আচমকা টেলিফোনটা ঝনঝনিয়ে উঠল। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন রজত। বেড সুইচ টিপে আলোটা জ্বালালেন। ঘড়ি বলছে এখন কাঁটায় কাঁটায় রাত দুটো। ফোনটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। ফোনটা বাজছে তো বাজছেই। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে খাট থেকে নেমে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে ফোনটার দিকে যেই না হাত বাড়িয়েছেন অমনি সব চুপচাপ। ফোনের রিং বেমালুম থেমে গেল। হঠাৎ একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল ঘরের মধ্যে। ঘড়ির কাঁটা বলছে টিক, টিক, টিক। খাটের খুব কাছ থেকে একটা টিকটিকি বলে উঠল ঠিক, ঠিক, ঠিক। এইসব কিছু ছাপিয়ে রজত নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনতে পাচ্ছেন।
এই নিয়ে পর পর দু-দুটো রাতে বিশ্রী অভিজ্ঞতা হল রজতের। কী যে মাথায় ভূত চেপেছিল তাঁর, এই তাঁবুতেই থাকবেন। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আর মুখ্যমন্ত্রী অবধি অনুরোধ করেছিলেন এখানে না থাকার জন্যে। কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরে থর মরুর বুকে একটা তাঁবু বেখাপ্পাভাবে পড়ে রয়েছে কেবলমাত্র একটা ভূতুড়ে টেলিফোনের কারণে এ কথাটা আর যেই হোক অন্তত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডাইরেক্টর রজত বোস বিশ্বাস করেননি। নানান সার্ভের কাজে তাঁর সহকারীদের প্রায়শই আশেরপাশের তাঁবুগুলোতে থাকতে হয়, অথচ তাঁদেরই মাঝখানে ভানগড় ফোর্টের মতো এই তাঁবুটা আর সঙ্গে লাগোয়া আরও চারটে তাঁবুকে এত বছর ধরে সবাই এড়িয়ে যাচ্ছেন। আবার পর পর দু’রাত যে অভিজ্ঞতা হল তাও ফেলে দেওয়ার নয়। প্রতি রাতে ঠিক দুটোয় টেলিফোন বেজে ওঠে। ধরতে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে কেটে যায়। অথচ ফোনের লাইন কাটা। ব্যাপারটা আপাত ভৌতিক হলেও এর পেছনে যেন অন্য রহস্যের গন্ধ পান রজত।
জয়সলমীরের সকালটা একদম জমজমাট। দেশি-বিদেশি টুরিস্টরা ক্যামেরা নিয়ে খুচুক খুচুক ছবি তুলেই চলেছেন। সকাল সাতটাতেই বালি বেশ গরম হয়ে উঠেছে। চারদিকের হৈ চৈয়ে রাতের আতঙ্কটা দিব্যি ভুলে থাকা যায়। চট করে মুখহাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলেন রজত। এই ‘রুকস্যাক’ তাঁবুর মালিক মিস্টার তিলক বর্মার বাড়িতে আজ চায়ের নেমন্তন্ন। বর্মা মানুষটি বেশ হাসিখুশি।
চা, কেক, পুরি-সবজিতে আড্ডা জমে উঠল। খাওয়া শেষ করে আরেক দফা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রজত জিজ্ঞেস করলেন, “বর্মাসাব, এই তাঁবুর গল্প আমি অনেকের কাছে শুনেছি খাপছাড়া খাপছাড়া। আর আমি তো আপনাকে আগেও বলেছি, এই গল্প আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এ ঘটনাটা তো আপনার সামনেই ঘটেছিল, নাকি?”
“হাঁ, সাব। একদম আমার চোখের সামনে ঘটা। এখনও ভাবলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়।”
“তাহলে আপনার কাছ থেকে আমি ঘটনাটা ডিটেলে আরেকবার শুনতে চাই।”
বর্মা চায়ের কাপ টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে শুরু করলেন, “ঘটনার সূত্রপাত সাত-আটবছর আগে। তখন এই তাঁবুগুলো ছিল টুরিস্টদের হৈ হৈ করার জায়গা। মরুভূমি দর্শন আর থাকার জন্যে আমার রুকস্যাক তাঁবুগুলোই ছিল টুরিস্টদের প্রথম পছন্দের। বুঝতেই পারছেন যে যথেষ্ট রমরমা বাজার ছিল আমার। সে বছর অনেক পার্টির মধ্যে এক সদ্য বিবাহিত দম্পতিও ছিলেন। তারা এই তাঁবুটিতে উঠেছিলেন এক রাত্রে। পরদিন সকালে সবাই মিলে উটে চড়ে মরুভূমি দর্শনে বের হন। সেদিনই ঘটে সেই দুর্ঘটনা। খানিক দূর যাওয়ার পরই চালকরা টের পায় যে মরুর ঝড় খুব দ্রুততার সাথে ধেয়ে আসছে তাদের দিকে। অতএব উটের মুখ ঘুরিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সবাইকে তাঁবুতে ফিরিয়ে আনা হয়। যে যার তাঁবুতে নিরাপদভাবে ফিরে এলেও ফিরে আসেননি সেই নব্য বিবাহিতার স্বামী। উটটিও বেপাত্তা। ঝড়ের তাণ্ডব থামলে পরে সবাই চতুর্দিকে খোঁজাখুঁজি আরম্ভ করেন। পরিশেষে সেই উটটি মেলে বটে, কিন্তু ভদ্রলোকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরের দিন রেসকিউ টিম খোঁজাখুঁজি করে মাঝ মরুভূমি থেকে একটা মৃতদেহ পায়। আর সেই খবর তারা ফোন করে আমাদের জানালে সেই মহিলা ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে মারা যান। সম্ভবত মহিলার কোনও হার্টের সমস্যা ছিল। পরে যখন সেই মৃতদেহ শনাক্তকরণের জন্য নিয়ে আসা হয় তখন দেখা গেল যে সে দেহ এক বিদেশি পর্যটকের, সেই মৃতা স্ত্রীর স্বামীর নয়। আকস্মিক এরকম দুর্ঘটনায় সবার মধ্যেই একটা শোকের ছায়া নেমে আসে।
“এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর সবাই সব ভুলে যায়। এমনকি আমিও প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। ঐ তাঁবুতে আবার অন্য যাত্রীরা আসতে থাকেন। সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়। তারপর প্রায় বছর খানেক বাদে একদিন ঐ তাঁবুর নামে একটা অভিযোগ আসে। যাত্রীরা অভিযোগ করতে থাকেন যে প্রতিরাতেই ঐ তাঁবুর টেলিফোনে কেউ একজন ফোন করে তার স্ত্রীকে চান। তারা প্রথম প্রথম ভাবতেন যে কেউ ভুল করে এই নম্বরে ফোন করছে। পরে ভাবতে লাগলেন যে কেউ ইচ্ছে করে রোজ গভীর রাতে ফোন করে রীতিমতো বিরক্ত করছে তাদের। ব্যাপারটা বুঝে দেখতে আমি একদিন রাতে ফোনটা ধরলাম। তখন রাত প্রায় দুটো। একটা ফ্যাসফ্যাসে গলার মালিক ফোনের ওপার থেকে অদ্ভুত কাঁপা কাঁপা গলায় তার স্ত্রীর খোঁজ করছিলেন। আমি যথারীতি বললাম, ‘আপনি বোধহয় ভুল নম্বরে ফোন করছেন বারে বারে। আপনি কি জানেন যে এটা কোথাকার নম্বর?’
‘এটা রুকস্যাক হোটেল না?’
‘হ্যাঁ, ঠিক। কিন্তু এখানে আপনার স্ত্রী নেই।’
‘আমিও জানি যে আমার স্ত্রী এখানে নেই।’
‘আপনি জানেন? তাহলে জেনেশুনে কেন ফোন করেছেন?’
‘আমি জানতে চাই যে আমার স্ত্রী কোথায়।’
“আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়লাম। তাও মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললাম, ‘আরে মশাই, আমরা কী করে জানব যে আপনার স্ত্রী কোথায়?’
“ওপারের স্বর কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘বিশ্বাস করুন, আমি সব জায়গায় খুঁজেছি, কিন্তু কোথাও ওকে খুঁজে পাইনি।’
‘তাহলে পুলিশে জানান। এখানে ফোন করলে কি আমরা আপনার স্ত্রীকে খুঁজে দিতে পারব?’
