শম্মীর আজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিন। শম্মী তার ক্লাসরুমে বসে বসে ভাবছে, জীবনটা কতোটা দ্রুত চলে যায়! তাই না? এইতো কদিন আগে সে স্কুলে পড়তো! দেখতে দেখতে কলেজে উঠে গেলো! আর এবার উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়েও উঠে গেলো! কত দ্রুত চলছে তার জীবন! হয়তো আলোর বেগের চাইতেও দ্রুত!
শম্মী ক্লাসরুমে অন্য মনস্ক হয়ে বসে থাকে। ক্লাসের সবারই আজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিন। তাই কার আনন্দ কে দেখে? সবাই হাসাহাসি,দুষ্টুমি, একে অপরের সাথে পরিচিত হওয়া, আড্ডা দেওয়া নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। ব্যাতিক্রম শুধু শম্মী। সে জানে না,কেনো যেনো আজ তার অতীতের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে! তার মেয়েবেলার বন্ধু, স্কুল বন্ধু, কলেজ বন্ধু সবার কথাই হঠাৎ তার আজ মনে পড়ছে! তাই তাদের ছাড়া শম্মীর আজ নিজেকে ভীষণ একা লাগছে । তাই মন খারাপ করে ক্লাসের শেষ বেঞ্চে একা একা বসে রইলো সে।
এরপরেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসটা শুরু হলো। ঘড়িতে সকাল ১১ টা বাজতেই তাঁদের ক্লাসে একজন ম্যাডাম এসে হাজির হলো। ম্যাডামটা বেশ সুন্দর, মার্জিত এবং মজার। সবার সাথে বেশ রসিকতা করেই কথা বলে। তার ক্লাসের প্রথম ৩০ মিনিটেই কথা বলে পুরো ক্লাসের সবার মন জয় করে নেয় সে। ম্যাডাম বেশ মজার মজার কথা বলেই শম্মীদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসটা শুরু করেন। শম্মীর মনটাও মুহুর্তের মধ্যেই ভালো হয়ে যায় ম্যাডামের নানান ধরনের মজার কথা শুনে। শম্মীও ক্লাসের সবার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে হাসতে থাকে!
ম্যাডামের ক্লাশ নেওয়া যখন প্রায় ৩০ মিনিট শেষ। ঠিক তখনি ক্লাস রুমের দরজার সামনে ফুল হাতা শার্ট, গিয়া কালারের প্যান্ট, পায়ে সাধারণ সেন্ডেল আর চোখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা পড়া ছেলে এসে হাজির হলো।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনে এতো দেরি করে ক্লাসে আসা তাও আবার এইরকম সাদা-সিধে পোশাক পড়ে!! এটা দেখেই ক্লাসের সবাই জোড়ে শব্দ করে হেসে উঠলো। তবে এতে যেনো ছেলেটা মনে বিন্দুমাত্রও কষ্ট বা লজ্জা পেলো না। আর ছেলেটা কষ্ট পেলেই বা বোঝার উপায় কী? ছেলেটা প্রথম থেকে সেই একই রকম ভাবে মুখটা মলীন আর গম্ভীর করে মাথা নিচু করে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটার চেহারার মধ্যে হাসির ছিটেফুটও নেই । ছেলেটাকে দেখেই যেনো বোঝা যাচ্ছে যে , ছেলেটা হাসলে তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগবে। কিন্তু ছেলেটা মনে হয় অনেকদিন ধরে হাসে না! মনে হয় ছেলেটা হাসতে ভালোভাসে না! কিন্তু কখনো হাসে না এমনো মানুষও কী হয়? শম্মী ছেলেটার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে লক্ষ করে যে ছেলেটার মুখের উপর একটা দুঃখ আর কষ্টের চাদর পড়ে রয়েছে। অনেক মুল্যবান জিনিসও যেমন দীর্ঘদিন খোলা অবস্হায় অযত্নে ফেলে রাখলে তাতে ধুলার আস্তরণ পড়ে তার সৌন্দর্য্যকে নষ্ট করে, ঠিক তেমনি ভাবে হয়তো ছেলেটারো হাসিমাখা মুখটা দীর্ঘদিন অযত্নে ফেলে রাখার ফলে এতে দুঃখ আর কষ্টের আস্তরণ পড়ে গেছে!
প্রথমে ছেলেটাকে দেখে সবাই হাসলেও এরপর সবাই চুপ হয়ে শম্মীর মতোই ছেলেটার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সবাই যেনো ছেলেটার মুখের এই গম্ভীরতা আর মলীনতার রহস্যের উদগাঁটন করতে চাইছে! ছেলেটার মুখের মধ্যে একটা অদ্ভুত রকমের মায়া রয়েছে। তার মুখ যেনো তার সব দুঃখ কষ্টকে প্রকাশ করছে। সবার সাথে শম্মীও অনেক্ষণ ছেলেটার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এরপর শম্মী লক্ষ করলো, যে ম্যাডাম এতোক্ষণ নিজের সাথে সাথে পুরো ক্লাসকে হাসিয়ে মাতিয়ে রেখেছিলো সেই ম্যাডামো ছেলেটার মুখের দিকে গম্ভীরতো আর নীরবতা মিশ্রিত দৃষ্টিতে অপলকম ভাবে তাকিয়ে রয়েছেন। যেনো সেও ছেলেটার এই করুন মুখের পেছনের রহস্য জানতে চাইছে! পুরো একটা ক্লাশ কয়েক মুহুর্তের জন্য নীরব হয়ে যায়। যে ছেলেটার জন্য ক্লাসে নীরবতা নেমে এলো সে ছেলেটা ক্লাসের দরজার সামনেই বেশ কিছুক্ষণ একইভাবে মলীন মুখ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর সবার নীরবতা ভেঙে ক্লাশের ম্যাডাম একটু মুচকি হেসে মিষ্টি কণ্ঠেই ছেলেটাকে প্রশ্ন করলেন:
-কী ব্যাপার? ক্লাশের প্রথম দিন এতোটা দেড়ি করে এসেছো কেনো? তোমার বাড়ি কী অনেক দুরে?
কিন্তু ছেলেটা ম্যাডামের প্রশ্নের কোন উত্তর দিলো না। চুপচাপ শুধু মেঝের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এমন ভাব করলো যে মনে হলো সে কোন প্রশ্নই শুনতে পায়নি! এরপর ম্যাডাম কয়েক মুহুর্ত প্রশ্নের উত্তর শোনার অপেক্ষায় ছিলেন। কোন উত্তর না পেয়ে ম্যাডাম চেহারায় কিছুটা গম্ভীরতা ভাব এনে ছেলেটাকে বললেন:
-আচ্ছা ঠিক আছে! যাও ক্লাসে গিয়ে বসো। কাল থেকে আর দেড়ি করে আসবেনা।
এরপর ছেলেটা ধীরো পায়ে হেটে ক্লাসেরশেষ বেঞ্চে অর্থাৎ শম্মীর ঠিক পাশের সাড়িতেই গিয়ে বসলো। এরপর যথারীতি ম্যাডাম আবার ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। ছেলেটাকে প্রথমবার দেখেই ক্লাশের অনেকেরই ছেলেটার প্রতি কৌতুহলতা জন্মে গিয়েছিলো। কিন্তু কিসের কৌতূহলতা? হয়তো ছেলেটার মুখ এতোটা গোমড়া কেনো এটা জানতে চাওয়ার কৌতূহলতা!! তাই ম্যাডাম ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ক্লাসের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ছেলেটার কাছে গিয়ে ছেলেটার নাম? আগে কোথায় পড়াশোনা করেছিলো? কোথা থেকে এসেছে? মন খারাপ কেনো? এই ধরণের নানান প্রশ্ন করতে থাকে। তবে ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যে, সে কারো সাথেই কথা বলতে উৎসাহী নয়! সবাইকে দেখে একটা সৌজন্য হাসিও দিলো না সে। সেই মুখ গোমড়া করেই বসে রইলো। কারো কোন প্রশ্নের উত্তরও দিলো না সে। সবাই ছেলেটার এই রকম আচরণে বেশ অবাক হলো এবং অপমানবোধ করলো । সবাই ভাবলো ছেলেটা হয়তো অনেক অহংকারী! তাই এরপর থেকে সবাই ছেলেটার সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দেয়। ছেলেটাও উৎসাহো নিয়ে কারো সাথে এগিয়ে কথা বলতে আসতো না।
শম্মী প্রায় প্রতি ক্লাসেই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আর ভাবতো, ছেলেটা এতোটা গম্ভীর কেনো? ছেলেটা কারো সাথে কথা বলেনা কেনো? ছেলেটার মুখ এতো মলীন কেনো? ছেলেটা হাসে না কেন? ছেলেটার কিসের এতো দুঃখ? ছেলেটার কী হাসা নিষেধ আছে নাকি? ছেলেটার চেহারা দেখে শম্মীর কিছুতেই মনে হয় না যে ছেলেটা অহংকারী হতে পারে। ছেলেটার মুখের মধ্যে একটা মায়া আছে যা অহংকারী মানুষের মুখে থাকে না। তাহলে কী ছেলেটা বোবা? কিন্তু বোবা হলে কি হাসতে মানা? অন্তত একটু হাসতেতো পারে সে! কিন্তু ছেলেটা হাসে না কেন? শম্মী কোন প্রশ্নেরই উত্তর পায় না! আবার সাহস করে ছেলেটার কাছে গিয়ে এইসব কথা জিজ্ঞাসও করতে পারে না! ভাবে যদি ভাব দেখিয়ে তার সাথেও কথা না বলে তাহলে সবার সামনে কী লজ্জাটাই না পাবে সে!
শুধু শম্মী না। ক্লাশের কেউই এখনো পর্যন্ত এই ছেলেটার মুখের কথা শুনেনি বা হাসি দেখেনি। শম্মীর মতো সবাই ভাবে ছেলেটা কী বোবা? কিন্তু তাও ছেলেটা হাসে না কেন?
তবে একদিন ছেলেটা নিজে থেকেই প্রমাণ করে দিলো যে, সে একটু মলীন আর গম্ভীর চেহারার অধিকারী হতে পারে কিন্তু সে বোবা, অমনোযোগি কিংবা অমেধাবি নয়। ছেলেটার নীরবতা শিক্ষক-শিক্ষিকারাও লক্ষ করতো। তাই একদিন ছেলেটাকে হুট করেই একজন শিক্ষক সেই দিন যা পড়াচ্ছিলেন তার ভেতর থেকে একটা জটিল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন? ছেলেটা খুব দ্রুতই সেই জটিল প্রশ্নের উত্তরটা দিয়ে দেয় সবার সামনে। সবাই বুঝতে পারে যে ছেলেটা বোবা না। ছেলেটা ইচ্ছা করেই নিজে থেকে কারো সাথে কথা বলে না! এবং হয়তো নিজে থেকেই ইচ্ছা করেই কখনো হাসে না! কিন্তু কেনো? উত্তর জানা নেই কারো!
তবুও ক্লাসের শিক্ষার্থীরা কেউই হাল ছাড়ে না। তারা নানান ভাবে ছেলেটাকে হাসানোর চেষ্টা করে। কখনো তাকে হাসাতে ইচ্ছা করেই কেউ তার সামনে এসে পড়ে যায় বা কখনো কেউ তার পাশে এসে নানান হাসির, মজার গল্প বলতে থাকে । কিন্তু এতে ছেলেটার চেহারার বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন ঘটে না। হাসবে তো দূরের কথা! ছেলেটা তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। সে যেনো তার মলীন মুখের মলীনতা ধরে রাখতেই ব্যাস্ত। ছেলেটাকে কেউই আর বুঝতে পারে না। কারোই জানা হয় না যে, ছেলেটা হাসে না কেন?
সবাই এই বিষয়টা নিয়ে ভাবা বন্ধ করে দিলেও শম্মীর মাথায় শুধু এই প্রশ্নই ঘুরতে থাকে। ছেলেটা হাসে না কেন? ছেলেটা হাসে না কেন? তাহলে কী তার পারিবারিক কোন সমস্যা রয়েছে? ছেলেটা কী খুব গরিব পরিবারের একটা ছেলে? তাদের কী অনেক কষ্ট? তাই ছেলেটা হাসে না? শম্মী ভাবতে থাকে! এরপর ভাবে! আচ্ছা ছেলেটা থাকে কোথায়? কোথা থেকে রোজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে সে? হয়তো তার বাড়িতে গেলেই ছেলেটার না হাসার পেছনের রহস্যটা জানা যাবে!
এরপর শম্মী সিদ্ধান্ত নেয় যে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির পর শম্মী ছেলেটার পেছনে পেছনে তার বাড়িতে যাবে!
যেই ভাবা সেই কাজ! পরের দিন ক্লাস ছুটির পরেই সেই ছেলেটাকে অনুসরণ করে হাটতে থাকে শম্মী। শম্মী এই প্রথম কাউকে অনুসরণ করে রাস্তায় চলছে। তাও ছেলেটা আন্দাজও করতে পারে না যে তাকে কেউ অনুসরণ করতে পারে! অবশ্য ছেলেটা আর কী আন্দাজ করবে?! তার কি কোন চিন্তা শক্তি রয়েছে? ছেলেটার ধ্যান-জ্ঞান এখন অন্যভুবনে। ছেলেটা অনেকটা অন্যমনস্ক হয়েই রাস্তা দিয়ে হাটছে! বরাবরের মতোই ছেলেটার মুখের ভেতর হাসির ছিটেফুটোও নেই! ছেলেটাকে অনুসরণ করতে করতে শম্মী অনেকটা পথ অতিক্রম করে ফেলেছে। হাঁটতে হাঁটতে তার পা প্রায় ব্যাথা হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে না যে ছেলেটা আর কতোদুর যাবে? তার বাড়ি কী এতোটাই দুরে? ছেলেটা কী রোজ এইভাবেই পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে? কিন্তু তার বাড়িটা কোথায়?
এরপর দেখতে দেখতে ছেলেটা একটা বস্তীর ভেতরে ঢুকে যায়। শম্মী বেশ অবাক হয়! তাহলে কী ছেলেটা বস্তীর ভেতর থাকে? তাই তার অনেক কষ্ট এবং সে হাসে না? শম্মী এই রাস্তা দিয়ে আগে গেলেও কখনো সে বস্তীর ভেতর ঢুকেনি। নোংরা বস্তী তার বরাবরই অসহ্য লাগতো। কিন্তু আজ তার আর কোন উপায় নেই। ছেলেটা কোথায় থাকে এটা তাকে জানতে হলে ছেলেটাকে অনুসরণ করতেই হবে! এরপর শম্মী ছেলেটাকে অনুসরণ করতে করতে বস্তীর ভেতরেও ঢুকে গেলো। বস্তীর ভেতরের অনেকগুলো গলি পাড় হয়ে যাওয়ার পরেও ছেলেটা হাটতেই থাকে। এবার শম্মী বেশ বিরক্ত হয়ে গেলো। সে ভাবছিলো, দুর! আজ এই ফালতু ছেলেটাকে অনুসরণ করাটাই ভুল হয়েছে!
গোমরামুখো একটা!!
এরপরেও শম্মী ছেলেটাকে অনুসরণ করা বন্ধ করে না। এরপর ছেলেটা হাটতে হাটতে যেখানে গিয়ে থামলো সেটা দেখে শম্মী পুরো নির্বাক হয়ে গেলো। শম্মী কল্পনাও করতে পারেনি যে ছেলেটা এই রকম একটা জায়গায় গিয়ে এইভাবে থেমে যাবে!
ছেলেটা একটা কবরের সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। শম্মী অবাক হয়ে দুর থেকেই ছেলেটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সে ছেলেটাকে কখনো হাসতে দেখেনি ঠিক আছে। কিন্তু কখনো কল্পনাও করেনি যে ছেলেটাকে এইভাবে কোনদিন কাঁদতে দেখবে! এরচেয়েতো ছেলেটার গোমড়া, মলীন, হাসিহীন মুখটাই বেশি ভালো! কিন্তু ছেলেটা এই কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে কেনো? এই কবরটাই কী তাহলে তার না হাসার কারণ? কিন্তু এই কবরটা কার? তার কোন আপনজনের?
শম্মী অনেকটা কৌতুহলতা আর অবাক মিশ্রিত দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে দূর থেকেই তাকিয়ে রইলো। যদিও ছেলেটা তাকে লক্ষ করে না। পাগলের মতো কাঁদতেই থাকে। এরপর হঠাৎ শম্মীর পেছন থেকে একটা মাঝবয়সী লোক শম্মীকে জিজ্ঞেস করে:
-কী হইছে মা? এইভাবে এইখানে দাঁড়াইয়া আছো কেন? কাউরে খুঁজো?
শম্মী হঠাৎ আৎকে পেছনের দিকে তাকালো। লোকটাকে দেখে মনে হয়, হয়তো লোকটা কোন রিক্সাওয়ালা বা দিন মজুর। লোকটার প্রশ্ন শুনে শম্মী কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবেই লোকটাকে বলে:
-ইয়ে মানে চাচা! ঐ ছেলেটা ঐ কবরের সামনে বসে কাঁদছে কেনো? এটা ছেলেটার কার কবর?
এরপর সেই লোকটা নিজের চেহারার মধ্যে কিছুটা বিষন্নতা আর মলীনতা এনে শম্মীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো:
-আর বইলো না মা! পুলাডার নাম আবির। পুলাডা অনেক ভালা আছিলো। পুলাডা সব সময় হাসি-খুশি থাকতো। ও নিজেও সারাদিন শুধু শুধু হাসতো আর আমরা যারা বস্তীতে থাকি সবাইরেই হাসতে শিখাইতো। ওয় কইতো হাসলে নাকি আয়ু বাড়ে আর শরীরো ভালো থাকে। পুলাডারে এই বস্তীর সবাই অনেক পছন্দ করতো। কিন্তু পুলাডার জীবন আছিলো বড় দুঃখের! ওর জন্মের ৩ মাস আগেই বাপ মইরা যায়। বাপের কোন জায়গা জমি ছিলো না। তাই আবিররে নিয়া ওর মা এই বস্তীতে চইলা আসে। বড় অভাবের সংসার ছিলো তাগো। আবিরের মা সেলাই মেশিন চালাইয়া আবিররে বড় করে। তার মায়ের স্বপ্ন আছিলো পুলারে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াইয়া শিক্ষিত করবো। আবিরেরে যখন ১১ বছর বয়স তখন ওর মায়ের একটা এক্সিডেন্ট হয়।
এক্সিডেন্টে তার মায়ের একটা হাত অবশ হইয়া যায়। এরপরে তাগো অভাব আরো বাইড়া যায়। বস্তীর আমরা কয়েকজন তাদের একটু সাহায্য করতে চাইতাম। কিন্তু আমরা যা রোজগাড় করি তাতে আমাগোই সংসার চলে না। তাই তেমন ভাবে তাগো কোনো সাহায্য করতে পারতাম না। এরপর ঐ বয়স থিকাই আবির বোতল টুকাইয়া, রাস্তা পরিষ্কার কইরা নিজের মারে দেখতো আর নিজে লেখাপড়া করতো। তয় ওর মনে এক ফোটাও দুঃখ আছিলো না। ও পৃথিবীতে ৩টা জিনিস অনেক বেশি পছন্দ করতো। তার মা রে, তার লেখাপড়া আর তার হাসি। এতোটা কষ্টের জীবনেও ওয় সব সময় হাসি মুখে থাকতো। ও বলতো, ও পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী। কারণ ওর পাশে ওর মা আছে! এইভাবে পুলাডা আরো বড় হয়! ওর লেখাপড়ার চাপ আরো বাড়ে। ও এক পর্যায়ে রিক্সা চালাইয়া ওর মায়ের দেখাশোনা আর লেখাপড়া চালাইয়া যায়! ও এই বস্তীতে একটা স্কুল খুলছিলো। ঐখানে ও সব বয়সী মানুষগো ফ্রিতে লেখাপড়া করাইতো আর মানুষরে সব পরিস্হিতিতে হাসতে শিখাইতো। এছাড়াও ও বাইরেও টিউশনী করাইতো।
এইভাবে পুলাডার দিন ভালোই কাটতাছিলো। দেখতে দেখতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাও দিয়া দিলো পুলাডা। সব পরীক্ষাতেই আবির ভালো রেজাল্ট করতো। ভালাই কাটতাছিলো আবিরের হাসি-খুশি দিনগুলা। কিন্তু সবার সুখ বিধাতার সহ্য হয় না রে মা! আবিরের সুখের জীবনডাও একরাতে পুরা শেষ হইয়া গেলো। সেই সময় আবিরের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল দিতে আর মাত্র কয়দিন বাকি! একদিন রাতে আবিরের মা হঠাৎ কইরা অনেক অসুস্থ হইয়া পড়লো। আমরা সবাই মিইল্লা আবিরের মারে নিয়া হাসপাতালে গেলাম! হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তার আমাগোরে যা কইলো তা শুইনা আমরা পুরাই অবাক হইয়া গেলাম। আবিরের মায়ের নাকি রক্তে কেন্সার হইছে! কথাটা শুইনা আবির পুরা পাগল হইয়া গেলো। এরপর ডাক্তার কইলো আবিরের মায়ের নাকি প্রায় ৩ মাস ধইরা এই কেন্সার। এখন অনেক দেড়ি হইয়া গেছে। তার মারে আর বাঁচানো সম্ভব না! অবশ্য আবিরের মা এই কেন্সারের কথা অনেকদিন আগে থিকাই জানতো। তয় আবিররে কয় নাই। কারণ সে জানতো যে আবিররে যদি সে এই কথা কইতো তাইলে আবির আর লেখাপড়া করতো না। আবির তার মায়ের চিকিৎসা নিয়াই ব্যাস্ত হইয়া পড়তো। এরপরে সেইরাতেই হাসপাতালেই আবিরের মা মইরা যায়। আবিরের মা মরার আগে আবিররে কইয়া গেছিলো যাতে সে অনেক লেখাপড়া কইরা একজন শিক্ষিত মানুষ হয়!
কিন্তু আবির তার মায়ের মইরা যাওয়ার পর টানা ৬ দিন অজ্ঞান হইয়া হাসপাতালেই ছিলো। ডাক্তার কইছিলো আবির হঠাৎ মানসিক আঘাত পাইয়া কোমায় চইলা গেছে!! ৬ দিনের ভেতর তার আর কোন জ্ঞান ফিরে নাই। তাই তারে ছাড়াই আমরা তার মায়ের কবর এই বস্তীর ভেতরই এই জায়গায় দিয়া দেই! এরপর আবিরের যেদিন জ্ঞান ফিরে সেদিন ও পাগলের মতো চারিদিকে ওর মারে খুঁজতে থাকে। এরপর আমরা তারে তার মায়ের কবরডা দেখাই। এরপর যে পুলাডার মুখের হাসি চইলা গেলো! আর কোনদিন হাসে নাই! এরপর থিকা আজ পর্যন্ত কেউই তার মুখের হাসি দেখে নাই! এরপরেও অনেকদিন পুলাডা খাওয়া,গোসল বাদ দিয়া সারাদিন পাগলের মতো তার মায়ের কবরের পাশেই পইড়া থাকতো। পুলাডায় লেখাপড়া বাদ দিয়া দিতে চাইছিলো। তাও আমরা জোর কইরাই পুলাডারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাইয়া দেই! পুলাডার প্রতি এই বস্তীর সবারই একটা আলাদা মায়া জন্মাই গেছে। পুলাডারে সেই ছোটবেলা থিকা আমরা দেখতাছি। পুলাডা আমাগো লাইগা কতোকিছু করতে চাইছিলো! এখন পুলাডা বাঁইচা থাইকাও মইরা গেছে। পুলাডার মুখে আর হাসি নাই! মায়ের ইচ্ছা পুরণ করতেই হয়তো জোর কইরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। তয় জোর কইরাও কখনো হাসে না!
লোকটা এতোটুকু কথা বলেই কাঁদতে কাঁদতে শম্মীর কাছ থেকে চলে যায়! শম্মীর নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে অঝড়ে পানি ঝরতে থাকে। শম্মী সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কাঁদতে থাকে! আর ভাবতে থাকে একটা ছেলে তার মাকে কী এতোটাও ভালোবাসতে পারে? একটা ছেলের জীবন কী এতো দ্রুত এতোটাই পাল্টে যেতে পারে? হাসি প্রিয় মানুষটার মুখের হাসিও কি এতোটা দ্রুতই বিলীন হয়ে যেতে পারে?! পৃথিবী কী এতোটাই নিষ্ঠুর?! শম্মী ভাবছিলো এতোটা কষ্ট আর দুঃখ নিয়ে একটা মানুষ বেঁচে আছে কি করে? আর তাইতো তার মুখে হাসি এতোটা অযৌক্তিক। হয়তো এর জন্যই ছেলেটা কখনো হাসে না! আর জানাও নেই কখনো হাসবে কিনা?!
শম্মী ভাবছিলো আসলেই তার এই অপরিচিত ছেলেটা সম্পর্কে এতো কিছু জানা উচিত হয়নি! শম্মীও ছেলেটার প্রতি এক অজানা অদ্ভুত মায়ায় আটকে যায়। সে কল্পনাও করতে পারে নি যে তার মনে জাগা ছেলাটা হাসে না কেন ? এই প্রশ্নের উত্তর এতোটা আবেগী আর কষ্টের হতে পারে ! শম্মী সেখানেই অনেক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো সে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে ছেলেটার মুখের সেই পুরোনো হাসি দেখার জন্য!! শম্মী ভাবে, ছেলেটা হাসলে কি আসলেই তাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগবে?!