কোণার্কের দেবতা

কোণার্কের দেবতা

দোলনরা এবার পুরীতে বেড়াতে এসে খুব ঘুরছে। সমুদ্রে চান করতে দোলনের খুব মজা। দুদিন ধরে ওরা শুধু পুরীতেই থাকল। আর কোথাও গেল না। আর অনেক অনেক ঝিনুক কুড়ুলো দোলন আর টুবলু।

সেদিন বিকেলে বাবা বলল, “কালকে আমরা পুরীর আশেপাশে ঘুরে দেখব।”

দোলনের তাই শুনে জিজ্ঞাসা, “আমরা কোথায় কোথায় ঘুরব বাবা?”

“এই নন্দন কানন, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি আর অবশ্যই কোণার্ক।”

“বাঃ কোণার্ক সেখানে যেতে যে আমার খুব ভালো লাগবে, ওহ্‌কত বড়ো সূর্য মন্দির!”

“হ্যাঁ কোণার্কের সূর্যমন্দির খুব খুব বড়ো।”

ওরা সেদিনকে একটু আগে আগেই শুয়ে পড়ল। পরদিন ভোর ভোর উঠে বেরোতে হবে। ঠিক সময়ে যেতে না পারলে বাস আর ওদের জন্যে দাঁড়াবে না, ছেড়ে দেবে।

খুব ভোরেই দোলনের ঘুম ভেঙে গেল মায়ের ডাকে, “অ্যাই দোলন ওঠ দেখছিস না বেলা হয়ে গিয়েছে।”

মায়ের ডাকে দোলন ধড়ফড় করে উঠে পড়ে ভাইকে ডাকতে থাকে। টুবলু তখনও ভালোই ঘুমোচ্ছে ও দোলনকে বলে দিদি এত সকালে ডাকছিস কেন, আমায় একটু ঘুমোতে দেনা।”

“অ্যাই টুবলু তুই নন্দন কাননে যাবি না?”

নন্দনকাননের কথা শুনে টুবলু কি আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে? সেও সোজা ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। ওর আবার পুরীতে আসার মূল আনন্দ হচ্ছে নন্দনকাননের সাদা বাঘ আর অন্য জীবজন্তুদের দেখা।

মা সমানে তাড়া দিচ্ছে, “তোদের এই দিদি ভাইয়ের জন্যেই সব জায়গায় দেরি হয়ে যায়, তাড়াতাড়ি কর নাহলে কিন্তু বাস আমাদের না নিয়েই চলে যাবে।”

ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল। বাসে হইহই করে দুজনে উঠে পড়ল। নন্দনকাননে গিয়ে টুবলুর কী মজা। ও অনেক আনন্দ করল, দোলনেরও নন্দনকাননে গিয়ে খুব মজা কিন্তু ওর অপেক্ষা কখন কোণার্ক আসবে। সূর্য মন্দির কখন আসবে। আগেরবার যখন এসেছিল তখন দোলন অনেক ছোটো কিন্তু তখনকার কথা ওর এখনও ভালোই মনে আছে।

বাসে এবার যে গাইড ছিল সে ঘোষণা করল, “এবারে আমাদের গন্তব্য হচ্ছে কোণার্ক। ওখানে আমরা বিখ্যাত সান টেম্পল বা সূর্য মন্দির দেখব।”

তারপর গাইড আরো নানা কথা বলে যেতে থাকে ওই সূর্য মন্দির নিয়ে। দোলনের অবশ্য সেইসব কথা মাথায় ঢোকে না। ওর চোখের সামনে তখন ভেসে উঠেছে ওই বিখ্যাত সূর্য মন্দির।

দোলেনের এইসব ভাবার মধ্যেই কখন যে সূর্যমন্দির চলে এসেছে তা তো খেয়ালই করেনি।

হঠাৎ গাইড ঘোষনা করল, “আমরা এবার কোণার্কের সূর্য মন্দিরের খুব কাছে চলে এসেছি, আপনারা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই সূর্য মন্দির দেখতে পাবেন।”

সেইমতো সবাই জানলা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে, হ্যাঁ ওই তো সেই বিখ্যাত সূর্য মন্দির। দোলন তক্ষুনি বাস থেকে নামতে যায়। গাইডের বারণ “ না না এক্ষুনি নেমো না, এখনও সূর্য মন্দির আরেকটু দূর আছে, বাস আরেকটু যাবে।”

দোলনের আর অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না। ওর ইচ্ছা করছে ও ছুটে গিয়ে ওই সূর্যমন্দিরের কাছে চলে যায়। কিন্তু এখন যাওয়া যাবে না বাসটা চলছে। আরেকটু দূরে গিয়ে বাসটা থামল।

দোলন সোজা ছুট লাগাল সূর্য মন্দিরের দিকে। ওর বাবা-মা দুজনেই চ্যাঁচাচ্ছে, “অ্যাই দোলন ছুটিস না, দেখছিস না আমরা সবাই একসঙ্গে যাচ্ছি।”

দোলন আর কী করে মায়ের বারণ, ও না শুনে পারে না, ওরা চারজনে একসঙ্গে আস্তে আস্তে সূর্য মন্দিরের দিকে গেল। দোলন আর টুবলু সূর্য মন্দিরের চারপাশে অনেক ছবি তুলল। মন ভরে ওরা সূর্য মন্দির দেখছে। ওরা দেখছে ওখানে ছবি তোলার জন্যে অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা দোলনদের শুধু বলছে, “আপনাদের একটা ছবি তুলে দিই, খুব ভালো করে তুলে দেব।”

বাবা তাই শুনে বলল, “না না আমাদের নিজেদের ক্যামেরা আছে তোমাদের আর ছবি তুলতে হবে না।”

“তবুও আমাদের ক্যামেরায় একটা ছবি তুলুন, দেখবেন খুব ভালো হবে।”

“না বললাম তো আমাদের ছবি তোমাদের তুলে দেওয়ার কোন দরকার নেই।”

“তাহলে স্যার আপনাদের ক্যামেরায় আপনাদের সবার একটা ছবি তুলে দেই, আপনি শুধু দশটাকা আমায় দেবেন।”

“না বললাম তো আমাদের ছবি তোলার কোনো দরকার নেই।”

এবারে বাবার কথাটা বেশ একটু জোরেই বলেছিল আর এতে ছিল স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। ছেলেটা মুখ কাঁচুমাচু করে ওদের পাশ থেকে সরে গেল।

দোলনের আবার মনে হচ্ছে বাবা একটা ছবি ওই ছেলেটাকে দিয়ে তোলালেই পারত। বেশি তো আর চাইছিল না, ওর দাবি ছিল মাত্র দশ টাকা। মনে হয় খুব গরীবই হবে। এরপরেও ওরা কোণার্কের মন্দিরে এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখছে শুধু ছেলেটা ওদের দেখলে দূরে চলে যাচ্ছে।

বেশ খানিক্ষন পরে হঠাৎ বাবা বলে, “আমার শরীরটা কীরকম যেন করছে…”

এইটা বলতে বলতে বাবা বুকের বাঁদিকে হাত দিয়ে বসে পড়ে। দোলনরা বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। দোলন খুব জোরে জোরে “হেল্প হেল্প” বলে চ্যাঁচাচ্ছে কিন্তু সবাই বাবার ওই অবস্থা দেখে দূরে সরে যাচ্ছে। অনেকে একটু জিজ্ঞেস করছে ব্যাস তারপরেই চলে যাচ্ছে।

দোলন সত্যি কী করবে এই অজানা অচেনা জায়গায় বুঝতে পারে না। ওর মা আর টুবলু দুজনেই খুব কাঁদছে। হঠাৎ দেখে সেই ছেলেটা যে ওদের ছবি তুলে দিতে চেয়েছিল সে ছুটে আসে আর তাকে জিজ্ঞাসা করে “কী হয়েছে এনার?”

দোলনই বলে, “দেখুন না বাবার হঠাৎ শরীরটা কীরকম করছে। বলছে বুকে ব্যাথা হচ্ছে।”

“তাই বুকে ব্যাথা হচ্ছে তাহলে তো ওনাকে এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে একটুখানি দাঁড়ান আমি সব ব্যবস্থা করছি।”

এই বলে ওই ছেলেটা আরো কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে এসে দোলনের বাবাকে একটা গাড়িতে তুলল ধরাধরি করে তারপর সোজা হসপিটাল্। দোলনরাও ওই গাড়িতে উঠে গিয়েছে।

হসপিটালের ডাক্তাররা বাবাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসা শুরু করে দিল। দোলনরা বাইরে বসে আছে। ওদের মনে খুব চিন্তা বাবার কী হয়, সেই ছেলেটাও বসে আছে।

বেশ খানিক্ষন পরে ডাক্তার বেরিয়ে এসে বলল, “ওনার বেশ ভালোমতো একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, ঠিক সময়েই হসপিটালে আনা হয়েছে না হলে বিপদ হতে পারত।”

দোলন ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করে, “ডাক্তারবাবু বাবা কেমন আছে?”

“এখন ভলো আউট অফ্‌ডেঞ্জার।”

“আমি কি এখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারি।”

“হ্যাঁ যাও বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারো কিন্তু একদম কথা বলবে না শুধু দেখেই চলে আসবে।”

“ঠিক আছে ডাক্তারবাবু আমি শুধু দেখেই চলে আসব।”

এই বলে দোলন সোজা ছুটে বেডের কাছে চলে গেল। বাবা তখনও চোখে বুজিয়ে। বাবাকে একবার ভালো করে দেখে ও যখন বেড়োচ্ছে তখন দেখে সেই ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়েছে। দোলনের মা ওর হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে চাইছে কিন্তু সেই ছেলেটা কিছুতেই টাকা নেবে না। ও শুধু একটা কথাই বলছে, “এই টাকা আমি নিতে পারবনা ম্যাডাম, এটা যে আমাদের কর্তব্য আপনারা টুরিস্ট। আপনাদের কেউ বিপদে পড়লে এই অজানা অচেনা দেশে আর কে দেখবে…”

ছেলেটা এইসব কথা বলে চলে কিন্তু দোলনের মনে তখন বাসের গাইডের কথা, “কোণার্কের এই সূর্য মন্দিরে কোনো দেবতার প্রতিমা নেই কারণ……”

কিন্তু গাইডের কথা সত্যি নয়, কোণার্কের মন্দিরে দেবতা নেই কে বলল? এই ছেলেটা যে একজন অচেনা, অজানা মানুষকে বিপদের থেকে বাঁচানো নিজের কর্তব্য বলে ভাবে সে দেবতা না হয়ে কিছুতেই যায় না, অথচ এই ছেলেটাকে দশ টাকা দিতে হবে বলে বাবা কীরকম ভাবে বলেছিল।

দোলনের চোখে কৃতজ্ঞতার জল ভরে আসে, ও চোখ মুছতে মুছতে বলতে চায়, “দাদা আপনি আমাদের একটা কেন অনেক অনেক ছবি তুলুন , যত পারেন। কোণার্কের দেবতার ক্যামেরায় ছবি তোমার সৌভাগ্য আর ক”জনের হয়।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত