হঠাৎ দেখা

হঠাৎ দেখা

সমীর চলে গেছে দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেল। নীলা এখন খানিকটা সামলে নিয়েছে, সমীরের মা এবং তাদের ছোট্ট মেয়ে তিতলিকে নিয়ে দিন চলছে। নীলা সমীরের চাকরিটা পেয়েছে, তাই সংসারটা চালিয়ে নিয়ে যেতে তাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি। তবে দিনের শেষে যখন বাড়ি ফেরে, বাসের জানালা দিয়ে যখন বাইরে তাকিয়ে থাকে, তখন কোথাও একটা নিঃসঙ্গতা অনুভব করে, ক্লান্ত দুটো চোখ আজও খুঁজে ফেরে সমীরের হাসি ঠাট্টা। তারপর বাড়ি পৌঁছে হাজারো কথার ভিড়ে সব হারিয়ে যায়। তখন কেবল তিতলি আর তার ঠাম্মির নানান কান্ড-কারখানার গল্প শুনতে হয়। তার শাশুড়ি মা যে এখন আর সমীরের মা নয়, সে যে তার মা। সব মিলিয়ে তিন জনের সংসার।

সকালে রোজ যেমন তিতলির স্কুলে যাওয়ার আগে জলখাবার তৈরী করে, আজ তেমনটি করছিল নীলা। মা কাছে এসে বললেন, “নীলা, আজ একটু অফিস থেকে আগে ছুটি নিতে পারবি? যদি হাফ ডে হয় তো খুব ভালো হয়। তাহলে তোকে নিয়ে একটু বেরোতাম, সন্ধের যানজটে শহরের রাস্তায় বেরোতে ইচ্ছে করে না, তাই আর কি।”

-“ঠিক আছে মা। আজ তো মাসের প্রথম, খুব একটা চাপ নেই। আমি অফিসে পৌঁছে একটু কথা বলে তোমাকে জানিয়ে দেব। তুমি তৈরী থেকো, আমি তোমাদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে যাব।” তারপর একটু থেমে বলল, “তাহলে মা আজ আমরা তো বাইরে লাঞ্চ করতে পারি! অনেকদিন তো বাইরে খাওয়া হয় না, তুমি সকালে একটু বেশি করে খেয়ে নিও, তাহলে অসুবিধে হবে না।”
-“দুর বোকা মেয়ে! এই বয়সে বেশি খেতে নেই, বুঝলি?” এই বলে নীলার গালে আলতো আদর করে বললেন, “যাই দেখি, আমার দিদিভাই কি করছে! স্কুল বাস আসার সময় হয়ে গেল তো।”

অফিসে যাওয়ার পথে যদি বাসে বসবার জায়গা পেল, তবে নীলা কানে হেডফোন দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে যায়। আজ একটা জায়গা পেয়েছে, তাই কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছে। সমীর বেঁচে থাকাকালীন নীলা বেশ গান গাইত, আর সমীরের বন্ধুমহলে একপ্রকার অহংকার করেই বলত, “তোরা যাই বলিস না কেন, আমার নীলা ভারী সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গায়! আমি একপ্রকার ওকে প্রথম যেদিন দেখতে যাই সেদিনই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এক শ্রাবণের সন্ধ্যায় নীলাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আর ওকে গান করতে বলায় একটু দূরে বসে হারমোনিয়ামে গেয়েছিল ‘আমার নিশীথ রাতে শ্রাবন ধারা।’ উফফ! এখনো সেই দিনটা ভুলতে পারিনা।” হঠাৎ বাসের ড্রাইভার বেজায় জোরে ব্রেক কষতেই মুহূর্তের মধ্যে সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল নীলার। না, আজ আর সে গান গায় না, শুধুই শোনে আর পুরোনো দিনগুলির পাতা ওল্টায়।

অফিসে পৌঁছে কয়েকটা দরকারি কাজ সেরে বসের রুমে ঢুকে হাফ ডে ছুটির কথা বলে নীলা তার মাকে ফোন করতে যাবে এমন সময় হঠাৎ রিসেপশনের দিকে চোখ গেল। মনে হল কাঁচের ফাঁক দিয়ে দেখা এক ঝলক চেহারাটা যেন নীলোৎপলের। “কিন্তু ও এখানে কেন আসবে, ধুর আমি যে কাকে দেখতে কাকে দেখছি!” এই ভেবে আবার মা কে ফোন করল এবং সব জানিয়ে রাখল, মানে কখন বেরোবে তারা, তিতলি ফিরেছে কিনা এই সব।

-“নীলাদি, তোমাকে একটু স্যার ডাকছেন”, রমেন এসে তার ডেস্কের সামনে বলে গেল। -“এই তো স্যারের সঙ্গে কথা বলে এলাম, আবার কেন? যাই দেখি কি বলেন।” দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে স্যার বললেন, “ইয়েস, কাম ইন। আরে নীলা, এসো। তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, তাই আবার ডেকে পাঠালাম।” ভেতরে ঢুকতেই নীলা দেখল সেই ভদ্রলোক যাকে রিসেপশনে দেখছিল, তিনি স্যারের দিকে মুখ করে বসে আছেন।

-“এসো বসো, আলাপ করে দিই। উনি হলেন নীলোৎপল বসু, আমাদের নতুন প্রজেক্টের জন্য তোমার সঙ্গে কাজ করবেন।” দুজনে মুখোমুখি নমস্কার করল, সেই সময় চোখে চোখ পড়তে দুজনে যে ভালো করে চিনে গেল সেই বিষয়ে আলাদা করে কিছু বলার অপেক্ষা র‌ইল না। সৌজন্যমূলক কথাই হল, কারণ নীলাকে বেরোতে হবে। তাই স্যার আবার বললেন, “কাল থেকে দুজনে বসে ডিটেইলে ডিসকাস করে নিও, আজ তো নীলাকে একটু বেরোতে হবে। আর নীলা, তুমি তো সিনিয়র, এর আগে সমীর থাকাকালীন যেমন ভাবে আমরা সাকসেস হয়েছিলাম সেটা তোমার সময় ব্যতিক্রম হয় নি। তাই এবার ও আশা করব তেমনটাই হবে।” -“নিশ্চয় স্যার! আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব, আর তো উনি আছেন।” এই বলে হালকা হাসি হেসে বেরিয়ে গেল নীলা।

ঘরের মধ্যে এসি থাকা সত্ত্বেও কেমন যেন দমবন্ধ লাগছিল নীলার। কিন্তু বাইরে থেকে সেটা কোনো ভাবেই বুঝতে দিতে চাইছিল না। আর সেটা তে যে সফল হয়েছে। এখন রাস্তায় বেরিয়ে রোদের মধ্যেও যেন হালকা বাতাস তার শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার মন? সে যে পুরোনো সিন্দুক খুলে একটার পর একটা দিন গুনতে চাইছে। “আমাকে যে শক্ত হতেই হবে। মা এর কথা, তিতলির কথা ভাবতে হবে। তারাই যে আমার শক্তি, বল, ভরসা।” মনে ভাবল নীলা। উবার এসে তাদের ফ্ল্যাটের নিচে এসে দাঁড়াতেই মা এবং তিতলি গাড়িতে উঠে বসল।

-“কি রোদের তেজ রে! এই নে।” বলে একটা বোতল নীলার দিকে এগিয়ে দিতে, নীলা বলল, “মা আমার ব্যাগে জল আছে তো!”-“আরে এটা জল নয় রে, আম পোড়া শরবত করেছি। খেয়ে নে তো, নাহলে আবার গরম হয়ে গেলে ভালো লাগবে না।” -“তুমি পারো বটে মা! এই গরমে দু’দন্ড বিশ্রাম নিতে পারো না? দাও খাচ্ছি। …এবার বলো কোথায় যাবে? বাঙালি কোনো রেস্তোরাঁ, নাকি চাইনিজ খাবে?” পাশ থেকে তিতলি বলে উঠল, “ঠাম্মা, আমি চাইনিজ খাব। তুমিও তাই খাবে তো।” -“এই তো, আমার উত্তর দিয়ে দিয়েছে।” নীলা এবার চোখ বড় করে তিতলিকে বলল, “ঠাম্মা কে বলেছি, তো তুমি বললে তো হবে না।”
-“না রে নীলা, ও ঠিক বলেছে। চল কোন চাইনিজ রেস্তোরাঁতেই যাই।”
-“তুমি তো নাতনির কথায় একমত হবেই, চলো তাই যাই।”
লোকেশন বলে দেয়া হল ড্রাইভারকে।
লাঞ্চ সেরে শপিংমলের থেকে খুব সুন্দর একটা এথেনিক ওয়্যার কিনে দিলেন নীলাকে, আর তিতলিকে একটা গরমে পড়ার সুন্দর জামা।
“মা, এসব আবার কেন? আমার এখন আর কিছু ভালো লাগে না, আর অফিসে পরার জন্য তো আছেই।”
-“তা বললে কি হয় রে নীলা! তোর মা থাকতে জন্মদিনে কিছু দেবে না সেটা তো হয় না রে। এটা পরিস অফিসে যাওয়ার সময়। সেইজন্য এমনটা বেছে নিলাম।”

বাড়ি ঢুকে রাতের খাবার শেষে যখন বিছানায় গেল তখন আবার অফিসের কথা মনে পড়ল। কাল থেকে বেশিরভাগ সময় নীলোৎপলের সঙ্গে সময় কাটবে। …আচ্ছা ও কি আবার পুরোনো প্রসঙ্গে কথা বলবে!… নাকি একদম নতুন করে কলিগের মতো শুরু করবে?… ঘুম আসছে না নীলার। তাই আবার কানে হেডফোন দিতেই বেজে উঠল, ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ আর হঠাৎ দেওয়ালে টাঙানো সমীরের হাসিমুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। “ইশ! আমি কার কথা ভাবছি! ছি ছি!” এই বলে হেডফোনটা খুলে পাশ ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ল নীলা। গতকাল রাতে একটুও ঘুম হয় নি আয়নায় নিজের মুখ দেখে বুঝতে পারল সে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে অফিসে রওনা হল। অফিসে পৌঁছে কাজের মধ্যে ডুবে গেল নীলা। কোনোরকম বাড়তি কথা বলার সুযোগ দেয় নি। নীলোৎপল অনেকবার কাজের মাঝে কিছু বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না। তারপর লাঞ্চ ব্রেকে একটু সুযোগ পেল, অল্প কথায় নীলা নিজের কথা বলল। এবং সেই সময় জানতে পারল নীলোৎপল বিয়ে করেছিল, তবে ডিভোর্স হয়ে গেছে বছর তিন আগে।

ধীরে ধীরে প্রজেক্টের কাজ এগোচ্ছে, স্যার ভীষণ খুশি তাদের কাজ দেখে। নীলার আজকাল তেমন নিঃসঙ্গ মনে হয় না, অফিসে কাজের মাঝে কলেজের বন্ধুকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে কাজের গতি বেড়েছে। মাঝে মাঝে কলেজের দিনগুলির কথা উঠে আসে।

আজ ৭ই মে, নীলার জন্মদিন। সকাল বেলা তার শাশুড়ি মা পায়েস করে টেবিলে নিয়ে এসে হাজির, “অফিস যাওয়ার আগে এটা মুখে দিয়ে তবে ঘর থেকে বের হবি, বুঝলি? আজ বকবো না তাই কথা শুনতে হবে।” স্নান সেরে নীলা মাকে প্রণাম করতে তিনি বললেন, “এবার তোর জীবনটা যদি একটু সাজিয়ে দিতে পারতাম তবে শান্তি পেতাম।” নীলার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। তা বোঝার আগেই তিতলি হাতে আঁকা কার্ড তার দিকে নজর গেল, হাতে নিয়ে মুচকি হেসে বলল, “দেখো মা, আমার মেয়ে বড় হয়ে গেছে। নিশ্চয় তুমি বলেছো ওকে।” -“হুম, কাল রাতে গল্প করতে করতে বলেছি ‘আজ পায়েস করতে হবে মায়ের জন্য’ তখন ও বুঝে গেছে।” নীলা নিজের ঘরে গিয়ে সমীরের ফটোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, “কেউ তোমার জায়গা পূরণ করতে পারবে না, কেউ না! ও জায়গা যে এখনো তোমার‌ই আছে সমীর।”

অফিসে ঢুকে রোজকার মত কাজে ডুবে গেল নীলা। তারপর একটু ফাঁকা হতেই ডেস্কের একটা ফাইল সরাতে নজরে এলো দুধ সাদা গ্লাডিওলাস আর সঙ্গে ছোট্ট একটি নোট ‘শুভ জন্মদিন নীলা, ভালো থেকো।’ নীলা কয়েক বছর পিছিয়ে কলেজ জীবনে চলে গেল। অনার্স ক্লাসের ডেস্কের ভিতরে প্রতি বছর ঠিক এই লেখা সহ এই রকম ফুল রাখা থাকত। “তবে সে নীলোৎপল! কিন্তু কোনো সময় তো মনে হয় নি ও আলাদা চোখে দেখছে, তবে কি ও আমাকে…” হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে এল, “ছি ছি এ আমি কিসব ভাবছি।” সারাদিন কাজ করে সেই ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরল। মা দেখলেন, কিন্তু কিছু জানতে চাইলেন না। সাজিয়ে রাখলো যত্ন করে।

এমনি করে দুদিন অফিস করল, প্রজেক্টের প্রেসেন্টেশন ভীষণ ভালো হয়েছে। আজ নীলা অফিস থেকে রিলাক্স মুডে ফিরছে, ক্লান্ত লাগছে না, মনে প্রশান্তি। বাড়ি ঢুকে একটু রেস্ট নিতে মনে হল, আজ তো রবীন্দ্র জয়ন্তী। মা এবং তিতলি ক্লাবে গেছে। অনুষ্ঠানে নাচবে তিতলি, তাই একা নীলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ভেসে আসা রবীন্দ্রসংগীত শুনছে। মোবাইলে হোয়াটস্ অ্যাপ টোন বেজে উঠতেই বিছানায় রাখা মোবাইলটা চেক করতে দেখে নীলোৎপল মেসেজ। খুলে পড়তে দেখে তাতে লেখা, “আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি?” বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল নীলার। ছুটে গেল বেডরুমে, সমীরের ফটোর কাছে গিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল, “তুমিও কি আমাকে ভুল বুঝছ সমীর?” তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলল, দাঁতে দাঁত চিপে মোবাইল হাতে নিয়ে লিখল, ‘আমি মিসেস সেন বলছি। আপনি বোধহয় ভুল করে আমাকে উপরের মেসেজটা পাঠিয়েছেন মিস্টার বসু।’

বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো আকাশের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে উঠল, “এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত