শুধু একবার ফিরে এসো

শুধু একবার ফিরে এসো

আমি তখন বিশ বছরের তরূণী। পরিবার থেকে আমার বিয়ে ঠিক করা হলো চল্লিশ বছরের এক মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে। আমার বয়সের দ্বিগুণ বয়স তার। আবার তিনি ছিলেন বিপত্নীক। আর আমি সদ্য প্রস্ফুটিত ফুল। কুমারীত্বের গন্ধ সবে তীব্র হতে শুরু করেছে।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। বাবার সামান্য আয়ে আমাদের সংসার চলতো। আমার মা কখনো অভিযোগ করেন নি। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে স্বামীর সাথে থাকতে পারাটাই তার কাছে ছিলো সুখের সংজ্ঞা। শুনেছি একবার নাকি বাবার বিলেত যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। মা নাছোড়বান্দা। তিনি দুবেলা পান্তা খাবেন। কিন্তু স্বামীকে দূরে পাঠাবেন না! এতে আয় কম হলে হোক। পেটে কিছু পড়লেই হলো।

আমিও মার মতোই স্বপ্ন দেখতাম। অল্প রোজগারে সাজানো সংসার। অভাব থাকলে থাকবে। তবে ভালোবাসা থাকতে হবে অফুরন্ত।

আমার বেলায় তাদের মত পাল্টে গেলো। বিত্তশালী এক লোকের সাথে তারা আমার বিয়ে দিয়ে দিলো। উনার আগের ঘরের দুটো বাচ্চাও আছে। বাসর রাতে লোকটি শান্ত ভঙ্গিতে আমার পাশে এসে বসে। নাক সিটকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেই। মনে মনে “বুড়ো” বলে গালিও দেই। বিষয়টা বুঝতে পেরে উনি বলেন,
_ আমি জানি, আমাকে তোমার পচ্ছন্দ নয়। আমার মনোরঞ্জনের জন্য আমি বিয়েটা করি নি। বাচ্চা দুটো খুব মা কাতুরে জানো? সেলিনা মরে যাওয়ার পর সবসময় ওরা মাকে খুঁজে বেরায়। মায়ের জন্য কাঁদে। আমি তোমার কাছে স্বামীর অধিকার চাইতে আসি নি। তবে অনুরোধ করে বলছি বাচ্চা দুটোকে আগলিয়ে রেখো।
কঠিন স্বরে তাকে বলি,
_ আপনার বাচ্চাদের আমি খেয়াল রাখবো তবে আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। আর আমি বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা ঘরে থাকবো। সেই ঘরে আপনি যেতে পারবেন না।
উনি হেসে বলে,
_ বেশ। তুমি যা চাবে তাই হবে। এখানে তুমি নিরাপদেই থাকবে।
শুধু এটুকুনি বলেই লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আমি অবাক হয়ে চেয়ে দেখি তার প্রস্থানের পথ।

বুড়োকে আমার সহ্য হতো না ঠিক, তবে তার বাচ্চা দুটো খুব দ্রুত আমার মনে বিশালাকারে জায়গা করে নেয়। গর্ভে ধারন না করেও যে মা হওয়া যায় তার বাস্তব প্রমাণ ছিলো তারা। ভার্সিটি থেকে যখন বাসায় ফিরতাম, দীর্ঘ তিন ঘন্টা পর আমায় দেখতে পেয়ে তারা কি যে খুশি হতো! “মা” ডাকের স্বমসুরে তারা আমার তৃষ্ণার্ত প্রাণ ভিজিয়ে দিতো।

একবার প্রচন্ড জ্বরে কাতরাচ্ছিলাম। বুড়ো খুব উসখুস করছিলো। অস্থিরতা নিয়ে আমার ঘরের দরজার সামনে অনবরত পায়চারি করছিলো। তার ভেতরে ঢোকা বারণ। বাচ্চা দুটোর একজনের হাতে ওষুধ আরেকজনের হাতে পানি ভর্তি বাটি দিয়ে ফিসফিস করে বলেছিলো,
_ মার জ্বর হয়েছে। মাকে ওষুধ খাওইয়ে জলপট্টি দিয়ে দাও। যাও।
বাধ্য ছেলেমেয়ের মতো তারা আমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়েছিলো। গুটি গুটি হাতজোড়ায় ভাত মেখে আমায় খাওইয়ে দিয়েছিলো!
আর বুড়ো? দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো। হয়তো ভাবছিলো, কখন ওপর মহল থেকে অনুমতি প্রদান করা হবে,
” ভেতরে আসতে পারেন!!”

বুড়োর ঘর পেরিয়ে আমাকে রান্নাঘরে যেতে হতো। প্রায় সময়ই দেখতাম তিনি তার প্রথম স্ত্রীর ছবির সামনে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছেন। প্রথম দিকে বিষয়টা ভালো লাগলেও পরেরদিকে খুব রাগ হতো। কেনো হতো বুঝতে পারতাম না।

ইদের আগের দিন আমি রান্না ঘরে পায়েস রান্না করছিলাম। বাচ্চা দুটো বায়না করেছে তারা গুড়ের পায়েস খাবে। আমিও উৎফুল্ল মনে আমার বাচ্চাদের জন্য রাঁধছি। এমন সময়, মানুষটা রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতে বেশ বড়সড় বাদামী রঙের একটা প্যাকেট। উনি সামান্য ঝেড়ে কেশে বললেন,
_ এটা তোমার জন্য।
আমি বললাম,
_ কি আছে এতে?
_ কাজ শেষ করে খুলে দেখো। আশা করি তোমার পচ্ছন্দ হবে। এই টেবিলের ওপর প্যাকেটটা রেখে গেলাম।
উনি চলে গেলেন। আমি রান্না শেষ করে প্যাকেট হাতে নিজের ঘরে চলে এলাম। খুলে দেখি খুব দামী এক খানা শাড়ি। সাথে একখানা চিরকুট ও আছে। তাতে লিখা, ” তোমায় নীল আর সাদায় বেশ মানাবে। জানি আমার জোর করার অধিকার নেই। তবুও আগামীকাল শাড়িটা পড়লে খুব খুশি হবো। ”

শাড়িটা আমার পচ্ছন্দ হয় নি। কিন্তু চিরকুটের কথাগুলো আমায় বাধ্য করেছিলো ইদের দিন শাড়িটা পড়তে। বুড়ো সেদিন গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। অনেকবার চোখে চোখ পড়েছে। লজ্জায় সে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু পুনরায় তাকানোর লোভ উপেক্ষা করতে পারে নি।

প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত লোকটির চিলেকোঠার ঘরের টেবিল ল্যাম্প জ্বলতো। ধূসর রঙের এক ডায়রির ওপর সে মুখ থুবড়ে পরে থাকতো। বিরামহীনভাবে কিছু না কিছু লিখে যেতো। আর লিখা শেষে, চশমা খুলে চোখ জোড়া কচলিয়ে যত্ন করে ডায়রি তুলে রাখতো। যেনো কোনো মূল্যাতীত বার্তা রাখা আছে সেখানে।

বুড়োর চায়ের নেশা ছিলো। একদিন বিকেলে অসাবধানতা বশত চায়ের পাতিল ফসকে গরম পানি আমার হাতের কিছু অংশে পড়ে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠি। তিনি আমার চিৎকার শুনতে পান। উন্মাদের মতো ছুটে আসেন।
_ কি হয়েছে?
_ হাতে গরম পানি পড়েছে।
_ কই দেখি?

তিনি উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে আসেন। আমার হাত ধরেন। সেই স্পর্শে কোনো চাহিদা ছিলো না।
কোনো আকাংখা ছিলো না। তবে মিশে ছিলো অনুরাগ। না বলা অনেক অনুরক্তি। সেদিন তিনি আমার হাতে বার্নল লাগিয়ে দিয়েছেন। আমি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করি নি। মানুষ বেঁচে থাকলে বদলায়। আমিও মানুষ। এ নিয়ম অবজ্ঞা করার সাধ্যি কি আমার আছে?

Blessings are not valued till they are gone. প্রচলিত সত্যি। দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বোঝে না। মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কখনো কখনো এতটাই দেরী করে ফেলে, ফলাফল হয় শূন্য।

বেশ কয়েকদিন ধরেই বুড়ো তীব্র মাথা ব্যাথার যন্ত্রণায় ভুগছিলো। রাতে ঘুমুতে পারেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে বললাম ডাক্তার দেখাতে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
_ তুমি যাবে আমার সাথে?
_ যাবো।
বুড়ো খুশি হয়ে গেলেন। আমি উনার সাথে ডাক্তারের কাছে গেলাম। সিটিস্ক্যান করা হলো। এম আর আই করা হলো। ডাক্তার আমায় আলাদা করে ডেকে বললো,
_ রোগীর ব্রেইন টিউমার হয়েছে। টিউমারের অবস্থা ভালো নয়। চিকিৎসা করিয়ে বিশেষ কোনো লাভ হবে না।
_ চেষ্টা করতে তো কোনো দোষ নেই। আপনি ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে রোগীকে আজই ভর্তি করা হোক।

ডাক্তারের সাথে কথা বলে বাইরে বেড়িয়ে আসি। বুড়ো আমায় দেখে ফ্যাকাসে হাসলো। আমি ধীর পায়ে টলতে টলতে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার বিবাহিত জীবনে সেদিনই প্রথম তাকে জড়িয়ে ধরি। দুই বাহু প্রসার করে জড়িয়ে ধরি। আমার চোখ দিয়ে অজস্র ধারা সেদিন টপ টপ করে ঝড়ে পড়ছিলো।

ডাক্তারের সকল চেষ্টা আর আমার প্রার্থনা দুটোই বিফলে যায়। শাস্তিস্বরূপ উপরওয়ালা বুড়োকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়।

সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিলো। শঙ্খচিল ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়াচ্ছিলো নীলে। মেঘের ফাঁকে উঁকি দেওয়া রোদের তীব্রতা ছিলো না। বুড়োর চিলেকোঠার ঘরের জানালা খোলা ছিলো। বাতাসের তীব্রতায় খুলে গেছিলো ডায়রির পাতা। সেটি হাতে নিয়ে আমি পড়তে শুরু করি। পড়তে পড়তে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ডায়রির শেষ পাতায় শুকিয়ে যাওয়া চোখের পানির ওপর লিখা ছিলো,

_” মানুষ প্রেমে পড়ে। বারবার প্রেমে পড়ে। আমায় দেখে তরূণীর নাক সিটকানোর স্বভাব আমায় বাধ্য করে তাকে ভালোবাসতে। রান্নাঘরে কর্মরত তরূণীর কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম, আমায় বাধ্য করে প্রেমে পড়তে। নীল-সাদা শাড়িতে তার স্নিগ্ধ মুখখানি যেনো আমার চোখের জায়ু। হয়তো একদিন ফুরিয়ে যাবে আয়ূ। তার হাত ধরে জোৎস্না দেখার ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে যাবে। তার দীঘল কালো চুলের ঘ্রাণ নেওয়া আর হবে না। লুকিয়ে তার রোদে ভিজা সেই মুখ আর দেখা হবে না। আমার বাচ্চাদুটোর সাথে তার খুনসুটি, সেই মূল্যবান মুহূর্ত গুলো আর উপভোগ করা হবে না।
জানি, তার চোখে আমি অপরাধী।

তবু সে ভালো থাকুক! নতুন করে বেঁচে উঠুক তার স্বপ্নেরা। শুধু আফসোস থেকে যাবে, ভালোবাসি – কথাটা হলো না বলা।”

আকাশ কাঁপিয়ে সেদিন আরো একবার কেঁদেছিলাম। চিৎকার করে বলেছিলাম,
আর বুড়ো বলবো না, তোমায়। শুধু একবার ফিরে এসো! একবার সুযোগ দাও ভালোবাসার। সে আর ফিরে আসে নি। মৃত মানুষ কখনো ফিরে আসে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত