কালের ক্যানভাসে

কালের ক্যানভাসে

অনেক দিন পর আজকে আবার কলেজ স্ট্রীট এসেছিলাম । কাজ ছাড়া আর বই কেনা ছাড়া অনেক দিন এই দিকটায় আসা হয়নি ।আজ হাতে বেশ কিছুটা সময় ছিল আর তার ওপর অনেক দিন বই কেনা হয়নি তাই এ দোকান ও দোকান ঘুরছি । কফি হাউসের পাসে সামনে এগিয়েছি চেনা শব্দ কানে এলো “দাদা কি বই ?” একটা ছেলে দেখলাম খুব দাম দর করছে কি বই নিয়ে করছে সেটা দেখতে গিয়ে দেখি আরে সুবির যে। দেখা হতেই সেই পুরানো হাসি

“কি রে কেমন আছিস?”
“এই চলে যাছে , তোর খবর বল ?”
“আমি তো দিব্যি আছি কলেজের পর দেখাই হয়নি প্রায় বছর ২ । তারপর কি করছিস এখন? ”“এই তো এখন হলদিরামে আছি । ডিস্ট্রিবিউটার ম্যানেজার হাওড়াতে ।“

“বা !!! খুব ভালো …তারপর তোর মোহন বাগান ক্লাবের খবর কি ? এখনও আগের মত পাগলামি টা আছে নাকি ?”
“তা যা বলেছিস পাগলামি বটে । হ্যাঁ ক্লাবের সাথে সম্পর্ক টা চিরকালীন । “

“তা এখন সেই খেলার সময় তুকতাক গুলো আছে নাকি ? যা সব করতিস বাপরে বাপ ।আমি কলকাতার বাইরে থেকেও এই একটা ব্যাপারে আমার মুম্বাই র বন্ধু দের কাছে বলতাম তোর ফুটবল প্রেম নিয়ে ।“

“তুকতাক তো এখনও আছে কিন্তু অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে জানিস । সেই সকাল বেলা উঠে পড়ার ফাকে প্লেয়ার দের সই দেখা তাদের সম্পর্কে লিখে রাখা এখন ও আছে । কিন্তু ক্লাব তা আর আগের মতও নেই । “

“আরে এটা তো হবেই, যুগের সাথে সেও তো এগবে সব কিছু কি আর পুরানো দিনের ঐতিহ্য দিয়ে হবে ? আধুনিকরন টা তো দরকার “

“ব্যাপার টা সেটা নয়, জাজ্ঞে পরে হবে সে সব কথা । দেখলি কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করতেই ভুলে গেলাম । তুই এখন কি করছিস ?”

“কলেজের শেষ এ মুম্বাই এ একটা কোম্পানি তে চাকরি পাই । এখন ওখানেই আছি । ছুটি তে কদিন ভাবলাম বাড়ি তে আসি । একদিন আয় না ? কাল তো রবিবার আয় আমার বাড়ি অনেক দিন আড্ডা হয়নি ।“
“হ্যাঁ । কাল যাওয়া যায় যদি মাসিমার চিকেন পাওয়া যায় “
“হা হা হা!! তাই হোক তবে …তোর নাম্বার টা দে তো “
“৯৬৭৭৪………”
পরের দিন সকালে
“মাসিমা ভালো আছেন ???”
“আরে দেবু না ?? কাল তো বনি তোমার কথা বলছিল । এসো এসো ……”
“যাক প্রায় তিন বছর পর আমার বাড়ি এলি”
“হা হা হা!”

চল আজ ব্রেকফাস্ট টা তোর ক্লাবেই করবো । এই বলে সুবির গাড়ি বের করলো । হ্যাঁ রে কাজুদার ক্যান্টিন টা নিশ্চয়ই ক্যাফে হয়ে গেছে ??
কোনও উত্তর দিল না দেবু ।
গাড়ি নিয়ে ধর্মতলা হয়ে সোজা মোহন বাগান ক্লাব ।
দেবুর মুখটা কিছুটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল ।
কিরে কি ব্যাপার ? এমন শুকনো লাগছে কেন ?
গাড়িটা ক্লাবের বাইরে টা পার্ক করলো সুবির।
দেবুর মুখে তখন ও উত্তর নেই ।

উত্তর টা পাওয়া গেল ক্লাবের ভেতরে ঢুকে । বেশ কিছু কালো পোশাক পরা লোক ঘুরছে । সুবির জিজ্ঞাসা করলো “আছা ড্রেসিং রুম টা কোন দিকে ?”

