেকে আমি পণ করি আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজবো না। এরপর অনেক দিন রাতে ঠিক মত ঘুমাই নি খোকার ঠান্ডার কারনে।

খোকার বয়স তখন ১ বছর হয়ে গেছে। ওর ৪টা দাঁত উঠপছে । দুষ্টমীর ফাঁকেও মাঝে মাঝে কামড় দিয়ে দিতো। সেই কামড়ের মাঝেও আমি সুখ খোঁজে পেতাম। খোকাটা খাবার নিয়ে বড্ড বায়না ধরতো আর সব সময় ওরে নিয়ে হাঁটতে হতো নয়ত ঘুমাতো না। আর রাতে তো কয়েকবার উঠে উঠে ওর ঘুমানোর বিছানাটা বদলে দিতে হতো। নয়ত রাতেই ঘুম ভেঙ্গে যেতো আর কাউকেই ঘুমাতে দিতো না। খোকার বাবাটা বড্ড ভাল ছিল তাই মাঝে মাঝে আমাকে ঘুমাতে দিতে নিজেই সব পরিষ্কার করতো। রাতে প্রায় সময়ই খোকা ভয়ে ভয়ে কেঁদে উঠতো তখন আমাকে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকতো। তখন যেন মনে হতো দুনিয়াতে আমার চেয়ে সুখী কেউ নেই।

খোকা তখন হাঁটতে শিখে গেছে আর ওর বয়সটাও ২ বছর হয়েছে। দুই পা সামনে হাটে তো ১ পা আছাড় খায়। তবে ও প্রথম হাঁটা আমার আঙ্গুল ধরেই শিখেছিল। যেদিন থেকে খোকা হাঁটতে শিখেছে ওইদিন থেকে আমার আর শান্তি রইলো না। ঠিক মত রান্না করতে পারতাম না। ঘরের এইটা না ওইটা ভেঙ্গেই ফেলতো। ওর জ্বালায় নিজেকে একটা মানুষ ভাবতেও পারতাম না। একদিন রাতে ওর সাথে খেলতেছিলাম তখন প্রথম ও মা বলে ডাকে।সেই দিনের সুখটা মনে হয় স্বর্গ সুখের চেয়ে কম না। সেই দিন খোকাকে কোলে নিয়ে সাড়া বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছি। তারপর আস্তে ওরে বাবা ডাকটাও শিখেছি। খোকার বাবা যখন বাবা ডাক শুনেছিল তখন থেকে মনে হয় ১ সপ্তাহ কাজে যাই নি। শুধু খোকার পাশেই সময় কাটিয়েছে।

যখন খোকার বয়স ৪ বছর তখন খোকা ভাল ভাবে কথা বলতে আর হাঁটতে চলতে পারতো। ঠিক এমন সময়ই আমার শ্বাশুড়ি মা মারা যান আর পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পরে আমার উপর। সেই দিন খোকার বাবাকে অনেক কান্না করতে দেখেছিলাম। আমার বিয়ের পর থেকে আমার স্বামীকে কখনো কান্না করতে দেখেনি তবে আমার শ্বাশুড়ি মারা যাওয়ায় অনেক কেদেঁছিল। শোনে ছিলাম আমার শ্বশুড় নাকি আমার স্বামীর জন্মের পরই মারা গিয়েছিল। এরপর আমি, খোকা আর খোকার বাবা মিলে পরিবারটা পূরন করি।

আস্তে আস্তে খোকাকে আদর্শ লিপি বই পড়াতে শুরু করি। ছেলেটা পড়ার প্রতি অনেক ইচ্ছা ছিল। ওর বাবা ওরে একটা স্কুল ব্যাগ কিনে দিয়ে ছিল। ছোটরা স্কুলে যায় বলে খোকাও স্কুলে যাওয়ার জন্য বায়না করতো। অনেক সামলিয়ে রাখতে হতো খোকা কে।

খোকার বয়স যখন ৬ বছর তখন আমি আর খোকার বাবা ওরে সরকারী প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেই। মনে হয় প্রথম ২ দিন ঠিক মত স্কুলে গিয়ে ছিল। তবে এর পরে যে লেখা পড়া লাটে উঠে যায়। তখন ভাবতাম ৪ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়ার এতো শখ ৬ বছরে এসে শেষ। তবে আমি মাঝে মাঝে ওরে ক্লাসে দিয়ে নিজেই বাইরে বসে থাকতাম। তখন মনে মনে ভাবতাম আজ খোকার জন্য যতটা সময় স্কুলে দেই ততটা সময় যদি আমি ছোট বেলায় দিতাম তাহলে আমিও আজ কিছু না কিছু হতে পারতাম।

