মিনতির দুই পায়ের আঙ্গুল গুলোতে হাজা হয়ে এত চুলকোচ্ছে! গোলাপী বাড়ির নতুন বৌ বলেছিল – একটা মলম দেবে। সেটা লাগালে নাকি হাজা চলে যাবে। বরের সাথে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে গেছে জানি কোথায় বৌটা। মিনতিকে মলমটা দিয়ে যেতে ভুলে গেছে। মাস ফুরোতে এখনো দশ দিন বাকী। নতুন বাজারের ওষুধের দোকানটা থেকে যে একটা মলম নিজেই পয়সা দিয়ে কিনে নেবে মিনতি – তারও যো নেই। সংসারের কত যে খরচ! পাজির -পাঝাড়া সোয়ামি জুটেছে বটে একখানা মিনতির কপালে! এত কুঁড়েও যে কোনোও মানুষ হতে পারে! স্রেফ বাড়িতে বসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে গেল সারাটা জীবন।
অথচ একটু লেখাপড়া জানে । একটা দোকানে খাতা লেখার কাজ ও করতো। কিন্তু কি যে হয়েছে গত দু-তিন বছর ধরে! সবকিছু ছেড়েছুড়ে বাড়িতে বসে আছে ।আর মিনতি লোকের বাড়ি ঠিকে ঝি- গিরি করে -বাসন মেজে, কাপড় কেচে, হাতে পায়ে হাজা নিয়ে একটা অভিশপ্ত জীবন কাটাচ্ছে। বাপের বাড়ির তিনকূলে কেউ নেই। ভাসুররা কোনোও খবর রাখে না মিনতিদের। আসলে নিজের বদমাশ ভাইটাকে তো তারা চেনে হাড়ে মজ্জায়! ভয় পায় যদি কখনো পুরো পরিবার নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে ওঠে মিনতিরা!
মেয়েটা ছোট ,ছেলেটা বড়। দুজনেই খিচুড়ি স্কুলে যায়।
এই একমাস হলো গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধ। মিনতির চাপের যেন শেষ নেই আর। স্কুল থাকলে দুপুরের খাওয়াটা স্কুলেই সারে ছেলে মেয়ে। কিন্তু ছুটি থাকলেই মুশকিল। ছেলে মেয়ের জন্য রেঁধে -বেড়ে তবে কাজে বেরোতে পারে মিনতি। নিজের সারাদিনের খাওয়ার জন্য মুড়ি বেঁধে নিয়ে বেরোয়। কাজের বাড়িগুলোতে যদি কিছু দেয় মুড়ির সাথে সেটা খেয়ে নিয়ে খিদে মেটায়! তবে ভালো কিছু দিলে প্রাণে ধরে খেতে পারেনা মিনতি। ছেলে -মেয়ের মুখ দুটো ভেসে ওঠে চোখে। কোঁচরে বেঁধে সেগুলো বাড়িতে নিয়ে আসে। কি যে আনন্দ করে খায় ছেলে মেয়ে গুলো! মিনতির বর সকাল থেকে ঘুমিয়ে উঠে দুপুরে নিজের মত একটু জল মুড়ি খেয়ে নেয়। ছেলে মেয়ের স্কুল থাকলে কাক ভোরে উঠে রান্না করার হ্যাপা টুকু থাকেনা মিনতির। একেবারে বিকেলের সব বাড়ির কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরে রান্না করে।
কিন্তু গত একমাস ধরে চলছে সাংঘাতিক খাটুনি মিনতির! স্কুল ছুটি বলে ছেলে মেয়ে বাড়িতে ।দুপুর আর রাত – দুবেলাই রান্না করতে হচ্ছে তাই মিনতিকে। দুবেলা রান্না করা মানে – বেশী কেরোসিন তেল লাগছে। সকালেই যে একবারে দুবেলারটা রেঁধে রাখবে তার তো যো নেই ।যা গরম ! সকালের রাখা খাবার তো রাত অব্ধি রাখা যাবে না ।পচে উঠবে ।
লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা করে যে কি কষ্ট করে কেরোসিন তেল জোগাড় করতে হয়! ছেলে মেয়ে আর তাদের বাপ তিন জনের মতো রান্না করে ঝুড়ি চাপা দিয়ে তিন জনের খাবার বেড়ে রেখে -বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে সকাল ছটা বেজে যায়। টিউকলের পাশের বাড়ির -‘বোস গিন্নি’ ছটা বেজে গেলেই রাগের চোটে দাপাদাপি করতে থাকে। সকাল সকাল কি যে মুখ সহ্য করতে হয় মিনতিকে! কিন্তু ও বাড়ির কাজটা মাইনে আন্দাজে এমনিতে হালকা। একদম ঠিক ঠিক সময়ে ঢুকে বাসন কটা মেজে দিয়ে জলখাবার তৈরি করে দিলেই সকালের মত নিশ্চিন্ত। আবার সেই বিকেল বেলা যেতে হয়। বোস গিন্নির মনটা খুব ভালো। দেরি হলে মুখ ঝাঁক করলেও গরমে – আম লিচু, শীতকালে কমলালেবু -আপেল কখনো সখনো ভালোবেসে দেয় মিনতির ছেলে মেয়েকে খেতে। এই গরমের ছুটির সময়টাতে, দেরী করে কাজে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকদিনই সকালবেলা মিনতি খুব বকা খায় বোস গিন্নীর কাছে। কিন্তু কিই বা করার আছে ওর! বোস গিন্নি মাইনেটা ভালোই দেয় যে। এ কাজটা ছাড়া যাবে না।
আজও রান্না সেরে খাবার গুলো গুছিয়ে, বোস গিন্নির বাড়িতে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সকাল সাড়ে ছটা বেজে গেল মিনতির । পায়ের হাজার জন্য চটিটা ঠিক করে পরতেও পারেনি মিনতি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোওরকমে এসেছে। বোস গিন্নি দরজাটা খুলে দিয়ে যা নয় তাই বলল মিনতিকে। এক প্রকার জবাবই দিয়ে দিল! বাসন মেজে, জল খাবার তৈরী করতে করতে পোড়া চোখ দুটো ফেটে জল আসছে বারবার মিনতির! এই কাজটা চলে গেলে খুব আফসোস হবে। অনেক কটা টাকা কমে যাবে। এই এলাকায় মিনতির মতো তোলা কাজের মেয়ে আরো আছে! বলা ভালো – মিনতির মতো পোড়া কপালী আরো অনেক অনেক আছে। বোস গিন্নির বাড়ির হালকা কাজে বেশী মাইনে পাওয়ার লাইনে অনেকেই আছে ।বোস গিন্নি কথায় কথায় তো তাই শোনায় – ”ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হবে না।”
এতবার করে মিনতি বলল যে ছেলে মেয়ের স্কুলটা খুলে গেলে আর দেরী করে আসবে না – তা সে কথা বোস গিন্নির কানেই গেল না। কট কট করে কেমন শুনিয়ে দিল –
-” কাজে ঢোকার সময় পই পই করে তোকে বলেছিলাম না – আমার কাছে সকাল ছটা মানে ছটা। একচুল নড়াচড়ার উপায় নেই। আমি কথার খেলাপ মোটে পছন্দ করি না। ”
আজ যেন গরমটা আর সহ্য হচ্ছে না মিনতির। রুটি বেলতে বেলতে শরীরটা যেন জ্বলে যাচ্ছে! কোমর আর পিঠের ঘামাচি গুলো চুলকোচ্ছে খুব। গরম পড়লে বস্তিতে জলের এত কষ্ট! ভালো করে রোজ স্নানটাও যে করতে পারে না মিনতি!
খিদেও পেয়েছে যে ভীষণ। ছেলে মেয়ে দুটোকে বড় করবার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে এই যে রোজকার লড়াই, সকাল -সন্ধ্যে কঠিন পরিশ্রম, ঘরের মানুষটার থেকে কোনোওরকম সাহায্য না পাওয়া, ভূতের মতো খাটতে খাটতে নিজের শখ-আহ্লাদ কোনোও কিছুই না মেটা – এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে একটা অদ্ভুত খেয়াল এল মিনতির মাথায়!
আচ্ছা – নিজের জন্য যদি একটা দিন পাওয়া যেত! একদম শুধুমাত্র নিজের জন্য একটা দিন? যেদিন কাক-ভোরে স্টোভ জ্বালিয়ে রান্না করে নয়, যেদিন তোলা কাজ করতে করতে যথেষ্ট ভালোভাবে কাজ না করতে পারার ফল স্বরূপ সে বাড়ির বউদের বকুনি খেয়ে নয় – মাসের শেষে চাল বাড়ন্তর সময় ছেলে মেয়ের খিদের মুখে তাদের পাতে ভাতের হাঁড়ির সবটুকু ভাত গুছিয়ে দিয়ে নিজে জল খেয়ে শুয়ে পড়া নয়, যেদিন এই এতগুলো বছর ধরে কি পেল আর কি পেল না তাই নিয়ে দুঃখ করে নয় – একদম নিজের খেয়াল খুশীতে ,ভালো লাগায় যদি পাওয়া যেত নিজের সাথে নিজে কাটানোর জন্য একটা দিন? নিজের মনের মতো করে একটা পুরো দিন কাটানোর সুযোগ?
কি করতো মিনতি তবে?
কি করতো এই ভাবনাটা ভাবতে ভাবতেই রমা বৌদির বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালো মিনতি। মাথার পোকাগুলো কেমন কিলবিল করে নড়ে উঠল যেন! বারবার মনে ওই প্রশ্নটা আসছে। যদি পাওয়া যেত নিজের জন্য একটা গোটা দিন?
ভোরবেলা সেদিন ঘুম থেকে উঠতোই না মিনতি। বাসি ঘর ঝাড় দেওয়া, জল তোলা কিছুই করতো না। ছেলে মেয়ে বর সবাইকে বলে দিত –
-” আজ আমি ঘুম থেকে উঠবোই না। খবরদার কেউ যদি আমাকে ডেকেছ! ”
কুঁড়ে বরটাকে মুখ ঝামটা দিয়ে বলতো-
-” ছেলে মেয়ে গুলোকে নিয়ে যাও না কোথাও একটু কাছে পিঠে ।একখানা তো মোটে ঘর আমাদের ।এখানে যদি তোমরা ঘোরাফেরা করো তাহলে ঘুমাবো কি করে?” ঘরের মানুষ তিনটে যেই না চলে যেত কোথাও – ‘দুগ্গা দুগ্গা’ বলে মিনতিও বেরিয়ে পড়ত। দুশো আঠেরো নম্বর বাসটা নাকি বাবুঘাট যায়। ওখান থেকে গঙ্গা নদী খুব কাছে। পাশের বাড়ির পরেশের মায়ের কাছে অনেকবার শুনেছে মিনতি। কোনোওদিন যাওয়াই হয়নি। পরেশের মা অনেকবার পাড়ার ঠাকুর বিসর্জনের সময় লরিতে করে গেছে বাবুঘাট। মিনতির কোনোওকালেই যাওয়া হলো না।
‘ওই বিশেষ দিনটাতে’ কিন্তু মিনতি ঠিক বাসে করে পৌঁছে যাবে বাবুঘাট আর সেখান থেকে গঙ্গা!
চুপটি করে নদীর পাড়ে বসে থাকবে মিনতি। সময় সুযোগ বুঝে নদীতে নেমে ইচ্ছেমতো স্নান করবে। সেই যেমন ছেলেবেলায় ‘সোনাই নদীতে’ নেমে স্নান করতো, মনের আনন্দে সাঁতার কেটে জল ছিটিয়ে। সে যেন আগের জন্ম! মা -বাবা এত তাড়াতাড়ি দুজনেই মরে গেল! মিনতি এ -দোর ও- দোর ঘুরে ঘুরে শেষে এখন বাবু মিস্ত্রির বউ ঠিকে ঝি মিনতি মিস্ত্রি। সমর আর চামেলীর মা।
ওই বিশেষ দিনটাতে নদীর পাড়ে বসে চুল শুকিয়ে নেবে মিনতি। অবশ্য চুল আর ক- গাছাই বা বেঁচে রয়েছে মিনতির এত অযত্নের পরে !আর তারপর খিদে পেলে…!
দূর! সেদিন খিদে -তেষ্টা কিচ্ছুটি পাবে না। প্রতিদিন এই খিদেটাই তো ভীষণ জ্বালায় মিনতিকে। পেট ভরে কিছু খেতে গেলেই খালি ছেলে মেয়ে দুটোর মুখটা চোখে ভেসে ওঠে। কিন্তু সেদিন!
সারাটা দিন মিনতির কেটে গেল একটা স্বপ্নের দিন নিজের মতো করে কাটানোর ভাবনা ভেবে ভেবে। রাতে সব বাড়ির কাজ সেরে ঘরে ফিরে মিনতি তো অবাক! ওর কুঁড়ে অলস বর আজ ভাত চাপিয়ে দিয়েছে স্টোভে। ডাল ,আলু ভাজাও করে রেখেছে। অবাক বিস্ময়ে মিনতি যখন দেখছে বরের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে -তখন ওর ছেলে মেয়ে দুটো পড়া থেকে উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল-
” মা, বাবা একটা কাজ পেয়েছে। পরশুদিন থেকে কাজে যাবে। একটা দোকানে খাতা লেখার কাজ। বাবা বলেছে মাইনে পেলে আমাদের সবাইকে নিয়ে একদিন বেড়াতে যাবে। বাবুঘাটে গঙ্গার ধারে। ”
সারাদিনের খাটুনির পরে এমনি সময় রাতে বিছানায় শুলে ঘুমে চোখ বুজে আসে মিনতির। আজ যেন এক অদ্ভূত উত্তেজনায় দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না ও। এতদিন পরে ঘরের মানুষটার টনক নড়েছে তাহলে ! হে বাবা বড় ঠাকুর – মানুষটাকে সুমতি দাও । কাজটা যেন টিকিয়ে রাখতে পারে ।কুঁড়েমি করে যেন আবার খুইয়ে না বসে।
নাই বা হলো নিজের মতো একটা দিন কাটানোর স্বপ্ন পূরণ মিনতির- তার বদলে ছেলে ,মেয়ে, স্বামীকে নিয়ে যদি সত্যি সত্যিই একদিন বাবুঘাট ঘুরতে যেতে পারে, গঙ্গার পাড়ে বসে বসে ঢেউ দেখতে পারে – তাহলে এই জীবনের বহুদিন ধরে দেখা একটা স্বপ্ন সফল হবে। তীব্র আবেগে মেয়ে চামেলীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল মিনতি!
একদিন -প্রতিদিনের এই রোজনামচায় মিনতি মিস্ত্রিরা বোধহয় এভাবেই ‘দিনবদলের স্বপ্ন’ দেখতে দেখতে – নিজের ব্যক্তিগত ভালো লাগা, ভালো থাকাকে ভুলেই যায় !একটা গোটা দিনকে শুধু নিজের মতো করে নিজের জন্য বরাদ্দ করা মিনতিদের কাছে যে একটা চিরকালের ‘অধরা বিশ্বাস…!’
সমাপ্ত