বাঁশঝাড়টার ফাঁক দিয়ে ফালি চাঁদটা যেন লুকোচুরি খেলছে। আকাশ জুড়ে আজ কোদালে কাটা মেঘে ছেয়ে আছে।
‘মরণ!’ বলেই শম্ভু হাতজালটা বগলদাবা করে দাওয়া থেকে লাফিয়ে পড়ল।তা প্রকৃতির অনেক কটা ব্যাপারেই শম্ভুর রাগ আছে বৈকি!
চাঁদের আলো যদি এই কোদালে কাটা মেঘ মাঝে মাঝে চাপা না দিত, তবে পথ দেখতে সুবিধে হতো যে তার। পূর্ণিমার আগে পরে কদিন পথ চলতে অত অসুবিধে নেই।
” আজ সপ্তমী নাকি অষ্টমী – কি জানি! এই তো কদিন আগে অমাবস্যে গেল। ”
নিজের মনেই হিসেব কসে শম্ভু। এ তার রোজকার ব্যাপার। কুচকুচে কালো রাত হোক বা ধবধবে ফর্সা রাত, শম্ভুর কাছে দুই সমান। তার রুজিরোজগার আর শখের সময় যে রাতের আঁধারবেলা। তবু পথে একটু খানি আলোর আশায় হাপিত্যেশ করে সে।
সাতকুলে কেউ নেই ওর। ছিল এক হেঁপো রুগী পিসি,তা সেও গত বছর সগ্যে গেছে। বিয়ে থা করেনি।গায়ে গতরে মরদ সে।দিনের বেলা জন খাটে।একলা মানুষের পেট চলে যায়। কিন্তু অভ্যেস যাবে কোথায়। তার বাপ ঠাকুর্দার বড্ড চুরির অভ্যাস ছিল। এককালে ডাকাতিও করত। গ্রামের সকলে শম্ভুকে চোরের বংশের ছেলে বলে।তা সে তেমন কিছু মনে করে না। দু পাটি দাঁত বের করে হাসে শুধু।রাত হলেই ওর হাত পা নিশপিশ করতে থাকে। হাত জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
এর তার পুকুরে জাল ফেলে মাছ চুরি করে। পরদিন বটতলার বাজারে সে গুলো নিয়ে বেচতে বসে। ওই-ই বেলা আটটা বড়জোর।এরপর কোথাও না কোথাও জন খাটে। তারপর বিক্রি না হওয়া মাছ বাড়ি এনে ঝাল করে ভাত দিয়ে মেখে খায়। এরপর তার ধেনোর নেশার বাতিক ওঠে। সেটা খেয়ে দেয় চম্পট ঘুম। ঘুম ভাঙতে রাতদুপুর। পেটে তখন হাঁ হাঁ খিদে। সকালের হাঁড়ির তলানি ভাত নুন, পেঁয়াজ মেখে খেয়ে বেরিয়ে পড়ে চুরি করতে। চুরি করতে গিয়ে সে যে খুব বেশি লাভবান হয় তা নয়। রাঘব বোয়াল জোটে কখনো সখনো। বেশির ভাগ সময় চারাপোনা, চুনো। তা সে তাতেই খুশি। বেশি লোভ নেই ওর। এক খেপ মেরেই রেহাই দেয়। রায়বাবু একদিন ওর কাছ থেকে মাছ কিনতে গিয়ে হেসে বলেন,
” কি জানি শম্ভু, কাল কার পুকুরে জাল ফেলেছিস! আমার পুকুরের মাছই আবার আমায় গছাচ্ছিস না তোরে ব্যাটা! কোন দিন না লোকের হাতে মার খাস।”
তা শম্ভুর চুরি বাটপারির কথা সকলের জানা। কেউ কিছু তেমন বলে না।আসলে সবাই জানে শম্ভু মানুষটা বড় ভালো। চরিত্রের দোষও নাই। সে এমন চুরি করে না যে লোকের বড় ক্ষতি হয়। তাই এক হিসেবে সারা গাঁয়ের মানুষ তার এই চুরিটা উদার ভাবেই মেনে নিয়েছে। শুধু দুটো পুকুর এড়িয়ে চলে শম্ভু। চন্দরের বুড়ি ঠাকমা রাতের বেলাও পুকুরঘাটে শৌচ করতে আসে। বুড়ির আবার বাজখাঁই গলা। আর পালেদের পুকুর। ওদের বাড়ির ষণ্ডাগুলো খুব ত্যাঁদোড় প্রকৃতির।
অমাবস্যায় ও অবশ্য বেরোয় না। ওহ! বড্ড আঁধার। নিজের হাত পা পর্যন্ত ঠাওর হয় না।
রাতের বেলা রোজ বেরিয়ে বেরিয়ে শম্ভুর কত যে অভিজ্ঞতা হয়েছে! কত কি দেখেছে, কত কি শুনেছে, বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। যাক গে সে সব নিয়ে সে কখনো কারোর সাথে আলোচনা করে না। শুধু শুয়ে শুয়ে নিজের মনে ভাবে।
আজ হারানের ঘরের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছে, শুনতে পেল হারান আর ওর বউ সোহাগ করছে। একটুখানি দাঁড়িয়ে শুনল সে। তারপরই ভাবল,
” ছি! ছি! পরের বাড়ির বউয়ের সোহাগের কথা শুনতে আছে নাকি! ”
মাঝে মাঝে ওরও যে বিয়ের সাধ জাগে না তা নয়। তবে ওর মতো বাউণ্ডুলের বিয়ে দেয় কে!
