গা ঘেষে কালো রঙের কার টা পাশ কাটিয়ে গেল৷ আরেকটু হলেই আমাকে ধুমড়ে মুছড়ে দিচ্ছিলো৷ এই মূহূর্তে কিছু করার ক্ষমতা নেই আমার৷ মনে মনে গালি আওড়াচ্ছিলাম৷ সামনে তাকাতেই অবাক কান্ড৷ গাড়িটা আবার ফিরে আসছে৷ ভেতরের গালিটা বুঝে ফেললো নাকি৷ গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে নামলো আমার বয়সী এক যুবক৷ চেহারাটা চেনা মনে হচ্ছে৷ মনে করতে পারছিনা৷ আজকাল কিছু মনে রাখতে পারি না৷ আবার যাই দেখছি চেনা মনে হচ্ছে৷ বড্ড খারাপ রকমের অসুখে পরেছি৷ যুবক হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো৷ আমি তখনো বুঝে উঠতে পারিনি৷ জড়িয়ে ধরা অবস্থায় পিঠে মৃদ্যু চড় দিয়ে বলল,
-কেমন আছিস বন্ধু?” আমি আবারো অবাক হই৷ বন্ধু ডাকটা আমি ভুলতে বসেছি৷ কালেভদ্রে গ্রামে গেলে শুনতে পাই৷ এই নিঃস্বঙ্গ শহরে সবশেষ কবে শুনেছি মনে নেই৷
-কিরে চুপ কেন তুই?” আমার প্রতুত্যর না পেয়ে আবার বলে ছেলেটা৷ আমি হেসে বলি,
-চিনতে পারিনি ভাই!
-আরে আমি সুজন৷
-কোন সুজন?” এবার সামনের ছেলেটা অট্টহাসিতে ফেটে পরে৷ হাসিটা কেমন জানি৷ জড়িয়ে ধরার আগের হাসিটা না৷ চোখের চশমাটা খুলল ছেলেটা৷
-আরে লাষ্ট বেন্ঞ্চার সুজন আমি বন্ধু৷
ঐ যে স্যার যখন বলার মতো টপিক না পেয়ে, আমাকে পঁচাতো আমি সেই সুজন৷ ভার্সিটি প্রোগ্রামে সবাই যখন স্যারের প্রতি মুগ্ধতার বুলি আওড়াতো৷ আমি তখন মুখ লুকিয়ে বাঁচতাম৷ আমার ভয় হতো৷ “তোমাকে তো দেখিনি” কথাটা শুনতে হবে বলে৷ পরপর তিন সেমিষ্টারে রেফার্ড ছিল বলে ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই যখন বলল, সুজন তোকে আর রাখা যাচ্ছে না রে বন্ধু৷ সংসারের চাপে নিয়ম মতো ক্লাসে যেতে পারতাম না বলে ডিপার্টমেন্টের মেহমান উপাধী পেয়েছিলাম! তোর মনে আছে? হ্যা আমি সেই সুজন৷” জানিস দোস্ত! সেদিন শফিস স্যারের সাথে দেখা হুট করে৷ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন৷
ভেবেছিলাম সামনে গিয়ে স্যারকে সালাম করবো একবার৷ তারপর পরিচয়টা দিবো৷ সম্ভবত সেদিনের আগের মতো বলবে, তোমাকেতো কখনো দেখিনি ছেলে!” কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানিস! স্যার আমাকে দেখামাত্রই জড়িয়ে ধরলো৷ বুক টানটান করে বলল, আমার ছাত্র৷ খুব ভালোবাসতাম তাকে!” আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি৷ হেসে হেসে বলেই ফেলেছি, “ছেলে তোমাকে তো জীবনে ক্লাসে দেখিনি!” কথাটা বলবেন না! স্যারের চেহারাটা কেমন জানি হয়ে গেল৷ আচ্ছা আমি কি অতো ভেবে বলেছি বল৷ স্পেশাল মেহমান” নামটা আমার পেছনে লাগিয়ে দেয়া অনিকের সাথে দেখা৷ দেখামাত্রই জড়িয়ে ধরলো আমাকে৷ আমিও ধরলাম ভদ্রতার খাতিরে৷ শেষে মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে, ঘামের গন্ধ বেরুচ্ছে শার্ট দিয়ে৷ কোথায় কামলা কাটিস রে?” অনিকের দিকে তাকাতে পারছিলাম না বন্ধু৷
বেচারি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল৷ আমি শান্তনা দিয়েছিলাম, টাকার আঁচ লেগেছে তো বন্ধু৷ অহংকার ভর করেছে আমার কাঁধে৷ কিছু মনে নিস না৷ সোনিয়ার সাথে দেখা হলো পরশু৷ ঐ যে ফ্রেন্ড সার্কেলের অলিখিত নেত্রী মেয়েটা৷ আমাকে দেখে নাকে সিটকানো ভাব ধরা মেয়েটা৷ “দোস্ত সরি! তোকে আর রাখতে পারছিনা৷” বলা মেয়েটা সেদিন তার স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো৷ আমি নাকি তার বেষ্টফ্রেন্ড ছিলাম৷ ঘরে ফিরে আমি গড়িয়ে গড়িয়ে হেসেছি মেয়েটার কথা শুনে৷” টাকার গরম আসছেরে বন্ধু! টাকার গরম আসছে আমার ভেতরে৷ তোকে দেখে ভালো লাগছে বন্ধু৷ রেফার্ড এক্সামের আগের দিন তোর ফোন পেতাম৷ তোর হ-য-ব-র-ল নোটসগুলো ছিল পরীক্ষার আগে আমার ভরসা৷
আমাকে দাঁড় করিয়ে মজা নেয়ার সময় তোর মুখে কখনো হাসি দেখিনি আমি৷ তোর সাথে আমার তেমন সখ্যতা ছিল না হয়তো৷ তবে অদ্ভূত ব্যাপার কি জানিস? আমার বন্ধু তালিকার মনের ডায়েরিতে তোর নামটা প্রথমে রয়ে গিয়েছে৷ শুনলাম সামনের সপ্তাহে ডিপার্টমেন্টের পুনঃমিলনি৷ “স্পেশাল মেহমান” হিসেবে দাওয়াত আমি পেয়েছি বন্ধু৷ ভালো লাগে কখন জানিস? যখন স্পেশাল মেহমান নামক টিপ্পনিটাকে সত্যিই স্পেশাল বানিয়ে ফেলেছি নিজের অজান্তে৷ দেখা হবে বন্ধু৷ ভালো থাকিস সবসময়৷” সুজন গাড়িতে উঠে বসে৷
আমি কল্পণা করি সেদিনের সুজনকে৷ বেক বেন্ঞ্চার কিংবা স্যারের কৌতুকের খোরাক হওয়া কাচুমাচু হয়ে থাকা ছেলেটাকে৷ টাকার গরম এসেছে” বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল ছেলেটার৷ ভাসা চাহনির চোখ দু’টোতে অপমানের জবাব দেয়ার তীব্র আকাংখা৷ আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি৷ হাঁটা ধরি গন্তব্যে৷ অদ্ভূত ব্যাপার, আমার ভালোলাগা বোধ হচ্ছে৷ ভালো থাকুক, অবহেলিত কিংবা কৌতুকের খোরাক হওয়া মানুষগুলো৷ টাকা কিংবা খ্যাতির অহংকার ছড়িয়ে পড়ুক তাদের শরীরের প্রত্যেকটা কোষে৷