যাই হোক, প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল খোকাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও বাসায় আনা। তবে প্রতি সপ্তাহে আমার বাসায় কোন না কোন বিচার আসতোই কারন দুষ্টু তো কম ছিল না। অবশ্য একবার খোকা একটা ছেলেকে রাস্তায় ধাক্কা দেয় আর ছেলেটা একটা রিকশার সাথে ব্যথা পায়। ওই দিন প্রথম আমি খোকার উপর হাত তুলি। সেই দিন রাতে আমিও কেঁদেছিলাম। কিন্তু আমার খোকা আমার কাছে মাফ চায় তাই সেই কান্নাটাও ভুলে গিয়েছিলাম। অনেক আত্মীয় বলতো আরেকটা সন্তান নেওয়ার জন্য জন্য কিন্তু আমি আর খোকার বাবা আমাদের সন্তানের আদর কাউকে ভাগ দিবো না বলে আর সন্তান নেই নি। খোকা ৭ বছর বয়সেও বিছানায় হিসু করে দিতো আর আমাকেই সব ধুতে হতো। এর জন্য ওরে বকতে বকতে আমি যে পাগল হওয়ার অবস্থা। অবশ্য বয়সের পরিবর্তনের সাথে খোকার রাতে হিসু করার অভ্যাস বন্ধ হয়েছিল।

বয়স তখন ১১ কি ১২ হবে সেই খোকা প্রাইমারি স্কুল পার করে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়। খোকা তখন যেন অনেক বড়। খেলার ফাঁকে ফাঁকে খোকার বাবার দোকানে গিয়ও বসতো। তবে দোকানে যেত ওর বাবার থেকে টাকা আনতে। আমি বারন করলেও ওর বাবা ওরে ঠিকই টাকা দিতো। খোকা লেখাপড়ায় একটু ফাঁকিবাজি করতো তাই ক্লাস টিচার মাঝে মাঝেই বিচার দিতো। আর এতে খোকার বাবা রেগে যেত। তবে আমাদের খোকাও কম দুষ্টু ছিল না। যখন খোকার বাবা বা আমি রেগে যেতাম তখনই খোকা বই খোলে পড়তে শুরু করতো। এরপর খোকার বাবার কথা মত খোকাকে আমরা আলাদা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দেই।

খোকাকে আমরা সব স্বাধীনতাই দিয়েছি তবে সেই স্বাধীনতার ১ বার অপব্যবহার করে ছিল। যার কারনে ২য় বারের মত ওকে আমি অনেক জোড়ে একটা চড় মারি। তখন খোকা ক্লাস নাইনে উঠেছিল। তখন সময়টা ওর বয়ঃসন্ধিকাল চলতে ছিল। একবার খোকার রুম থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছিল। তখন ওর রুমে গিয়ে দেখি খোকা সিগারেট খাচ্ছিল। যদিও রাগের বসে চড় মেরে বসি তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করে ওরে বুঝাতে শুরু করি যে এই বয়সটা শুধু পরিবর্তনের বয়স। একটা মানুষের জীবনের সব চেয়ে কঠিন সময় পার করে এই সময়টাতে। খোকার বাবা যদি সিগারেটের কথা জানে তাহলে খোকাকে অনেক মারবে তাই আমি আর বলি নি। তবে খোকাকে আর সিগারেট খেতে দেখি নি। তবে খোকা পরিবারের সাথে সময় দেওয়ার চেয়ে বাইরে বেশি থাকতো। তখন খোকার ব্যাপারে সব কথা আমি খোকার বাবাকে বলি। যদিও খোকার বাবা রেগে যায় তবুও আমার কথা মত খোকার মত খোকার সাথে সময় কাটাতে শুরু করে।

দেখতে দেখতে খোকা এস এস সি পরীক্ষা শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। দিন গুলো ভালই কাটছিল কিন্তু সেই আবার বয়সের দোষের ফাঁদে পরে আর কোন এক মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে যায়। অবশ্য আমাকে না বললেও আমি বুঝতে পারি। মা তো তাই নিজের নাড়ির খবর তো অবশ্যই জানবো। তখন খোকা বায়না ধরে মোবাইল কিনে দেওয়ার জন্য। আমরা বলি যে ইন্টার শেষ করলে অবশ্যই দিবো কিন্তু বাজে বন্ধুদের পাল্লায় পরে ও বাসায় রাগ দেখাতে শুরু করে। এরপর নিজেরা ওর রাগের কাছে হার মানি আর একটা মোবাইল কিনে দেই। রাতে যখন বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠতাম তখন খেয়াল করতাম খোকার ঘর থেকে আলো জ্বলছে। তখন মাঝে মাঝে রাগ দেখালে নিজেই খুব কষ্ট পেতাম তবে ছোট খোকাটা যে বড় হয়েছে সেটা মেনে নিতে হতো।

ইন্টার শেষে করলে ওরে বলি পাবলিক ভার্সিটির জন্য পড়াশোনা করার জন্য কিন্তু খোকার টার্গেট হয়ত ন্যাশনাল ভার্সিটি ছিল। তবু আমরা বলে ছিলাম যেখানেই পড় না কেন মন দিয়ে লেখাপড়া করো। ভার্সিটি জীবনের যখন ৩য় বর্ষ আসে তখন খোকার মাঝে সব চেয়ে বড় পরিবর্তনটা দেখি তা হলো খোকা একদিন সকালে ওর বাবার সামনে বলে “ও একটা মেয়েকে ভালবাসে আর বিয়ে করতে চায় “। সেই দিন আমি বুঝে গিয়ে ছিলাম আমাদের খোকা অনেক বড় হয়েছে। তখন খোকার বাবা অনেক রাগারাগী করে। কিন্তু খোকার বাবার তো হাই প্রেসার ছিল তাই মাঝে মাঝে হার্টেও সমস্যা দিতো। খোকার লেখাপড়া শেষ হলে খোকা আমাদের পারিবারিক ব্যবসায় বসে তবে ওর মাথায় সেই মেয়েকে বিয়েই নেশাটা চেপে বসে। তাই আমি আর খোকার বাবা বাধ্য হয়ে মেনে নেই।

খোকার বিয়েটা খুব ধুম ধাম করে দেই। অনেক আত্মীয় স্বজন আসে বিয়েতে। খোকাকে সেই দিন অনেক খুশি দেখেছিলাম। আস্তে আস্তে বিয়ের সব নিয়ম অনুযায়ী বিয়েটা শেষ হয়। আর খোকা নতুন বউ নিয়ে বাসায় পা রাখে। সেই দিন যেন আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল তবু মুখ বুজে সব সহ্য করে ছিলাম। খোকার শ্বশুড় বাসার লোক অনেক বড় লোক ছিল আর খোকা নিজের বাসার চেয়ে শ্বশুড় বাসায়ই বেশি সময় কাটাতো।

এর প্রায় ২ বছর পর খোকার বাবা ঘুমের মাঝে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। সেই দিন আমার মন আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল এই বাড়ির খাবার আমার কপাল থেকে উঠে গেল। আমার কান্নায় সব শান্ত হয়ে ছিল। কিন্তু আমার খোকাটা একবারও আমার কাছে ছিল না। সব নিয়ম অনুসারে আমার স্বামীর শেষ কাজ সম্পূর্ণ হয়।

এর ১ বছর পর আমার খোকার ঘরে আরেকটি খোকা আসে। মিষ্টি ফুটফুটে তবে মনে হয় আমাকে ১ বার ই সেই খোকাকে কোলে নিতে দিয়েছিল। আসলে বয়সটা বেড়ে গিয়ে ছিল তো। আমাকে কখনো আমার খোকা বলতো না আমি ভাত খেয়েছি কি না? আমি প্রতি দিনের মতই ভোরে ঘুম থেকে উঠে রাতের বাসি থালা বাসন ধুয়ে রাখতাম আর ঘরও পরিষ্কার করতাম আর আমার খোকার বউ তো বড় লোকের বেটি তাই সে ১০টায় ঘুম থেকে উঠতো। নিজের বাচ্চাকে ঠিক মত পরিচর্যা করতো না।

মাঝে মাঝেই খোকার ঘর থেকে আমাকে নিয়ে ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পেতাম তবু চুপ চাপ বসে থাকতাম। এবার আমার অনেজ জ্বর হয় আর কাশিও অনেক হয় কিন্তু কেউ যে একটু মাথায় জল দিয়ে দিবে সেই মানুষটাও পাই না। সেই দিন ইচ্ছা করছিল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই কিন্তু যাবো কোথায় সেটাও তো ঠিক নেই?

একবার রাতে আমার অনেক কাশি বেড়ে যায় আর খোকা তখন আমার রুমে এসে আমাকে যা ইচ্ছা তাই শুনিয়ে দেয়। আচ্ছা আমি তো নিজের ইচ্ছায় আর কাশতে ছিলাম না। এরপর দিন সকালে খোকা বলে আমাকে নাকি কোথায় রেখে আসবে? আমি মোটামোটি আন্দাজ করতে পেরে ছিলাম হয়ত বৃদ্ধাশ্রমেই পাঠাবে। হয়ত আমি প্রতিবাদ করলেও করতে পারতাম যে এইটা আমার বাড়ি কিন্তু দুই দিন পরে তো মরেই যাবো সবাই। এইসব বাড়ি নিয়ে বড়াই করে লাভটা কি? যদি আমার খোকা আমাকে ছাড়া সুখী থাকতে পারে তাহলে সুখী থাকুক না।

এরপর আমাকে নরসিংদীর একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। যদি ঢাকাতে অনেক বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে তবুও আমাকে নরসিংদী পাঠালো। কারন আমার খোকা মনে করতো আমি বার বার বাসায় চলে আসবো। তাই আজ খোকাকে দেখার ইচ্ছা হয়। আর তিন মাস পর বাসায় আসি। কিন্তু খোকা তো আমাকে দেখেই রেগে যায়। যাই হোক, আমি মন থেকে চাইবো আমার খোকার খোকাটা যেন তার বাবা মায়ের সাথে এমন না করে । আন্টি কথা গুলো বলতে বলতে চোখের জলে গাল দুইটি ভিজিয়ে দিয়েছে। আর আমার বিবেককেও আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে আমি একটু আগে কত বড় ভুলটা করে আসছি। তখন আমি আন্টিকে বললাম…

— আন্টি আপনি নরসিংদীর কোন বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন?
— শেষ ঠিকানা।
— ওকে আন্টি আমি আসবো আপনার কাছে কারন আমার বাসাও নরসিংদী তবে একটু আগে করা একটা ভুল আমি এখন সংশোধন না করলে অনেক বড় অন্যায় হয়ে যাবে। আমি আসছি।

আমি আর না দাঁড়িয়েই সেখানেই বাস থেকে নেমে গেলাম আর দেখি আমি আপাতত পূবাইল চলে আসছি। তাই ওইখানের বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এর মাঝে নিত্তিয়া একবার ফোন দিয়ে বলেছে আমি কোথায় আছি? তখন আমি বলে ছিলাম ” ভুলবশত করা পাপটা ঠিক করতে যাচ্ছি “।

প্রায় দেড় ঘন্টা পর আমি সেই বৃদ্ধাশ্রমের কাছে গেলাম। আমাকে দেখে সেখানের অনেকেই অবাক। কারন আমি হয়তো প্রথম কেউ যে নিজের মাকে রেখে যাওয়ার পর আবার এসেছে। অফিসে গিয়ে মায়ের কথা বলতে একজন আমার মাকে নিয়ে আসলো। তখন আমার পা দুইটি এমনিই ভেঙ্গে বসলো আর মায়ের পা ধরে কান্না করে দিলাম। জীবনে বুঝতেই পারি নি মা কি জিনিস। তারপর মা আমাকে তার বুকে টেনে নিলো।

এরপর মাকে নিয়ে আমি আমার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। মা অবশ্য বলে ছিল আমি আমার ফেরত আসার কারন কি? তখন আমি শুধু বলে ছিলাম একটা মা আমার বিবেক কে তার চোখের জল দিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে। আর আমি নিত্তিয়ার বাবাকে সবটা খুলে বলি তখন নিত্তিয়ার বাবা মাও বলে মায়ের পায়ের নিচে ছেলের স্থান তাই মাকে নিজের কাছেই রাখতে। আর ওই দিকে নিত্তিয়াকেও ওর মা বাবা হয়ত বুঝিয়েছে। তবে মনে মনে ভাবছি পৃথিবীতে জানি এমন কত মায়ের গল্প রয়েছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত