টুইটি

টুইটি

“দুষ্টু পাখি, মিষ্টি পাখি, কোথায় গেলি?”

“এই তো আমি,” শিউলিগাছের আড়াল থেকে মান্টি দিল সাড়া।

ছোটন বলে, “দূর বোকা মেয়ে, চেঁচাস কেন, মিষ্টি পাখি পালিয়ে যাবে, আর যাবে না ধরা। সেই যে পাখি নরম-সরম, ঠোঁটদুটি যার টুকটুকে লাল, চিকন পালক হলদে-কালো, সেই পাখিটা কাল থেকে যে সেই লুকোলো, আর তো তাকে যায় না দেখা!”

ছোট্ট দু’বোন মান্টি-ছোটন দুপুরবেলা ঘন বনের আড়ালটাতে একা; কালকে তাদের খাঁচা থেকে হুশ করে সেই দুষ্টু পাখি সেই যে গেল উড়ে, সেই পাখিকে খুঁজতে গিয়ে মান্টি-ছোটন দুইটি বোনে বেড়ায় বনে ঘুরে।

চড়া রোদের আকাশ যেন মাথায় গায়ে ঢালছে আগুন। বনের লতা শুকিয়ে গেছে, গাছগুলো সব শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে সোজা। এই গরমেও দুই বোনেতে খেলা ফেলে এই বনেতে, চলছে পাখি খোঁজা।

বাড়ির পাশে এই বাগানে অনেক পাখি থাকে। তাদের মাঝে এই পাখিটা কোনখানে যে মুখ লুকোলো, কে তার খবর রাখে?

পাখিটা তো দিব্যি ক’দিন ছিল ওদের ঘরে। রঙিন খাঁচায় থাকত বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখত শুধু এদিক ওদিক; ঠোঁট ডুবিয়ে ছোট্ট বাটির জল খেত সে। টুই-টুই-টুই টিটির টিটির কতরকম কথা, মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হলে মিষ্টি সুরে শিসও দিত। দুটি বোনের সঙ্গে তো বেশ ভাবও ছিল। তবে কেন এমন করে পালিয়ে গেল? কী ছিল তার বায়না? মাথা খুঁড়েও দুটি বোনে কিচ্ছু ভেবে পায় না।

সপ্তাখানেক আগে, যেদিন প্রথম এই পাখিটা এল ওদের ঘরে, ওদের বাপি নাম দিল তার ‘টুইটি’। হয়তো পাখির ডাকটা শুনেই এমনতর নাম। নাম ধরে তার ডাকলে ও তো সাড়াও দিত। মায়ের হাতে খাবার খেতে কী ভালোই না বাসত! সেই আদরের পাখি ওদের কাল বিকেলে হঠাৎ করেই যেই না গেল উড়ে, মায়ের সে কী মনখারাপ যে সারা সন্ধেজুড়ে! রাত্রিবেলা বাপি এলেন, সব শুনে তো তাঁরও ভীষণ শোক। ততক্ষণে মান্টি-ছোটন কেঁদে কেঁদেই লাল করেছে চোখ।

যা হোক, তবুও রাত কেটে যেই সকাল হল, চলল খোঁজাখুঁজি। কিন্তু বৃথাই। টুইটি কি আর এ তল্লাটে আছে? সে তো পগারপার। কাজেই তেমন আগের মতোই দুটি বোনের মুখ রইল ভার।

সময়মতো বাপি গেল অফিস। কাজকর্ম সেরে নিয়ে মা যেই শোবার ঘরে, ঠিক তখনই দু’বোন মিলে অ্যাডভেঞ্চার করে। পেছনদিকের বাগানটাতে চুপিচুপি গিয়ে, এ গাছ সে গাছ, এ ঝোপ সে ঝোপ ঘুরে দু’চোখ মেলে খুঁজে বেড়ায় তাকে। নানান পাখির ডাক শুনে ঠিক বুঝতে চেষ্টা করে, কোনও গাছের ডালে পাতায় টুইটি যদি লুকিয়ে বসে থাকে!

তিনটে দিকে হয়েছে খোঁজা, পুবদিকটা বাকি। একটু আগেই দু’বোন মিলে পূর্বদিকে এল। এইদিকে তো অনেকগুলো বড়ো বড়ো গাছ। সূয্যিমামার রোদটা আড়াল করা। একটু যেন গা ছমছম ভাব। দু’জনে তাই কেউই কারুর হাত ছাড়ে না, শক্ত করে ধরা।

এমন সময় হঠাৎ যেন চেনা গলার শিস! খুবই চেনা, খুবই চেনা। ছোটন বোনের হাতটা চেপে ধরে। মান্টি কেমন বোকার মতো দিদির দিকে তাকায়। হঠাৎ দিদি কেন এমন করে? ছোটন মুখে আঙুল দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, “চুপ করে থাক, টুঁ শব্দটি করবি না তো মুখে।”

মান্টি তাকায় বড়ো বড়ো চোখে, “কেন দিদি? কী হয়েছে?”

ছোটন বলে, “চুপ। মনে হচ্ছে এবার বোধহয় খুঁজে পাব ওকে।”

দিদির কথা শুনেই বোনের মিষ্টি হাসি মুখে। বুক যে ভরে সুখে। ধীরে ধীরে দু’জন মিলে এগিয়ে যায় বনের ভেতরপানে। আগাছা আর ঝোপঝাড়ের ফাঁকে কেমন ভেজা ভেজা মাটি। মাঝারি এক পেয়ারাগাছ হাতের পরে হাত তুলেছে ঐ আকাশের দিকে, দাঁড়িয়ে সেইখানে। সেই গাছেরই একটু উঁচু দুটো ডালের মধ্যিখানে ছোট্টমতন একটা পাখির বাসা। সেখান থেকে ভেসে আসছে ডাক — টুই টুই টুই টিটির টিটির, খুব চেনা সেই ভাষা।

ওই আমাদের টুইটি না? মান্টিসোনা কেঁপে ওঠে খুশির শিহরণে।

ছোটনেরও বুকে কাঁপন, আনন্দ তার মনে। ওই তো এবার যাচ্ছে দেখা একটু একটু করে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ-কালো পালক। কিন্তু ও কী? সবুজবরণ গাছে, টুইটি কি ঠিক একলা বসে আছে? ছোট্ট বাসায় ওর সঙ্গে কারা?

ছোটন দিশেহারা। তারপরই সে দাঁড়িয়ে পড়ে, ভুরু কুঁচকে গাছের দিকে দ্যাখে। ছোটোবোনের হাতটা ধরে বলে, “এইখানে তুই দাঁড়া। আমি একটু এগিয়ে দেখে আসি।”

মান্টি দাঁড়ায়। বাধ্য মেয়ের মতো। দু’চোখে তার প্রশ্ন ঘোরে যত। ঐ তো দিদি যাচ্ছে গাছের দিকে। এবার তাদের টুইটিকে কি ফিরে পাবে ঠিক আগেরই মতো?

ছোটন তখন চুপটি পায়ে এগিয়ে যায় আরও। বুক ঢিপঢিপ তারও। গাছের থেকে একটু দূরে দাঁড়ায়, পায়ের ওপর ভর করে তার গলাটাকে উঁচু করে বাড়ায়।

সেখানে কী দ্যাখে? কী দেখে তার দু’চোখ বেয়ে নামে জলের ঢেউ? কেউ জানে না, জানে না তা কেউ।

শুধুই দেখা যায়, ওই তো ছোটন আসছে ফিরে বোনের কাছে চুপিচুপি পায়। তারপরে সে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বোনকে আদর করে কোলে তুলে ফিরে চলে সেই গাছটার কাছে, যেখানে সেই টুইটি বসে আছে।

দু’বোন মিলে দ্যাখে, ছোট্ট বাসায় ছোট্ট দুটো কিউট কিউট ছানা, চোখ ফোটেনি ভালো করে, ঠোঁট বাড়িয়ে, মুখ বাড়িয়ে ছুঁতে চাইছে তাদের মায়ের ডানা। চাইছে খাবার, চাইছে আদর, আহ্লাদে আটখানা। আর তাদের মা, ওদের প্রিয় টুইটিরানি, সোহাগভরে যত্ন করে ঢাকছে তাদের গা।

দুটি বোনের চোখেই যেন অপার বিস্ময়! এ কী দেখছে তারা? টুইটি তবে মা? এই গাছে তার বাচ্চাগুলো আছে? আর তারা এই সাত-সাতটা দিন, খাবার ছাড়া, মাকে ছাড়া…

দুটি বোনের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে যেন বাঁধনহারা। এই পাখিকে কেমন করে নিয়ে যাবে তারা? টুইটি যে আজ মা। তাকে ওরা কক্ষনও তো নিয়ে যাবে না। না, কিছুতেই না।

মান্টি-ছোটন ফিরতে থাকে বাড়ি। মনে তাদের আনন্দেরই বান। আকাশ-বাতাসজুড়ে খুশির গান, সেই খুশিটা ভুবন জুড়ে ভাসে। সূয্যিমামা পশ্চিমে দেন পাড়ি। দুপুর গিয়ে বিকেল নেমে আসে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত