নবনী

নবনী

রেস্টুরেন্টের মালিক প্রায় অপমান করেই নবনী আর জাকির কে রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে দিলো। ওরা বের হয়ে যাবার সময় মালিক অন্যান্য কাস্টমার দেখে গলা উঁচু করেই বললো, আমার রেস্টুরেন্টে এসব চুমাচুমি, ধস্তাধস্তি চলবে না। হালাল ভাবে আমি রেস্টুরেন্ট চালাই। এসব বেহালাল কাজ আমার রেস্টুরেন্টে হবে না।

রাস্তায় বের হয়ে নবনী প্রায় কেঁদে ফেললো। কি হতে কি হয়ে গেলো নবনী কিছুই বুঝতে পারেনি। জাকির নবনীর পিছুপিছু হাঁটছে। ওকে কি বলবে সে নিজেও ভেবে পাচ্ছে না। আসলে ব্যাপারটা যে এরকম হবে সেটা ও নিজেও বুঝতে পারেনি।

আজবাদে কাল নবনীর সাথে জাকিরের বিয়ে হবে। নবনীর বাবাই এই বিয়ে ঠিক করেছে। এর আগেও ওরা দুইবার বাইরে দেখা করেছে। রেস্টুরেন্টে বসে বিভিন্ন গল্পগুজব করেছে। বিয়ের পর কি কি ভাবে সংসার সাজাবে। কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে সেসবই ছিল গল্পের মূল বিষয়।

আজকেও স্বাভাবিক ভাবেই ওরা রেস্টুরেন্টে এসে খাবার অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় লোডশেডিং হয়। হঠাৎ জাকিরের মনে কি যেন হয়ে গেলো। অন্ধকারে চুপ করে নবনীর গালে চুমু খাবার সময়ই জেনারেটর চালু হয়ে গেলো। আলো জ্বলতেই সরাসরি ওদের দেখে ফেললো রেস্টুরেন্টের মালিক।

উনি এগিয়ে এসে বললেন, উঠুন আপনারা চেয়ার থেকে। এক্ষুনি আমার রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যান। রেস্টুরেন্টের অন্যান্য কাস্টমার সবাই একে অন্যের মুখ দেখাদেখি করছিল তখন। আসলে ওরাও বুঝতে পারেনি। কেন এভাবে ওদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। নবনী আর জাকির অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
পরিবার শিক্ষা দেয়নি নাকি? লজ্জা করেনা পাবলিক প্লেসে এসে পরপুরুষের সাথে এভাবে ঢলাঢলি করতে। মুরুব্বি মানেন না?বাড়িতে আমার নিজের ছেলে মেয়ে আছে। ওদের তো আমি কখনো এমন শিক্ষা দেইনি। কেমন বাপ মা আপনাদের? এরকম নানান কথা বলে উনি চিৎকার করে যাচ্ছেন। ততক্ষণে ওরা দুজন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে।

নবনী বেশ অপমানিত বোধ করছে। কথাগুলো ভেবে প্রায় কেঁদেই দিলো। এতগুলো মানুষের সামনে লোকটা অপমান করে বের করে দিলো তাদের।

জাকির বারবার ডাঁকছে কিন্তু নবনীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছে। সে এখনো বুঝতে পারছেনা এতগুলো মানুষের মধ্য থেকে কেন তাদের এভাবে অপমান করে বের করে দেয়া হলো। ঢলাঢলির কথাটা কাকে বললেন উনি। সে তো জাকিরের থেকে দূরত্ব রেখেই বসেছিলো। জাকির দ্রুত পায়ে এগিয়ে নবনীর সামনে এসে দাঁড়ায়।

~ নবনী প্লিজ শুনো, আমি সত্যিই চুমু খেতে চাইনি। এমন কোনো ইচ্ছে আমার ছিলোনা কিন্তু তখন হঠাৎ করে কিভাবে কি হয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারছিনা।

~ তাহলে চুমু খেতে গেলেন কেন? নবনী দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নিলো।

~ বললাম তো ভুলে। এছাড়া আজ বাদে কাল তুমি আমার স্ত্রী হতে যাচ্ছ। এভাবে ওভার রিএক্ট করার কি আছে?

