‘ লাগছে লাগছে ছাড় না – ‘
‘ লাগছে বেশ হচ্ছে । ও তুই কদিন স্কুলে আসিস নি কেন ? জানিস না তুই না এলে আমার ভালো লাগে না ‘- চুল ধরে টান মেরে আঁখি বলল – মরে গেছিলি ? ভুত হয়ে উঠে এসেছিস ? শয়তান । ‘
মিলি চুলটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল – ‘ না রে , বাড়িতে কাজ ছিল । ভালো লাগছিল না । তুই তো আগের দিন এলি না।কালকের নোটসটা দিবি ? ‘ মিলি বলল ।
‘ না দিয়ে উপায় আছে । শোন না নতুন একজন teacher আসবেন জানিস । ‘
‘হুম শুনলাম ।’
Class – 11 বাংলা ক্লাস বলেই হয়ত একটু বাধাহীন । হাই বেঞ্চে বসে পা ঝোলাতে ঝোলাতে ওরা গল্প করছিল । দেবেশের ক্লাস টেস্টের নম্বরটা বেশ কম হয়েছে । Common একটা প্রশ্ন নিয়ে তর্ক করছিল ওরা । যুবি বলল – ছাগল ওই জন্যেই বলেছিলাম একটু কম পড়। বেশি পড়লে ভুলে যাবি ।
হঠাৎ ঘরে ৩৫-৪০ বছরের এক পুরুষের আগমন । কোন রকম কোন ভাবান্তর দেখা গেল না ওদের মধ্যে । হঠাৎ মিলির নজর পড়ল চক – ডাস্টার আছে মানুষটার হাতে । আঁখি স্যার । লাফিয়ে যে যার জায়গায় শান্ত – শিষ্ট – গো বেচারা মুখ নিয়ে বসে পড়ল সবাই । পরিচয় পর্ব শেষ হতে শুরু হল ক্লাস । প্রথম দিন যেন খানিকটা হেলা ফেলাই মনে হল মি: সেনের । মি: শুভদীপ সেন । দিবাপুর মহাবিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ।
দিন গড়াতে লাগল । প্রায় প্রতিদিনের পড়াশোনায় কোথায় যেন মিশে গেলেন রবি ঠাকুর , মানিক , শরৎচন্দ্ররা । স্বল্প পরিচয়ের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিল বরেণ্য সাহিত্যিকের কালজয়ী লেখনী । ভালোলাগা বাংলাকে ভালোবেসে ফেলল ওরা । হৃদয়বৃত্তির ক্ষরণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠল ক্লাস ।
একদিন ক্লাসে আঁখি নোটস তুলছে, রোলকল করার সময় স্যার বললেন তোমার লেখা শেষ কখন হবে ? আঁখির চটপট উত্তর আপনার রোলকল শেষ হলেই । যা কখনও কোন টিচার এর সামনে বলা যেত না তা অনায়াসেই ওনার সঙ্গে আলোচনা করতো সবাই।আস্তে আস্তে শুভ ওদের কাছে ফ্রেন্ড , ফিলোসফার এবং গাইড হয়ে উঠলেন।বিশেষ করে আঁখির আঁখি পল্লবে শুভ হলেন দেবতাসম।
মানুষ দেবতার পুজো করে কারণ তাকে ভালোবাসে।দেবতাকে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা। আঁখির কাছে শুভ র প্রতিটি কথা, প্রতিটি ক্লাস এক অনুপম ছন্দে বাধা হয়ে গেল। তখন ১১ – ১২ এবং BA কোর্স দুটোই পড়ানো হতো কলেজে। বেশ কিছুদিন ধরেই শুভ বেশ গম্ভীর। ক্লাস ও পড়ানোর মাঝে একটা কথাও বলেন না। ক্লাসে চরম অস্বস্তি । ওনার একটা গুন ছিল তিনি প্রথম বেঞ্চ থেকে শেষ বেঞ্চ অবধি প্রত্যেকের সঙ্গে মিশতে পারতেন। এই গুনের জন্যে তাঁকে প্রত্যেকে ভালোবাসত। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে ? কে জিজ্ঞাসা করবে কি হয়েছে আপনার?বস্তুত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ভয় ত্রিধারার মিশ্রণ ছিল মানুষটার প্রতি।
স্যার- পেছন থেকে ডেকে উঠলো আঁখি। হ্যাঁ বল।
‘ না মানে– কি ?
― আপনার কি হয়েছে। আপনি ক্লাস এ কেন কথা বলছেন না ? আমরা কি কেউ কিছু করেছি ? প্লিস স্যার এভাবে ক্লাস করা যাচ্ছে না। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। সেই পুরোনো স্যার কে আমরা চেষ্টা করেও খুঁজে পাচ্ছি না।
মুখস্থ বলার মত কথাগুলো বলে থামল আঁখি চোখ নিচু করে । একটু থেমে শুভ বললেন – ‘ আমি জানতাম তুই সাহস করে এগিয়ে আসবি । বাড়িতে একটু সমস্যা ছিল ।” তার জন্যে আমরা কি করলাম ? ” বটেই তো ; OK , Class আবার পূর্বেই মতই চলিতে লাগিবে Promise ‘ ।
এভাবে কিছুটা অসম বয়সী বন্ধুত্বের নাকি অন্য কোন রসায়নে বয়ে চলতে লাগল সময় ।’ স্যার কোন অনুষ্ঠানে আপনি স্টেজে উঠে কিছু বলেন না কেন ? অথচ সমস্ত কাজ তো আপনার উপরেই থাকে । ‘ মৃদু হেসে শুভ বললেন – ‘ ওরে মাইক্রোফোনের পিছনে কিছু মানুষ থাকে , তারা না থাকলে সামনে এসে লোকজন বলবে কি করে ? ‘
মেয়েটা আজ বোঝে ; যখন সংসারের বেশিরভাগ কাজে তার পরিশ্রম থাকে অথচ প্রচারের আলো ঝলসে ওঠে অন্য মুখে তখন সংসারের কথা মনে করে মেয়েটা হেসে ওঠে । কতদিন হয়ে গেল স্যার এর সাথে দেখা হয় না , কথা হয় না । পড়াশোনা থেকে শত হাত দূরে থাকে সে , তেল নুন মশলায় তার দিন – রাত কেটে যায়। বহু স্বপ্ন দেখা চোখ এখন ক্লান্তিতে বুজে আসে ।
আর পড়াশোনা ? আর্তনাদের মত শুনিয়েছিল কথাটা ওর মুখে । সে বছর প্রথম হয়েছিল তার বিভাগে। আর সম্ভব নয় । অমোঘ সত্য যেন উচ্চারিত হয়েছিল অভিভাবকের গলায় । অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিল ওর চোখে । পড়াশোনা যে মিশে ছিল ওর অস্তিত্বে । কিন্তু ধরার মত শক্ত হাত সেদিন পাশে ছিল না ওর । তাই বাধ্য মেয়ের মত সিঁথি রাঙিয়ে সীমন্তিনী হল সে । বহু স্বপ্নের সমাধি ঘটল আর পাঁচটা মেয়ের মতই ।
সকলের মাঝে থেকে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা ?
আমার চোখেই শুধু বাঁধা
আমার পথেই শুধু বাধা ?
বহুদিন আগে পড়া কবিতার লাইনগুলো ভেসে ওঠে চোখে । বিবাহিতা জীবন আলো করে মাতৃত্বে আজ সে পূর্ণা । তবু কেন বারবার ফিরে ডাকে সেই ছেলেবেলা ? – ‘ এই তো Master Degree করে ক বছর পরেই তোমরা Established হয়ে যাবে । কানে অনুরণিত হয় শুভদীপের কথাগুলো ।
‘বলি ভাবের জগতে ঘোরো নাকি মেয়ে ? কতক্ষণে চা হবে ? চা করতে গিয়ে দার্জিলিং গেলে নাকি ? ‘ – সম্বিত ফেরে আঁখির । গড়িয়ে আসা জলবিন্দু মুছে নিয়ে রোজনামচায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে ।
Facebook এর জগতে নতুন আঁখি । তবে Smartfone আলাপ করিয়েছে নতুন পুরানো বন্ধুত্বের সাথে । মিলির সাথে তো রোজ কথা হয়। এরকম সময়েই মিলি খবর দিল – ‘ কবে আসবি বাড়ি ?’
‘কেন ? ‘
‘শুভ স্যার এর খুব অসুখ । জানিস তো অবসরের পর স্যার একটা স্কুল খুলেছেন ।বিয়ে তো করলেন না। ওটাই এখন ধ্যান জ্ঞান ওনার । ‘ বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আঁখির । এক লহমায় মনে পড়ে গেল তার অতীত । গরমের ছুটি চলছে । তাই মিলি বলার দিন কয়েকের মধ্যেই আঁখি এল বাড়ি । এর মধ্যে নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়েছে শুভকে । মিলি ও আঁখি মিলে দেখতে গেল একদিন । কিন্তু আটকে দেওয়া হল ওদের। শুভর অবস্থা বেশ Critical । সবচেয়ে বড় কথা ওনার এখন B–ve রক্ত লাগবে যেটা খুবই দুষ্প্রাপ্য । বিন্দু বিসর্গ চিন্তা না করে আঁখি বলে আমার B–ve রক্ত । Pls স্যারকে বাঁচিয়ে তুলুন । এই Critical পরিস্থিতিতে ডাক্তাররাও হাতে স্বর্গ পায় । মিলি কিছু বলার চেষ্টা করতে আঁখি বলল – Pls তুই অন্তত বাধা দিস না , আমার কোন কথাই তো তোর অজানা নেই রে । জীবনে অন্তত একবার পূজাটা করতে দে ।
ডাক্তার বলে গেলেন Out of Danger , চরম স্বস্তির নিঃশাস ফেলল ওরা।
পরদিন আবার নার্সিংহোমে গেল ওরা। শুভ অনেকটাই ভালোর দিকে। আঁখিকে দেখে বললেন ― ‘ তুই আমায় রক্ত দিয়েছিস? পাগলী কোথাকার। চোখ নিচু করল আঁখি। শুভর চোখে চোখ রেখে কথা সে আজও বলতে পারে না। কিন্ত্তু তোকে যে শোধ নিতে হবে। শুধু শুধু ঋণী হয়ে আমি থাকতে পারবো না। চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো আঁখি। আমি জানি তুই আজও কষ্ট পাস তোর স্বপ্নের জন্যে। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হবার এই এক সমস্যা। জানিস তো আমরা প্রায় প্রত্যেকেই স্বপ্নের সমাধির উপর দাঁড়িয়ে থাকি।তো যা বলছিলাম আমি অনেক দিন থেকেই চিন্তা করছি আমি, আমার Blooming Buds -র কি হবে? যদি তুই এই দায়িত্বটা নিস তবে আমি নিশ্চিন্ত হই।খুব কি অসুবিধা হবে ?
নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না আঁখি।Blooming Buds এর প্রধান শিক্ষিকা সে । শুভ কে প্রণাম করে একটা কথাই বলল সে- আপনার মুখের উপর না বলার ক্ষমতা আমার আজও হয়নি স্যার। শুধু পারিশ্রমিক টা আমি নিতে পারব না।আপনি আমাকে যে কাজটা দিয়েছেন আমি সেটা পালন করতে চাই।
শুভ হেসে বললেন-তোর কাছে এটাই expected ।কিন্ত্তু তোর সংসার ― বাধা দিয়ে আঁখি বললো সে তো রইল। এত দিন মন দিয়ে করেও কারোর মনের মত হতে পারিনি স্যার। আজ নাহয় একটু নিজের মত করে বাঁচলাম। একটাই তো জীবন স্যার। এর জন্যে যে লড়াইটা করতে হবে সেটা আমি লড়তে পারব। আর আপনি তো রইলেন।
আঁখির মাথায় হাত রাখলো শুভ। আঁখির মনে পড়ল বহুদিনের পড়া এক কবিতা ―
কোনো প্রেম কোনো স্বপ্ন কোনোদিন মৃত হয় না / আমরা পথ থেকে পথ চলি শুধু।