“সে অনেক অনেকদিন আগের কথা। একটা দেশ ছিল। আর পাঁচটা দেশের থেকে একটু আলাদা।”
“কেন আলাদা, মা? সেখানে বুঝি রাজামশাইয়ের ইয়াব্বড় গোঁফ নেই বাবার মতো?”
“না না, তা নয়।”
“তবে কি রানিমা তোমার মতো পাস্তা রাঁধতে পারে না? নাকি রাজপুত্তুর নয়ের ঘরের নামতা ভুলে যায় খালি আমার মতো?”
“আরে, কী জ্বালা! সেসব কেন হতে যাবে?”
“ও! তাহলে নির্ঘাত প্রজারা সব ভারি গরিব। খেতে-পরতে পায় না। সবসময় কাঁদে।”
“উঁহু! মোটেই না। বরং পুরো উল্টো।”
“মানে? প্রজারা সব তবে সেই পি.টি. ক্লাসের ব্যায়ামের মতো শীর্ষাসন করে নাকি?”
“ফের বাজে বকছিস? যা, তোকে আর গল্পই বলব না।”
“না না, মা! এই আমি মুখে আঙুল দিলুম। আর কিচ্ছুটি কইবুনি কো। দোহাই তোমার, গল্পটা বল। নইলে যে সে ‘আলাদা দেশটার’ কথা ভেবে ভেবে আমার আর ঘুম হবে না। কাল তবে বেলা করে উঠব। আর স্কুলের দেরি হলেই তো তুমি আমায় বকবে।”
“ঠিক আছে, বাবা! হয়েছে। পাকা বুড়ো কোথাকার। এবার চুপটি করে শোন।”
“হুমমমম। লক্ষ্মী মাটা আমার। বলো…”
“সেই আলাদা দেশটার নাম হল মুক্তোনগর। কেন জানিস? সে দেশের আকাশে জাদুর মেঘ উড়ে বেড়ায়। যখন মেঘগুলো সব ছোট্ট শিশু থাকে, এই তোর মতো পুচকে, তখন ওরা কতরকম রঙের হয়! লাল, নীল, হলুদ, কমলা, সবুজ। আর যখন ওরা হাসে তখন সারা আকাশজুড়ে রামধনু আঁকা হয়ে যায়। আর মজার কথা কী জানিস? যখন ওরা কাঁদে তখন ওদের চোখের জল মুক্তো হয়ে ঝরে। বিভিন্ন রঙের চকচকে গোল গোল উজ্জ্বল মুক্তো।”
“ওরাও বুঝি কাঁদে!”
“কাঁদবে তো বটেই। যখন দুষ্টুমি করে তোর মতো, ওদের মা-বাবারা তো বকে। অমনি ওরা মুক্তো ঝরায়।”
“ওরা কী দুষ্টুমি করে? ওদের কি স্কুল আছে? নাকি পার্ক আছে? না বাড়ি আছে, যেখানে দুষ্টুমি করবে?”
“ওদের স্কুল আছে বৈকি! সূয্যিমামা ওদের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। ভারি রাগী। তারপর চাঁদমামা আছে। সে অবশ্য একদম বকাঝকা করে না মোট্টে।”
“হি হি হি হি!”
“কী হল? হাসছিস কেন, পাগলছেলে?”
“তুমি ঠিক সূয্যিমামা আর বাবা হল চাঁদমামা।”
“তবে রে, দুষ্টু! আমি রাগী? আর তোকে যে এত্ত এত্ত গল্প শোনাই, তার বেলা? যা, আর গল্প বলব না।”
“ও মা! মা গো। আমি তো মজা করছিলাম। তুমি প্লিজ প্লিজ বলো বাকিটা। মেঘেদের ছানাগুলো কী করত সেটা বলো।”
“হুমমম! মেঘেদের ছানারা তো তারাদের আড়ালে সারাদিন লুকোচুরি খেলে বেড়ায়। কখনও খিলখিলিয়ে রামধনু ছড়িয়ে হাসে। কখনও আবার বকুনি খেয়ে মুক্তো ঝরায় টপাটপ। আর সেই রঙবেরঙের মুক্তোগুলো তো সব সূর্যের কিরণ আর চাঁদের আলোর সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে আসে পৃথিবীর বুকে। ঠিক মুক্তোনগর দেশটার মাটিতে, আর কোত্থাও না। দেশের রাজা-প্রজা সকলে সেই মুক্তো কুড়িয়ে জমা করে। তাই দিয়ে অন্যদেশের সাথে সওদা করে। দেশের সবারই অবস্থা ভালো। কারোর ঘরেই অভাব নেই।”
“ব্যস,হয়ে গেল? এ কেমন গল্প! যুদ্ধ নেই, রাক্ষস নেই, পরি নেই।”
“তুই শোন না আগে পুরোটা। কারোর ঘরে পয়সার আর সুখের অভাব না থাকলেও রাজামশাইয়ের মনে মোটেও সুখ ছিল না। রাজামশাই খালি ভাবতেন,
‘মুক্তো রাজার ঘরে
মুক্তো প্রজারও ঘরে,
রাজায়-প্রজায় তফাতটা
হবে কেমন করে!’
“ইস্, কী হিংসুটে পচা রাজাটা, মা।”
“বটেই তো। হিংসুটে রাজামশাই আর মন্ত্রীমশাই মিলে ডেকে পাঠালেন রাজ্যের সেরা কারিগরকে। চুপিচুপি ষড়যন্ত্র হল অনেক।”
“ষড়যন… সেটা কী গো, মা?”
“ষড়যন্ত্র? সেটা হল গিয়ে শলা-পরামর্শ। এই যেমন তুই আর তোর বাবা আমায় লুকিয়ে লুকিয়ে সব দুষ্টু প্ল্যান বানাস, অনেকটা সেরকম। তা সেইমতো বুদ্ধি খাটিয়ে কারিগর পাক্কা একমাস এগারো দিন ধরে ইয়াব্বড় একটা যন্ত্র বানাল।”
“গ্যাজেট? ডোরেমনের মতো?”
“সেরকমই। এই গ্যাজেটটা অনেকটা ওই তোর দমকলের খেলনাগাড়িটাতে যেমন ভাঁজ করা সিঁড়ি আছে, সেরকম। সবক’টা ভাঁজ খুলে দিলে আকাশছোঁয়া বিশাল লম্বা একটা আঁকশি তৈরি হয়ে যায়। আর সেই আঁকশির মাথায় একটা বড়ো লোহার সাঁড়াশি।”
“এ আবার কেমন যন্ত্র, মা? যেমন সেই আমরা গ্রামের বাড়িতে লম্বা লাঠি দিয়ে পেয়ারা পাড়ি গাছ থেকে, তেমন?”
“হুম। এই যন্ত্রটা দিয়েই তো রাজার সৈন্যরা সবাই মিলে আকাশ থেকে ছোট্ট রঙিন সবক’টা মেঘ ধরে আনল। যখন অমাবস্যার রাত্রে আকাশে চাঁদমামাও নেই, টিমটিম তারারা, মেঘেদের বাবা-মায়েরা সবাই গভীর ঘুমে, ঠিক তখনই। ধরে এনে তাদের দিল অন্ধকূপে বন্দি করে। কাকপক্ষীও টের পেল না।”
“কিন্তু কেন, মা? আমার খুব কান্না পাচ্ছে যে।”