হাতে সবসময় একটা কঞ্চি রাখে শম্ভু। সবাইকে আঁধার রাতে মোকাবিলা করতে পারে, কিন্তু মা মনসার বাহনকে ? গাঁয়ে বড় সাপের উপদ্রব। তার মধ্যে বিষধর তো অনেক। আসতে যেতে তাদের সরসরানি প্রায় টের পায় শম্ভু। চলতে চলতে কঞ্চি ঠোকে। আর মা মনসাকে জপ করে। চারদিকে ঝিঁঝিঁর একঘেয়েমি সুর। জোনাকপোকাগুলো সব দূরে দূরে বিন বিন করে জ্বলছে নিভছে। ওতে শম্ভুর কি! কুপকুপে অন্ধকারে মাঝে মাঝে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়।
আজ শম্ভু ঠিকই করে নিয়েছে, পালেদের পুকুরেই দাঁও মারবে। রোজ দুপুরে ফেরার পথে দেখে বড় বড় রুই কাতলা ঘাই মারছে। লোভ হয় খুব। পালেদের পুকুরে একবার জাল ফেলবেই।নিঃসাড়ে কাজ সারে। কেউ টের পাবে না। আর অত ভয় পেলে কি চুরি করা যায়!
তা আজ মনে জোর এনে হাজির হল পালেদের পুকুর পাড়ে। চাঁদের ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেল দূরে কি নড়ছে। ও বাবা! এ যে সাপে শঙখ লেগেছে!
” জয় মা মনসা! ওরে বাপ, ভাগ্যিস বেশি এগোই নি!”
মনে মনে ভাবে শম্ভু। পুকুরের যে পাড়ে পাল বাড়ির স্নানের ঘাট নেমে এসেছে তার ওপর পাড়ে শম্ভু সুবিধেজনক জায়গা খোঁজে। হঠাৎ কিসের নড়াচড়া দেখতে পায় পাল বাড়ির ঘাটে। এত রাতে কে এল পুকুরে, তাও কোন আলো ছাড়া। নিজেকে সামলাতে পারে না শম্ভু। ধীরে ধীরে পাড় ধরে ধরে হেঁটে হাজির হয় ঘাটের কিছু দূরে। একেই যা অন্ধকার শম্ভুর অস্তিত্ব সহজে টের পাওয়া কারোর সম্ভব নয়। তবুও গাছের পেছনে যতটা পারে নিজেকে আড়াল করে শম্ভু।
এবার বিনিয়ে বিনিয়ে কান্নার আওয়াজ পায়।এ যে পাল বাড়ির ছোট বউ! আলো আঁধারি থাকলেও ঠিক চিনেছে শম্ভু। পাল বাড়ি জন খাটতে এলে এউ বউটাই তো তাকে যত্ন করে মুড়ি, লংকা, পেঁয়াজ দেয়। অন্য কারোর হাত দিয়ে যেন জল গলে না।এই বউটা আলাদা। ঢেলে মুড়ি খেতে দেয়, মন ভাল। তাই তো শম্ভু এক দেখাতেই চিনেছে। কিন্তু, এত রাতে এখানে কি করছে! গতিক তো সুবিধের নয়। সাথে কলসীও আছে। শম্ভু এক নিমেষে পাল বাড়ির বউয়ের উদ্দেশ্য বুঝে ফেলল। গাঁয়ে ঘরে জলে ডুবে এর আগেও অনেক বউ মরেছে। সংসারের শত কষ্ট, অত্যাচার সইতে না পেরে গাঁয়ের অনেক বউ তাদের পরিণতি খুঁজতে চায় এই পুকুরের গভীর জলে।শম্ভুর রাগ হয়।
” কেন রে বাপু, জীবন তো এতটুকু। মরে করবি টাকি?”
