শতদল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, পারচেজ সেকশনের দীপা নামের মেয়েটিকে দেখলেই তার মনটা কেন উদাস যায়। দেখতে মেয়েটিকে সত্যিই খুব ভালো। সুন্দর মুখশ্রী, খুব ভালো চেহারা। কিন্তু এরকম সুন্দরী বা এর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী মেয়ে সে কম দেখে নি। তাহলেও তার এরকম কেন হচ্ছে গত তিন দিন ধরে?
শতদল রায়পুর রেলওয়ে কলোনিতে জন্মেছে, বড় হয়েছে। তার বাবা রেলের অফিসার ছিলেন। শতদল লেখাপড়া শেষ করে সরকারি চাকরি নিয়ে মুম্বাই চলে যায়। সেখানে পাঁচ বছর চাকরি করে প্রমোশন নিয়ে কলকাতায় এসেছে সবে চার দিন। তিনদিন ধরে সে তার কলকাতার অফিসে কাজ করছে। সে এখানকার অফিসের স্টোরস অফিসার। মেয়েটির শতদলের সমবয়সী হবে মানে মেয়েটির বয়েস সাতাশ-আঠাশের বেশি হবে না। হাতে শাঁখা, পলা বা লোহা কিছুই নেই। সিঁথিতে সিঁদুরও নেই। শতদল ধরেই নিয়েছে মেয়েটি অবিবাহিত। কিন্তু শতদলের মনে খটকা লাগে। এত সুন্দরী একটা মেয়ে, তার ওপর এত ভালো চাকরি করে। তাও মেয়েটির বিয়ে হয় নি কেন? মেয়েটি বিধবা নয়তো? শতদলের জানতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু কাকে জিজ্ঞেস করবে? পরক্ষণেই শতদল নিজের মনেই নিজেকে প্রশ্ন করে বসে। সে কেন এত আগ্রহী মেয়েটির সম্পর্কে? তবে সেকি.. না, না, সে মেয়েটিকে ভালোবাসতে শুরু করে নি। তবে মেয়েটিকে দেখলেই তার মনটা যেন যেন কেমন কেমন করে। সবচেয়ে বেশি হয় তাকে কোনো প্রশ্ন করলে সে যখন ঘাড় হেলিয়ে হেসে উত্তর দেয়। হাসলে মেয়েটির গালে টোল পরে। মেয়েটাকে তখন অসম্ভব সুন্দরী দেখায় আর শতদলের বুকের বাঁ দিকটায় যেন কেমন হতে থাকে।
শতদল বুঝে উঠতে পারে না, তার এরকম কেন হচ্ছে?
দেখতে দেখতে শতদলের কলকাতার অফিসের চাকরির বয়েস ছমাস হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে তার সাথে তার আন্ডারে যারা চাকরি করে মানে এসিস্ট্যান্ট পারচেজ অফিসার, তিন জন স্টোর কিপার, একাউন্টস সেকশনের একাউনট্যান্ট, সব ক্লার্ক এমনকি ক্লাস ফোর স্টাফদের সাথেও পরিচয় হয়ে গেছে। সে দীপার সাথেও আজকাল একটু আধটু কাজের বাইরে কথা বলতে শুরু করেছে। দীপার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছে। তার নাম দীপা ঘোষাল। গত পাঁচ বছর ধরে সে এই অফিসে চাকরি করছে। শতদল জেনেছে যে সে অবিবাহিত। শুধু তাই নয়, সে খোঁজ নিয়ে এও জেনেছে, যে দীপার বিয়ের জন্য অনেক সন্মন্ধ আসে, কিন্তু এক অজানা কারণে তার বিয়ে ভেঙ্গে যায়। কিন্তু সেই অজানা কারণটা যে কি, তা কেউ বলতে পারে নি। দীপা বলে ওই ক্লার্কটা নাকি অফিসে কারও সাথেই প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি কথা বলে না। এমনকি অফিসের লেডিজ স্টাফদের সাথেও কথা বলে না। অনেকেরই ধারণা সে একটু অহংকারী।
গত এই ছ মাস ধরে শতদল যত দিন গড়িয়েছে, সে ততই দীপার প্রতি যেন আরও বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। দীপা তার চেম্বারে এলেই সে কথায় কথায় দীপাকে নিজের চেম্বারে বসিয়ে রেখেছে যতটা সম্ভব। তার সাথে কাজের প্রসঙ্গের বাইরে গিয়েও কথা বলেছে। শুধু তাই নয়, দীপার মুখের সেই গালে টোল পড়া অপূর্ব হাসিটাকে দেখার জন্য প্রায়ই শতদল মজার কথা বলেছে। কিন্তু নিজের মনের কথাটা সে কিছুতেই বলতে পারে নি।
সেদিন তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। শতদল জানে যে এবার তার সব স্টাফ একে একে অফিস থেকে বেরোতে শুরু করবে যে যার বাড়ির উদ্যেশ্যে। শতদল হটাৎই বেলটা বাজিয়ে পিয়নকে ডাকলো। পিয়ন চেম্বারে আসতেই শতদল তাকে বলল,’ দেখতো, পারচেজ সেকশনের দীপা ঘোষাল এখনো আছে না বেরিয়ে গেছে? যদি থেকে থাকে তো, বল যাওয়ার আগে যেন একবার আমার সাথে দেখা করে যায়।’ পিয়ন বেরিয়ে যেতেই শতদল নিজেই যেন একটু ঘাবড়ে গেল। মনে মনে ভাবলো সে কি টেনশনে এসে গেল। টেবিল থেকে নিয়ে এক গ্লাস জল খেল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শতদলের চেম্বারের দরজাটা একটু ফাঁক করে মুখ বাড়িয়ে দীপা বলল,’আসতে পারি?’ শতদল বলল,’ হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন, ভেতরে আসুন।’ শতদল দীপাকে ডেকে নিজেই বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু দীপা ভেতরে আসার পর তার মুখের দিকে তাকিয়ে না হেসে থাকতে পারলো না। সে দেখল দীপার মুখটা শুকিয়ে গেছে। সারা মুখের ওপর যেন একটা ভয়ের ছায়া। শতদল, দীপার মুখের দিকে তাকিয়েই হাসতে হাসতে বলল,’ আরে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনি অফিসের কাজে কোন ভুল- ত্রুটি কিছুই করেন নি। আপনাকে ডেকেছি কারণ আপনাকে আমার কিছু জিজ্ঞাস্য ছিল। আপনি বসুন, আপনাকে বলছি।’
শতদল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার দিকে দীপা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তার মুখের ওপর থেকে ভয়ের ছায়াটা সরে গেলেও, মুখ থেকে তখনও যেন বিস্ময়ের ছায়াটা উধাও হয়ে যায় নি। শতদল ঢোক গিলে বলতে শুরু করল,’ দেখুন, আমি যা এখন বলবো, সেটা আমার একান্ত নিজের ইচ্ছের কথা। আমার সেই ইচ্ছের কথা শুনে, আপনি আপনার মত জানাবেন। আপনার মত যাই হোক না কেন, সেটাই আমি মেনে নেব।’ এইটুকু বলে শতদল একটু থামল। দীপার মুখের দিকে তাকাল। দীপার মুখে তখন কৌতুহলের ছায়া।
শতদল আবার বলতে শুরু করল,’ আমি যেদিন প্রথম আপনাকে দেখি, সেদিন থেকেই আপনাকে আমার ভালো লেগে যায়। ধীরে ধীরে যত দিন এগিয়েছে, আমি তত বেশি আপনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েছি। ইতিমধ্যে আমি জেনেছি যে আপনি বিয়ে করেন নি। কি তার কারণ জানি না। তবে যাই কারণ হোক, আমি ইতিমধ্যেই আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। আপনাকে আমি আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে চাই। অবশ্য আপনি যদি রাজি থাকেন।’ শতদল এতগুলো কথা বলে আবার টেবিল থেকে জলের গ্লাস তুলে নিয়ে জল খেল। জল খেয়ে তাকালো দীপার চোখের দিকে। দেখলো তার মুখ থেকে ভয় বা বিস্ময়ের ছায়াটা পুরোপুরি সরে গেছে।
সে ম্লান হেসে বলল,’এই ধরণের কথা আমি গত পাঁচ-ছ বছর ধরে বহুবার শুনেছি, তাই আপনার কথাতে আমি অবাক হচ্ছি না। তবে আমার সব কথা শুনলে, আমি নিশ্চিত যে আপনি আপনার প্রস্তাব ফিরিয়ে নেবেন বা কাল থেকে আপনি আমাকে এড়িয়ে চলবেন। তবে আগেও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব যারা দিয়েছিল, তাদেরও যেমন আমার জীবনের একটা মস্ত বড় ভুলের কথা বলেছি, আপনাকেও বলবো। নিশ্চই বলবো।’ এই কথা বলে দীপা নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,’ স্যার! ছটা বেজে গেছে। এখন থাক, অন্যদিন শোনাবো। তবে আপনার যদি আপত্তি না থাকে আপনি সাড়ে সাতটার পর আমার বাড়িতে আসুন, আপনাকে শোনাবো।’ শতদল বলল,’ আপনার বাড়ি..’ শতদলকে কথা শেষ করতে না দিয়ে দীপা বলল,’আপনি তো আমাদের স্টাফ কলোনি দেখেছেন। স্টাফ কলোনিতে থাকি। কোয়ার্টার নম্বর B-93, শপিং সেন্টারের ঠিক উলটো দিকে। আপনি চলে আসুন। আপনার অপেক্ষায় আমি থাকব। আর আপত্তি যদি না থেকে তবে রাত্রে আমার হাতের রান্না খেয়ে ফিরবেন।’ শতদল বলল,’ ঠিক আছে আমি আসবো আর হ্যাঁ, নিশ্চই আপনার হাতের রান্না আজ খেয়ে ফিরবো।’ দীপা উঠে দাঁড়িয়ে আসছি বলে শতদলের চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
শতদল এখনো কোয়ার্টার পায়নি। সে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছে। তার ফ্ল্যাট থেকে তাদের অফিসের স্টাফ কলোনিটা বেশ দূরে। সেই কারণে নিজের ফ্ল্যাটে এসে তাড়াতাড়ি স্নান করে বেরিয়ে পড়ল। শতদল স্টাফ কলোনির শপিং সেন্টারে বেশ কয়েকবার ইতিমধ্যেই গিয়েছিল, তাই তার চিনতে অসুবিধা হলো না। শপিং সেন্টারের পার্কিং জোনে নিজের মোটর সাইকেলটা পার্ক করে সে রাস্তা ক্রস করে দীপা যে বিল্ডিংটার কোয়ার্টারে থাকে, তার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখল বিল্ডিংটার দিকে। গেটের পাশেই লেখা B-88 থেকে B-92 একতলায় আর B-93 থেকে B-96 দোতলায়।
শতদল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠেই দেখে প্রথম দরজাটার ওপর লেখা B-93. কলিং বেল বাজাতেই, মুহূর্তে দীপা দরজা খুলে শতদলের দিকে তাকিয়ে একটা সেই মন কেমন করা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,’ আসুন, ভেতরে আসুন।’ শতদল ভেতরে ঢুকতেই, দীপা সোফার দিকে দেখিয়ে বলল,’ বসুন, আমি একটু চা করে আনি।’ শতদল তাকিয়ে তাকিয়ে দীপাকে দেখছিল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে স্নান সেরে এসেছে। লম্বা, ঘন, কালো চুল পিঠ ছাড়িয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে। চুল ভিজে থাকায় পিঠের দিকের ব্লাউজটাও ভেজা। তার শাড়ি পড়ার ধরণ বদলে গেছে। শতদলের মায়ের কথা মনে পড়লো। তার মাও ঘরে কাজ কর্ম করার সময় এই ভাবে শাড়ি পড়ে। এই ভাবে শাড়ি পড়লে কেমন যেন গিন্নী গিন্নী দেখতে লাগে। দীপাকেও আজ যেন সেরকম লাগছে। দীপা আবার সেই হাসি হেসে ভেতরে চলে গেল। শতদল সোফায় বসে ঘরের এদিক সেদিক দেখতে লাগলো।