দেখা গেল ওখানে লেখা আছে “Members Only”
“একিরে এখানে কি শুধু মেম্বার রা যেতে পারবে? আর এটা ক্যান্টিন ?? কি অবস্থা রে ?? আর তুই যে অমর এগারো নিয়ে বলতিস আমরাও গর্ব করতাম তার ছবি টা অমন ধুলোয় লুটোচ্ছে ?”
“চল গ্যালারিতে গিয়ে বসি “ দেবু বলল

গ্যালারির এক প্রান্তে বসে দেবু বলল “তোকে বললাম না মোহন বাগান টা আর সেই মোহন বাগান নেই । এই তো ভোটের আগে জেনেরাল মিটিং এ কর্তারা নিজেদের মধ্যে মারা মারি সেকি কাণ্ড, সবটাই ক্ষমতা র লোভ। আমরা তো সেই মোহন বাগান কে চিনি যারা ১৯১১ তে গোরাদের হারিয়ে শিল্ড জয় পায় আমরা তো সেই ক্লাব কে চিনি সেখানে ব্যারেটো বাবলু দা চুনি বাবু খেলে গেছেন । যেখানে গোষ্ঠ পাল কে গোরারা চীনের প্রাচীর বলতেন । যেখানে শৈলেন

বাবু অমল স্যার চিমা, পেলে-মারাদোনা দের পায়ের স্পর্শ পরেছে । তোর মনে আছে কি জানি না অভিকের কথা, ছেলেটার যেদিন মা মারা যায় সেই দিন ছিল ডার্বি ম্যাচ । ছেলেটা মায়ের সৎকার সেরে ছুটে আসে আবেগের টানে ম্যাচের শেষ এ ছেলেটা তার মায়ের জন্য কি কান্না!! মা জিতে গেছি বলে অকুণ্ঠ চিৎকার !! মোহন বাগানের মধ্যে মাকে খুঁজে নিয়েছিল সে । অঙ্ক পরীক্ষার খাতায় ৫ পেয়েছে ৫০ এ । বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল শুভ কে । ওই দিন বেলায় আমার কাছে এসে আজকে কলকাতা লিগের ফাইনাল খেলা না দেবু দা? আমাকে মাঠে নিয়ে যাবে ? লিগ জয়ের আনন্দে ভুলেই গেছিলো অঙ্কে ফেল করা শুভ …দুহাত দিক তুলে দিক বিদিক শূন্য করে ছুটে চলেছিল ওই সবুজ মেরুন পতাকা টা একবার নিজের গায়ে জাপটে ধরবে বলে … শঙ্করলাল স্যার কে ধরে সেকি কান্না !!

…নিজের জার্সি টা খুলে দিল দিপান্দা দিকা । কিন্তু হায় সে সব এখন কোথায় ? ভোটের আগে মিটিঙে দু পক্ষ মারা মারি জাতীয় ক্লাবের সন্মান ধুলোয় যাই হোক ভোটের আগে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিল কর্তারা না আজ প্রায় ১৫০ দিন হয়ে গেল …প্লেয়ার দের মাইনে বাকি। নতুন ভাবে কোনও পরিকল্পনা নেই যা আছে সবই প্রতিশ্রুতি।“

“তবে এ অচলাবস্থার উপায় ?”
“যারা মেম্বার তাদের সিংহ ভাগ দেখেও না দেখার ভান করে আছে তাদের বিশ্বাস আসবে হবে ব্যাস এটুকুই ।“
“আর সমর্থক ?”

“তাদের কোনও দাম নেই । এই তো আগের সপ্তাহে গোষ্ঠ বাবু র ছেলে ও নাতি কে চরম অপমানিত হতে হল।“
“বলিস কি ?? গোষ্ঠ বাবুর পরিবার কেও ?”

মিউসিয়াম করবে বলে গোষ্ঠ বাবু র পরিবারের থেকে ওনার সমস্ত স্মারক ও পুরস্কার ক্লাব নেন তারপর দীর্ঘ সময় পর কিছু না হওয়ায় ওনারা ফেরত চান তখন ওনাদের একটা চটের ব্যাগে করে কিছু স্মারক দেওয়া হয় যা প্রায় ভগ্নঅবস্থা আর অধিকাংশই পাওয়া যায়নি । কাঁদতে কাঁদতে ওনারা বিদায় নেন । একসময় এই ক্লাব নিয়ে তোদের কাছে গর্ব করতাম কিন্তু আজ কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের পাপের জন্য সব ভাঙছে । তুই কত আনন্দ করে ক্লাবের খবর জানতে চাইলি আর দেখ কি অবস্থা ?

“ সময় সব ঠিক করে দেবে, পাপ বাপ কেও ছারে না । ভগবান এর বিচার করবেন । তবে একটাই কথা হাল ছাড়িস না বন্ধু ……”

চোখের জলে বিদায় নিল দুই বন্ধু …পরে রইল কিছু ভাঙ্গা ঐতিহ্য আর সেগুলো কে হাতিয়ার করে নষ্ট করা কিছু পাপীর দল ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত