পাশের বাড়ির মিঠিদিদির বিয়ে। সকাল থেকেই ফোচনের ব্যস্ততার শেষ নেই। মিঠিদের সাথে ওদের প্রায় আত্মীয়ের সম্পর্ক। তাই আইবুড়ো ভাত থেকেই নেমন্তন্ন। ঝিমলি আগে থেকেই ভালো জামাকাপড় রেডি করে রেখেছিল। কিন্তু ফুচকাকে কিছুতেই টুপি পরানো যাচ্ছিল না। পৌষমাসের দিন, ভালোই ঠান্ডা আছে। নিজে হাতে এই ম্যাচিং টুপিটা বুনেছে ঝিমলি। পরিষ্কার বলে দিয়েছে, টুপি না পরলে বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ। অতএব আমাদের ফোচন চক্রবর্তীকে কম্প্রোমাইজ করতেই হল। আজ আবার সঙ্গে জুটেছে মাসতুতো বোন মিশকা। সেও আরেক যন্তর। ফর্সা, গোলগাল চেহারা। মুখ দেখে কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই কী সাঙ্ঘাতিক জিনিস। সেও একটা নতুন পিঙ্ক ফ্রক আর পিঙ্ক হ্যাট পরে ফুচকাদাদার পেছন পেছন ঘুরছে।
অপ্রত্যাশিতভাবে আজ ছুটি পেয়ে গেছে ঝিমলি। ভেবে রেখেছে, সকালে পার্লার খুলতে খুলতেই গিয়ে ফেসিয়াল ইত্যাদি করিয়ে নেবে। নিয়ে সোজা ব্যাঙ্কের লকার থেকে গয়নাগাটি তুলে বাড়ি। মিঠিদের বাড়ি জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়বে। কাজকর্ম সেরে এসে আবার স্কুলের কাজ নিয়ে বসতে হবে। একগাদা প্রজেক্ট জমে আছে, চেক করতে হবে। এস.এ. টু-এর কোয়েশ্চেন পেপার জমা দেওয়ারও সময় হয়ে এসেছে। এই স্কুলে যেন হাঁফ ছাড়ার উপায় নেই।
মিঠিদের বাড়ি গিয়ে দেখে ফুচকা আর মিশকা সারাবাড়ি ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। জলখাবারে লুচি-তরকারি হয়েছে। লুচি তো ফুচকার হট ফেভারিট। মিশকাটার খাওয়া নিয়ে বড্ড বায়না। তবে আজ ফুচকাদাদার দেখাদেখি মিশকাও বেশ পরিপাটি করে লুচি-তরকারি খাচ্ছে। ঝিমলি খানিকটা নিশ্চিন্ত হল। যাক, পেটটা তো ভরল। বিয়েবাড়ির ব্যাপার, খেতে কত অবেলা হবে।
ঝিমলি জলখাবার খেয়ে বেরোবে বেরোবে করছে, এমন সময় হৈ হৈ করে গায়ে হলুদের তত্ত্ব ঢুকল। ঝিমলিও দাঁড়িয়ে গেল। দারুণ তত্ত্ব পাঠিয়েছে মিঠির শ্বশুরবাড়ি থেকে। শাড়ি, কাপড়, জামা, জুতো, ব্যাগ ছাড়াও মিঠি ভালোবাসে বলে বেশ কয়েক ট্রে চকোলেট আর সফট টয়। ফুচকা আর মিশকাকে তো সামনে থেকে সরানো যাচ্ছে না। বাচ্চাগুলোকে আর কী বলবে? ঝিমলির নিজেরই যা লোভ হচ্ছে। তবুও চোখের ইশারায় দুই ভাইবোনকে বলল সামনে থেকে সরে আসতে। গায়ে হলুদ পর্ব শুরু হয়ে গেছে। আচমকা কেউ এসে মুখে হলুদ লাগিয়ে দেওয়ার আগে কেটে পড়াই ভালো। যাওয়ার আগে ফুচকা আর মিশকাকে ডেকে বেশ কড়া গলায় বলে গেল, “কোনওরকম দুষ্টুমি করবে না, কোনওকিছুতে হাত দেবে না। আর ঠিক সময় বাড়ি গিয়ে স্নান করে নেবে। নইলে সন্ধেবেলা যখন বর আসবে, তোমরা কিন্তু ঘরে আটকে থাকবে।”
সুবোধ বালক-বালিকার মতো ঘাড় নেড়ে তারা একছুট। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত জ্ঞান শোনার সময় কই? ঝিমলি বেরিয়ে যেতেই ওরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দুটোতে মিলে বাড়িময় ছুটোছুটি করতে ব্যস্ত। ফুচকাকে এ-বাড়ির সকলেই খুব ভালোবাসেন। যেতে আসতে অনেকেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন বা গালটা টিপে দিচ্ছেন। মিশকাকে তেমন কেউ চেনেন না। ফুচকার মাসতুতো বোন। ছুটিতে মাসির বাড়ি বেড়াতে এসেছে, তাই ওরও নেমন্তন্ন। এরই মাঝে মিঠিদিদির কোলে বসে বেশ পোজ মেরে ছবিও তোলা হয়ে গেছে ওদের। বেলা গড়াতে চলেছে। এদিকে যখন গায়ে হলুদের পর্ব চলছে, ওদিকে দুপুরের রান্না বসে গেছে। মাছ ভাজার গন্ধ ঠিক পৌঁছে গেছে শ্রীমান ফোচন চক্রবর্তীর নাকে। আর তাকে পায় কে? গিয়ে হাজির হয়েছে উঠোনে, যেখানে শামিয়ানা খাটিয়ে রান্না হচ্ছে।
ফোচন বা মিশকা কেউই এর আগে কোনওদিন বিয়েবাড়ির রান্না দেখেনি। এত বড়ো বড়ো হাঁড়ি, কড়াই, হাতা-খুন্তি দেখে তো দু’জনের চক্ষু ছানাবড়া। ভাত, ডাল, তরকারি ততক্ষণে হয়ে গেছে। একটা কড়াইয়ে তখন ঝুরঝুরে আলুভাজা ভেজে তোলা হচ্ছে। পাশে বিশাল বড়ো থালায় লম্বা ফালি ফালি করে বেগুন কেটে রাখা। আলুভাজা উঠলেই এবার বেগুনির পালা। অন্য এক স্টোভে বিশাল বড়ো কড়াইয়ে মাছ ভাজা হচ্ছে। কিছু মাছ ইতিমধ্যেই ভেজে তুলে রাখা হয়েছে। পাশে বসে একজন মশলা বাটছেন। মাছের কালিয়া হবে। মাছের গন্ধে উঠোন ম ম করছে। জিভে তো জল আসছে দুই ভাইবোনের। বাচ্চা দুটোর মনের ভাব বুঝতে পেরেই বোধহয় ঠাকুর সস্নেহে ওদেরকে, “এই, এদিকে এস,” বলে ডেকে দু’জনকে দু’পিস মাছভাজা দিলেন কাগজের প্লেটে করে। দু’জনে পরম তৃপ্তি করে মাছভাজা খাচ্ছে, এমন সময় ঝিমলির মা এসে হাজির। ছেলেমেয়েগুলোর বাড়ি ফেরার নাম নেই, অবেলায় স্নান করলে ঠান্ডা লাগবে। তাই উনি নিজেই নিতে এসেছেন। বাড়ির কোথাও খুঁজে না পেয়ে উনি ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন এদের দু’জনকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে। ইশ, কী লজ্জার কথা! বাড়িতে যেন খেতে পায় না। সবার সামনে কিছু না বললেও মনে মনে বললেন, ‘চল একবার বাড়ি, দেখাচ্ছি মজা।’
বিয়ের লগ্ন তাড়াতাড়ি। তাই বিকেল হতেই হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। মহিলামহল সাজগোজে ব্যস্ত। কারও শাড়ির কুঁচি ঠিক হচ্ছে না, কারও আবার চোখের মেক-আপ বা হেয়ার স্টাইলটা পছন্দসই হচ্ছে না। আয়নার সামনে ঠেলাঠেলি। কেউ কেউ তো এখনও পার্লার থেকে ফিরতেই পারেননি। কনের সাজ প্রায় হয়ে এসেছে। ফুচকা আর মিশকা ওখানেই ঘোরাঘুরি করছে। কী সুন্দর লাগছে মিঠিদিদিকে। যেন একদম রাজকন্যা। মাঝখানে গিয়ে অবশ্য পেট ভরে চিকেন পকোড়া খেয়ে এসেছে। কফিতে কোনও আকর্ষণ নেই ওদের।
হঠাৎ নিচ থেকে কে যেন চেঁচাল, “বর এসে গেছে, বর এসে গেছে।”
ব্যস, যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার সুরের টানে হুড়মুড় করে সব ছুটে চলল নিচে। কনে পড়ে রইল একা। কনে এখন সেকেন্ডারি। একা অবশ্য নয় মিঠি। গুণমুগ্ধ দুই খুদে পাহারাদার বসে আছে ওর সঙ্গে। মিঠি নিজে স্মার্টফোনে ব্যস্ত, সেলফি তুলতে আর হোয়াটস-অ্যাপ করতে। নিচে তখন জামাইবরণ চলছে। উলু আর শাঁখের আওয়াজে বাড়ি মুখর। জামাই বেচারা হাসি হাসি মুখে আদরের অত্যাচার সহ্য করছে।
ছেলে আশীর্বাদ শেষ, এবার মেয়ে আশীর্বাদের পালা। মিঠিকে ওপর থেকে আনতে হবে। এতক্ষণে সবার টনক নড়েছে যে মিঠি ওপরে একা।
মিঠির ঘরের সামনে যেতেই সবার চক্ষু ছানাবড়া। মিঠি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে; চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। চেঁচিয়ে কাউকে ডাকারও ক্ষমতা নেই। মেঝেতে পড়ে একটা লোক ছটফট করে কাতরাচ্ছে। ফুচকা আর মিশকা মিলে তাকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করছে। ফুচকা লোকটার গায়ের ওপর উঠে ঠিক বাঘের মতো লোকটার গলার কাছে কামড়ে ধরে আছে। আর মিশকা লোকটার পায়ে সমানে আঁচড়ে কামড়ে যাচ্ছে।
“সর্বনাশ, এ কী করছিস তোরা?” বলে এগিয়ে ফুচকা আর মিশকাকে সরাতে গিয়েই চোখে পড়ল লোকটার হাতের মুঠোতে মিঠির সোনার হার, দুল। লোকজন দেখে সাহস পেয়ে মিঠি গলার স্বর ফিরে পেয়েছে। মাকে জড়িয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে, কান কেটে রক্ত ঝরছে। বিয়েবাড়ির মধ্যেই থানাপুলিশ। এক বিশ্রী ব্যাপার। ফুচকা আর মিশকাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন সকলে। ওদের জন্যই এত বড়ো একটা দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে। বাকি বিয়ের অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নেই কেটে গেছিল। পরেরদিন সকালে ক্যালকাটা টাইমসের হেডলাইন ‘ডোমেস্টিক ফেলাইন্স ফয়ল থেফট এটেম্পটঃ সেভ ব্রাইডাল জুয়েলারি’। সঙ্গে ফুচকা আর মিশকার হাসি হাসি মুখের ছবি।