~ ওভার রিএক্ট! অন্তত একবার অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন ছিলো। আমি এটা চাই কিনা। এখনো কিন্তু আপনার স্ত্রী আমি হইনি। আর আপনার স্ত্রীকে কি আপনি রাস্তাঘাটে চুমু খেয়ে বেড়াবেন?

~ ঘরের বউ যখন । অনুমতি নেয়ার কি আছে?

একথা শুনে নবনী চুপচাপ হেঁটে চলে আসে। জাকির ডাকলেও ও আর পিঁছু ফিরে তাকায়নি। জাকির বারবার কল দিচ্ছে। নবনী কলটা কেটে মোবাইল বন্ধ করে রাখে।
বাসায় এসে চুপচাপ রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। কি হতে কি হয়ে গেলো। এরকম একটা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। তাছাড়া জাকির এরকম করবে সেটাও সে ভাবতে পারেনি। বিয়েটা পারিবারিকভাবে ঠিক হয়েছে, দুদিন পরে বিয়ে তা না হয় মানলাম। তাই বলে অন্ধকারে পেয়ে চুমু খেতে হবে? একবার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজনও মনে করলো না? জাকির এতটাই খারাপ। ছিঃ
.
নবনীর মনে হলো সে অন্যায় করছে নিজের সাথে। নীরবতা আর রাগ কোনো কিছুর সমাধান হতে পারেনা। নবনী জাকিরকে কল করে বিকেলে তার সাথে দেখা করতে বলে। জাকির এসেই প্রথমে নবনীর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে তার ভূলের জন্য। কিন্তু নবনী দমে যাওয়ার পাত্রী না। কোনভাবেই সে জাকিরকে আর মেনে নিবেনা। জাকিরের কথা বলার এক পর্যায়ে নবনী বলে উঠে,

~ শুনুন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।

~ আজ বাদে কাল আমাদের বিয়ে। আর এখন তুমি আমার সাথে মশকরা করছো? নিজের এত বড় ক্ষতি করোনা নবনী।

~ নিজের ক্ষতি করতে চাইনা বলেই এ বিয়ে আমি করবো না। যে নারীদেরকে সম্মান দিতে জানেনা তার সাথে আমার যায় না।

~ বললাম তো আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দাও। আমরা যে সংসারটা সাজাতে চেয়েছিলাম সেটা সাজাতে দাও প্লিজ।

~ প্রথমে বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে সম্মান দিতে শিখুন। যাকে বিয়ে করবেন তাকে পণ্য না ভেবে মানুষ বলে ভাবুন। তারপর সংসার সাজাবেন।

কথাগুলো বলেই নবনী ফিরে আসছে। এখন অনেক হালকা লাগছে নিজেকে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো। চুপচাপ এরকম অন্যায় মেনে নেয়ার মেয়ে সে না। এ অন্যায় মেনে নেয়ার কোনো কারণও নেই। নবনী জানে, তার বাবা তাকে সাপোর্ট করবে। বাবার আদর্শেই তো সে আদর্শিত।
.
বাসায় ফিরে নবনী তার বাবার কাছে গিয়ে বলে, বাবা কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে। একটু শুনো এদিকে। নবনীর বাবা তার পাশে এসে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবি?

~ আমি জাকিরকে বিয়ে করতে পারবো না বাবা। এ বিয়ে ভেঙে দিয়েছি আমি।

~ পাড়া-পড়শী সবাই জানে আজ বাদে কাল তোর বিয়ে হবে জাকিরের সাথে। আর এখন বলছিস বিয়ে করবি না। কাউকে পছন্দ করিস?

~ না

~ তাহলে বিয়ে করবিনা কেন?