“রাজা তো চায় না যে মুক্তোগুলো প্রজারা কেউ পাক। শুধু নিজের জন্যই লুকিয়ে রাখতে চায়। লোভী, হিংসুটে রাজা তো। কারোর সাথে ভাগ করে নেবে না সেই সম্পদ। দিনের পর দিন অন্ধকারে বন্দি করে রাখে মেঘবালক-মেঘবালিকাদের। তাদের ভয় দেখায়, কষ্ট দেয় যাতে তারা বেশি করে কাঁদে আর মুক্তো ঝরে অনেক অনেক। কিন্তু তারা সবাই তো গুম হয়ে চুপটি করে বসে থাকে। কথা কয় না, হাসে না, কাঁদে না। এভাবেই দিন কাটে, মাস কাটে, বছর ঘোরে। মেঘের বাবা-মায়েরা দিনরাত্রি কাঁদে। ভাবে, কোথায় গেল ওদের ছানাগুলো। ওদের কান্না তো আর মুক্তো হয় না। ওরা যে বড়ো হয়ে ধূসর বর্ষার মেঘ হয়ে গেছে। তাই শুধু জলই ঝরে অঝোর ধারায়। মুক্তোনগরের আকাশ শুধু কালো মেঘে আচ্ছন্ন থাকে। সূর্যকিরণ চমকায় না, রাত্রে চাঁদের আলো ছড়ায় না। চারদিকে শুধু জল আর জল। প্রজারা ভারি কষ্টে, অভাবে দিন কাটায়।”
“মা, আমি সকলের সাথে শেয়ার করব সবকিছু। ওই পচা রাজাটার মতো কিছুতেই হব না।”
“তুমি তো আমার লক্ষ্মী বাবুসোনাটা। তারপর কী হল জানিস? একদিন এক রাখালছেলে রাজার কারাগারের পেছনের মাঠে বাঁশি বাজাচ্ছিল। তাই শুনে মেঘছানারা আস্তে আস্তে কয়েদঘরের স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা মেঝে থেকে ভেসে উঠল। ওপরের একচিলতে লোহার গরাদ লাগানো জানালায় চোখ রাখল সবাই। গানের সুরে তাদের মন ভালো হয় একটু। তারা রাখালছেলেকে ডেকে বলে,
“বন্দি মোরা এই কারাতে
এবার যাবেই বুঝি প্রাণ,
রাখালছেলে বিদায়বেলায়
শোনাও তোমার গান।”
“মেঘেদের দুঃখের কথা শুনে রাখালছেলে তার অন্যসব খেলুড়ে বন্ধুদের ডেকে আনল। সবাই মিলে হেসে গেয়ে মেঘেদের খুশি করার চেষ্টা করে। ওরা খুশি হলে হয়তো আবার সূর্যের আলো ছোঁবে এই মুক্তোনগরের মাটিকে। কিন্তু সেই গানের সুর যেই না দুষ্টু রাজার কানে গেল, সে অমনি পাঠাল তার সৈন্যদল। হুপ-হাপ, ধুপ-ধাপ করে সৈন্যরা এসে তো ধরতে লাগল রাখালছেলে আর তার বন্ধুদের। তাদের শক্ত করে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধতে লাগল। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল অবোধ শিশুগুলো।”
“মা গো! ওদের মা কই? আমার ব্যথা লাগলে তো তুমি চুমু দিয়ে দাও, ব্যথা সেরে যায়। ওদের মা-বাবারা পাজি সৈন্যগুলোকে গুলি করে মারছে না কেন?”
“ওদের মা-বাবারা তো গরিব। কাজের সন্ধানে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় সারাদিন। তাই ওরা জানেই না এরকম ঘটনা ঘটছে বলে। আর সৈন্যগুলো তো হুকুমের দাস রে, বাবু। ঠিক তোর ওই রিমোট কন্ট্রোলওয়ালা রোবটটার মতো। রিমোটটা টিপছে তো দুষ্টু রাজাই।”
“তারপর কী হল, মা?”
“শিশুগুলোর আর্তনাদে মেঘের দল তো বদ্ধ গরাদের ওই পার থেকে অসহায়ের মতো ছটফট করতে থাকে। বার বার মিনতি করতে থাকে সৈন্যদের কাছে, শিশুগুলোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ সেই কাকুতিতে কর্ণপাত করে না। অসহায় মেঘের দল এবার ফুঁসতে শুরু করে। রাগে ফুলে ফুলে ওঠে ওদের ধূসর মেঘের শরীর।”
“মা, ওরা তো রঙিন ছিল। তাই না?”
“হুম। তাই ছিল তো, যখন ওদের বন্দি করা হয়েছিল। তারপর এইভাবে দিনের পর দিন কারারুদ্ধ হয়ে থাকতে থাকতে ওরা কবে যেন বড়ো হয়ে গেছে। ওদের শিশুসুলভ আনন্দ, খুনসুটি সব হারিয়ে গেছে। হাসি আর কান্নার বদলে শুধু আছে রাগ। সেই রাগ বিদ্যুৎ হয়ে ঝিলিক দিতে থাকে ওদের শরীরজুড়ে। ওদের শরীর থেকে ছিটকে আসা তীব্র বজ্রবিদ্যুৎ টুকরো টুকরো করে দেয় কারাগারের দেওয়াল।”
“মা, ওরা আগে কেন তাহলে বেরিয়ে আসেনি?”
“ওরা তো ওই অন্ধকূপে বন্দি থাকতে থাকতে বুঝতেই পারেনি যে কবে বড়ো হয়ে গেছে, কবে ওদের এত ক্ষমতা হয়েছে। ওদের ওই রূপ দেখে তো সৈন্যর দল ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ছুট্টে পালাল। মেঘের দল সবাই ভাঙা কারাগার থেকে বেরিয়ে গিয়ে জমা হল রাজপ্রাসাদের মাথায়। মুষলধারে নামল বৃষ্টি। শয়তান রাজা, তার পাজি মন্ত্রী, দুষ্টু সৈন্যর দল সক্কলে সেই জলের বন্যায় ভেসে একদম দেশের বাইরে বিদেয় হল। মেঘের ছানারা, রাখাল-ছেলেমেয়েরা, সব্বাই ভারি খুশি হয়ে তা-ধিনতা-ধিন করে নাচতে লাগল।
“রামধনু আর মুক্তো ঝরাই
আমরা মেঘের ছানা,
নাচব আজি গাইব আজি
কেউ কোরো না মানা।”
“আমরা বাঁধি গান, আর
বাজাই মনের সুখে বাঁশি,
রাখালশিশুর দল মোরা
ছড়াই খুশি রাশি রাশি।”
“কী সুন্দর গান! কী সুন্দর গান!”
“ওদের নাচগান শুনে রাখালশিশুদের মা-বাবারা ছুটে এল। আর এল কারা বল তো? মেঘছানাদের মা-বাবারা। তারা তো কতদিন দেখেনি তাদের ছেলেমেয়েদের। সে কী আনন্দ তাদের সব্বার! কিন্তু কেউ মোট্টেও কাঁদল না। কাঁদলেই তো বন্যা আসবে আবার।”
“আর মা, ওরা যে বড়ো হয়ে গেল, তাহলে আর মুক্তোও ঝরবে না, রামধনুও উঠবে না যে!”
“হ্যাঁ, বাবুসোনা। বড়ো তো একদিন সবাইকেই হতে হয়। তখন চারপাশটা এত রঙিন, এত সুন্দর থাকে না। তখন শক্ত হতে হয়, বুঝলি? গর্জে উঠতে হয় ওই মেঘের ছানাদের মতোই। তবেই তো দুষ্টুলোকেরা বিদায় নেবে। রামধনু এমনিই উঠবে, মুক্তোও এমনি ঝরবে। মানুষ তো ধনরত্নের চেয়ে ভালোবাসাই পেতে চায় বেশি। আর রাখালছেলেমেয়েরা কী বলল, জানিস?
“চাই না মণি, চাই না মুক্তো
থাকো তোমরা আকাশজুড়ে,
নাচব সবাই, গাইব সবাই
মেঘের ডানায় বেড়াব উড়ে।”
“কী দারুণ গল্প, মা! কী দারুণ! আরেকটা বলো।”
“তবে রে! এবার ঘুমো দেখি। আয় আমি গান গেয়ে ঘুম পাড়াই তোকে। আমার কথাটি ফুরোল… নটেগাছটি মুড়োল…”