রুগীদের সাথে গপ্পো করাটা, আমার একখানা বিলাসের অভ্যাস। বিশেষত, সময়টা যদি, আউটডোরের শেষের পথে হয়। মানে, এইইই ধরুণ দুপুর পৌনে দুটো টুটো নাগাদ আর কি!রোদ্দুরটা, এসময় ত্যাঁড়চা ভাবে পড়ে থাকে বারান্দায় একচিলতে। অশরীরী, আবেশী হাওয়া বয় উদাসী। পাটকিলে রঙের একটা হুমদো বেড়াল, রোদ্দুরে শুয়ে শুয়ে পেট চাটে। চড়াই ওড়ে বারান্দায় পিড়িং পিড়িং।
আসল-এ হাসাপাতালটা, আমার এই টি বি হাসপাতালটা, বয়সের ভারে প্রাচীন। এককালে রেডক্রশের সম্পত্তি ছিলো। পরবর্তীতে সরকার অধিগ্রহণ করেন। তা, সেওওও হলো গিয়ে বেশ কয়েক দশক আগেকার কথা। এ হাসপাতালের আনাচে কানাচে ঢুঁড়লে তাই, এখনো দিব্যি খুঁজে পাওয়া যায় মর্মরফলকের টুকরো, প্রাচীন সবজেটে হ্যারিকেন, মিক্সচার বোতলের শিশি। এ বিল্ডিংয়ের দরজা জানালা এখনো সেগুন কাঠের, এ বাড়ির দেওয়াল এখনো বিশ ইঞ্চির। এখানে, এইরকম দুপুরবেলাগুলোতে তাই বেশ ঘুম ঘুম নিজ্ঝুম ভাব হয়, মধ্যদুপুরে। তার উপর যদি কোনোদিন রোগীপত্তর কমসম হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। এ সময়ে, তাই আমার অন্তরের গোপ্পে সব্যসাচীটি গুটিগুটি জেগে ওঠে।
সেদিনও তেমনই হলো। বেশ মনে আছে, সময়টা শীতকাল। এবং শীতকাল গতবছরের। ঠান্ডাটাও পড়েছিলো সেবারে জমিয়ে। এবং সেই ঠান্ডায় জুজুবুড়ি হয়ে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে, আর উঠোনে বসে থাকা এক চিলতে সোনালী উষ্ণতার দিকে প্রলুব্ধ চোখে তাকাতে তাকাতে, উচ্চৈঃস্বরে খিস্তি করছিলাম আমি। সামনে তখন আমার বছর চল্লিশের এক রোগী। তেনার সর্দি হয়েছে চরম। স্টেথো বসিয়ে দেখলাম–বুকে সাঁই সাঁই শব্দের ঝড় বইছে তালে তালে।
ফটাস ক’রে কান থেকে স্টেথোটা খুলেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলুম–” এবার ধরে পেটাবো। মাক্কালি! পেটাবোই! দ্যাখো তুমি! ফাজলামি হচ্ছে? অ্যাদ্দিন কী রাজকর্ম করছিলে বাপ আমার শুনি? যখন সর্দি লাগলো, তখন আসতে কী হয়? ….যত্তসব…”
রোগীটি রাগ করলো না। ইঁট নিয়ে মারতেও এলো না তেড়ে। রোগীরা, এরকম করে না কখনোই কোনোদিনও। করে কারা, সেসব আমি জানি। আর কারা তাদের মদত জোগায়, সেটিও আমার উত্তমরূপে জ্ঞাত। আমি তাই সেইসব বেড়েপাকাদের “ভালোর জন্য” বাক্য খরচা করি না একটিমাত্রও “এ.টি.পি” খরচা ক’রে। বরং, বেড়েপাকা বাওয়ালদের চূড়ান্ত দাদাগিরির মাঝে, ঠাকুর নাম জপ করতে করতে, খসখসখসিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখে ছেড়ে দিই যত দ্রুত সম্ভব। আমি ডাক্তার। আমি যীশুখ্রীষ্ট নই।
যাহারা আমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে মম আলো, তাহাদের মুই ক্ষমা করি নাই, বাসি নি মোটেও ভালো।
সে যাক গে। তো এই যে এই সামনে বসা মধ্যচল্লিশের লোকটি, এ লোকটি তেমন নয়। আর তাই সে মাথা নীচু করে বললো–” সে আপনি বকেন! কি আর বলবো!..এমন কাজে ফাঁইসা থাকি…”।
আমি, গল্পের গন্ধ পেলুম।
সুর একটু নরম করে বললুম–” খুলে বলো তো দেখি! কিসের এমন কাজ, যে এই শেষ অবস্থা ছাড়া আসার উপায় থাকে না? তুমি জানো না,ভাই? যে তোমার অ্যাস্থমা আছে? জানো না যে, দেরিতে এলে বিপদ বাড়বে?….যাক গে, বাদ্দাও…কি হয়েছে বলো দেখি…কিসের এমন কাজ তোমার…করো তো মুদিদোকান…হাসপাতাল পাড়াতেই…তা, দু সেকেন্ড এসে দেখিয়ে যেতে পারলে না?”
ভদ্রলোকের চোখে দেখলাম, দপ করে একটা আগুণ জ্বলে উঠলো। উষ্মার আগুণ নয়। একটা…একটা…..অদ্ভুত রকমের স্পর্ধা এবং আশার আগুণ।
–” আপনি তো ছেলেকে দেখসেনই…ওই যে রণবীর…ওকে আমি ডাক্তার বানাইব স্যার…আপনার মতো…জয়েন দেবে এবারে…দোকান ছাইড়া আসার সময় নাই। কাস্টোমার দাঁড়ায় থাকে। লোস্কান হয়। ছেলের কোনো অভাব রাখব না আমি স্যার…ডাক্তার হবে..আপনার মতো…দেইখেন”।
আমি, প্রেসক্রিপশন হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে অস্ফুটে শুধু বলেছিলাম –” চান্স পেলে একটা খবর দিয়ো। খালি হাতে আসবে না কিন্তু…”।
রোগী, মধ্যচল্লিশ, আম-আদমী, রণবীরের বাবা, এবং মুদিদোকানী, হাসতে হাসতে উঠে গিছলো–” মিষ্টি আনবো ডাক্তার বাবু….পাথ্থোনা কইরেন…আপনারা ভগ্বান..”।
পরের ঘটনাটা, এর মাস চারেক পরের। তদ্দিনে আমি রণবীর ফনোবীর ভুলে মেরে দিয়েছি পুরোপুরি। বাবা সমেত রণবীর যদিও এরই মাঝে বার দুই তিন “দেখিয়ে” গ্যাছে আমায়। তবুও…সেসব কেইই বা আর মনে রাখে! ডাক্তার হতে হলে কী পরিমাণ অধ্যবসায় প্রয়োজন, সে কি আর আমার অজ্ঞাত? ধুমধাড়াক্কা স্বপ্ন দেখলেই হলো? যা খুশী?
কিন্তু হলো। সত্যি সত্যিই ধুমধাড়াক্কার স্বপ্ন জলজ্যান্ত সত্যি হলো। তদ্দিনে, রমরমিয়ে নতুন বছর পড়ে গেছে। পড়ে, তারপর পুরোনোও হয়ে গেছে। বারান্দার বাইরে লুটিয়ে পড়ে থাকা ওই যে এক চিলতে টগবগানো সোনা, সেটিকেও তদ্দিনে মনে হতে শুরু করেছে শত্তুর। মাথার উপরেও ফ্যান ঘুরতে শুরু করেছে ঝড়ের বেগে। বেড়ালটা এখন, রোদ্দুর তফাতে রেখে, ছায়াতে এসে ঝিমোয়। এমনকি, ব্যাটাচ্ছেলে চড়ুইপাখির দলও দু’টো বাজলেই পিড়িক পিড়িক ঢুকে পড়ে টুকুর টাকুর। ঢুকেই আবার পালায় ফির সে। ভাবখানা এমন, যেন–“এই য়ো…জল্দি আউটডোর খালি করো। রাউন্ডে যাও। এবার আমরা ঠান্ডা ঘরে ঘুমুবো”।
ঠিক এইরকম একটা দিনেই ঢুকলো রণদীপ। সঙ্গে, মধ্য চল্লিশ বাপ। আর ঢুকে কি ঢুকেই ঢিপ করে প্রণাম।
রণদীপও। রণদীপের বাপও।
আমি হাই হাই করে বাধা দেওয়ার আগেই, প্রণাম টনাম কমপ্লিট। বাপ ভদ্রলোক তৃপ্ত চোখে, কপোল মুছে বললেন—” আপনার রণদীপ ডাক্তারীতে চান্ছ পেয়েছে স্যার। আপনি স্যার, আশীর্বাদ করেন এরে…”।
এরপর গল্প হলো মিনিট পনেরো। কী কী বই লাগবে, কেমন করে পড়তে হবে, দুর্গাপূজায় ছুটি পাবে কি না..এইসব…মামুলি।
রণদীপ চান্স পেয়েছে কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। চান্স পেয়েছে আমার কলেজে। ভাগ বসিয়েছে আমার আত্মাতে।
রিভলভিং চেয়ারের গড়গড়ানি সামলে, উত্তেজনায় বাবু হয়ে বসলাম গুছিয়ে। শোনালাম, একের পর এক গপ্পো, তড়বড়ালাম একটার পর একটা টিপ্স। এবং সেসবকিছুর শেষে, পিতাপুত্রে যখন চলে যাচ্ছে বিদায় নিয়ে, চেয়ার ছেড়ে রাউন্ডে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে, আওয়াজ মারলাম হালকা—” খালি হাতেই এলে? ধ্যাৎ..কিপ্টে যতো রাজ্যের..”
রাউন্ড দিতে যাবো যে বিল্ডিংয়ে, সেই বিল্ডিংয়ে যাওয়ার পথই হলো, হাসপাতালের মূল প্রবেশদ্বারের পথ। তার একপাশে কদম্ব, অন্যপাশে শিরিষ। কদমগাছের ছায়াতেই ফট্ করে দাঁড়িয়ে গেলো বাপ-ছেলে। লজ্জা লজ্জা মুখে ঘুরে বললো–” হি হি..রাগ কইরেন না..আপনারে খাওয়াবো ঠিইইক! ছেলেটারে অ্যাডমিছন কইরে আসি…ডাক্তার হবে স্যার…আপনার মতো…চাকা লাগানো চেয়ারে বসবে….সবাই বলবে স্যার আপনাকে য্যাম বলে…ভালো ডাক্তার….।”
রণবীরের সাথে ওই আমার শেষ দ্যাখা। ফোন নাম্বার নিয়ে নিয়েছিলাম যদিও সেইদিনেই। দিয়েও দিয়েছিলাম হাসিমুখে। আর বলেছিলাম—” দরকার হলেই ফোন করবি রে পাগলা…যখন খুশি”।
তা রণবীর করতোও বা। এম্নি এম্নিও, কাজেকম্মেও, আবার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেও।
ক্রমে ক্রমে ফেসবুকেও চলে এলো রণবীর। সেল্ফি, গ্রুপি, স্টেটাস…পোস্ট। চোখের সামনে একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছিলাম, প্রান্তিক একটা ছেলে, স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে একটু একটু করে।
ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। সম্মানার্জনের স্বপ্ন। “কিছু একটা” ক’রে দেখানোর স্বপ্ন।
চলছিলো এরকমই।
তারপর তো এইইই।
এই যে, বর্তমান পরিস্থিতি।
উদ্বিগ্ন হয়ে, রণদীপকে ফোন করেছিলাম তাই আজ দুপুরে।
–” কেমন আছিস রণদীপ? কী অবস্থা রে?”
উত্তরে, যা শুনলাম, সেইটেই বরং লিখে দি উদ্ধৃতি স্টাইলে—
” সব্যদা…সব্যদা….পুলিশ সব্যদা…জলকামান…সব্যদা…আমি…আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি…সিনিয়াররা বলেছে ফার্স্ট ইয়ারদের পালিয়ে যেতে….বিকেলে হয়তো ভাঙচুর করতে ঢুকবে সব্যদা…আমাদের দাদারা …তোমরা…তোমরা তো কিছুই চাও নি! বলো?…শুধু দোষীদের শাস্তি হোক…শুধু যেন নিরাপত্তাটুকু…..তবুও?…কেন যে….কেন যে…..আমি কী করবো সব্যদা….সব্যদা…আমার বাবা…সব্যদা…আমার আর একমাস পরে পরীক্ষা…”
শেষের দিকে ছেলেটা ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেললো। আমি ফোন করতে করতে রুটি খাচ্ছিলাম। দুপুরের খাবার। আমার সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠলো। মনে হলো ম’রে যাবো। এই পলে। এক্ষুণি। আমার ভাই, আমার বন্ধু, আমার জুনিয়ার আজ কুকুরের মতো তাড়া খাচ্ছে।
চোখ দিয়ে টসটস করে জল বেরিয়ে এলো আমার। উত্তেজনাটা কোনোরকমে সামলে বললুম—” আরে ধ্যাৎ পাগলা…কাঁদছিস কেন? আরে ধুর..এরকম কতো হবে…ধ্যাৎ..তুই বাড়ি আয়..এসে দ্যাখা করিস আমার সাথে। কেমন? চিয়ার আপ বয়! চিয়ার আপ! ঘাবড়াবি না গান্ডু! শাল্লা..হ্যাপ”।
ফোন রেখে দিলো রণবীর। রাখার আগে শুধু বললো–” ক্যানো ডাক্তার হতে গেলাম সব্যদা? ক্যানো? ক্যানো?”
আর আমি অর্ধ চর্বিত রুটির টুকরো মুখে নিয়ে, মোবাইলটা রাখতে রাখতে ভাবলাম– কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারা যায় না নিজেকে? নিজের ক্লীবতায়?
সাঁইতিরিশ বছরের আমার এই নিশ্চিন্ত জীবনে, প্রিয়জন পরিবেষ্টিত এই ভরভরন্ত জীবনে, ভাত ডাল কাপড়ওয়ালা এই সম্বৃদ্ধ জীবনে, এই প্রথমবার আমার মনে হলো— আমি মরে যাই। এবার আমার মরে যাওয়াটাই শ্রেয়। এ জগতে, আমার ক্লীবত্বের কোনো ক্ষমা হয় না।
মরবো না যদিও। এত সহজে আমরা মরি না কেউই। আমি লড়বো। লড়বো শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত এই বার্তা তুলে ধরতে—” চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যে কোনো বিরোধিতা নেই। ছিলো না কোনোকালেও। ঠিক যেমন ভাবে “রাডক্লিফ লাইন” টেনে ভারত পাকিস্তানে বিভেদ ঘটিয়েছিলো ইংরাজ সরকার, ঠিক যেমন ভাবে এখনো কিছু শুয়োরের বাচ্চা “হিন্দু পেশেন্ট পার্টি” আর “মুসলিম পেশেন্ট পার্টি” গেম খেলছে, ঠিক তেমনই ভাবে একটা দল বিভাজন ঘটিয়ে চলেছে ডাক্তার আর রোগীর। তাইতে, বড্ডো আরাম। হেব্বি নিশ্চিন্ততা।— নিজেরা মারামারি করে মরুক দুপক্ষ, আমরা ঠান্ডা ঘরে বসে বসে অপদার্থতা লুকিয়ে রাখি। ”
মরবো না তো।
নাহঃ! অ্যাতো সহজে হাল ছাড়বো না ভাই। প্রমাণ করেই ছাড়বো আসল সত্য।
তদ্দিন আমার শান্তি নেই।
আর শান্তি নেই পরশু তক্।
যদ্দিন না রণবীরকে বুকে জড়িয়ে ধ’রে বলতে পারছি—” ভাই, ক্ষমা কর আমায়। যা খুশি হ। কিন্তু ডাক্তার হোস না প্লিজ। আর হ্যাঁ…পারলে ওই ডিউ থাকা মিষ্টির টাকাটা জমিয়ে রাখিস। বলা তো যায় না, পড়াশুনা ছাড়তে হলে, তোর গরীব বাপকে সাহায্য করতে কাজে লাগবে”