‘কিন্তু আমার স্ত্রী তো এখান থেকেই হারিয়েছে।’
‘কী আশ্চর্য! আপনার স্ত্রী কি বাচ্চা মেয়ে নাকি যে হারিয়ে যাবে? আর আমাদের হোটেল থেকে কেউ হারায়নি।’
‘হারিয়েছে। মনে করে দেখুন। ঠিক একবছর আগে। আমি আর আমার স্ত্রী আপনার হোটেলে উঠেছিলাম। মনে পড়ে?’
“তখন আমার খটকা লাগে। জানতে চাই, ‘কী হয়েছিল বলুন তো?’
‘মনে পড়ল? সেই যে একটা মরুঝড়ে পড়েছিলাম সব যাত্রীরা। তখন আমার উটটা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে অন্য রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করল। আমি চিৎকার করে আমার স্ত্রীকে ডাকছিলাম, কিন্তু ততক্ষণে তার আর অন্যান্য উটগুলো পুরো উলটো পথে রওনা দিয়ে দিয়েছিল। আর আমার ডাক কেউ শুনতেই পেল না।’
‘তারপর?’
‘তারপর আমি হঠাৎ উটের পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম। প্রচণ্ড বালির ঝড় আমার উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল, আর আমি বালিচাপা পড়তে থাকলাম। তারপর একসময় আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।’
“আমি স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি আর ফোনের ওপারের জন একটানা বলে চলেছে, ‘জ্ঞান হতে দেখি তখন অনেক রাত। আকাশে ঝিকিমিকি করছে তারারা। আর আমি মরুভূমির মাঝে শুয়ে। উঠে দেখলাম, আমি হাওয়ায় ভাসছি। আমার আত্মা আমার দেহ ছেড়ে দিয়েছে। সেই থেকে আমি আমার স্ত্রীকে খুঁজছি। এই একবছরভর খুঁজে চলেছি। গোটা শহরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, এমনকি আমার নিজের বাড়িতেও কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না।’
“এরপর বিশ্বাস করুন রজতসাহাব, ঐ ফোন আর আমি হাতে ধরে রাখতে পারিনি। আমি তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিয়েছিলাম আর সবাইকে ঐ টেন্টগুলো ফাঁকা করে দিতে বলে আমি নিজেও ওখান থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলাম। তারপর আমি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে সব ফোনের লাইন কাটিয়ে দিই। পুরনো ফোন, তাই ভাবলাম এখন পড়ে থাক। পরে নয় সময় করে সরিয়ে দেব। কিন্তু কোথায় কী? আবার সেই ফোনই রাত দুটোয় বাজতে শুনেছে বেয়ারা চম্পকলাল। তারপর প্রতিদিন রাত দুটোয় ওটা বাজে। আর আমার ব্যবসা তো লাটে উঠল। বাধ্য হয়ে আমাকে সব তাঁবু সিল করে দিতে হল।”
এতক্ষণ পর রজত মুখ খুললেন, “সিল করে দিলেন কেন? তাঁবুগুলো খুলে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যেত।”
“না বাবু, না। অত সোজা হল না। আমি তাঁবু খুলতে গেলেই মনে হত, কিছু একটা আছে ভেতরে। আমি তাঁবু খুলতে গেলেই আমাকে টুঁটি চেপে ধরবে। আর সাতবছর ধরে অমনি করেই ফেলে রাখতে হল।” বলেই ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁপাতে লাগলেন। আপন মনেই মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বললেন, “সে অনেক বছর আগের কথা, জনাব। এখন আর সে ভূত ধরা দেবে না, দেবে না।”
* * *
বর্মার বাড়ি থেকেই হোটেলগুলো দেখা যায়। সেই যাত্রায় যে সমস্ত উটচালকেরা ছিল, তারাও নিশ্চয়ই সেই ঘটনার সাক্ষী। সেই গোটা ঘটনায় আরও কিছু ঘটেছিল বলে তার বিশ্বাস। কিন্তু সমস্ত ঘটনা একজনের থেকে জানা কখনওই সম্ভব নয়। তাই রজত ঠিক করলেন, সেই দিনের মরুঝড়ে যে উটচালকরা সঙ্গে ছিলেন তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
কিন্তু সবার সঙ্গে কথা বলেও বিশেষ কিছু লাভ হল না। সবাই কমবেশি সেই একই সুর গেয়ে যাচ্ছে। রজতের বারে বারে মনে হচ্ছে, সবাই যেন সবকথা বলছে না। কিছু কথা চেপে যাচ্ছে।
দুপুরের খা খা রোদে মরুতট প্রায় শূন্য। টুরিস্টরা যে যার তাঁবুতে অথবা অন্যত্র ঘুরতে গেছেন। এসব ভাবতে ভাবতে রজত বালির ওপর দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল মরুভূমির ভেতর ঢুকে পড়েছেন। রজতের কাছে যদিও কম্পাস রয়েছে, তাও তাঁর মনে হল যেন তিনি রাস্তা হারিয়েছেন। হঠাৎ চারদিক কেমন শান্ত চুপচাপ হয়ে গেল। যেদিকেই তাকাও শুধু বালি আর বালি। এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়াটা তাঁর একদম উচিত হয়নি। কম্পাসটা পকেট থেকে বের করতে যাবেন, আচমকা একটা বিকট শব্দে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। চমকে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন দুটো শকুন ঘোরাঘুরি করছে আর বিশ্রী শব্দে ডাকছে। যাক, শকুন। অন্যকিছু নয়। টের পেলেন, এরকম শুনশান একটা জায়গায় শকুনের ডাকও কত ভয়ানক শুনতে লাগে।
কিন্তু কোনদিকে যাবেন কিছুতেই বুঝতে পারছেন না যে। কম্পাসের কাঁটা বলছে উত্তর-পশ্চিমে এগিয়ে এসেছেন। তাঁবুতে ফিরতে হলে তাঁকে আরও উত্তরে যেতে হবে। কয়েক পা হাঁটতে হাঁটতেই তাঁর মনে হল শকুনগুলোও যেন পিছু পিছু চলেছে। তিনি আরও কিছুটা এগোলেন, আর কী আশ্চর্য, শকুনগুলোও নিঃশব্দে তাঁকে অনুসরণ করে চলল। এবার তাঁর একটু একটু ভয় করছে। তিনি ঠিক রাস্তায় এগোচ্ছেন তো? রাস্তা যে আর ফুরোয় না। আর শকুনগুলোও তাঁর মাথার ওপরে ঘুরেই চলেছে। পায়ে সমস্ত জোর এনে রজত এবার উত্তরদিক বরাবর ছুটতে আরম্ভ করলেন। কতটাই বা হেঁটে এসেছে তিনি? এখন যত দ্রুত সম্ভব তাঁবুতে ফেরা দরকার। কিন্তু বালির ওপর দিয়ে পা আটকে যাচ্ছে। এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ জ্বালা করছে। দরদর করে ঘামছেন। হঠাৎ কিছুতে যেন পা বেঁধে গিয়ে দুড়ুম করে মুখ থুবড়ে পড়লেন। মুখে চোখে বালি ঢুকে যা তা কাণ্ড। চোখ ঝেড়েঝুড়ে তাকিয়ে দেখে আঁতকে উঠলেন। একটা কঙ্কালের কয়েকটা হাড়ে তার পা আটকে হোঁচট খেয়েছিল। শুধু পাটাই যা দেখা যাচ্ছে তার, আর বাকি শরীর তো বালির নিচে ডুবে আছে। দেখে তো মনে হচ্ছে মানুষেরই পা।
ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন রজত। মনে হচ্ছে, এটা কোনও মহিলার কঙ্কাল। পায়ে বালিমাখা ধাতব নূপুর পরা। বালির নিচ থেকে হলদে রঙের শাড়ির একটু অংশও বেরিয়ে রয়েছে। কঙ্কালটা কতটা বালির নিচে ডুবে আছে দেখার কৌতূহল হল তাঁর। আশেপাশের বালি সরাতে লাগলেন তিনি। পা ধরে অনেক টানাটানি করলেন, কিন্তু না, এ তোলার ক্ষমতা তাঁর নেই। যন্ত্রপাতি দিয়ে রীতিমতো বালি খুঁড়ে তবে বের করতে হবে। আহা রে, কোন অভাগী হয়তো কোনও বিপদে তাঁর মতোই রাস্তা হারিয়ে তারপর এখানেই মারা গেছে। ভাবলেন কাউকে নিয়ে এসে যদি তোলানো যায়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল, তিনি এখান থেকে বেরোবেন কী করে? রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন তো। কম্পাসটা যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু উত্তর বরাবর চলতে চলতে তিনি যে কখন আবার পশ্চিমে চলে এসেছেন বুঝতেই পারেননি। শকুনগুলোরও পাত্তা নেই। এখন বেশ বুঝতে পারছেন যে ঐ শকুনগুলোই ওকে এই পথে টেনে এনেছে। তবে দূরে মনে হচ্ছে কিছু উট আসছে। ভাগ্য খুব ভালো বলতে হবে যে উটগুলো ঠিক এদিকেই আসছে। সেদিকে হাত দেখিয়ে ছুটে গেলেন রজত। অনেকগুলো উট নিয়ে কিছু যাত্রী তখন মরুভ্রমণে বেরিয়েছে। ঘড়ির কাঁটাও দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পরে এসে ঠেকেছে।
উটের চালকদলের মধ্যে একটা ষোলো-সতেরো বছরের ছেলে ছিল। রজত তাকে বললেন, “আমাকে তুই হোটেলে নিয়ে যেতে পারবি?”
“জী, সাব। জরুর।”
“আর তারপর যদি তোকে নিয়ে এখুনি আবার এখানে ফিরে আসি, তুই ঠিক এই জায়গাটাই আমাকে চিনিয়ে দিতে পারবি?”
“হাঁ, জী। য়হ জগহ জেয়াদা দূর নহি হৈ সাব।”
“দেখ ভাই, ঠিক এই জায়গাটাতেই ফিরে আসতে হবে কিন্তু। পারবি তো?”
“জী, জনাব। জরুর সকেঙ্গে।”
“চল তা’লে, জলদি চল।”
এই বলে তারা একটা উট নিয়ে ছুটল হোটেলের দিকে। কিছু লোক, কোদাল আর শাবল নিয়ে আধাঘণ্টার মধ্যেই আবার ফিরে এল সেই জায়গায়। কিন্তু কই? কই? কই? কঙ্কালের চিহ্ন অবধি নেই। সবাই চতুর্দিক তোলপাড় করে খুঁজল, কিন্তু কঙ্কাল নেই।
তাঁবুতে ফিরে আসতে বেশ রাত হয়ে গেল। কিন্তু রজতের ছটফটানি ভাবটা কিছুতেই যাচ্ছে না। একটা গোটা মানুষের কঙ্কাল বালির নিচে আবার চাপা পড়ে যেতে পারে, কিন্তু ভোজবাজির মতো উড়ে যাবে কী করে? তিনি অস্থিরভাবে ঘরময় পায়চারি করতে লাগলেন। টেলিফোনটা যেন একটা জলজ্যান্ত দানব। ঘরের এক কোনা থেকে রজতের প্রতিটা গতিবিধি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লক্ষ করে যাচ্ছে যেন। ঘড়িতে এখন সাড়ে সাতটা। নাহ্, এমন কিছু রাত তো নয়। ঝপাঝপ গায়ের সোয়েটারটার ওপর একটা শাল জড়িয়ে হাতে একখানা বড়ো টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। কিন্তু এই টেলিফোন রহস্য তাকে সমাধান করতেই হবে। একগাদা প্রশ্ন তাঁর মাথায় জমাট বেঁধে রয়েছে। উত্তরগুলো খুঁজে বের করতেই হবে।
* * *
আচমকা কোনও খবর না দিয়ে আসায় বর্মা একটু হকচকিয়ে গেছেন। কিন্তু যথাসম্ভব মুখে সেই পুরনো হাসিটা টেনে এনে ভেতরে আসতে বললেন। হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে এসে রজত বললেন, “আমি বসতে আসিনি, বর্মা। আমাকে কয়েকটা খবর জানাতে পারবেন?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বলুন না।”
“আচ্ছা বর্মা, আপনি তো বললেন সেই মহিলা মানে হারিয়ে যাওয়া সেই ভদ্রলোকের স্ত্রী আপনাদের সবার চোখের সামনেই হার্ট ফেল করে মারা যান। কী, তাই না?”
“হাঁ, বিলকুল। একদম আমার চোখের সামনেই মারা যান।”
“তো তারপর সেই বডির কী করলেন?”
বর্মা একটুও না চমকে বললেন, “আমরা তো সেই বডি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আর পুলিশ সেই বডি…”
“আর পুলিশ সেই বডি? কী করেছিল সেই বডির?”
“আজ্ঞে, পুলিশ তো মনে পড়ছে যদ্দুর, সেই বডি তার অরিজিনাল ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়।”
“তার মানে পুলিশ জানতে পেরেছিল তাদের আসল ঠিকানা?”
“জী, মানে, তাই তো মনে হচ্ছে।”
রজত শ্যেনদৃষ্টিতে বর্মার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে তিনি বললেন, “জী, আপনি পুলিশকে জিজ্ঞেস করতে পারেন লোকাল থানায় গিয়ে। তারাই তো সব ব্যবস্থা করেছে।”
রজত দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “আমার সেটাই সবার আগে করা উচিত ছিল। পাপ করলে তার শাস্তি পেতেই হয় বর্মাজী।”
বলেই ধাঁ করে বেরিয়ে গেলেন। বর্মা স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাঁর চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
থানাটা আবার বড্ড দূর। রজত নিজের মনে মনেই নিজেকে ধিক্কার দিলেন। তাঁর সবার আগে উচিত ছিল লোকাল থানাতেই পুরো বিষয়টা খতিয়ে দেখার। কিন্তু তিনি তো গোড়াতে ব্যাপারটা বিশ্বাসই করতে চাননি। কিন্তু পর পর ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা সম্পূর্ণভাবেই অসংলগ্ন হতে পারে না। থানায় গিয়ে কিছু জিনিস জানা গেল। তাঁর আসল পরিচয় জেনে ও.সি. তাঁকে যথেষ্ট খাতির যত্ন করলেন। আর এও জানালেন যে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কথা অমান্য করে তিনি ঐ টেন্টে থেকে মোটেই ভালো কাজ করেননি। যদি কিছু হয়ে যেত তাহলে তারা উপরমহলের কাছে কী জবাবদিহি করতেন। কিন্তু রজতের এখন এসব ভাবার সময় নেই। তিনি আজ সারাদিনে যা যা ঘটেছে সমস্ত সবিস্তারে পুলিশকে জানালেন। আর পুলিশ জানালেন যে সেই ঘটনার পর সেই মহিলার বডি শনাক্ত করতে কোলকাতা থেকে তার বাবা-মা আসেন আর তাদের হাতেই সেই মৃতদেহ তারা তুলে দেন।
“কিন্তু তারাই যে তার অরিজিনাল মা-বাবা তা কি আপনারা নিশ্চিত ছিলেন? মানে, তারা কি সেরকম প্রমাণ নিয়ে এসেছিল?”
“দেখুন, এসব ক্ষেত্রে আমাদের যা প্রাথমিক তদন্ত তা করেই আমরা বডি ছেড়ে দিই। কিন্তু মা-বাবা বলে পরিচয় দিয়ে কান্নাকাটি করে যারা মৃতদেহ সনাক্ত করল, তাদের পরিচয় আর অত খবর নিয়ে দেখিনি আমরা।”
হাতের মুঠো পাকিয়ে টেবিলের ওপর সজোরে একটা ঘুসি মেরে রজত বললেন, “এই কাঁচা কাজটা আপনারা করতে পারলেন? ড্যাম ইট!”
“কী করি বলুন তো মশাই? সেই মুহূর্তে অন্য স্টেটের এক টুরিস্ট কী বিচ্ছিরিভাবে মারা গেলেন, যার স্বামীও নিরুদ্দেশ। সঙ্গে আরেক টুরিস্ট, যিনি আবার স্কটল্যান্ড থেকে এসেছিলেন তিনিও ঐ একই মরুঝড়ে মারা গেলেন। তাদের বডি নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে যেকোনও অবস্থায় বডি শনাক্ত হয়ে গেলেই আমরা বেঁচে যাই আর কী। তো তার জন্যেই তাড়াহুড়োয়…”
রজতের অসহ্য লাগছিল এসব। থানা থেকে বেরিয়ে দ্রুত তাঁবুর দিকে পা বাড়ালেন। চোখের সামনে শুধু বারবার ভেসে উঠছিল বালির ভেতরে ডুবে থাকা একটা বেওয়ারিশ কঙ্কাল। পুলিশকে সেকথা বলে বিশেষ লাভ হল বলে তো মনে হল না। উফ্, কী অসহ্য!
তাঁবুর কাছাকাছি আসতেই তার যেন মনে হল খুব কাছেই কয়েকজন কথা বলছে। একাধিক নারীপুরুষের কণ্ঠস্বর যেন। প্রথমে ভাবলেন, কে কথা বলছে তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা কীসে। কিন্তু তিনি যতই তাঁবুর দিকে এগোচ্ছেন মনে হচ্ছে শব্দগুলো সেদিক থেকেই আসছে যেন। তার তাঁবুর সামনে এসে মনে হল যেন পেছনের তাঁবুটাতেই কেউ কথা বলছে। কিন্তু পেছনের তাঁবু তো ফাঁকা। কারও তো থাকার কথা নয়। তিনি দেখার জন্যে এগিয়েই বুঝলেন যে কথাগুলো আসলে তারও পেছনের তাঁবুটা থেকে আসছে। এভাবে একটা করে তাঁবু এগোতে এগোতে তিনি শেষ তাঁবুটাতে এসে দেখলেন সেখানে কেউ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে কথাগুলো যেন সামনেই কোথাও থেকে ভেসে আসছে তার কানে। তিনি কৌতূহল দমন করতে না পেরে আরেকটু এগিয়ে গেলেন। তারপর আরেকটু। খানিকক্ষণ বাদে টের পেলেন যে মরুভূমি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেও থামতে পারছেন না কিছুতেই। ক্রমেই এগিয়ে চলেছেন গাঢ় অন্ধকারের দিকে। মরুভূমি এখানে ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে রজত হাতের টর্চটা জ্বালালেন। তার পাদুটো যে কোনদিকে টেনে নিয়ে চলেছে তা ঠাওর করার কোনও উপায় নেই।
চলতে চলতে হঠাৎ দেখলেন, মরুভূমির মাঝখানে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে। আর তিনিও ক্রমে সেদিকেই এগিয়ে চলেছেন। একসময় গতি ধীর হল। আগুনের কিছুটা আগেই তিনি থামলেন। আগুনের সামনে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। তাঁর সামনে কোশাকুশি থেকে ক্রমাগত কীসব যেন ঢেলে যাচ্ছেন নিজের মাথায়। উবু হয়ে বসে সেই আগুনের আঁচও মাথায় নিচ্ছেন। একসময় বৃদ্ধ ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর দিকে চাইলেন। সেই দৃষ্টিতে রজতের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। চোখ তো নয় যেন কঙ্কালসার মুখের কোটরে লাল টুনিবাল্ব জ্বলছে। হাত-পা অস্বাভাবিকরকম সরু। বৃদ্ধ ওঁর চোখ থেকে মুখ ফেরালেন আবার আগুনের দিকে। রজতের পাদুটো যেন বালির সাথে গেঁথে রয়েছে। সর্বাঙ্গ অসম্ভব ভারী ঠেকছে। নড়াচড়া করার ক্ষমতা অবধি নেই। বৃদ্ধ ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলতে আরম্ভ করলেন এক না শোনা কাহিনি। সেই কাহিনিতে একটা কথা বারে বারে ঘুরতে লাগল, “আর থাকবে না। আর থাকবে না।”
সেই কথা শুনতে শুনতে রজতের কান লাল হয়ে উঠল। চোখ জ্বালা করতে লাগল। সারা শরীরে আগুন গরম রক্ত বইতে থাকল।
* * *
যখন রজতের চোখ খুলল তিনি দেখলেন তাঁকে ঘিরে অনেক লোক দাঁড়িয়ে জটলা করছে। উঠতে গিয়ে টের পেলেন গায়ে অনেক জ্বর। সারা শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তাঁর। জানতে পারলেন, উটের সারি তাকে মাঝ মরুভুমিতে পড়ে থাকতে দেখে নিয়ে আসে তাঁবুতে। জয়সলমীর থানার ও.সি. তার জ্ঞান ফিরতে দেখে কাছে আসেন। জানতে চান গতরাতে তিনি বর্মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কি না। কারণ, তারপর থেকেই তাকে নাকি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রজত মাথাটা দু’হাতে ধরে উঠে দাঁড়ালেন। তার কথা বলার শক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। পুলিশকে তাঁর পিছু পিছু আসতে বলে তিনি মরুভূমির দিকে আবার পা বাড়ালেন। জ্বরে তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। আওয়াজ শুনে আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখলেন, দুটো শকুন তাদের মাথার ওপর ঘোরাঘুরি করছে। সবাই সবিস্ময়ে দেখল শকুনগুলোই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আর রজত কেবল তাদের অনুসরণ করছেন মাত্র।
খানিকটা পথ গিয়ে সবাই থামলেন। একটা জায়গায় বালির ওপর কয়েকটা সোনার আংটি, হার, দুল এসব পড়ে আছে। সেই জায়গার বালি খুঁড়তেই বেরিয়ে এল বর্মার মৃতদেহ। কেউ আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে তার মাথাটা ছিঁড়ে ধর থেকে আলাদা করে দিয়েছে। যা কোনও মানুষের কাজ হতেই পারে না। আর সঙ্গে একটা হলুদ শাড়ি জড়ানো কঙ্কাল। তার হাতে চুড়ি, শাঁখা, পলা, পায়ে নূপুর।
রজত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে শবদেহ আর কঙ্কালের শ্রাদ্ধকাজ করালেন। দুটো আত্মাই এবার শান্তি পাবে। গতরাতে দেখা সেই বৃদ্ধরূপী কঙ্কালসার জীবটিই সাতবছর আগের আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া সেই মহিলার স্বামী। সেই দুর্ঘটনায় আরও দু’জন মারা যান। যাদের একজন বিদেশি ছিলেন, তার দেহ শনাক্ত হয়। কিন্তু আরও এক অভাগী সেদিন সেই বালিতে চাপা পড়ে দমবন্ধ হয়ে মারা যায়। তার দেহই বদল করা হয়েছিল সেই নব বিবাহিতা বধূর মৃতদেহের সঙ্গে। টাকা দিয়ে কিছু মানুষের মুখ বন্ধ করে সবার চোখের আড়ালে সেই দেহ পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আর কিছু লোককে তার বাড়ির লোকজন সাজিয়ে একটা মিথ্যে গল্প রচনা করা হয় যে সে হার্টফেল করে মারা গেছে। পুলিশের তদন্তেও তাইই ধরা পড়ে। কিন্তু আসল ঘটনা হল যে সেই বউটি স্বামীর শোকে ভয়ে আতঙ্কে তাঁবুর ভেতরেই গলায় দড়ি দিয়েছিল। পাছে অপঘাতে মৃত্যুর দোষে হোটেলের বদনাম হয় ও ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় তাই বর্মা নিজেই সেই লাশ মাঝ মরুভূমিতে পুঁতে দিয়ে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল।
সমস্ত কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ও.সি. রজতকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি শুধু একটাই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছি না। সেই মৃতার স্বামীর তবে কী হল? তার অতৃপ্ত আত্মা কি তবে কোনও কালেই শান্তি পাবে না?”
রজত হেসে বললেন, “সে ব্যবস্থা সে নিজেই করে গেছে। কাল রাতে আমার চোখের সামনেই সে নিজের শ্রাদ্ধ করে তার অতৃপ্ত আত্মাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। আর সে কথা দিয়েছে কোনও টেলিফোন উৎপাতও আর থাকবে না, থাকবে না।”
সূর্য তখন মাঝ আকাশে পুরোদমে তার তেজ বিকিরণ করছে। রজত কপালে দু’হাত দিয়ে চোখ ঢেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, দুটো শকুন ওদের মাথার অনেক উঁচু দিয়ে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে গভীর মরুভূমির দিকে।