ঝিচকে আলোয় সকালটা থম মেরে বসে। সূর্য ওঠেনি, আবছা অন্ধকার। পুরো পাড়াটা যেন ঘুমিয়ে কাদা। শুধু পাশের পাড়া থেকে আসলামের কোরান পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। সারারাতের গুমোট গরমে হাঁসফাঁসের পর এই ভোরবেলায় একটু আরামের ঘুম হয়। তবে মাস্টারমশাইয়ের নিয়মে শীত-গ্রীষ্মের বালাই নেই।
বিপিনবিহারী চক্কত্তি। মাস্টারমশাই বলেই চেনে সবাই। ষাটের কাছাকাছি এসেও ছিপছিপে শরীরটায় ভালোই যৌবনের রেশ রয়ে গেছে। চোখে দেখতে এখনও অসুবিধে হয় না। সকাল সকাল উঠেই সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি পরে, সাদা চুলে ভরা মাথায় পরিপাটি করে চিরুনি বুলিয়ে নেন। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটা দেন কাশেদের চা-দোকানের দিকে। এই ভোরে শুধু এই চা-দোকানটাই খোলে। ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ ফেরত অনেকেই এখানে বসে চা খায়। সকাল সকাল কাজে বেরোনোর আগে মইবুব-ঝন্টুরাও চা-বিস্কুট খেয়ে যায় এখান থেকে। তবে মাস্টারমশাই এলেই কেউ না কেউ বেঞ্চে জায়গা ছেড়ে দেয়। গ্রামে একখানিই তো প্রাইমারি স্কুল। বেশিরভাগই ওঁর ছাত্র।
গ্রামটা খুব বড়ো নয়। আশি-নব্বইখানা বাড়ি হবে হয়তো। বেশিরভাগই ঘাসের ছাওয়া মাটির দেয়ালের বাড়ি। যারা একটু বিত্তশালী তারা পাকাবাড়ি তুলেছে। আজকাল বিদেশবিভুঁইয়ে নানান কাজ করে হাতে অনেকের টাকা হচ্ছে। তারা কেউ কেউ পাকা একতলা কিংবা টিন-অ্যাসবেস্টসের চাল করছে।
কাপড়ের তৈরি ঝোলাব্যাগটি ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মাস্টারমশাই। চা খেয়ে সোজা স্কুল যাবেন। গরমে মর্নিং স্কুল হচ্ছে ক’দিন। ব্যাগখানা কিনেছিলেন চার-পাঁচ বছর আগে পৌষমেলায় ঘুরতে গিয়ে। খুব পছন্দ হয়ে গেছিল ব্যাগটা। হালকা করে হাতের কাজ করা বড়োরকমের হওয়ায় কাগজপত্র বইতেও সুবিধে হয়। যৌবন থেকেই ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, তাই পূজো-অর্চনা করেন না। ভোর ভোর উঠে স্নান সেরে যোগ-ব্যায়াম করতে করতেই ভোর চারটে থেকে সকাল পাঁচটা বেজে যায়।
চা দোকানের দিকে আস্তে আস্তে পা বাড়ালেন। লাল মোরামের পথ। দু’পাশে ফাঁকা খেত কিংবা গেরস্থের কাঁটার বেড়া। মাঝে মাঝে দু’পাশের বড়ো বড়ো গাছগুলো রাস্তা অন্ধকার করে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। যেন ভূতের দল ওদের মাথার জটায় দলা পাকিয়ে বসে। কা কা স্বরে কাকগুলো বাসা ছেড়ে উড়তে শুরু করেছে দূর কোনও বাজারের দিকে। নিশাচর পাখিগুলোও ডানা ঝাপটে বাসায় ফিরছে। এক-দুটো ছুঁচো ‘কুঁই কুঁই’ আওয়াজ করে রাস্তার এপার ওপার করে গেল বার কয়েক। হালকা আলোয় ওদের চোখে ধাঁধা পড়ে গেছে বোধহয়।
বামুনপাড়ার শেষের বাঁকে এসেছেন। তিনদিক থেকে রাস্তা মিশেছে এখানে। পুবদিক থেকে টং-টং-ঝন-ঝন করে আওয়াজ ছুটে আসছে। অপটু হাতে লজঝড়ে পুরনো সাইকেল লাগামহীনভাবে ছুটছে মনে হয়। রাস্তার ছোটোবড়ো পাথরের গায়ে ঠোক্কর খাচ্ছে ঠন ঠন করে। মুহূর্তে আছড়ে পড়ল কিছু ঠিক করে বোঝার আগেই। জোরে মোড়ের বাঁক ঘুরতে গিয়ে আলগা মোরামে পিছলে গেছে সাইকেলখানা। ঘষটে গেল পাশের সাধনের বাঁশের কাঁটাবেড়ার দিকে। চোখের পলকে ঘটে গেল পুরোটা। বিপিনবাবু তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলেন পড়ে যাওয়া মানুষটাকে তুলতে। এ কী! এত্ত সকাল সকাল পিকলু!
হ্যাঁ, পিকলুই। ভালো নাম দিলীপ দাস। এই নামটা মাস্টারমশাই আর ওর বাবা-মা ছাড়া আর কেউ জানে না বোধহয়। পিকলু নামেই সবাই অতিষ্ঠ। বছর সাত-আটকের রোগপটকা চেহারা। হাফপ্যান্ট দড়ি দিয়ে বেঁধে পরে, না হলে যেকোনও সময় গলে যাবে। নতুন জামা না হলে জামার কারুকার্য বদলে যায়। ডুমুর থেকে কাঁচা আম, সবার কষের দাগ পাওয়া যাবে। সারাদিন শেষে এত মারামারির অভিযোগ আসে যে ওর বাবা সবসময় ভয়ে থাকে। মাস্টারমশাইকে এসে ধরে, “একটু মানুষ করে দিন, স্যার।”
এই সুদীপও বিপিনবাবুর ছাত্র। বেশিদূর পড়াশোনা করেনি। প্রাইমারির গন্ডি ছাড়িয়ে পাশের গ্রামের হাইস্কুলে গেছিল কয়েকবছর। কত ক্লাস পড়ল কে জানে। বোধহয় দু-তিনবার চেষ্টা করেও এইটের গন্ডি টপকাতে পারেনি। তারপর থেকেই কাঠের কাজে ঢুকেছে। তবে পিকলুর জন্য কোনও ত্রুটি সে রাখতে চায় না।
হাত ধরে তুললেন টেনে। গরম পড়েছে বলে মাথা নেড়া। উঠেই তড়িৎগতিতে হাত-পা ঝাড়তে থাকে। মাস্টারমশাইকে পাত্তাই দিল না। ধরে রাখা বামহাতের কনুই ছড়ে একটু রক্ত বেরিয়েছে। কিছু করার আগেই ফার্স্ট এইডও সারা। ডানহাতের চেটোতে থুতু নিয়ে মালিশ করে নিল কনুইয়ে। একটুর জন্য হলেও অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন বিপিনবাবু। অবাক চোখে দেখেন, এত জোরে পড়ার পরও ছেলেটির কাজ-কারবার। পেটানো অনেক খাওয়ার পরও কাউকে রেয়াত করে না সে। নিজের খেয়ালে থাকে। তবে মাস্টারমশাই খুব তারিয়ে তারিয়ে এই দুষ্টুমিগুলো উপভোগ করেন। খুব মজা লাগে। নিজেও তো ছোটোবেলায় কম ছিলেন না।
ঘোর কাটল ক্ষণিকেই। হেঁচকা টান দিয়ে রাগত স্বরে বললেন, “এত্ত সকাল সকাল কোনদিকে যাবি রে, ছোঁড়া?”
পায়ের ময়লা চামড়া উঠে গেছে খানিকটা। মোরামে লাল হয়ে গেছে পাটা। পায়ের মোরাম ঝাড়তে ঝাড়তেই উত্তেজিতভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “স্যার, মো-মো-মোকে উরা দরজার পাশে বুসতে দেয় না। মোকে মারে।”
হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে আরও অনেক অভিযোগ করে যায়। বুঝে গেছেন মাস্টারমশাই। ক্লাস থ্রির রুমটা ঠিক মাঠের পাশেই। খুব বাতাস দেয়। টিফিন বা ছুটির সময় আগে ছুটে গিয়ে গাছটাও ধরা যায় অন্যদের থেকে আগে। ছুটে আগে গিয়ে আমগাছ জড়িয়ে এক হাত তুলে এক বা দু’চক্কর দিয়ে দেয়। ততক্ষণে এসে পড়ে বাকিরা। চলে ছোঁয়াছুঁয়ি বা বুড়ি বুড়ি খেলা। সবার আগে এসে গাছ ছোঁয়ার মধ্যেই ওদের এভারেস্ট জয়ের আনন্দ। তাই আগে থেকে গিয়ে দরজার পশে বসে থাকবে। দরজা খুললেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়বে সবাই। পিঠের ব্যাগটাতেও খুব যত্নের চিহ্ন। সবক’টা চেনই কাটা। হাঁ করে খোলা। বড়ো চেনটার মুখে ওর মা সেফটি পিন লাগিয়েছে।
ইতিমধ্যে কোথা থেকে বলাই এসে হাতের গাড়ুটা রাস্তায় নামিয়ে সাইকেল তুলল। লুঙ্গিটা হাঁটু অবধি তুলে অন্ধকার থাকতেই খোলা আকাশের তলে কাজ সেরে ফিরছে। মুখের নিমের দাঁতনটা একপাশে চালান করে ভুরু কুঁচকে তেড়ে এল।
“দেড় ফুটিয়া, বাপের সাইকেল নিয়ে বেরিছু সকাল সকাল?”
পিকলু মাথা তুলে করুণ মুখে তাকায় বলাই আর মাস্টারমশাইয়ের মুখের দিকে। অপরাধী সে মুখে এক শিশুসুলভ সারল্য মাখা। দেখলে মনটা কেমন নরম হয়ে যায়। যেই না বলাইবাবুর হাত একটু আলগা হয়েছে, এক ঝাঁকে হাত ছাড়িয়ে পাঁই পাঁই করে ছুট। বলাই ওই ওই করে চিৎকার করে ওঠে, হাত বাড়িয়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা। বিপিনবাবু ধাক্কাটা সামলে ভ্যাবলার মতো ফেলে যাওয়া অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সাইকেল ধরে বলাই বিরস মুখে বলে, “আচ্ছা বিটকেল তু। মোর ঘাড়ে চাপিয়ে পগারপার।”
মাস্টারমশাই সাইকেলটা ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলে হাসতে হাসতে মাথা নাড়ান, “সত্যি বিটকেল বটে।”