যাইহোক এখন অত কিছু ভাবার সময় নেই। শম্ভু বুঝতে পারে না ওর কি করা উচিত। আগুপিছু ভাবার আগেই বউটা ঝাঁপ মারে জলে। ছুটে আসে শম্ভু। সেও ঝাঁপায়। কিন্তু, অতটুকু সময়ই বউটা অনেকটা জল গিলে ফেলেছে। দু হাত ছুঁড়ছে কোন রকমে। শম্ভু জাপটে ধরে ভাসিয়ে নিয়ে আসে পাড়ে। চ্যাংদোলা করে ঘাটের চাতালে এনে শোয়ায়। খাবি খাচ্ছে বউটা। বাঁচাতেই হবে যেমন করে হোক। ইতস্তত করে বুকে চাপ দিতে থাকে শম্ভু।
এর মধ্যে হই হই করে পাল বাড়ির গোটা তিনেক ষণ্ডা, তাদের মা হ্যারিকেন লম্ফ সব নিয়ে এসে পড়েছে।
নিরীহ বউটির শাশুড়ির গলা,
” বলি, ও পতাপ। বউকে শাসনও কি ঠিক মতো করতে শেখোনি ? আললাদীকে দু ঘা পেটানোর কি ছিল! ডুবে মরে মুখে চুনকালি দিতে এয়েছে আমাদের। ”
প্রতাপ নামের ছেলে তেড়িয়া হয়ে ওঠে।
” শম্ভু! তুই কিনা আমার বউয়ের বুকে উঠে বসেছিস! আজ তোকে খুন করে ফেলব।”
শম্ভু বুঝতে পারে, ঘরের বউ অনেকক্ষণ বাইরে গেছে দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু করে সবাই। পুকুরের চিন্তাই সবার প্রথম এসেছে। তার সাথে রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে জলে কিছুটা তোলপাড়ের আওয়াজ হয়েছে। সদলবলে তাই হাজির হয়েছে সেখানে।
বউটার মুখ দিয়ে ততক্ষণে অনেকটা জল উঠে এসেছে। কিছুটা স্বস্তি বোধ করে উঠেও বসেছে। তবে এরপর ওর কপালে যা নাচছে তা ভেবেই হয়ত আধমরা বউটার পুরো মরণের দশা এখন।
প্রতাপের দুই দাদা মিলে প্রতাপকে ধরে ফেলে। না হলে রাগে দিকবিদিকশুন্য হয়ে ততক্ষণে হয়তো শম্ভুকে মেরেই বসত।
তারা বোঝাল।শম্ভুর জন্যই বউটা রক্ষা পেয়েছে। বউটার জীবনের থেকে অনেক বড় কথা পাল বাড়ির সম্মান রক্ষা পেয়েছে। শম্ভু তাই মাছ চুরি করতে এসে ধরা পড়েও মারের হাত থেকে বেঁচে গেল।
এরপর শম্ভুকে সকলে মিলে শাসাল, এ ঘটনা যেন জানাজানি না হয়।তাহলে ওর লাশ গুম হয়ে যাবে।
খুব শিক্ষা হল শম্ভুর। রাতে মাছ চুরির কাজ ও পুরোপুরি ছেড়ে দেয়। দিনের বেলা বেগার খেটে রোজগার মন্দ হয় না। তাতেই চলে যায়। চুরির কথা ভাবলেই ওর মনে সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা মনে পড়ে।
পাল বাড়ির বউয়ের খোঁজ এরপর আর কখনো পায়নি শম্ভু। ও বাড়ির ধারে কাছেই যায় না আর। কানাঘুসো শুনেছে, বউটার চরিত্তিরের দোষের কারণে তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
হায় রে! সংসার। বউটার ইহজীবনের সবচেয়ে দুঃখের কাহিনি শম্ভু ছাড়া আর কেই বা জানে।
এখন শম্ভু রাতের বেলা গোগ্রাসে ভাত খায় তারপর ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে শুনতে ভসভসিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সমাপ্ত