~ যে পুরুষ নারীদের সম্মান করতে জানেনা তার সাথে আমার জীবন বাঁধা অসম্ভব। বাবা আমি “আলোকবর্তিকা” সংঘের সদস্য। সে সংঘ নারীকল্যাণমূলক কাজ করে। সমাজের অসহায়, অবহেলিত, নির্যাতিত নারীদের জন্য আমি কাজ করি। নারী সমাজকে এগিয়ে নেয়ার ব্রত নিয়ে পথ চলছি আমি। সেখানে নিজের সাথেই এতবড় অন্যায় আমি কিভাবে মেনে নিই বলো।

~ নবনী মা শোন, সে কি এমন করছে যার জন্য তুই একাই এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিলি। আর যা করুক না কেন। সেটার জন্য তোর কাছে না হয় ক্ষমা চেয়ে নিবে। কিন্তু বিয়েটা ভাঙিস না মা। বিয়ে ভাঙা মেয়েদের মর্যাদা এই সমাজ দেয়না।

~ প্রাচীন সমাজের ঘুণে ধরা চাকার নিচে পিষ্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না বাবা। আমি সমাজের উল্টো পথে হাঁটি। আমার কাছে আত্নমর্যাদা সবার আগে। আমি যদি নিজেকে সম্মান না দেই তাহলে অন্যজন থেকে সম্মান প্রত্যাশা করাটা বোকামি। আর যা-ই হোক, আমি নিজেকে অপমান করতে পারবো না।

~ নবনী একটু বুঝার চেষ্টা কর। তোর বিয়ের কথা সবার জানাজানি হয়ে গেছে। পরেরবার তোকে বিয়ে দিতে হলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। আর যদি বিয়ে না হয় তখন আজীবন সবাই তোকে ছোট করে দেখবে। অলক্ষুণে ডাকবে। পাড়া-পড়শীর একথা ওকথা শুনে হীনম্মন্যতায় বাঁচতে হবে। পারবি?

~ আজীবন মেয়েরাই কেন এসব সহ্য করে আসবে বাবা? চিরকাল ছেলেপক্ষ বিয়ে ভেঙে যায়, মেয়েটার অবস্থা বুঝার চেষ্টা করেনা। আজ কোনো মেয়ে স্বয়ং তার বিয়ে ভাঙলো। এবার তারা একটু সহ্য করুক, বুঝুক.. বিয়ে ভাঙার যন্ত্রণা। এ বিয়ে হবেনা। ব্যস।

~ নবনী আমাদের টিকে থাকা দায় হবে এ সমাজে। রাগ, জেদ এগুলো পুরুষদের মানায়। নারীদের সর্বদা কোমল হতে হয়।

~ বাবা তুমি তো আমাকে এ শিক্ষা দাওনি। তাহলে আজ কেন নিজের বিরুদ্ধে কথা বলছো? তুমিই আমাকে শিখিয়েছো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে।

~ অনেক সময় মাথা নোয়াতে হয় মা। সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার তাগিদে।

~ আর কত বাবা? নারীরা চিরকাল মাথা নুইয়ে সব সয়েই গেছে, প্রতিবাদ করেনি। মাথা নুয়াতে নুয়াতে এখন আর নুয়াবার জায়গা নেই। কপাল মাটিতে ঠেকে গেছে। এবার একটু ঘুরে দাঁড়াই?

নবনীর কথা শুনে তার বাবা প্রায় কেঁদে ফেললো। মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পেরেছে ভেবে গর্ব হচ্ছে। মেয়ের আত্নবিশ্বাস দেখে কলুষিত সমাজের ভয়টাও কাজ করছেনা আর।

আমাদের সমাজে নবনী চরিত্রের মেয়েদের খুব অভাব। এ সমাজের মেয়েরা পরিবারের জন্য চুপচাপ নিজেকে বিসর্জন দেয়। টু শব্দটি করেনা।

ঘুণেধরা সমাজে চিরকাল কন্যাপক্ষ শুধু পাত্রপক্ষের সামনে কেঁদে বুক ভাসায়। তাদের হাতে পায়ে ধরে আঁকুতি মিনতি করে। নারীরা তো দূর্বল নয়। ইসলাম নারীদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। নারী-পুরুষের মধ্যকার বৈষম্যটা আমরাই সৃষ্টি করি। নীরবে সব সয়ে অন্যের কাছে নিজেকে বলি দেওয়া কোনো যুক্তিসঙ্গত কাজ না। সবসময় সয়ে না গিয়ে কিছুসময় রুখে দাঁড়াতে হয়। বাঁচতে হলে বাঁচার মতো বাঁচুন। নিজেকে সম্মান করতে শিখুন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার সাহস রাখুন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত