হরেনদাদুর অঙ্ক

হরেনদাদুর অঙ্ক

“বসে বসে এত কী ভাবছ, দাদু?”

বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে রুনু দেখল, দাদু রোয়াকে অন্যমনস্ক হয়ে চুপচাপ বসে আছেন। নতুন চাকরির চাপে অন্যদিন ভালো করে কথা বলাই দায়। আজ ছুটি বলে রুনু একটু গল্প করার জন্য দাঁড়িয়ে গেল।

“কিছুই নয়, হাবিজাবি এইসব,” নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বললেন হরেনবাবু।

নব্বই ছুঁই ছুঁই হরেনবাবু চাকরি জীবনে অঙ্ক পড়াতেন। নিয়মমাফিক অবসর নেওয়ার পরেও পড়াশুনো নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, সঙ্গে ছিল সমাজসেবা। ইদানিং শারীরিক কারণে ছোটাছুটি একেবারেই বন্ধ, কিন্তু ভাবনাচিন্তার পরিধিতে অঙ্ক, দেশ, শিক্ষা, সমাজ সব আছে। বরাবর বিশ্বাস করে এসেছেন সে আমলের দুটো বিখ্যাত কথায় – ‘শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ’ আর ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। সেই বিশ্বাস ঘিরেই হরেনবাবুর বেড়ে ওঠা থেকে বুড়ো হওয়া; অনেক আশার শুরু, অনেক আশাভঙ্গ। তাই তো স্বাধীনতা দিবসে সকাল সকাল বাড়ির রোয়াকে এসে বসেছেন। সামনের রাস্তা দিয়ে বিভিন্ন স্কুলের প্রসেশনগুলো যাবে, উৎসাহে ভরপুর ছাত্রছাত্রীরা ‘দেশ’ নামের ধারণাটার শরিক হচ্ছে – এ তিনি দু’চোখ ভরে দেখবেন।

কিন্তু একটা চিন্তা হরেনবাবুকে কুরে কুরে খাচ্ছে। অনেকদিন আগে তাঁর মতো কিছু লোকের উদ্যোগে শুরু হওয়া বস্তির বাচ্চাদের একটা স্কুল এখন বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে। যতদিন পেরেছেন নিজে তদ্বির-তদারক করেছেন; তারপরেও খবরাখবর রাখতেন। শেষ খবর পেয়েছেন, টাকাপয়সার সংস্থান হচ্ছে না, হাল ধরারও কেউ নেই। স্বাধীনতা দিবসে বেশি করে মনে পড়ছে বাচ্চাগুলোর মুখ, আর নিরুপায় হয়ে আরেকটা আশাভঙ্গের যন্ত্রণা সইছেন তিনি। দীর্ঘ জীবনে হরেনবাবু বারবার লক্ষ করেছেন, ভেঙে যাওয়া আশার মধ্যে থেকেই নতুন স্বপ্ন জন্ম নেয় ফিনিক্স পাখির মতো। তাই আশার একটা ক্ষীণ আলো নিয়ে এখনও তিনি নাড়াচাড়া করছেন মনের মধ্যে।

“বসে বসে এত ভাবার কী আছে! আজ তোমার কষার মতো অঙ্ক নেই নাকি!” রুনু জানে দাদুর সঙ্গে অঙ্ক নিয়ে কথা শুরু করাটাই ভালো।

টোপটা কাজে লেগে গেল।

“অঙ্কই তো করছিলাম। আমাদের স্বাধীনতা দিবসের ভেতর কত অঙ্ক আছে, ভেবেছিস কখনও?”

“সে তো রাজনীতির অঙ্ক, আমাদের অঙ্কের বাইরে।”

“দূর বোকা, অঙ্কের বাইরে কিছু হয় নাকি! আচ্ছা, এক এক করে বল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয় কবে?”

“সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট।”

“সাতচল্লিশ সংখ্যাটা শুনে কী মাথায় আসে তোর?”

“একটা প্রাইম নাম্বার। ওকে অন্য সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায় না।”

“তার মানে ভারতকেও ভাগ করা যাবে না। স্রেফ প্রাইম?”

“সেফ প্রাইম। কারণ তেইশের দু’গুণ করে এক যোগ করলে সাতচল্লিশ হয়, তেইশও প্রাইম নাম্বার।”

“তাই হাজারটা সমস্যার মধ্যেও দেশটা ‘সেফলি’ এগোচ্ছে। আর বল।”

“সাতচল্লিশ লুকাস সিরিজে আছে।”

“লুকাস মানে কী?”

“গ্রীক ভাষায় লুকাস মানে যে সৌন্দর্য, আলো আর ভালোবাসা নিয়ে আসে।”

“ভারতও দুনিয়াকে আলো দেখাবে, দেখিস। সাতচল্লিশ ক্যারল নাম্বারও বটে। ক্যারল মানে আনন্দে ভরা, বন্ধুত্বে ভরা। বুঝে দেখ বছরটার মহিমা!”

“বুঝলাম।”

“তোদের ধৈর্য্য এত কম কেন বুঝি না! শুরুতেই শুধু সাল থেকে সব বুঝে গেলি! দিনটা দেখলি না, পনেরো তারিখ!”

“বল, তুমি তো না বলে ছাড়বে না!”

কথায় বিরক্তি দেখালেও রুনু আলোচনাটা চালিয়ে যেতে চায়। দাদুর সঙ্গে আড্ডাতেও অনেক শেখার জিনিস থাকে।

হরেনবাবুও ছদ্মরাগ দেখিয়ে বলেন, “এই বুড়োটা বকবক করবে আর তুই মজা লুটবি! তোকেই বলতে হবে।”

“কে বকবক করছে, তা দেখাই যাচ্ছে।”

“বকবকানি দেখা যায় না, শুনতে হয়।”

“ঠিক আছে, বলছি। পনেরো ট্রায়াঙ্গুলার নাম্বার। একটা লাইনে পাঁচটা ফুটকি দিয়ে শুরু করে তার ওপরে চারটে, তারপর তিনটে, দুটো একেবারে মাথায় একটা, মোট পনেরোটা ফুটকি দিয়ে একটা সমবাহু ত্রিভুজ তৈরি হবে।”

“তার মানে তিল তিল করে গড়ে ওঠা দেশে রোটি, কপড়া আর মকানে সবার সমান অধিকার।”

“মুন সাইন থিওরি মেনে পনেরো একটা সুপার সিঙ্গুলার প্রাইম নাম্বার, সাতচল্লিশও তাই ছিল।”

“তবে দেখ, সাল তারিখ সবই সুপার সিঙ্গুলার। ভারতের একমেবাদ্বিতীয়ম হওয়া আটকায় সাধ্যি কার!

“তা বটে। কিন্তু চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধতা বা শান্তি কই? হানাহানি তো লেগেই আছে।”

“আহ্‌, সুপার সিঙ্গুলার হতে গেলে স্পোরাডিক গ্রুপ, মনস্টার গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে তো! তাই একটু আধটু ওসব হবে।”

“ভালো, সব ভালো! এরপরে বলবে ফসফরাসের অ্যাটমিক নাম্বার পনেরো, তাই ভারত অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করবে।”

“তোর সন্দেহ আছে? কেমিস্ট্রির কথা যখন তুললি, পিরিয়ডিক টেবিলে গ্রুপ ফিফটিন কী বল তো?”

“নাইট্রোজেন।”

“বাতাসে সবথেকে বেশি থাকে। একদিন ভারতের গরিমাও সবচেয়ে বেশি হবে।”

“বুঝেছি, পনেরো আর সাতচল্লিশে ভর করে ভারতবর্ষ আকাশ ছোঁবে!”

“মাঝের আটটাকে বাদ দিচ্ছিস কেন?”

“বাদ দিলে তুমি ছাড়বে? ওটা একটা পারফেক্ট পাওয়ার নাম্বার, কম্পোজিট নাম্বারও বটে।”

“বুঝলি তো, ভারত অনেকরকম জাতিধর্মের কম্পোজিশানের মধ্যেও পারফেক্ট পাওয়ার হবে।”

“রক্ষে কর, অনেক হয়েছে।”

“আগের বার কেমিস্ট্রির কথা তুই তুলেছিলি। এবার আমি বলি, কার্বনের আটটা ন্যাচারাল অ্যালোট্রোপ আছে। ভারতেরও বহুরকম রূপ থাকবে কিন্ত ভেতরে ভেতরে সব এক।”

“উফ্‌!”

“হাঁফিয়ে গেলি? একটু অক্সিজেন নে। অক্সিজেনের অ্যাটমিক নাম্বার আট। ভারত দুনিয়াকে অক্সিজেন, মানে বাঁচার রসদ যোগাবে।”

“আমার তো আট বললে মাকড়সা বা অক্টোপাসের কথা মনে পড়ে। অষ্টচরণ ষোলো হাঁটু নিয়ে দেশটা জেরবার হয়ে যাচ্ছে; সমস্যার শুঁড় চারদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। আচ্ছা মেনে নিলাম, পনেরো-আট-সাতচল্লিশ-এ স্বাধীনতা পেয়েছে বলে ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’। কিন্তু কবে?”

“এই এক মস্ত দোষ তোদের। ভালো জিনিস ছেড়ে খারাপটা আগে দেখিস।”

“সাদা চোখে প্রতিদিন যা দেখছি, তাই বলছি।”

“দেখারও চোখ লাগে রে! একটু অপেক্ষা কর, এইবার সব হবে।”

“সত্তর বছর পেরিয়ে গেল, আরও কতদিন লাগবে?”

হরেনবাবু কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনে মনে কী অঙ্ক করলেন কে জানে। হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বললেন, “আজকের তারিখ কত?”

“পনেরোই আগস্ট।”

“পুরোটা বল।”

“পনেরো-আট-সতেরো।”

“সংখ্যা তিনটে একটা পিথাগোরিয়ান ট্রিপল কি না?”

আটের স্কোয়ার আর পনেরোর স্কোয়ার যোগ করলে সতেরোর স্কোয়ারই হয় বটে। এই হিসেবটা বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কে প্রথম হিসেব করেছে জানা নেই, কিন্তু তাঁর উদ্দেশে হ্যাটস অফ করেছে রুনু।

“সংখ্যা তিনটে একেবারে প্রিমিটিভ পিথাগোরিয়ান ট্রিপল, খেয়াল করেছিস?”

“তাই দেশটাও প্রিমিটিভ এজে রয়ে গেল।”

বলল বটে, কিন্তু অবাক হল রুনু। সত্যিই তো আট, পনেরো আর সতেরোর কোনও কমন ফ্যাক্টর নেই। বিস্ময়ে রুনুর মুখটা একটু হাঁ হয়ে গেছিল বোধহয়।

“মুখ বন্ধ কর। প্রিমিটিভ কথাটার কি একটাই মানে? প্রিমিটিভ মানে প্রাচীনও হয়, মৌলিকও হয়। দেশটার মধ্যে কতরকম মৌলিকতা আছে বল তো।”

“শেষ হল তোমার অঙ্কের প্যাঁচ?”

“একটু বাকি। এই ট্রিপলের সবচেয়ে ছোটো সংখ্যা আট একটা জোড় সংখ্যা। তার মানে এই ট্রিপলেটটা প্লেটোনিক সিকোয়েন্সে আছে। ভারত প্লেটোনিক ভালোবাসায় বিশ্বাসী।”

“মানেটা কী দাঁড়াল?”

“মানে এই তোদের মতো হতাশাবাদীদের হতাশ করে ভারতবর্ষ হু হু করে এগোবে। এত অঙ্কযোগ আগে কখনও হয়নি।”

“সত্তর বছরটা কম সময় নয় দাদু। এতদিন কিছুই হল না, আজ হঠাৎ করে সব বদলে যাবে?”

“নয় তো কী! এই পিথাগোরিয়ান ট্রিপল নিয়ে ফার্মা’স লাস্ট থিওরেম-এর সমাধান হতে কতদিন লেগেছে! বইয়ের মার্জিনে ফার্মার লেখা ছোট্ট একটা মন্তব্য অঙ্কের দুনিয়াকে সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে নাকানি-চোবানি খাইয়েছে। বহুবার সমস্যাটার সমাধান পাওয়া গেছে বলে হৈচৈ হয়েছে। কিন্তু সে সমাধানের মধ্যেকার গোলমাল কিছুদিন পরেই ধরা পড়েছে।

“মিলেনিয়াম প্রবলেম কি আর সাধে বলে!”

“তাই বলছি, একটু অপেক্ষা কর। তোদেরও এই ‘হল না, হচ্ছে না’ ভুল প্রমাণ হবে একদিন। লাস্ট থিওরেম-এর সমাধান খুঁজতে গিয়ে অঙ্ক নতুন করে অনেক ডালপালা ছড়িয়েছে। ভারতের ভালোমন্দ খুঁজতে গিয়ে অনেক নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেশটাকে দেখতে পাবি।”

“তুমি এবার চুপ করবে! আমাকে বাজার যেতে দাও।”

“চুপ করব, যদি তুই আমার একটা কাজ করে দিস। রবির দোকানে বলা আছে, কেক, লাড্ডু, ডিমসেদ্ধ দিয়ে পঞ্চাশটা ঠোঙা বানিয়ে রাখবে। ঠোঙাগুলো তুই তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিবি আজাদ কলোনির বাচ্চাদের স্কুলে।”

“দেখছি।”

“দেখছি নয়, তোকে করতেই হবে। বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো বস্তির বাচ্চাগুলো স্বাধীনতা দিবসের নাম করে একদিন তো একটু আনন্দ করুক! এই সামান্য জিনিসের জন্য বাচ্চাগুলোর মুখের হাসিটা দেখবি শুধু। ওদের ওই বিশাল আনন্দকে ছোট্ট হাসি দিয়ে বুঝতে গেলে লগারিদম ছাড়া উপায় নেই রে, দাদুভাই।”

তারপরে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, “আর বোধহয় স্কুলটা চলবে না। বাচ্চাগুলো একটু পড়াশুনোর সুযোগও হারাবে। হয়তো এদেরই কেউ বড়ো হয়ে একটা পেট ভরানোর কল বানাত বা যুদ্ধ বন্ধ করার উপায় বার করত।”

রুনু দাদুকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল, “তোমাকে ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। স্কুলের জন্য টাকাপয়সার জোগাড়ের চেষ্টা আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে করছি, কিছু ব্যবস্থা হয়েছে। আর শুনে রাখো, আজ রাত্রে ওখানে বাচ্চাদের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাত, ডাল, মাংস, চাটনি, রসগোল্লা – এই হল মেনু।”

শুনে আনন্দ হলেও বাস্তব অঙ্কটা ভেবে প্রশ্ন করলেন হরেনবাবু, “এত খরচ, পয়সা আসছে কোথা থেকে?”

“চাকরি পাওয়ার আনন্দে খরচ আমি দিচ্ছি। তোমারই নাতি তো।”

ভালো কিছু করার আনন্দ প্রকাশ হয়ে পড়ল রুনুর কথায়। বলছি বলব করেও দাদুকে বলা হয়ে ওঠেনি এতদিন। একটা রিক্সা করে দাদুকে আজাদ কলোনি থেকে ঘুরিয়ে আনার কথাও ভাবল রুনু।

বলিরেখায় ভর্তি হরেনবাবুর মুখটা চকচক করে উঠল খুশিতে। অনেক ভাঙাগড়া দেখতে অভ্যস্ত ঘোলাটে চোখদুটো ঝিকিয়ে উঠল। ব্যাটা চুপে চুপে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো অভ্যেস করে ফেলেছে! কী বলবেন ঠিক করে উঠতে না পেরে চুপ করে বসে রইলেন। মনে মনে ভাবলেন, ভালো কাজগুলো সব ডিসক্রিট ফাংশন। ঠিক মতো ইন্টিগ্রেট করতে পারলে দেশের একমেবাদ্বিতীয়ম হওয়া আটকাবে না। আর নতুন করে আবার বুঝলেন, আশা একটা পজিটিভ কন্টিনিউয়াস ফাংশন, কখনও কখনও ট্রেন্ডস টু জিরো হলেও নন রিটার্ন টু জিরো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত