আজ অনেকদিন পর হঠাৎ ফারিয়ার কথা খুব মনে পড়ছে আমান এর।সেই বটতলায় দাড়িয়ে আছে আমান যেখান থেকে সে খুজে পেয়েছিল তার নীল পরি কে,যদিও এখন আর এদিক এ তেমন একটা আসা হয়না কিন্তু আজ আবহাওয়া টাও যেন আবেদন করছে পুরনো ভালোবাসা নিয়ে নতুন করে ভাবতে। আজ থেকে বছর তিনেক আগের কথা আমান ও তার বন্ধুদের আড্ডার আস্তানা ছিল এই বটতলা।প্রথম বারের মত ফারিয়ার সাথে সাক্ষাৎ টা মোটেও ভালো ছিলনা আমান এর।আমান বাইক টা পার্ক করছিল বটতলায়,হঠাৎ করে এসে ফারিয়া আমান এর গালে কসে এক চড় লাগালো আমান কিছু বুঝে উঠার আগে ফারিয়াই বললো বেয়াদব মেয়ে দেখলেই সহ্য হয় না তাইনা? আমান কিছু বলতে যাবে ফারিয়া আবার বলে উঠলো তোকে কে এত সাহস দেয় তুই আমাকে চিঠি দেস, আজ কিছু বললাম না পরের বার তোকে দেখলে পিটিয়ে কিছু রাখবোনা।
আমান কিছুই বলার সুজোগ পেলনা।ফারিয়া বাতাস এর গতিতে এসে তুফান এর গতিতে চলে গেল। আমান গাল চুলকাতে চুলকাতে বন্ধুদের সামনে গেল বন্ধুরা কেও দেখেনি বলে সম্মান বেচে গেল নিজেই চিন্তা করলো আর মনের অজান্তে ফুলতে লাগলো।সে তো কিছু করেই নি কেন তাকে মেয়েটি এভাবে বকে ঝকে গেল। আমান মনে মনে বললো এটার শেষ সে দেখে ছাড়বে।সেদিন আর বন্ধুদের সাথে বেশি সময় কাটালো না, বাসায় এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল ফারিয়া নামে ফেসবুকে আইডি খুজতে।ভাগ্য ভালো যাওয়ার আগে ফারিয়া কে তার এক বান্ধবী ডাক দিয়েছিল আর আমান সেটা শুনেছিল।ফারিয়ার আইডি খুজে পেতে বেশি একটা বেগ পেতে হলনা কারণ সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য যেকোন একটি বসত ফারিয়া আমান এর ভার্সিটিরই ছিল। আরো খোজ নিয়ে আমান যা জানলো তাতে তার ভেতরের রাগ আরো ফুসে উঠলো।ফারিয়া তার দুই ব্যাচ জুনিয়র অথচ সেদিন আন্দাজে এসে আমান কে চড় দিয়ে গেল।
আমান দেখে নিল ফারিয়া ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট এর ছাত্রী।পরের দিন থেকেই আমানের আড্ডার আস্তানা বটতলা থেকে বদলে হয়ে গেল ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট।যদিও এখন ও তার বন্ধুরা কেওই এইকথা জানেনা আমান এখানে কেন এসেছে।এভাবে প্রতিদিন ক্লাস শেষে আমান বসে থাকতো ফারিয়ার ক্লাস এর ঠিক বাইরে, এসেছিল সে বদলা নিতে কিন্তু উল্টো আমান ফারিয়ার মানুষ এর প্রতি মায়া ও ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল, তার ভার্সিটির আশেপাশের সব গরিব মানুষ গুলোই যেন তার আপন।প্রেমেই পড়ে গেল আমান ফারিয়ার এত গুন দেখে।তাই এখন বদলা নেয়ার থেকে ফারিয়া কে দেখতে পাওয়াটাই যেন আমান এর জন্য অনেক কিছু।এভাবে বসে থাকতো আর ফারিয়া কে দেখতো আমান।এভাবে একদিন ফারিয়ার নজরে পড়লো আমান।সেই আগের মতই তেড়ে ফুড়ে এলো ফারিয়া কিন্তু আজ সাথে আমান এর বন্ধুরাও ছিল।ফারিয়া এসে আমান কে বকে যাচ্ছে কিন্তু আমান এর ওইদিক এ নজরই নেই।সে শুধু এক নজরে ফারিয়ার দিক তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ করে আমান বুঝলো কিছু একটা ঠিক নেই।তারপর বুঝলো ফারিয়া এসে ওকে বকা ঝকা করছিল যা শুনে আমান এর বন্ধুরা তাকে ভালো ভাবে ঝেড়ে দিয়েছে,এটাও বলে দিয়েছে আমান যে তার সিনিয়র। আমান বুঝলো ফারিয়া হয়তবা ওর বন্ধুদের কথায় কষ্ট পেয়েছে সে তারাতারি উঠে ফারিয়া কে খুজতে লাগলো কিন্ত ফারিয়া কে সেইদিন আর খুজে পেল না। আসলে সেইদিন বললে ভুল হবে সেই পুরো সপ্তাহে ফারিয়া আর ভার্সিটি এলো না। ফারিয়া কে না দেখতে পেয়ে আমান এর ও খারাপ অবস্থা, রীতিমতো নাওয়া খাওয়া ছেড়ে ফারিয়ার অপেক্ষায় আমান দিন পার করছিল।এর মধ্যে আমান আবার ফারিয়ার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী মিম এর থেকে ফারিয়ার খোজ খবর নিয়ে জানলো ফারিয়া জ্বরে ভুগছে তাই আসছেনা কিন্তু আমান এর এমন অবস্থা যেন তার জীবন টা হয়ে গেছে ফারিয়াময়।সে ফারিয়া কে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছেনা।পরের সপ্তাহেই আমানের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফারিয়া ভার্সিটি এলো।
অদ্ভুত হলেও আমান লক্ষ্য করলো ফারিয়া আমানের দিকে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝেই। আমান ফারিয়ার পিছে ছায়ার মত ঘুরতেই থাকতো ফারিয়া সেটা টের পেয়েও কিছু বলতোনা। আমান অবশেষে তার বন্ধুদের ব্যাপারটা টা জানালো তার বন্ধুরা উল্টো আমান কে পচাতে লাগলো জুনিয়র এর কাছে মার খেয়ে আমান এর মাথা গেছে আরো হাবি জাবি বললো, আমান বুঝলো এই ব্যাপারে তার হতচ্ছাড়া বন্ধুদের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাবেনা।সে নিজে সরাসরি ফারিয়া কে তার মন এর কথা জানাবে বলে ঠিক করলো।সৌভাগ্য বসত একটা ভালো সুযোগও পেয়ে গেল।ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন আমান আগেই চলে এসেছে ফারিয়ার ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং এর সামনে ফারিয়ার অপেক্ষা করতে করতে যখন বৃষ্টি নামলো আমান বৃষ্টি থেকে বাচতে বিল্ডিং এর সামনে আমগাছ টার নিচে গিয়ে দাড়ালো হঠাৎ সে দেখলো ফারিয়াও এসে একি জায়গায় দাড়িয়েছে।
আমান ভেবে নিল এটাই সুযোগ কিন্ত কিছু বলতে যাবে এমন সময় ফারিয়া নিজেই বলে উঠলো সরি। আমান তো অবাক।সে ফারিয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফারিয়া আবার বলে উঠলো ওইদিন আপনাকে চড় মারার জন্য সরি আমি জানতাম না আপনি আমার সিনিয়র। আমান এবার বলে উঠলো ভালোবাসি।ফারিয়া কিছুই বুঝলো না কিন্তু এমন একটা চেহারা বানালো যেন সে আগে থেকেই জানে আমান এমন কিছুই বলবে।ফারিয়া সেখান থেকে চলে যেতে চাইলো কিন্তু আজ আর আমান তাকে যেতে দিল না তার হাত টা ধরে টান দিল ফারিয়া বড় বড় চোখ করে আমান এরদিক এ তাকালো কিন্তু আমান এমন ভাব করলো যেন তার কিছুই যায় আসেনা তাতে। আমান এবার ফারিয়া কে তার লিখা কবিতার দুটি লাইন শুনালো,ফারিয়াও কেন যেন মন্ত্র মুগ্ধের মত আমান এর কথা শুনছে।ফারিয়া এবার বলে উঠলো হাত ছাড়ুন কেও দেখলে ঝামেলা হবে।
আমান অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে ফারিয়া কে প্রপোজ করে বসলো কিন্তু ফারিয়া কিছু না জানিয়ে চলে আসলো।এরপর যে আমান এর ফারিয়ার পিছে ঘুরা কমে গেল তা না, সে আগের মতই ঘুরছে কিন্তু ফারিয়ার মন কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে তা বুঝলো ফারিয়ার আইডি থেকে পাওয়া মেসেজ দেখে।ফারিয়া কিভাবে তার আইডি পেল তা আমান বুঝলো না কিন্তু ফারিয়ার পাওয়া মেসেজ পেয়ে আমান যেন ঈদ এর চাদঁ হাতে পেল ।ফারিয়া তাকে বললো এভাবে ভ্যাবলাদের মত পিছে পিছে না ঘুরে তাকে তার ফোন নাম্বার দিতে।এভাবে ধীরে ধীরে ফারিয়া আর আমান এর ভালোবাসার শিকড় বেড়ে উঠতে লাগলো।প্রতিদিন রাত জেগে ফোনালাপ এরপর সকাল হতেই ভার্সিটি এসে একসাথে ঘুরা ফেরা এভাবেই চলতে লাগলো তাদের সুন্দর দিনগুলো। আজ ফারিয়ার জন্মদিন মনে মনে অনেক কিছু ভেবে রেখেছে আমান কারণ আজ ফারিয়ার জন্মদিন এর পাশাপাশি তাদের একসাথে চলার দুইবছর পূর্ণ হয়েছে।
আমান অপেক্ষা করছে ফারিয়ার জন্য কিন্তু সকাল গড়িয়ে দুপুর তারপর বিকেল ফারিয়ার কোন খোজ নেই।ফারিয়ার ফোন টাও বন্ধ। আমান কিছুই বুঝলোনা কেমন যেন নিঃস্ব মনে হচ্ছিল তার তাকে।সারাদিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেল তাও ফারিয়ার কোন খোজ আমান পেলনা।ফারিয়ার বান্ধবীদের কাছেও সে কোনো খবর পেলনা।এভাবে দুইদিন পেরিয়ে গেল ফারিয়ার কোন খোজ আমান পেলনা। দুইদিন পর এর কথা আমান পেপার এর দোকানের সামনে দিয়ে আসছিল তার পাগলপ্রায় অবস্থা হয়ে গিয়েছে এই দুইদিনে।পেপার এর দোকানে ঝুলিয়ে রাখা একটি পেপারের দিকে নজর পড়তেই থমকে গেল আমান।একটি মেয়ের ছবি দেয়া হয়েছে, সেখানে লেখা এই লাশটি হসপিটালের মর্গে পড়ে আছে বেওয়ারিশ হিসেবে,লাশটির আত্মীয় কেও শনাক্ত করতে পারলে যেন এসে নিয়ে যায়। আমান এর চিন্তে এতটুকুও সময় লাগেনি এটা তার ফারিয়া।সে সেখান থেকে হসপিটালে গেল,গিয়ে লাশটা দেখে সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা ওখানেই জ্ঞান হারালো।এবার ফিরে আসা যাক দুইদিন আগে,কি হয়েছিল ফারিয়ার সাথে।
ফারিয়ার আজ জন্মদিন সে একটা নীল শাড়ি আর খুব সুন্দর সাজ নিয়ে ঘর থেকে বের হলো ভার্সিটির উদ্দেশ্য সে জানে ওখানে একটা পাগল তার জন্য অনেকটা সময় ধরে অপেক্ষা করছে। আজ কি খুশিটাই না হবে আমান ফারিয়া কে দেখে কারণ সে আমান এর পছন্দের নীল শাড়িটা পরেছে এটা ভেবে মনের অজান্তেই ফারিয়া হেসে দিল।ফারিয়ার বাসা ছিল তার ভার্সিটি থেকে অনেকটা দূরে।তাকে প্রথমে বাস পরে রিকসা ব্যবহার করতে হতো কিন্তু ফারিয়া চিন্তা করছে আজ যেহেতু সে শাড়ি পড়েছে সেহেতু সে আজ কোন একটা রাইড শেয়ারিং এ্যাপ ব্যবহার করবে,যা ভাবা তাই করা।সে একটি বাইক কল করলো বাইক এলো ফারিয়া তাতে বসে পড়লো কিন্তু ফারিয়া বুঝতেও পারলোনা এটাই হয়তবা তার শেষ যাত্রা।বাইক এর লোকটি খালি রাস্তা পেয়ে অতিরিক্ত গতিতে বাইক চালাচ্ছিল ফারিয়া তাকে দুই-তিনবার মানা করার পরও লোকটি গতি কমালোনা। সামনেই রাস্তায় কাজ চলছিল যা লোকটির ও জানা ছিলনা বাইকের গতিটা বেশি হওয়ায় তার বাইক টি সরাসরি গিয়ে বাড়ি খেল সামনে বন্ধ পড়ে থাকা একটি ট্রাক এর সাথে।
ফারিয়া ছিটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়লো প্রচুর রক্তক্ষরনের ফলে ফারিয়া পথিমধ্যেই মারা যায় সে আর তার প্রিয় মানুষটার কাছে পৌছাতে পারলনা।হসপিটাল এ আমান এর জ্ঞান ফিরলো কিন্তু সে কেমন যেন পাগল এর মত আচরণ করছিল সে বুঝতে পারছিলনা সে কি হারিয়েছে।ফারিয়াকে হারানোর পর আমান অনেকদিন নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছিল কিন্তু সময় কারো জন্য থেমে থাকেনা। আমান এর সাথেও তাই হলো সে আবার স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপন করতে লাগলো কিন্তু কথায় আছে অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর। আমান এর সাথেও তাই হয়েছিল, তার সকল হাসি খুশি যেন ফারিয়ার সাথে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে।
হঠাৎ কারো ডাকে আমান এর সম্ভিত ফিরলো সে বটতলায় বসে আছে বিকেল থেকে রাত কখন হয়ে গেছে তার খেয়ালি নেই। আজ আমান একজন বড় ম্যাজিস্ট্র্যাট সে মাঝে মাঝেই বের হয় ওই অপ্রতিরোধ্য গতিগুলোকে থামাতে সে চায় না আর কেও তার মত চিরতরে হারিয়ে ফেলুক তাদের ভালোবাসার মানুষটাকে ওই অপ্রতিরোধ্য গতির কাছে।