আমার গল্প

আমার গল্প

মিহিন বেরিয়ে এল রুম থেকে। আমি রান্না ঘরে ছিলাম। ওকে দেখতেই আমার চোখটা ওরদিকে আঁটকে গেল। আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কিছু একটা যেন আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করছে। আমাকে খুব টানছে। আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। আমার বুকের ভেতর অদ্ভুত শিহরন হতে থাকল। যেন নতুম মিহিনকে দেখছি। নতুন কোনো মিহিনের প্রেমে পড়েছি। মিহিন স্লিভলেস টপসের সাথে জিন্স পরেছে। কালো জিন্স। টপসের কালার পিংক। ন্যাচারাল মেকাপ। গোল গোল চোখ দুটোতে গাঢ় কাজল দেয়া। কী সুন্দর করে কাজল দেয় ও।

আমি মুগ্ধ হই। চোখ দুটোর মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। ঠোঁটে রেড কালারের লিপস্টিক। আমার খানিকটা লোভ হয়। খুব ইচ্ছে হয় দৌড়ে গিয়ে ওর ওই লাল ঠোঁটে চুমু খাই। আমার ইচ্ছে ইচ্ছেই থাকে। চুমু খাওয়া হয় না। চুল গুলোও বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে। আমার মনে হয় না এই পৃথিবীতে অন্য কোনো মেয়ে এমন সুন্দরে করে চুল সাজিয়ে রাখতে পারে। হাতের গোলা ডায়ালের ঘড়িটাও বেশ মানিয়েছে। সব মিলিয়ে মিহিনকে বেশ লাগছে। ওকে চমৎকার লাগছে। আমি ওকে দেখছি আর নতুন করে ওর প্রেমে পড়ছি। আমি প্রতিবারই ওর প্রেমে পড়ি। যতবার দেখি ততবার। আমার মনে হলো ও আমার জন্যেই সেজেছে। আমার প্রায়ই এমন মনে হয়। কিন্তু প্রতিবারই আমার মন ভুল প্রমাণিত হয়। আমার কষ্ট লাগে। মিহিনটা কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে। আমার গুরুত্বটা ওর কাছে কমে গেছে। ও বদলে যাচ্ছে। আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম,

-কোথাও যাচ্ছো? মিহিন নিজের হাইহিল ঠিক করতে করতে বলল,
-হ্যাঁ, লারা আজ একটা পার্টি রেখেছে। ওখানে যাব।
-প্রতিদিনই তো যাও। আজ না গেলে হয় না?  মিহিন আমার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকাল এবার। বলল,
-আজ কি স্পেশাল কিছু আছে? আমি খানিকটা চুপ থেকে বললাম,
-আজ অফ ডে। তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব ভেবেছিলাম।
-সরি। আজ আমার যাওয়াটা খুবই জরুরি। আমরা নেক্সট উইকে যাব। কেমন? আমি বিড়বিড় করে বললাম,
-তোমার তো প্রতিদিন যাওয়াটাই জরুরি। ও যেন বুঝতে পারল। বলল,
-কিছু বললে?  আমি চুপ করে থাকলাম। মন খারাপ হলো আমার। মিহিন নিজেই বলল,
-দেখো, আমার জীবনে আমার ফ্রেন্ডদের ইম্পর্টেন্সি বেশি। আমি ওদেরকে কখনই এভয়েড করতে পারব না।
-আর আমি? আমাকে এভয়েড করবে?
-দেখো তুমি তোমার জায়গায় ওরা ওদের জায়গায়

। আর তোমার সাথে তো নেক্সট উইকে যাওয়া যাবেই। কিন্তু লারার সাথে তো আর দেখাই হবে না। ওর পরশু ফ্লাইট। লন্ডন যাচ্ছে। ওর হাজবেন্ডের সাথে ওখানেই সেটেল্ড হবে।
কথাটা যেন আমাকে ইংগিত করেই বলল। আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। ঠিক সেই সময়ে আমি আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা স্বীদ্ধান্ত নিলাম। যেটি আমি নিব নিব করে নিচ্ছিলাম না। প্রক্রিয়া চালু ছিল কেবল। তবুও আমি শেষবারের মতো বললাম,

-আজ কোনোভাবে এটাকে এভয়েড করা যায় না? কোনো ভাবেই কি যায় না?  মিহিনের রাগ উঠল যেন। খানিকটা কড়া স্বরে বলল,
-তোমাকে এতক্ষণ ধরে কি বুঝাচ্ছি আমি? কথা কি সহজ ভাবে বুঝতে পারো না?
-মিহিন,তুমি কি জানো, তুমি এভাবে আমাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছো?
-আবার শুরু করলে? তুমি না জাস্ট বোরিং একজন মানুষ।

আমি কোথাও যেতে চাইলেই তোমার মুখ দিয়ে এসব কথা বের হয়। ধ্যাত! তোমার সাথে কেন যে যে… বলে আর বলল না ও। খানিকটা চুপ থেকে ভ্রু কুচকে মুখে রাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম,
-ডিনার কোথায় করবে?

ওর জবাব এলো না। কেবল হাইহিলের টুপুস টুপুস আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনা গেল না। আমি দরজার কাছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। রান্নাঘরের দিকে চোখ যেতেই মনিরাকে দেখতে পেলাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে আমার জন্যে ভীষন মায়া দেখছি আমি। আহ! যার মায়া করার প্রয়োজন সে মায়া করল না। যে মায়া দেখাচ্ছে তার মায়া না হলে চলে। এটাই হয়তো জীবন। মনিরার বয়স আট বছর। আমাদের বাসার খুঁটিনাটি কাজ গুলো ও করে। সত্যি বলতে রান্না করা ছাড়া বাকি কাজ গুলো ওকেই করতে হয়। যদিও আমাদের বাসায় এতো বেশি কাজ নেই। মানুষ দুজনের যা হয় আরকি। মনিরা এবার ক্লাস ফোরে উঠেছে। ওকে পড়ানোর ব্যাপারের মিহিন কোনো দ্বিমত করেনি। তবে তার কাজ সময় মতো হলেই চলবে বলে বলেছে। মনিরার বাবা মা রাজি ছিলেন না। তাঁদেরকে আমিই ইম্প্রেস করি এবং ওকে স্কুলে ভর্তি করাই। খুবই ভালো একটা মেয়ে। নিজের বোনের মতো স্নেহ করি। আমি দরজা লাগিয়ে মনিরার কাছে গিয়ে বললাম,

-কিরে? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?  মনিরা সহজ গলায় জবাব দিল,
-এমনেই। আমি মাংস কাটা শুরু করলাম। মনিরা তখনও আমার দিকে তাকিয়েছিল। খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল,
-ভাইজান,আপায় প্রত্যেকদিন সন্ধ্যায় কই যায়?  আমি হাসলাম খানিকটা। বললাম,

-তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যায়। বুঝলি?
-দেখা করতে এত সময় লাগে নাকি? উনি কত্তো রাইত কইরা ফেরেন!
-তুই বুঝবি না এসব। বন্ধুবান্ধব পাইলে সবাই একটু মজামাস্তি করেই। স্কুলে তোর বন্ধু নেই? তুমি ওদের সাথে  হাসিতামাশা করিস না? মনিরা চুপ থাকল। আমিও চুপ থাকলাম। অথচ আমার ভেতরটা তখন জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। মনিরা আবার বলে উঠল,

-ভাইজান?
-হু
-আপায় কি রাঁধতে জানে না?
-জানে।
-তাইলে উনি রাঁধে না ক্যান?
-ব্যস্ত থাকে তো। তাই রান্না করে না। তা চা কফি তো ও-ই বানায়। তুই দেখিসনি? মনিরা এবারেও জবাব দিল না। খানিকটা আদুরে গলায় বলল,

-ভাইজান?
-হু
-আপনের খুব কষ্ট, না?
আমি ওর দিকে তাকালাম। বললাম,
-তোর কী হয়েছেরে? এগুলো কেমন প্রশ্ন করছিস?
– আপা এমন করলে আপনের কষ্ট হয়। আমি জানি।
-তুই ভুল জানিস। আমার কোনো কষ্টই হয় না। আমি ভালো আছি। তুই যা। তৈরি হয়ে নে।  মনিরা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। তার গাল ফুলে আছে। মাথা নিচু করে আছে। সে কান্না করে দিবে এমন একটা অবস্থা। আমি ওর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলাম। বললাম,

-মন খারাপ করছে?  ও কিছু বলল না। কেবল মাথাটা উপরনিচ করল। আমি ওর গালে হাত রেখে বললাম,
-মন খারাপ করিস না। আমি কয়েক মাস পর পর তোকে দেখে যাবো। কেমন?
ছোট্ট মনিরা কান্না শুরু করে দিল। আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-ভাইজান, আপনে আমারে নিয়া যান। আমি আপনার সাথে যামু।
-এভাবে বলিস না। তুই এখানে থেকে পড়াশোনা করবি। আমি তোর বাবার সাথে কথা বলব।
-না ভাইজান। আমি আপনার সাথে যামুই। যামুই যামু। আমি উঠে দাঁড়ালাম। মাংশটা চুলায় বসিয়ে দিয়ে মনিরাকে বললাম,
-ভাইয়ার হাতের শেষ বিরিয়ানি খাবি আজ। খেয়ে বলবি কেমন হয়েছে। ঠিকাছে?

মনিরা মুখ ভার করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। টু শব্দও করল না। রাত প্রায় এগারোটা বেজে গিয়েছে। আমি বাইরে হাঁটছি। সোডিয়াম লাইটের নিচ দিয়ে। ভালো লাগছে না কিছুই। মন ভীষণ খারাপ। মনিরাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে মন চায়নি। তবুও দিয়ে এলাম। এখানে থাকলে ওর প্রব্লেম হবে। কারণ সামনের দিন গুলো চরম খারাপ হবে আমার জন্যে। মেয়েটা ভালো করে পড়ে মানুষ হোক। এটাই চাই আমি। ওর খারাপ চাই না। যদিও আমার চাওয়া পাওয়ার দাম বিধাতার কাছে আছে কি না কে জানে। থাকলে হয়তো আমার সাথে এমন হতো না। মিহিন এমন করত না। আমি বুঝে পাই না। মিহিন এমন করছে কেন? এভাবে চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে কেন? আজকাল সে লেট নাইট পার্টি করে বাসায় ফেরে।

ড্রিংকস করে। অথচ আমি আজ পর্যন্ত সিগারেট ফুক দেইনি। আমাদের প্রেমটা তার ইচ্ছেতেই হয়েছিল। আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। বিয়ে করে স্বাধীনতা চাইল। আমি বাধা দিলাম না। মেয়েরা মনে করে বিয়ে করে তারা অন্যের অধিনে হয়ে যায়। স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। প্রায় অনেকের ধারণাই এমন। মিহিন এমনটা ভাবতেও পারত না। সে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করত। আমিও ওকে সাপোর্ট করতাম। আমার মতে বিয়ে করে কি আমি গোলাম কিনে এনেছি? সারাদিন তাকে বাসায় খাটাব? রাতে এসে ঝাড়ি দিব? এটা ওটার ফরমাশ দিব? এমন কেন হবে? কেন তার স্বাধীনতা থাকবে না। কেন সে নিজের মতো করে চলতে পারবে না? কিন্তু আমি তখনও জানতাম না আমি একটা বৃহৎ ভুলের মাঝে আছি। আমি ভুল করেছি। মিহিনকে এভাবে ছেড়ে দেয়া উচিৎ হয়নি।

খুব বড়সড় ভুল করে ফেলি আমি। এর মাসুল আমাকেই গুনতে হবে। এসব ভাবছিলাম আর হাঁটছিলাম। হাঁটতে কোথায় চলে এলাম টের পেলাম না। ঘোর ভাঙ্গল কারো ধাক্কায়। দেখলাম কয়েকজন লোক আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বুঝে গেলাম আমাকে লুট করা হবে এখন। আশেপাশে তাকালাম। কাউকে দেখা গেল না। এ কোথায় চলে এলাম? কিছুই তো চিনতে পারছি না। সামনের দিকে সব অন্ধকার। এলাকার সবাই কি ঘুমায়া গেছে? ল্যাম্পপোস্ট গুলো আলো দিচ্ছে না কেন? আমি কি কোথায় ফেঁসে গেলাম? একটা ছেলে একটি ছুরি নিয়ে এগিয়ে এল। বলল,

-এইডা চেনেন? জায়গা মতো এইডার ব্যবহার করলে মারাত্মক ক্ষতি হয়। বুঝলেন? আমি সোজা সাপ্টা উত্তর দিলাম,
-বুঝলাম।
-কী বুঝলেন?
-আপনি যা বুঝাতে চেয়েছেন।
-আমি কী বুঝাতে চেয়েছি?
-সেটা আপনিই ভালো জানেন।
-কেন? আপনি জানেন না?
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। ছেলেটা আবার বলল,
-দেন! যা আছে বের করে দেন।
-আমার কাছে কিছুই নেই ভাই।
-ওই? বিটলামি করোস আমার লগে? এতক্ষণ ভালা ভালা কতা কইছি দেইখা কি ভাবচস? আমি বোকা? আমারে দেইখা তোর বোকা মনে হয়?
-জ্বী না। আপনাকে দেখে আমার বোকা মনে হয় না।
-এই, তুই দেখি পটাং পটাং কইরা কথা কস। তোর ভয় করে না?
-জ্বী না। আমার ভয় করে না।
-এত সাহস তোর? বাব্বাহ! দাঁড়া তোর সাহস ভাঙ্গামু আইজ। কইরে? চল। মুরগি পাইয়া গেলাম। এইডারে রোষ্ট করবি না তোরা?

তারপরের সব কিছু দ্রুত হতে থাকল। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। একের পর এক মার পড়তে থাকল আমার উপর। রাস্তায় ফেলে লাত্থি মারতে থাকল। মাথার কাছে আঘাত করা হলো। পাঁয়েও। আমি ভীষণ ব্যাথা অনুভব করলাম। চিল্লানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু চিল্লাতে পারলাম না। ওরা আগেই আমার হাত আর মুখ বেঁধে নিয়েছে। তাদের এমন আঘাত আমি সহ্য করতে পারলাম না। আমার চোখে জল চলে এল। আমি বাচ্চাদের মতো কান্না করে দিলাম। ঠিক তখনই একটি কার এসে থামল। সেটির হেডলাইটের আলো পড়ছিল আমার চেহারার উপর। আমি চোখ বন্ধ করে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকি রাস্তার উপর। কেউ একজন গাড়ি থেকে বের হয়। দরজা খোলার শব্দ পাই আমি। ছেলে গুলো চলে গেছে তার আগেই। নিজেদের আড়াল করেছে। আমি মাথায় প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করি। তল পেটে ব্যাথা করে। আমি চোখ মেলতে পারি না। শক্তি কুলিয়ে আসে না। দম বন্ধ আসে। ঠিক তখনই একটি নারী কণ্ঠ শুনতে পাই।

-এই, হ্যালো? আপনি ঠিকাছেন?

আমি তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না। মুখ দিয়ে শব্দ আসছিল না। শব্দ বের করার শক্তি হারিয়ে ফেলি আমি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকি রাস্তার উপর। ঘুম আসতে থাকে ভীষণ ক্লান্তিতে। মেয়েটা আমাকে উপড় করে এবার। আমাকে দেখতেই বলে উঠে,

-আরেহ! আপনি?

ঠিক তারপরেই আমি জ্ঞান হারাই। মনে একটা আক্ষেপ থেকে যায়। জানার কৌতুহল রয়ে যায়। মেয়েটা কী আমাকে চেনে? আমার যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন আমি নিজেকে একটা রুমে আবিষ্কার করি। সম্ভবত এটা কোনো হাসপাতালের কেবিন। আমি চোখ মেলে চারপাশে দেখতে থাকি। নামীদামী হাসপাতালের কেবিন গুলো সুন্দর হয় যাতে রোগি মানসিক প্রশান্তি পায়। এই হাসপাতালটাও মনে হয় নামীদামী হবে। এই রুমটা আমার কাছে চমৎকার লেগেছে। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাকে কেউ কেন এত ভালো হাসপাতালে এডমিট করাবে। রাস্তা কাউকে পেলে তাকে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাওয়া হয়। প্রাইভেটে না। আমি এখানে কীভাবে? উত্তরটা এর অল্পকিছু পরেই পেয়ে যাই। আমার ডান পাশে একটা মেয়েকে দেখে। সে একটা চেয়ারে বসে আছে। ঘুমে ঢুলছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। বুকের ভেতর কেঁপে উঠল আমার। ভীষণ মায়া হয় তার জন্যে। আমার জন্যে কতো কষ্ট করল সে। এখন রাত জাগছে। আমি কীভাবে তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করব? আমি জানি, ওর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার কোনো ক্ষমতা নেই আমার।

আমি তার যোগ্য না। আমি এও জানি এই মেয়ে আমার জন্যে সব করতে পারবে। সব। আমি ওকে বেশ ভালো করেই চিনি। ভার্সিটিতে আমার জুনিয়র ছিল। কঠিন পড়াকু মেয়ে ছিল ও। সারাদিন বইয়ের সাথে লেগে থাকত। এছাড়া আর কোনো কাজই সে করত কি না সে সম্পর্কে আমি অবগত নই। অন্তত আমি যখনই দেখতাম ওকে তখনই সে হাতে একটা বই নিয়ে বসে আছে। বইটার দিকে মনমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি দেখতাম,সবাই দেখত। অথচ এর আড়ালেও সবার একটা বৃহৎ জিনিস অদেখা রয়ে গেল। যেটা কেবল সে জানে। হয়তো ভাগ্যক্রমে আমিও। মেয়েটা যে আমাকে কী পরিমাণ ভালোবাসত সেটা আমি ওর ডায়েরীটা না পড়লে বুঝতে পারতাম না।

আমি জানতে পারি একটা পড়াকু মেয়েও কাউকে পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে। তার জন্যে সব করতে পারে। এমন কী সে আমার জন্যে নিজের ভালোবাসাটাকেও বিসর্জন দিয়ে দিল। আমি আজও ওই ডায়েরীটা আগলে রেখেছি। খুব গোপনে। বিয়ের পর যখনই ডায়েরীটা পড়তাম তখনই খুব আপসোস হতো। ভাবতাম, মেয়েটার ডায়েরীটা আগে কেন পাইনি। সত্যি বলতে আমার আজকাল এমনই মনে হচ্ছে, মিহিনকে বিয়ে করাটা আমার ভুল ছিল। এরচে নীরাই ভালো। নীরা, মেয়েটার নাম। যে সারাদিন পড়ত। আর আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত। আমার সাথে প্রেম করত কল্পনায়। তার কল্পনার কথা ডায়েরিতে লিপি বদ্ধ আছে। আমাকে নিয়ে তার প্রতিটি স্বপ্নের কথাও। অথচ আমি যদি ভার্সিটিতে ওর ব্যাচের কাউকে এই কথাটা বলতাম সে চোখ বন্ধ করে আমায় বলত যে ভাই, আপনি পাবনায় যান। আপনার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন। নীরা আর প্রেম? সম্ভব কখনও?

– আপনার ঘুম ভেঙ্গেছে? আমি ওর দিকে তাকালাম। সে মায়াভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম,
-কেমন আছো নীরা?  ও মেকি হাসল। আমি ভালো করে লক্ষ্য করলাম। ওর ঠোঁট কাঁপছে। হাত কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-ভা-ভা-ভালো। এই বলে ও চুপ হয়ে গেল। আমিও চুপ থাকলাম। খানিকটা সময় নীরাবতায় কাটল। নীরাবতা ভেঙ্গে আমি বললাম,
-ক’টা বাজে বলতে পারবে? নীরা নিজের হাতের ঘড়িটা দেখল। বলল,
-সাতটা বেজে গিয়েছে।
-সকাল সাতটা?
-জ্বী।

-তুমি এতক্ষণ রইলে যে? বাসায় চলে যেতে? ও মাথা নিচু করে বলল,
-আমি গেলে আপনাকে দেখবে কে?
-আমার তেমন কিছু হয়নি। অন্তত দেখার জন্যে মানুষ প্রয়োজন ছিল না।
-হ্যাঁ আপনাকে বলেছে। পরে যদি সত্যি সত্যি কিছু হয়ে যেত?
-কিছু আর কী হবে? সর্বশেষ আমি মারা যাব। এইতো? নীরা জবাব দিল না। সে মুখ কালো করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিল। আমার মনে হলো ও কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে। কিছু সময় পার হলো। কোনো শব্দ হলো না। শেষে নীরা বলল,

-কী দরকার ছিল এত রাতে বাইরে বের হওয়ার? আজ আমি না এলে হয়তো…
আমি আর জবাব দিলাম না। ভাবছিলাম আগের কথাটা বলব। বললে হয়তো ও সত্যি সত্যি কান্না করে দিবে। নীরা আবার বলল,

-ভাবি কি খেয়াল রাখে না নাকি? আপনি দেখছি শুকিয়ে গেছেন অনেক।
-নীরা তুমি কি আমাকে একটু হেল্প করবে? আমি বাসায় যাব।
-থাকুন না আরেকটু। এতো জলদি কিসের?
-তোমার ভাবি চিন্তা করবে।

ও কিছু বলল না আর। চুপ করে থাকল। আমি ওর চুপ থাকায় খানিকটা ঈর্ষা দেখতে পেলাম। ওর চোখে তা ভাসছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসলাম। নীরা আমাকে হেল্প করার জন্যে উঠে এল। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে কেউ একজন দৌড়ে এল। এসেই আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি তাকালাম না মিহিনের দিকে। তাকাতে ইচ্ছে হলো না। দরজার দিকে চোখ যেতেই দেখলাম মিহিনের বাবা এবং দুই ভাই এসেছে। তারা কেন আসলেন সেটা বুঝে উঠতে পারলাম না আমি। মিহিন ভেজা গলায় বলল,

-কি হয়েছে তোমার? হাসপাতালে কেন? জানো তোমার চিন্তায় আমি অস্থির হয়ে গেছি। কতো খুঁজেছি তোমায়। বাবা ভাইয়া সবাই খুঁজেছে। কোথায় গিয়েছিলে তুমি? এই অবস্থা কী করে হলো? আমি চুপ থাকলাম। নীরা উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম,

-নীরা? তোমার সাথে কথা আছে আমার।  নীরা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমি তাকিয়ে থাকলাম দরজার দিকে। মিহিন বলে উঠল,
-মেয়েটা কে?  আমি ওর প্রশ্নের জবাব দিলাম না। ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আসসালামুআলাইকুম বাবা। কেমন আছেন? তিনি এগিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন। বললেন,
-ভালো। কিন্তু তোমার এই অবস্থা হলো কী করে?
– ঘরে লবন শেষ হয়ে গিয়েছিল। লবন আনতে গিয়েই চিনতাইকারীর মুখোমুখি হই।
-তোমাদের ওইদিকে তো এমন হওয়ার কথা না। সিকিউরিটি গার্ড থাকে সব সময়।
-আমিও বুঝতে পারছিলাম না। এটা কীভাবে যে হলো?
-এখন কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ। বাসায় যেতেই শোয়া থেকে উঠে বসলাম। তখনই আপনারা এলেন।
-আচ্ছা। তাহলে চল। বাসায় যাওয়া যাক।

মিহিনের বাবারা অল্প কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেন। আমি আমাদের রুমে ছিলাম। আধশোয়া হয়ে বসেছিলাম। কিছু সময় পরেই মিহিন রুমে এলো। একেবারে আমার কাছে এসে চেয়ার টেনে বসল। বলল,

-তখন থেকে দেখলাম তুমি আমার সাথে কথা বলছো না। এমনকি আমার দিকে তাকাচ্ছোও না। কেন বলতো?  আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। একটা হাই তুললাম কেবল। মিহিন বলল,
-রাগ করে আছো?  আমি এবারেও কিছু বললাম না। ও নিজেই বলল,
-কাল রাতে বাসায় জলদিই ফিরেছিলাম। তোমার রান্না করা বিরিয়ানিটা জাস্ট অসাধারণ হয়েছে। যদিও প্রতিবারই ভালো হয়। বাই দ্য ওয়ে মনিরা কোথায় গেল? ওকে দেখছি না যে? ও নিজেই কথা বলে যাচ্ছে। আমি চুপ করে আছি। ওর এসব কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই।

-পাজিটা মনে হয় পালিয়েছে। এই মেয়ে গুলো এমনই হয়। দাঁড়াও আমি ওর বাবাকে ফোন দিচ্ছি।
মিহিন চেয়ার ছেড়ে উঠবে ঠিক তার আগেই আমি বললাম,

-দাঁড়াও। ওর বাবাকে ফোন দেওয়া লাগবে না। আমিই ওকে ওর বাসায় রেখে এসেছি।
-ওর বাসায় রেখে এসেছো? কেন?
-আমার ইচ্ছে। ওকে এনেছি আমার ইচ্ছেতে, এখন দিয়েও এসেছি আমার ইচ্ছেতে। আর এছাড়া ও এখানে থাকবে  কই? কার কাছে থাকবে?
-মানে? কিসব বলছো তুমি? কার কাছে থাকবে মানে?
-একটা কথা বলতো আমায়? তোমার সাথে কতদিন পর আমার এভাবে সামনাসামনি বসে কথা হয়েছে? কতদিন পর  তুমি আমার খবর নিয়েছো? জানতে চেয়েছে কেমন আছি। কত দিন পর?
ও কোনো জবাব দিল না। মাথা নিচু করে ফেলল। চুপ থাকল। আমি বললাম,

-এক মাস আঠারো দিন চলছে। আমাদের এমন ভাবে কথা হয়নি। বিয়ে হয়েছে মাস চারেক হবে। এর মাঝে একমাস আঠারো দিন আমরা হেলায় হেলায় কাটিয়েছি। এটাই ছিল আমাদের দুজনের মাঝের গভীর ভালোবাসা। আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসতাম তাই না?  মিহিনের জবাব পাওয়া গেল না। আমি আবারও বললাম,

-অহ সরি। তোমার কাছে তো তোমার ফ্রেন্ডরাই বেশি ইম্পোর্টেন্ট। তাই তো রোজ হয় অফিস থেকে আসতে কিংবা আফিস থেকে ফিরে বাসায় এসে আবার যেতে। তাই না?  মিহিন মন মরা করে বলল,
-তুমি তো জানো। আমি এমনই।
-তোমার এমনই’র কারণেই তো আজ এ অবস্থা।

আমার দাম কমে গেছে তোমার কাছে। কেয়ার করছো না আমার। ভালোবাসা তো বাদই দিলাম। আসছো যাচ্ছো। এইতো। আর কি বললে না! লারার কথা। লারা চলে যাবে। পরশু ওর প্লাইট। লন্ডন সেটেল্ড হবে। এসব সত্য? আমাকে তুমি শেখাও? কি ভাবো? আমি তোমার খবর রাখি না?আমি জানি না তুমি কি করো? কোথায় যাও?

-এই? কী বলছো তুমি এগুলো। আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছি?
-তুমিই বলো। তুমি আমাকে সত্য বলেছো? মিহিন কিছু বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে থাকল জলভরা দৃষ্টিতে।
-মিহিন,আমি তোমাকে বলেছি। তুমি এভাবেই আমাকে হারিয়ে ফেলবে।

তখন তোমার মনে হয়েছে আমি বোরিং। অযথা ঝগড়া শুরু করি। মিহিম, তুমি আমাকে আজ সত্যিই হারিয়ে ফেলেছ। একদম হারিয়ে ফেলেছ। তুমি জানো না। তোমার অপূর্ণাতা আমায় কী ভীষণ কষ্ট দেয়। আমি রোজ রাতে কান্না করি। তুমি দেখো না। কাল দুপুরে খাইনি। রাতেও না। অথচ তুমি সেটা জানতেই পারলে না। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, আমি তোমার জীবনের আনন্দ হয়ে আসব। তোমার স্বাধীনতা হবো। তোমাকে কষ্ট দিব না। তোমার সাথে থাকব। তুমি যা চাইবে তাই করবে।

আমি চেয়েছি এসব। তোমাকে দিয়েছি। আমার ভাবনায় ছিল বিয়ের পর বাকি জীবন একসাথে আনন্দে কাটাব। স্বাধীনতাটাও একসাথে ভাগ করে নিব। অথচ তুমি সেই আনন্দ, সেই স্বাধীনতা একাই উপভোগ করতে শুরু করলে। আমাকে তোমার সার্কেলে নিয়ে যেতেও তোমার মাঝে দ্ধিধা দেখি। তুমি চাও না। আমি তোমাকে বলেছি, তোমার সুখে বাধা হবো না আমি। আমি তোমার সুখে বাধা হইনি কখনও। আর হবোও না।  আমি মিহিনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার চোখে জল জমতে থাকল। সামনের দিকটা ঝাপসা হলো দ্রুত। আমি চোখ মুছলাম। মিহিম পাথরের মতো আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার দৃষ্টি আমি আপরাধবোধ দেখি। দুঃখ দেখি। কষ্টও। মিহিন ধরে আসা গলায় বলে,

-তুমি কী বলতে চাইছো? আমি যা ভাবছি তাই? আমি বললাম,
-হ্যাঁ।
-প্লীজ, আমাকে এতবড় শাস্তি দিও না। আমি সহ্য করতে পারব না।
-শাস্তি তো শাস্তিই। অসহ্য হলে সহ্য করতে হয়।
-তুমি জানো না।

কাল তুমি এক বেলা ছিলে না আমার কাছে। আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাবলাম তুমি চলে আসবে। তুমি আসোনি। পুরো রাত জেগে থাকলাম। তুমি এলে না। বাবাকে ফোন দিলাম। বাবা আর ভাইয়ারা এল। তারা খুঁজতে বের হলো। থানায় ফোন করল বাবা। আমি নিজেও বের হলাম তোমার খোঁজে। এক মূহুর্তের জন্যে মনে হলো আমি তোমায় হারিয়ে ফেলেছি। বিশ্বাস করবে তখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন।

-মিহিন,তুমি আমাকে আরো আগেই হারিয়ে ফেলেছ।
-প্লিজ! এভাবে বলো না। আমি মারা যাব তাহলে।
-আমরা প্রমিস করেছিলাম। আর যাই হোক কেউ সুইসাইড করব না। অন্তত একটু যদি ভালোবেসে থাক তাহলে
আমাদের ওই প্রমিসটা রাখবে।

-প্লীজ, এমন করো না। একটু ভুল তো হবেই। তবুও কী তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না।
-ভুলটা তোমার জন্যে সামান্য হতে পারে। আমার জন্যে না। আমি কি তোমাকে নিষেধ করিনি। বাধা দেইনি না যেতে? আমাকে সময় দিতে বলিনি? তুমিই তো কাল কাল করে কাল ডেকে আনলে।
-আচ্ছা ঠিকাছে। আমি আর কোনোদিনই পার্টিতে যাব না। কোনোদিনই না। আই প্রমিস।
-মিহিন, প্লিজ, আমাকে আর অপরাধী বানাইও না। আমি চাই তুমি সুখে থাক। আমার জন্যে কেন তুমি নিজেকে সুখ থেকে বঞ্চিত করবে?
-আমার সুখ তো তুমিই। জানো না?
-তোমার এই সুখ তোমার অবহেলায় পাথর হয়েছে।
-না না এমন বলো না। আমার কষ্ট হয়।
-তোমার মনে আছে? একুশে ফেব্রুয়ারির কথা?

সেদিন রাতে তুমি ড্রিংকস করে বাসায় ফিরেছ। এর পরের দিন প্রমিস করেছো। আর কখনই পার্টিতে যাবে না। তুমি সেই প্রমিসটা রাখলে না। তোমার কাছে প্রমিসের মুল্যই নেই। মিহিন আমার হাত টেনে নিল। হাতে চুমু খেল। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল,

-না। প্লিজ। এমন কইরো না। তুমি ছাড়া আমি অপূর্ণ।
-তোমাকে অপূর্ণতার দেওয়ার জন্যেই তো আমি তোমাকে ত্যাগ করছি। মিহিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিল আমার কাছ থেকে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কেবল। আমি ওর হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে রেখে বললাম,

-একটা কথা বলব না ভেবেছিলাম। কিন্তু কথাটা না বলে থাকতে পারছি না। ভেতরটা খুব জ্বলছে আমার। এই হাতটা আমি একদিন ধরেছিলাম। এরপর আর ছাড়িনি। কিন্তু আজ ছাড়তে হচ্ছে। জানো কেন? কারণ এই হাতটা এখন অন্য কেউ ধরে ফেলেছে।

-মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?
-মিহিন,তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও। আমার রাগ উঠছে। তুমি জানো আমার রাগ উঠলে আমি বাজে বিহেভ করি ।
-না। আমি যাব না। আগে তুমি বলো আমার হাত কে ধরেছে? কখন ধরেছে?
-তুমি জানো না? অভিনয় করছো? ওইদিন সোহান নামের ছেলেটা তোমার হাত ধরেনি? বলো ধরেনি?
-আরে ওটা তো এমনিই ধরেছে। আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়েছে কেবল। তুমি ভুল বুঝছো।
-আমি ভুলই বুঝি। হাত ধরে এখানে গাড়ি থেকে নামায়। তাহলে ওখানে কী করে?
-কি বলছো এসব? আমাকে বিশ্বাস করো না তুমি?
-মিহিন, আমি আর কথা বলতে চাই না।তুমি চলে যাও এখান থেকে। ও কান্না করে দিল। কান্না করতে করতে বলল,
-না। আমি যাবো না।
-তাহলে তুমি থাকো। আমি যাই।
-এই? এমন করছো কেন তুমি? যেও না। প্লিজ। আমাকে ছেড়ে যেও না।

শেষঃ আমি চলে যাচ্ছি। এখানে থাকব না আর। এই শহর আর ভালো লাগে না আমার। ট্রান্সফারটা নিজেই করিয়েছি। কেবল এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। নিজের ব্যাগটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। বসার ঘরে মিহিনের মা বাবা বসে আছেন। উনাদের মন খারাপ নিশ্চয়ই। মিহিন কান্না করছে। আমার রুমে ছিল এতক্ষণ। এই মাত্র আমার সাথে বেরিয়ে এল। আমার পিছনে এসে দাঁড়াল। আমার হাত ধরল। কান্না করতে করতে গলার স্বর পালটে গেছে ওর। নিচু গলায় বলল,

-যেও না। প্লীজ! আমি ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-বাবা, আমি তিনমাস পর আবার আসবো। উকিলের ঠিকানা দিয়ে গেছি আপনার মেয়ের কাছে। উকিল আমার বন্ধু। কোনো প্রব্লেম হবে না আশা করি। ওর বাবা উঠে এলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

-তুমি তো একমাস আঠারো দিন অপেক্ষা করেছো। আমি তাও করতাম না। তুমি চেষ্টা করেছো অনেক। কিন্তু আমার মেয়ে বাধা মানেনি। পারলে ওকে ক্ষমা করে দিও বাবা।

-ওর প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। যত ভুল আমারই। আচ্ছা। যাক। এসব বলে আর কী লাভ। আমি যাই। হয়তো শেষবারের মতো আবার দেখা হবে। আর মিহিন! নীরা নামের একটি মেয়ে আসবে আমার খোঁজে। তাকে ওই জিনিসটা দিয়ে দিও। বলিও এটা আমার পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া একটা বিশেষ উপহার। এই বলে আমি থামলাম। কিছুক্ষণ পর চুপ থেকে বললাম,

-মিহিন আমি যাই। ভালো থেক তুমি।

আমার গলাটা ধরে এল। খুব কষ্ট হলো কথাটা বলতে। মিহিন আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইল। ওর মা ওকে ধরে রাখলেন। চড় দিতেন হয়তো। আমার কথা রেখে দেননি। আমি বলে দিয়েছি আমি যাওয়ার পর যেন ওর উপর মেন্টালি ফোর্স না করা হয়। মিহিন কান্না করছে। শব্দ করে কান্না করছে। আমি থমকে দাঁড়ালাম। পাঁ কাপছে। সামনে যাওয়ার সাহসটুকু পাচ্ছি না।

আমার কি ফিরে যাওয়া উচিৎ? ওকে জড়িয়ে ধরা উচিৎ? আমি কী করব? হাহ! আমার একটাই করণীয়। সামনে এগিয়ে যাওয়া। পেছন ফিরে তাকানোর কোনো মানেই নেই। আবেগ আবেগ খেলা প্রচুর হয়েছে। আর না। সব এখানেই শেষ। আমি বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। হাঁটতে থাকলাম দূর অজানায়। অজানা কোনো শহরের পানে। একটু সুখের খোঁজে। হ্যাঁ এটা আমার গল্প। আমার নাম সাকের আহমেদ তাসফি। এটা আমার আর মিহিনের গল্প। আমার আর মিহিনের শেষ ভালবাসার গল্প। মিহিন। তোমার শহর দিয়ে গেলাম তোমায়। ভালো থেকে তুমি।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত