দিন তিনেক হলো মঞ্জুলা সেনগুপ্ত মেদিনীপুরের বাড়িতে এসেছে। বেশ কয়েক বছর পর, আর সেই ভাবে আসাই হয়ে ওঠেনা, ভীষণ ব্যস্ততার জীবন। মঞ্জুলা মধ্যবয়স্কা, বয়স হয়ে যাবে প্রায় বাহান্ন-তিপান্ন। শরীর বেশ ভারী হয়ে গেছে, কয়েক বছর ধরে বাতের ব্যাথাটা ভালোই ভোগাচ্ছে। এক মাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে দু-বছর হলো। বিয়ের পর স্বামীর ব্যাবসা সূত্রে মঞ্জুলাকে স্থায়ীভাবে থেকে যেতে হয়েছে পুনেতে। তারপর ক্রমেই পুনেই হয়ে গেছে তার ঘর-সংসার সব কিছু। এই বছর দুই একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারছে মঞ্জুলা, আসলে মেয়ে বিনীতার বিয়ে হয়ে গেছে। ও যত দিন বাড়িতে ছিল পাগল পাগল ভাব, এই দাও ওই দাও, পড়াশুনা, তার বন্ধুবান্ধব, আচার-অনুষ্ঠান সে পাগল করে দেবার মত ব্যাপার স্যাপার। বিনীতার বিয়ে হয়েছে পুনে থেকে প্রায় একশো কিমি দূরে লোনাভালাতে। তাই হঠাৎ আর আসতে পারেনা সে, যত আবদার ফোনে ফোনেই চলে। জামাই বেশ মনমত হয়েছে, বাঙালি, নামী কোম্পানিতে কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার।
দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে একটু একটু করে এই বাংলার সাথে শিকড় আলগা হয়ে গেছে মঞ্জুলার। ভুলে যেতে হয়েছে অনেককিছু, মানিয়ে নিতে হয়েছে অনেক নতুনকে, তা কখনো-কখনো ভালোমন্দ পছন্দ-অপছন্দকে তোয়াক্কা না করেই। আসলে মেয়েদের জীবন, যত তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে শিখবে ততই মঙ্গল, নিজের সাথে সাথে অন্যেরও ভালো। মঞ্জুলার স্বামীর পুনেতে গার্মেন্টসের বড়সড় ব্যবসা, বেশ প্রাচুর্যে কেটেছে বিনীতার জীবন।
মঞ্জুলা মেদিনীপুর শহরের মেয়ে ছিল, তার সমস্ত পড়াশুনা এই মেদিনীপুরে, স্কুল, কলেজ সব। বেশ ভালোই মেধাবী ছিল, তার থেকেও বেশি ভালোবাসত পড়াশুনা করতে, সাথে গান, আবৃত্তি, সে এক অন্য জীবন ছিল। ইচ্ছা ছিল মাস্টার ডিগ্রি করে শিক্ষিকা হবে, কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না মঞ্জুলার। বাড়ি থেকে বেশ চাপ এলো বিয়ে করে নেওয়ার, শেষে মাথা নত করে মেনে নিতে হল বাস্তবকে। বিয়ে হয়ে গেল পুনে নিবাসী বাঙালি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের সাথে। বাঁক নিলো জীবন। প্রবল স্রোতে জীবন ভেসে যেতে থাকলো ভিন্ন পথে। আর ফিরে দেখার সময় হয়নি এই জীবনে, যা ছিল সে সবগুলোকে বস্তাবন্দি করে অবহেলায় রেখে দিতে হলো আস্তাকুঁড়ে।
মঞ্জুলার একটাই মাত্র বোন নাম মন্দিরা, কোন ভাই নেই, মন্দিরার বিয়ে হয়েছে কলকাতার টালাতে। তিন বছরের ছোট মন্দিরা। দুই বোনের ভীষণ ভাব ছিল, সেই ভালবাসা টান এক রকমই আছে কিন্তু ব্যস্ততায় দৈহিক দুরত্বটা বেড়ে গেছে বেশ। মঞ্জুলার এক পিসি ছিল, খুব ভালোবাসত ওদের দুজনকে, বলতে গেলে নিজেদের মেয়ের মতোই। মেদিনীপুর থেকে ঘন্টা দুয়েকের পথ শালবনি, তাই প্রায়ই যাওয়া হত পিসিমনির আদর খেতে। সত্যি কথা বলতে কি শুধু মাত্র পিসিমনির জন্য নয় ওখানকার প্রকৃতি মন কেড়ে নিতো মঞ্জুলাদের। আঁকাবাঁকা পথের পাশে নুইয়ে পরা গাছের সারি, নানান পাখি ডাক, বেশ অন্যরকম। পিসির ছেলে জয়ন্ত আমাদের এই সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখাতো। জয়ন্ত মঞ্জুলার থেকে দু বছরের ছোট।
চালতা পুকুরে কত না ছিপ দিয়ে মাছ ধরেছে সবাই মিলে, একসাথে পিকনিক করা, আম-পিয়ারা পারতে অন্যের বাড়ি যাওয়া কত কি! ছোটবেলায় সব থেকে আনন্দের জায়গা ছিল এই পিসির বাড়ি, স্বাধীন জীবনের চলাফেরা। মঞ্জুলা তখন স্নাতকের প্রথম বর্ষ। মনে পরে সেই দিনটা যেদিন প্রথম সাইকেলে চেপে যাওয়া ছেলেটাকে দেখে মঞ্জুলার মন শিহরিত হয়েছিল। ছেলেটা সাধারণ। বাহ্যিক চাকচিক্য কিছুই ছিলোনা। পরে নামটা জয়ন্তর থেকে জেনে ছিল পুস্কর। মঞ্জুলার থেকে বছর চারেকের বড় পুস্কর। খুব গরিব। পড়াশুনা চালাতে সামান্য কটা টাকার জন্য টিউশন করত, বাবা ছিলোনা, মা আর ছোট ভাই। অভাবের সংসারে কিভাবে যে এসে গিয়েছিল মঞ্জুলা তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
প্রথম দেখা করতে চাপটা মঞ্জুলাই দিয়েছিল পুস্করকে। পুস্কর স্নাতক হলেও অভাব ও দায়িত্বের বোঝার চাপে আর বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি। পুস্কর সামাজিক, এলাকার যাবতীয় আপদ বিপদে ঝাঁপিয়ে পরে নির্দ্বিধায়। এটা থেকেই হয়তো ভালোলাগা মঞ্জুলার আর ভালোবাসা পুস্করের সারল্যে-নির্লোভ আচরণে। মঞ্জুলা ভাবতো এমন একজনকেই ভালোবাসতে চেয়েছি আমি, আমি পেয়েছি আমার প্রকৃত ভালোবাসা। এই ভাবে বেশ চলছিল তাদের প্রেমের কাহিনী, আর এই উপলক্ষ্যে ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছিল পিসির বাড়ি আসা। সার্বজনীনভাবে মঞ্জুলার বাড়ি থেকে পুস্করকে মেনে নেবে এমন বিশেষ কারণ ছিল না। দুই বোনের প্রায়ই একটা বিষয় নিয়ে কথা হত যদি বাড়িতে জানতে পারে তাহলে তো গেল একেবারে। পায়ে শিকল বেঁধে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেবে। মঞ্জুলা মাঝেমধ্যে মেদিনীপুরে এলেও আর কোনদিন আসা হয়নি শালবনির দিকে। হয়তো আসার প্রয়োজনটা কোথায় যেন ফুরিয়ে গিয়েছিল। দুই বোন একসাথে এসেছে,একা একা। দুই বোন একসাথে গাড়িতে উঠেই মঞ্জুলা বললো যার বাড়ি যাচ্ছি সেই পিসিই নেই, কত বছর পর ভাবতেই অবাক লাগছে। সমস্ত পথটা দুই বোন বকবক করতে করতে এসে গেল গন্তব্যে।
জয়ন্ত কেমন বুড়ো হয়ে গেছে, বয়সের তুলনায় বেশি বুড়ো, একটু ধীর-স্থির, মনে হচ্ছে জীবনের রঙটা কোথায় হারিয়ে ফেলেছে। বাড়িতে ঢুকে একটু জল খেয়ে মঞ্জুলা একা হাঁটতে হাঁটতে বেড়িয়ে গেল, সেই পুকুরটার দিকে পৌঁছে কি একটা ভাবছে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে টপটপ করে, কেন এত আবেগমোথিত হয়ে পড়লো জানেনা সে, ফেলে আসা সময়ের জন্য আর্তি না নাকি মমি হয়ে যাওয়া ভালোবাসায় প্রানের সঞ্চার। খুব ইচ্ছা করছে পুস্করের সাথে একবার দেখা হোক, কিন্তু কিভাবেই বা দাঁড়ায় সামনে এসে। এই ভাবতে ভাবতে ফিরে এলো বাড়িতে। মন্দিরা বললো কিরে দেখা হলো নাকি? কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মঞ্জুলা জয়ন্তকে বললো একবার দেখা করিয়ে দিবি পুস্করের সাথে, শুধু একবার দেখবো। কোনো কথা না বলে জয়ন্ত চলে গেল। আজ বিকালে ফিরে আসবে মঞ্জুলারা। জয়ন্ত ফিরে এসে জানালো পুস্কর আর এখানে থাকে না ও শহরের দিকে চলে গেছে, ওখানেই থাকে বেশ কয়েক বছর হলো। পুস্করের পাড়াটা জয়ন্তদের পাড়া থেকে একটু দূরে, তাই আর বিশেষ খবরাখবর রাখা হয় না।
আর খুব একটা দেরি করেনি মঞ্জুলারা, একটু তাড়াতাড়ি করেই বেরিয়ে পড়ল তারা। কি যেন একটা শেষ হয়ে গেল, সূর্যটা ওই দূরের শাল গাছটার ফাঁক দিয়ে যেন হারিয়ে গেল, এমন ভাবে ডুব দিলো যেন অনেক অভিমান মেখে সারাজীবনের মত। মঞ্জুলার মনে হলো আর কি কোনদিন সূর্যোদয় হবে না! মন্দিরা গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লো, সুতো দিয়ে বাঁধা অতীতকে ছিঁড়তে ছিঁড়তে গাড়িটা ছুটছে ভবিষ্যতের দিকে, জানলা নামানো, মঞ্জুলা আনমনে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। ভাবছে একবার দেখা হতে তো পারতো, কি বা ক্ষতি হত। হয়তো আর এই জীবনে দেখা হবে না, আচ্ছা দেখা হলে আমাকে চিনতে পারতো তো পুস্কর, দেখা হলে কি বা বলতো সে, আমি কি বলতাম, মনে মনে ভাবছিল মঞ্জুলা। তার থেকে এটাই ভালো হলো, আর দেখাই হলো না!
ফেরার সময় সারা রাস্তাটায় কেউ কিছু বললো না, গাড়ি থেকে সেই নেমেছে মঞ্জুলা হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো, মা তুমি কবে আসছো? পরশুদিন তোমার পুনের বাড়িতে ছয়জন আসবে আমার বন্ধু, আমি সব কিছু রেডি করছি, কিন্তু রান্না তোমাকেই করতে হবে। আমি কালই চলে যাবো মা, তোকে ছেড়ে আমিও থাকতে পারছি না, তোর বাবা কেমন আছে…. মঞ্জুলা খুব দ্রুত কথাগুলো বলে ফেললো।
পরের দিন দমদম বিমান বন্দর থেকে দুপুর 2.20 তে স্পাইস জেট টেক অফ করলো, বিমানের জানলায় উঁকি দিয়ে মঞ্জুলা কিছু দেখতে চাইছে, যেন কিছু খুঁজছে তারপর ক্রমশ বিমানটি ঢুকে গেলো মেঘের সারির মধ্যে।