ছোটোকাকুকে এই জন্যই এত ভালো লাগে সুমনের। ওর মনের কথা ছোটোকাকু যেন ঠিক কীভাবে টের পেয়ে যায়। এতও জানে ছোটোকাকু! সুমন তো গোড়ায় মাকেই জিজ্ঞাসা করেছিল। কিন্তু বলতেই পারল না মা। খানিক দেখে-টেখে বলল, “ছোটো কাঠঠোকরা হবে বুঝি। নতুন এসেছে তো বাগানে!”
নতুন তো এসেছেই। সুমন গতকালই দেখেছে পাখিদুটোকে। চড়ুইয়ের থেকেও ছোটো। হালকা নীল রঙের পিঠ। পেটের দিকটা গাঢ় বাদামি। লেজটা দেখে মনে হয় কেউ বুঝি দুষ্টুমি করে কাঁচি চালিয়ে ছেঁটে দিয়েছে। লম্বা সূচলো ঠোঁট দিয়ে দিনভর দুটিতে জানালার পাশে মস্ত আমগাছের গা ঠুকে ঠুকে খাবার খুঁজছে। মধ্যে মধ্যে ডালের নিচের দিকে পা আটকে ঝুলন্ত অবস্থায় ঠোকরাতে ঠোকরাতে মুহূর্তের মধ্যে এ-মাথা থেকে ও-মাথা এমন ছুটে যায় দেখে ফিক করে হেসে ফেলেছিল সুমন।
গতকাল সারাদিনটা জানালা দিয়ে পাখিদুটো দেখেই কাটিয়ে দিয়েছে। দিনটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, একটুও বোঝা যায়নি। মাত্র সাতদিনের মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠেছে সুমন। দিনভর জানালার ধারে এইভাবে বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা যে কী কষ্ট! অথচ উপায়ই বা কী। কোমর থেকে গোটা ডান পা’খানা প্লাস্টারে মোড়া। কবে যে আবার হাঁটতে পারবে! গোড়াতে তো বুক ঠেলে কান্না আসতে চাইত।
সন্ধের আগেই পাখিদুটো কোথায় উড়ে গেল, আর দেখা গেল না। সুমনের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল তখন। মনে মনে প্রার্থনা করেছিল, হে ভগবান, পাখিদুটো কাল যেন আবার আসে।
সেই রাত্তিরেই ছোটোকাকু ধানবাদ থেকে এল। সুমনের দুর্ঘটনার খবর পেয়েই দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। ছোটোকাকুকে দেখেই সুমনের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।
ছোটোকাকুর বাড়ি আসা মানেই সুমনের দিনগুলো রঙিন হয়ে ওঠা। দিনগুলো তখন যে কীভাবে পেরিয়ে যায়! অথচ এবার সবকিছুই অন্যরকমের। ছোটোকাকু ওর পাশে বসে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়েছে, “ছিঃ সুমন, পুরুষমানুষের কখনও কাঁদতে নেই।”
রাত্তিরে ছোটোকাকু ওকে অনেকক্ষণ ধরে ট্রেজার আইল্যান্ডের গল্প শুনিয়েছে। গল্পের ঘোরে সকালে সুমন ভুলেই গিয়েছিল পাখিদুটোর কথা। হঠাৎ জানালার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। আরে, পাখিদুটো আজকেও এসেছে! ছোটোকাকু পাশে বসে কাগজ পড়ছিল। সুমন ডেকে দেখাল।
কাগজ থেকে মাথা তুলে ছোটোকাকু পাখিদুটোকে খুঁটিয়ে দেখছিল। সুমন জিজ্ঞেস করে, “কী পাখি ও-দুটো, কাকু?”
ছোটোকাকু ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “ভারি সুন্দর পাখি, তাই না রে, সুমন! নামটাও ভারি মজার, চোরপাখি। ইংরেজি নাম, নাটহ্যাচ। কাঠঠোকরাদের স্বজাত। তবে কাঠঠোকরা নয়। আগে দেখিসনি কখনও?”
সুমন মাথা নেড়ে বলল, “পাখিদুটো কালকেই বাগানে এসেছে কাকু। সারাদিন দেখেছি।”
ছোটোকাকু বলে, “কেমন জোড়ায় ঘুরছে দেখেছিস? দাঁড়া, একটা মজা করব।”
কিন্তু কী মজা? ছোটোকাকু তখন আর কিছুই ভাঙল না।
ব্যাপারটা বোঝা গেল বিকেলে। ছোটোকাকু বাগান ঘুরে কোথা থেকে ইঞ্চি চারেক মোটা শুকনো গাছের গুঁড়ির ছোট্ট একটা টুকরো জোগাড় করে করাত চালিয়ে সেটা লম্বালম্বি চিরে ফেলল। ছোটোকাকুর বাক্সে এসব যন্ত্রপাতি সবসময় মজুত থাকে। তারপর হাতুড়ি, বাটালি নিয়ে সারা বিকেল ধরে ঠুকে ঠুকে টুকরোদুটোর চেরা দিকে নৌকোর খোলের মতো গর্ত করে ফেলল। শেষে গর্তের একটা করে দিক গুঁড়ির ধার পর্যন্ত বার করে দিয়ে, টুকরোদুটো ফের যেমন ছিল সেইভাবে জুড়ে একটা মোটা তার দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল।
গোড়ায় ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি সুমন। কিন্তু ছোটোকাকু টুকরোদুটো জুড়ে দিতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তাই ছোটোকাকু যখন জিজ্ঞেস করল, “এটা কী হল বল দেখি।” সুমন তৎক্ষণাৎ হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, “গাছের কোটর।”
সত্যিই গাছের গুঁড়ির টুকরোটার ভেতর সুন্দর একটা কোটর তৈরি করেছে ছোটোকাকু। একপাশে বড়সড় একটা ফোকর, কোটরের মুখ। সন্ধ্যার মুখে ছোটোকাকু সেটা সুমনের জানালার সোজাসুজি আমগাছটার ডালে শক্ত করে বেঁধে রেখে এল।
মজাটা বোঝা গেল দিন দুয়েক পর। পাখিদুটো যথারীতি আমগাছে আসে খাবারের খোঁজে। হঠাৎ বড়ো পাখিটা এ-ডাল ও-ডাল ঘুরতে ঘুরতে ছোটোকাকুর সেই গুঁড়িটার ওপর এসে বসে। তারপর এদিক ওদিক খানিক তাকিয়ে টুক করে কোটরের ভেতর ঢুকে যায়। একটু পরেই দেখা গেল, কোটরের ভেতর থেকে মুখ বার করে পাখিটা ঘাড় বেঁকিয়ে চারপাশ দেখছে।
ছোটোকাকু বাড়ি ছিল না। আসতেই খবরটা দিল সুমন। ছোটোকাকু কিন্তু একটুও অবাক হল না। শুধু বলল, “আরও অনেক মজা হবে। তুই শুধু আমাকে চিঠি দিয়ে খবর জানাবি।”
সেদিন বিকেলেই ছোটোকাকু ধানবাদ ফিরে গেল। সুমনের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলেও পরদিনই ও ভুলে গেল সব। কী আশ্চর্য! পাখিদুটো সকাল থেকেই রাজ্যের খড়কুটো ঠোঁটে করে সেই কোটরে জড়ো করতে শুরু করেছে। বাসা বাঁধছে।
ধানবাদে সেদিনই চিঠি লিখল সুমন। ক’দিন পরেই এল ছোটোকাকুর চিঠি। ছোটোকাকু লিখেছে,
‘সেলিম আলির বই থেকে চোরপাখির প্রাথমিক পরিচয়টুকুই সেদিন তোকে শুনিয়েছিলাম। চোরপাখি জোড়ায় ঘোরে না। দেখেই বুঝেছিলাম, ওদের ডিম পাড়ার সময় হয়েছে। সুবিধামতো গাছের কোটর পেলেই বাসা বাঁধবে। এবার কিন্তু তুই আমাকে চোরপাখির বাকি সব খবর দিবি। ভালো করে লক্ষ করা চাই।’
সবশেষে চিঠির নিচে পুনশ্চ দিয়ে লিখেছে,
‘আশা করি সুমন সোনার এখন আর সারাদিন শুয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে না।’
সত্যি আজকাল সুমনের খাওয়ার সময়টুকুও বুঝি নেই। ছোটোকাকু একটা সুন্দর বই দিয়ে গিয়েছে। উইজার্ড অফ ওজ। কিন্তু পড়ার সময় কোথায়। সারাদিন জানালা দিয়ে পাখিদুটো দেখেই কেটে যায়।
বাসা তৈরি হয়ে গেছে। খুদে খুদে ঠোঁটে কাদা এনে কোটরের মুখটা বোঝাই করে ফেলেছে। মাঝখানে ছোট্ট একটু ফুটো রেখেছে মাত্র। তাই দিয়েই দিব্যি যাওয়া আসা করে। ছোটোপাখিটা আজকাল বাসা ছেড়ে বড়ো একটা বার হয় না। বড়োটা ঠোঁটে করে খাবার এনে ফুটো দিয়ে খাইয়ে যায়।
দিনগুলো আজকাল যে কোথা দিয়ে কেটে যায় বুঝতেই পারে না সুমন। এর মধ্যে ছোটোকাকু একবার এসে ঘুরে গেছে। ইদানীং সুমন একটা খাতায় ওদের রোজকার কাজকর্মের সব খবরাখবর লিখে রাখছে। যেমন সেদিনই ও দেখল, কোত্থেকে একটা বীজ নিয়ে এল পাখিটা। তারপর ডালে বসে পায়ে চেপে ধরে ঠোঁটে ঠুকে ঠুকে দিব্যি খোসাটা ছাড়িয়ে ফেলে ভেতরের শাঁসটা খেয়ে ফেলল। এছাড়া এমনিতে তেমন ডাকাডাকি না করলেও মাঝে মধ্যে যখন ঘাড় বেঁকিয়ে শিস দেয়, ভারি মিষ্টি লাগে শুনতে।
খাতাখানা দেখে ছোটোকাকু ওর পিঠ চাপড়ে দিয়েছে। ছোটোকাকু এবার চলে যাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুল। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল পাখিদুটোর দৌড়ঝাঁপ। দিনভর খাবার খুঁজে বেড়াবার বিরাম নেই। ঠোঁটে কিছু খাবার জমলেই গর্ত দিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে। পরমুহূর্তেই পাখিদুটো আবার খাবারের খোঁজে বেরিয়ে যায়।
গোড়ার দিকে বাচ্চাদের সাড়াশব্দ বিশেষ পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই দিব্যি চিঁ চিঁ ডাক শুনতে পেল সুমন। সেই শুরু। তারপর তাদের চেল্লানির বিরাম নেই।
পরের মাসে ছোটোকাকু এল না। চিঠিতে সুমনের দ্রুত উন্নতির খবর পেয়ে ছুটি নেয়নি আর। সত্যিই সুমনের উন্নতি দেখে বাড়ির সবাই খুশি। মাত্র আড়াই মাসেই ফ্র্যাকচার প্রায় জোড়া লেগে গেছে। এক্স-রে রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবু বলেছেন, সপ্তাহখানেকের মধ্যে প্লাস্টার কেটে দেবেন। অবিশ্যি সুমনের ওসব দিকে এখন মোটেই হুঁশ নেই। ওর মন এখন সবসময় পড়ে রয়েছে বাচ্চাগুলোর দিকে।
দুটো বাচ্চা হয়েছে। আজকাল দিব্যি ওরা বাসার ফুটো দিয়ে বাইরে মুখ বার করে। এদিক ওদিক তাকায়। বাপ-মাকে সামনে দেখলেই অ্যাত্ত বড়ো একটা হাঁ। দুটোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা লেগে যায় কে কত বড়ো হাঁ করতে পারে। মধ্যে মধ্যে ডানা ঝাপটায়। বোধহয় আর দিন কয়েকের ভেতর উড়তে পারবে।
ইতিমধ্যে সুমনকে একদিন হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল। প্লাস্টার কেটে দিলেন ডাক্তারবাবু। একবারে ভালো হয়ে গেছে ওর পা। কিন্তু সুমন হাঁটতে পারে কই! কেমন সরু হয়ে গেছে পাখানা! ইস্কুলের ডাকসাইটে রাইট আউট সুমন কোনও জোরই পায় না। ডাক্তারবাবু বাড়িতে একটু একটু করে হাঁটতে বলেছেন। অথচ হাঁটার কথা বললেই বুক কেঁপে ওঠে। সাতদিনে বাবা-মার কাঁধে ভর দিয়েও একটানা কয়েক পাও হাঁটতে পারে না। এর মধ্যেই সেদিন দুপুরে ব্যাপারটা ঘটে গেল।
বাড়িতে প্রায় কেউ নেই। মা পাশের ঘরে ঘুমুচ্ছে। সুমনের চোখে ঘুম নেই। জানালার পাশে খাটে শুয়ে যথারীতি তাকিয়ে আছে। বাচ্চাদুটো প্রায়ই গর্তের মুখে এসে বসে থাকে। সুন্দর পালক গজিয়েছে। একটু বুঝি চোখ ফিরিয়েছিল ও। হঠাৎ একটা চিক চিক শব্দে সুমন চমকে দ্যাখে, কী কাণ্ড! দুটো বাচ্চাই ওড়ার মহড়া দিতে গিয়ে একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মাটিতে। আর তৎক্ষণাৎ পাশের বাড়ির বেড়ালটা এসে হাজির।
ক’দিন ধরেই সুমন দেখছে বেড়ালটা প্রায়ই এসে ওত পেতে থাকে। সেদিন তো গাছেও উঠেছিল ছানা খেতে। শেষটা ঠোক্কর খেয়ে পালিয়েছে। আজ বেড়ালটা প্রথমবারেই হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ত। নেহাত ওদের বাপ-মায়ের ঠোকরানির চোটেই পারছে না। চিক চিক শব্দে সামনে ওরা ছোঁ মেরে ঠুকরে চলেছে বেড়ালটাকে।
হঠাৎ কী যে হল। ‘মা’ বলে চিৎকার করেই সুমন লাফিয়ে পড়ল মেঝের ওপর। তারপর একদৌড়ে বাগানে। বেগতিক দেখে বেড়ালটা মুহূর্তে ভোঁ দৌড়। আর সেই সাথে দারুণ ঘাবড়ে গিয়ে বাচ্চাদুটোও ফুড়ুত করে তুখোড় উড়িয়ের মতোই বাপ-মায়ের সঙ্গে গাছের আড়ালে কোথায় হারিয়ে গেল।
দেখে হায় হায় করে উঠল সুমন। ওর এতদিনের সঙ্গী পাখিদুটো বাচ্চা নিয়ে গেল কোথায়! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও। হঠাৎ চমক ভাঙল মায়ের ডাকে। ওর চিৎকারে মা কখন ঘুম চোখে উঠে এসেছেন। ওকে বাগানে ওইভাবে দেখেই দৌড়ে এলেন, “ওমা সুমন, তুই বাগানে হেঁটে এসেছিস! হাঁটতে পারছিস!”
ছুটে এসে তিনি জড়িয়ে ধরলেন সুমনকে। আর তক্ষুনি সুমনের চমক ভাঙল, আরে, তাই তো! হেঁটে কোথায়, সে তো দৌড়েই বাগানে এল! একটুও কষ্ট হচ্ছে না। রীতিমতো শক্ত পায়েই ও দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ সুমনের মনে হল, চোরপাখি দুটো এই ক’মাস ওর কষ্টটুকু কোন ফাঁকে চুরি করে নিয়ে গেছে। ওর দু’চোখ ভরে জল এল হঠাৎ, ছোটোকাকুর জন্য।