দীপা একটু পরেই একটা ট্রে তে করে দু কাপ চা আর কয়েকটা নিমকি বিস্কিট শতদলের সামনে রাখা সেন্টার টেবিলে রেখে, সেও শতদলের মুখোমুখি বসলো উল্টো দিকের সোফায়। তারপর বলল,’ নিন, আপনি চা খেতে শুরু করে দিন আর আমি চা খেতে খেতে সব বলছি। ও ভালো কথা, আমি ডাল, ফুলকপির তরকারি আর খাসির মাংস বানিয়েছি। রুটি বানাতে গিয়েও বানাই নি। কারণ আপনাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম, আপনি রাত্রে রুটি খান না ভাত খান।’ শতদল বলল,’ দুটোর যে কোনো একটা চলবে। তবে মাংস যখন বানিয়েছেন, ভাতই খাবো।’ শতদলের কথা শুনে দীপা হেসে বলল,’ ঠিক আছে, একটু পরে ভাত বসিয়ে দিলেই হবে।’ দীপা চায়ে একটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করল-
আমি ছিলাম আমার মা, বাবার বেশি বয়েসের সন্তান। হয়তো তাদের অসাবধানতার ফলেই ঘটেছিল আমার জন্ম। কারণ আমি যখন জন্মাই, তখন আমার এক মাত্র দিদি ক্লাস টেনের ছাত্রী। আর আমার যখন তিন বছর বয়স তখন আমার মা, বাবা ট্রেন এক্সিডেন্টে মারা যান। দিদি তখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। আমরা থাকতাম একটা ছোট মফস্বল শহরে। সেই শহরের একটা জুটমিলে বাবা চাকরি করতেন। নিজেদের দোতলাবাড়ি ছিল আমাদের। বাবা, মা মারা যেতে আমি আর আমার দিদি বলতে গেলে অনাথ হয়ে গেলাম। বাবা ছিলেন দাদুর একমাত্র সন্তান। সেই দাদু আর ঠাকুমা, আমি জন্মানোর আগেই মারা গিয়েছিলেন। আমাদের মামা বাড়ি ছিল উত্তর বঙ্গে। বড় মামা আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছিলেন, কিন্তু দিদি রাজি হয়নি।
দিদি একতলাটা ভাড়া দিয়েছিল। এছাড়া বাবার অফিস থেকে কিছু টাকা পয়সা পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো দিদি ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করেছিল। সেই ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ আর ভাড়ার টাকায় দিদি চালিয়ে নিচ্ছিল। তখন আমি এত ছোট ছিলাম যে এসব বোঝার মত বয়েস আমার ছিল না। কিছু মনেও নেই। বড় হয়ে এসব দিদির মুখে শুনেছি। আর আমার দিদি আমার কাছে দিদি ছিল না, সে যেন আমার মা ছিল। সত্যিই দিদি আমাকে মায়ের স্নেহ দিয়ে বড় করেছিল। দিদির জন্যই বোধ হয় আমি কোনদিন মায়ের অভাব বুঝতে পারি নি। ছোটবেলায় প্রায়ই দেখতাম দিদির এক কলেজের বন্ধু আমাদের বাড়িতে আসতো। তার নাম ছিল বিশ্বরূপ। সেও দিদির মতোই আমাকে খুব ভালোবাসতো। এমনকি আমি যেমন দিদির কোলে উঠতাম, ঠিক তেমনি ওই দিদির বন্ধু বিশ্বরূপদা, আমাদের বাড়িতে এলেই, আমি তার পিঠে চড়ে বসতাম। একটু বড় হয়ে বুঝলাম, বিশ্বরূপদা দিদির শুধু কলেজের বন্ধুই নয়, ওরা একে অপরকে ভালোবাসে। আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি, দিদি বিএ পাস করে এম এ পড়তে শুরু করল।
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। দিদি তখন এম এ পাস করে স্কুলে পড়াচ্ছে আর বিশ্বরূপদা চাকরি করে। একটু আধটু বুঝতে শুরু করেছি। সেদিন ছিল আমাদের পাশের বাড়িতে দিদির বান্ধবী শেফালীদির বিয়ে। সেই বিয়ের দিন রাত্রে আমি দিদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,’ দিদি!
তোর সাথে বিশ্বরূপদার বিয়ে কবে হবে?’ আমার কথা শুনে দিদি চোখ বড় বড় করে বলেছিল,’ ওরে মেয়ে! খুব দুস্টু হয়েছিস তো!’ তারপর আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলেছিল,’ হ্যাঁ, হবে। তুই আগে একটু বড় হয়ে নে, তারপর।’ তখন বুঝিনি বড় হওয়া বলতে কত বড় হওয়া। দিদি আর বিশ্বরূপদা বিয়ে করেছিল আমি মাধ্যমিক পাস করার পর। দিদির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে আমি বাড়ির দোতলায় একাই থাকতাম। তবে ভয় করতো না। কারণ আমাদের নিচে ভাড়া থাকতেন অনিমা কাকিমারা। ওরাও আমাকে খুব ভালো বাসতো। তাছাড়া রবিবার বা ছুটির দিনে দিদি আর বিশ্বরূপদা সকাল থেকে এসে আমাদের বাড়িতেই থাকতেন।
দেখতে দেখতে আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তি হলাম। কলেজে পড়তে পড়তেই আমার সাথে তীর্থর আলাপ হয়। আলাপ থেকে বন্ধুত্ব আর শেষে ভালোবাসা। দিদি আর্টস পড়লেও, দিদির ইচ্ছায় আমি সায়েন্স নিয়ে পড়তাম। এম এস সি পাস করার পর পরই তীর্থ দু বছরের জন্য ইউ এস চলে গেল। আবার আমি একা। তখন আর পড়াশোনাও ছিল না। সময় কাটতে চাইতো না। শেষে স্থানীয় একটা স্কুলে এক জন টিচারের লিভ ভ্যাকেনসিতে পড়ানোর সুযোগ পেলাম। আমার জীবনের সেই ঘটনাটা ঘটেছিল সেই সময়ে।
সেদিন ছিল রবিবার। দিদি আর বিশ্বরূপদা যথারীতি সেদিন এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তখন বাজে সকাল দশটা। আমাদের বাড়ির পেছনে একটা ছোট বাগান ছিল। বেশ কিছু ফুলের গাছ ছিল। এক সময় দিদি তাদের পরিচর্যা করতো, দিদি চলে যাওয়ার পর থেকে আমিই করতাম। সেদিনও ওই বাগানে আমি কাজ করছিলাম। বাগানের পাশেই একতলার রান্নাঘর। সেই রান্নাঘরে তখন দিদি আর অনিমা কাকিমা কথা বলছিলেন। কথা গুলো আমার কানে আসছিল। অনিমা কাকিমা বললেন,’কিরে মিতা! ডাক্তার কি বলল?’ অনিমা কাকিমার কথা শুনে দিদি বলল,’ খুব চিন্তায় আছি কাকিমা। ডাক্তার বলছেন যে খুব শিগগির একজন সারোগেট মাদারের প্রয়োজন। ভ্রুনটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন সারোগেট মাদারের শরীরে প্রতিস্থাপন করা দরকার। যে মেয়েটিকে সিলেক্ট করা হয়েছিল, তার কোনো এমন রোগ আছে, যার ফলে ডাক্তার তাকে রিজেক্ট করেছেন। এখন কি হবে জানি না। না হলে আবার নতুন করে সব কিছু করতে হবে।’ অনিমা কাকিমা গলা নামিয়ে বললেন,’ তা সারোগেট মাদার তো শুনেছি হসপিটাল থেকেই জোগাড় করে দেয় টাকা পয়সার বিনিময়ে। তা সে ব্যবস্থা হসপিটাল করে দিচ্ছে না? আমার দিদি বলল,’ চেষ্টা চলছে, কিন্তু তারা এখনো নাকি সুটেবল সারোগেট মাদার জোগাড় করে উঠতে পারে নি। কি যে হবে, কে জানে?’
আমি বাগানে বসে কাজ করছিলাম। উঠে পড়লাম। মনে মনে ভাবলাম দিদির বিয়ে হয়ে গেছে প্রায় ছ বছর। অথচ দিদির ছেলে মেয়ে এখনও হয় নি। কারণটা আজ জানতে পারলাম। এও বুঝলাম যে দিদি কেন বেশ কয়েক বছর ধরে মন মরা হয়ে থাকে।
মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি সারোগেট মাদার হবো। যে দিদি আমাকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছে, আমার সব শখ পূরণ করেছে, তার মুখের হাসি দেখতে আমি এটুকু তো দিদির জন্য করবো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর আমি দিদিকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম,’ দিদি! আমি সব শুনেছি। তুই এত টেনশন নিস না। তোর বাচ্চার আমি সারোগেট মাদার হবো।’ দিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে আমার মুখ চেপে বলল,’ ছিঃ, দিপু! এরকম কথা মুখেও আনিস না। আমার খুশির জন্য তোর জীবনটা আমি শেষ করতে পারবো না। তুই জানিস না, ব্যাপারটা জানাজানি হলে, তোকে আর বিয়ে দিতে পারব না।’ আমি দিদিকে শান্ত করে বললাম,’দিদি বিদেশে এমনকি আমাদের দেশেও আজকাল এসব আকছার হচ্ছে। পরিবারের যাদের সেরকম কেউ নেই, তারাই পয়সা দিয়ে সারোগেট মাদার ভাড়া করে। কিন্তু আমি আছি। আমি জানি এটা কোনো পাপ কাজ নয়। আমি এও জানি তোদের এটা গেসটেসনাল সারোগেসি। আমার সাথে এতে কারো শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। আর এটা শুনে যদি কেউ আমায় বিয়ে না করে তো জানবো যে আজও প্রকৃত শিক্ষিত যুবক এদেশে নেই। তুই আমাকে কালই ডাক্তারের কাছে নিয়ে চল।’
আমার এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আরও একটা কারণ ছিল তীর্থ। তীর্থ ইউ এস চলে যাওয়ার পর থেকে আমাকে আর কোনোদিন ফোন করে নি। অথচ আমি খবর পেতাম যে ও, ওর নিজের বাড়িতে এমনকি অনেক বন্ধুর সাথেই স্কাইপে বা ফোনে যোগাযোগ রাখছিল। বুঝেছিলাম তীর্থ আর আমার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড নয়। কেন তা বুঝতে পারিনি তখন। পরে জেনেছি যে তীর্থ আমার সাথে ভালোবাসার অভিনয় করে গেছে শুধু। সে আসলে ভালোবাসতো নিজের পাড়ার একটি মেয়েকে। তাই তখন প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে, এসবের ওপর থেকে ভরসা উঠে গিয়েছিল।
আমার ডেলিভারির তিন মাস আগে থেকেই দিদি আর বিশ্বরূপদা আমাদের বাড়িতে থাকতে চলে এসেছিল। দিদি সন্তান পাওয়ার অতি উৎসাহে নিজের স্কুলের চাকরিটাও ছেড়ে এসেছিল। যদিও আর্থিক দিক দিয়ে দিদির চাকরির প্রয়োজন ছিল না।
একটা সুন্দর ফুটফুটে ছেলে হয়েছিল। কিন্তু আমার ডেলিভারির আগে থেকেই হটাৎ করে দিদির মনে আমার আর বিশ্বরূপদার সম্পর্কে সন্দেহ জাগতে থাকে। যদিও দিদির সেই সন্দেহটা ছিল অমূলক। বিশ্বরূপদা আমাকে দিদির মতোই নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতো। তার ভালোবাসায় স্নেহ ছাড়া, অন্য কিছু ছিল না। কিন্তু দিদি ততদিনে বোধ হয় মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। আর সেটা ধীরে ধীরে বেড়েই চলল। এমনকি দিদিরা ছেলের অন্নপ্রাশনের পর নিজেদের বাড়িতে চলে যাওয়ার পরও, দিদির মন থেকে সেই সন্দেহ দূর হলো না। বিশ্বরূপদার কোনো কারণে অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলেই, ঘরে দিদি অশান্তি শুরু করে দিত। আর সেটা বেড়েই চলল। বাড়তে বাড়তে এমন হলো, একদিন দিদি আত্মহত্যা করে বসলো। আমি কিন্তু দিদির এই বিশ্বরূপদাকে আমাকে নিয়ে সন্দেহের ব্যাপারটা জানতাম না।
বিশ্বরূপদাও লজ্জায় কোনোদিন সে কথা আমাকে বলতে পারে নি। দিদির আত্মহত্যার খবর পেয়ে আমি গিয়েছিলাম। পোস্টমর্টেম আর শশ্মান এর কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরে রাত্রে কাঁদতে কাঁদতে বিশ্বরূপদা আমাকে সব বলেছিল। শুনে আমারও আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু মরতে পারি নি।
খুব মনমরা হয়ে থাকতাম। অনেকদিন আগের এপ্লিকেশন আর ইন্টারভিউর ভিত্তিতে হটাৎ একদিন এই চাকরিটা পেলাম। কলকাতায় এসে বেশ কিছুদিন ওয়ার্কিং উইমেন হোস্টেলে ছিলাম। তারপর কোয়ার্টার পেতে চলে এলাম এই কোয়ার্টারে। আমাদের বাড়িটা বেঁচে দিয়ে, সেই টাকা দিয়ে কলকাতায় একটা ছোট ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়েছি। একা মেয়ে, তাই মনে হয়েছে অফিসের স্টাফ কলোনির এই কোয়ার্টার অনেক বেশি সেফ। বিশ্বরূপদা মাঝে মধ্যে ছেলে পিকলুকে নিয়ে আসে এখানে। দীপা এবার একটু থামলো। সে কথা বলা শুরু করার পর থেকে একবারও শতদলের মুখের দিকে তাকায় নি। এখনো সে নিচের দিকে তাকিয়েই একটু যেন দম নিল আর মনে মনে কিছু ভাবলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো-
চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে এই অফিসের এমনকি বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর পেয়ে অনেকেই আমার কাছে আসেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু যখন তারা শোনে আমি সারোগেট মাদার, আমার দিকে এক অদ্ভুত বিস্ময়ে তাকায়। পরে আবার দেখা করবে বলে চলে যায়, কিন্তু আর ফিরে আসে না। তবে কেউ কেউ আসেন, তারা সব শুনে রাজি হন, কিন্তু তাদের কথায় যেন আমার মনে হয় তারা যেন দয়া দেখাতে চাইছেন। কিন্তু আসলে তাদের কপালে যে কোনো কারণেই হোক, মেয়ে বোধ হয় জোটে না, তাই তারা এমন একটা ভাব দেখায় যেন আমাকে বিয়ে করে তারা দয়া করবেন। তবে ব্যাপারটা আমিও যে বুঝি না, তা নয়। এত প্রেম, ভালোবাসা করে বিয়ে নয়, সন্মন্ধ করে বিয়ে। সেই ধরণের বিয়েতে আমার মত মেয়ে যার এরকম একটা খুঁত আছে, তাকে কেন বিয়ে করবে? তাই এখন মনে হয় জীবনে যেন একটা মস্ত বড় ভুল করে ছিলাম। ভুল এই কারণে বলছি, যে দিদির মুখে হাসি দেখার জন্য এত বড় একটা কাজ করলাম, সেই দিদির মুখে হাসি তো দেখতেই পেলাম না, সেই দিদিই চিরকালের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গেল। দীপা শতদলের দিকে তাকিয়ে বলল,’ চলুন, এবার আমি ভাত বসাই। আপনি ভেবে চিন্তে কাল হোক, পরশু হোক উত্তর দেবেন।’
এই কথা বলে দীপা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। শতদলের ততক্ষণে চোখ জলে ভিজে গেছে। সেও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে দীপার দুটো হাত ধরে বলল,’ না,তুমি কোনো ভুল করো নি, তুমি একটা আধুনিক শিক্ষিত মেয়ের মতো, ছোট বোনের মত কাজ করেছিলে। শিক্ষিত, আধুনিক সমাজের মধ্যে এখনও অন্ধকার কাটে নি। সেই অন্ধকারে তুমি আমার দীপা নও, তুমি দীপশিখা। তোমার মধ্যে কোনো খুঁত নেই, খুঁত আছে সমাজের মানুষের মনে। আর তোমার কথায় কথা মিলিয়ে বলি, আমি তোমার সাথে সন্মন্ধ করে বিয়ের কথা ভেবে আসি নি। আমি যে তোমাকে দেখার প্রথম দিন থেকেই তোমায় ভালোবেসে এসেছি। প্লিজ, আমায় ফিরিয়ে দিও না।’ দীপাও নিজেকে সামলাতে পারলো না। সে শতদলের বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না ভেজা গলায় ফিস ফিস করে বলল,’ না, তোমাকে ফেরাবো না। তুমি আজ থেকে আমারই থাকবে।’
…. শেষ….