তোমরা কেউ দুলদুলিকে দুষ্টু বোলো না। ও বেশ শান্তশিষ্ট ছোট্টখাট্টো ভালো মানুষটি। থুরি, মানুষ কোথায়, ও বেশ ভালো হাতি। একমাস আগে ও জন্মেছে এই সার্কাসের তাঁবুতে। জন্মের সময় ও আরও ছোটো একটা কাপড়ের পুতুলের মতো নরম ভারি মিষ্টি দেখতে ছিল। খাড়া হয়ে দাঁড়ানোর জোর তেমন ছিল না ওর ছোটো ছোটো পায়ে। ওর মা শুঁড় দিয়ে ঠেলেঠুলে খাড়া করবার সময় গোল একটা বলের মতো গড়াগড়ি খাচ্ছিল বলে রিং মাস্টার ওর নাম দেন ‘ইল্লু গুল গুল’। দুধ খাবার সময় মাঝে মধ্যে মা ভুল করে ফেলে বলে দড়ির খেলার ওস্তাদ ওসমান ওকে ডাকে ‘ভুলুয়া’। এবার ওর আসল নামটা কী করে হল বলি।
বড়ো মাপের মাথা, তার উপর খাড়া খাড়া লোম। লটপটে কান। সরু নলের মতো নুলনুলে শুঁড় আর গোলগাল শরীরের তলার চারটি পা। লেজের কথা বলতে মনে নেই। বিশেষ করে ওটিই নড়েচড়ে বেশি। শুঁড় আর লেজ নিজের নিজের কাজ করেই চলেছে সর্বক্ষণ। আর গুবলু-গাবলু শরীরটা সামনে পিছনে দুলেই চলেছে। থামতে জানে না! তাই ওর রকমসকম দেখে হরিপদ জোকার নাম দিয়েছে দুলদুলি। থেকে গেল সেটাই।
সর্কাসের এই অ্যাত্ত বড়ো তাঁবুটার তলায় সবাই সারাদিন কাজে ব্যস্ত। শুধু কোনঅ কাজ নেই দুলদুলির। ঘুম থেকে উঠে শুঁড় দুলিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে ছুট্টে গিয়ে মায়ের দুধ খাওয়া, এই ওর সারাদিনের কাজ। দুষ্টুমি করে না বলে সবাই ওকে ভালোবাসে, নজরে নজরে রাখে। শুধু মাঝে মাঝে দুলদুলি টের পায় কে যেন ওর গায়ের ভেতর থেকে সুরসুরি দিচ্ছে। তখন কিছু না করে ও থাকতে পারে না। তাও এমন কিছু নয়। একদিন গেটের কাছে একগোছা টিকিট কেড়ে নিয়ে ওড়ানো, ম্যানেজারের বেড়ালকে তাড়া করা, পাখির খাঁচার দরজা খুলে দেওয়া আর হরিপদ জোকারের চশমা নিয়ে পালানো। এরকম কিছু গোলমেলে কাজ মাঝে মাঝে করলেও এটুকু কাজের জন্য ওকে দুষ্টু বলে। আদর আদর গলা করে বকুনিও দেয়। আবার কাপড় কাচা হয়ে গেল ফেনা ওঠা সাবান-জলের বেলুন ওড়াতে ওর মতো কেউ পারে না। মোট কথা, আসলে দুলদুলি মোটেই দুষ্টু নয়, সে তোমারা যাই বলো।
বড়ো গোল তাঁবুটার চারপাশে অনেকগুলো ছোটো ছোটো তাঁবু। তাতে থাকে খেলোয়াড়, জোকার, কুলি, ম্যানেজার, পাহারাদার, পালোয়ান, রিং মাস্টার, মালিক, নানারকম লোকজন। আর আছে খাঁচায় ঢাকা রেললাইনের ওপর খাঁচা-গাড়িতে বন্দি হয়ে বাঘ, সিংহ, চিতা, হায়না, ভালুক, বনমানুষ আর রংবেরঙের পাখির দল। বড়োমাপের পাখিগুলো থাকে খাঁচার বাইরে। বেড়ি লাগানো পায়ে টুকুস টুকুস ঘুরে বেড়ায়, উড়ে যায় না।
আর ছাড়া থাকে মালিকের পোষা দুই রামছাগল চককর সিং আর বককর সিং। ওরা নিজের ইচ্ছেমতো এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। উট, ঘোড়া আর হাতিদের থাকবার জায়গা মূল গেট দিয়ে সার্কাসের বড়ো তাঁবুতে যাবার পথের দু’ধারের চাঁদোয়া ঢাকা মাঠে। শেকল বাঁধা পায়ে ওরা দিনের বেলায় ওখানেই ঝিমোয় আর কলাপাতা নারকেলপাতা চিবোয়। সন্ধে হলেই খেলা দেখাতে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়।
দুলদুলির মা হরিমতী হাতিদের দলের সবচেয়ে বড়ো খেলোয়াড়। বল খেলা, ছবি আঁকা, ঘন্টা নেড়ে গণেশপুজো, তিন চাকার সাইকেল চালানো আর টুলের ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যালান্সের খেলা ওর মতো এত ভালো আর কেউ জানে না! আরও কত কী পারে হরিমতী। কোনও জানোয়ার সার্কাসের জোকার হয়েছে কোথাও? হরিপদ জোকার বলে, হরিমতী নাকি ওর চেয়েও বড়ো জোকার। ছবি আঁকার খেলা দেখাবার সময় মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের গায়ের রং লাগিয়ে দেয়। গোল পোস্টে বল না মেরে রিং মাস্টারের গায়ে বল মেরে দেয়। জোকারদের গায়ে শুঁড়ে করে ধুলো ছুঁড়ে মারে। এরকম আরও কত কী যে করে! এগুলো কোনওটাই ওকে শেখানো হয়নি, নিজের থেকেই করে। এরকম মায়ের মেয়ে দুলদুলি তো একটু গোলমেলে হবেই। একটা ওর অসুবিধে, যখন তখন ঘুম পাওয়া। ঘুম পেলে শুঁড় থেকে বাঁশির মতো শব্দ হয় ওর। আর স্বপ্নে কত কী যে দেখে!
খাঁচার বাইরে চককর-বককর, হাড়গিলে বুড়ো যার নাম সনাতন, খান চারেক কুকুর, একটা কাবলি বেড়াল, দুটো লালমুখো চোট খাওয়া বাঁদর যাদের মিচকে আর ফিঁচকে বলে ডাকে সবাই আর দুলদুলি। ওদের দড়ির বাঁধনটিও নেই। অবশ্য খেলা আর মহড়ার সময় সকলেই খোলা থাকতে পায়। এদের সবাই খুব ভালোমানুষ না হলেও নিজেরা মিলেমিশেই থাকে। তবে ডাকু নামের মালিকের খাস গ্রে হাউন্ড কুকুরটাকে সমঝে চলে সবাই। খুব যে আঁচড়ায় কামড়ায় বা হাঁকডাক করে তা নয়। ওর চোখ! কাজ তো সারাদিন মালিকের খাটের তলায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা আর মাঝে মাঝে কালো হাঁড়ির মতো মুখটা তুলে আধবোজা মুখে ঘুম ঘুম চোখে তাকানো, যার তল খুঁজে পাওয়া যায় না। ওই চাউনিতেই সবার শিরদাঁড়ায় শীত করতে থাকে। সবার করলেও দুলদুলির নয়। তবে ডাকুর কাছে ঘেঁষতেও যায় না ও।
এই তো সেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ভরপেট দুধ খেয়ে আবার একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল দুলদুলি। মিচকে আর ফিঁচকে ওর গা মাথা থেকে উকুন বেছে দিচ্ছিল। হঠাৎ কী করে ঘুম ভেঙে যেতেই দেখে মা নেই। আংটা শেকল আছে, মা নেই। মায়ের গায়ের গন্ধ আছে, মা নেই। নেই তো নেই, কোথাও নেই।
গোল গোল ঘুম ভাঙা চোখদুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাকে খুঁজল দুলদুলি। ঠোঁট ভেঙে একটু কান্না কান্না আওয়াজও করল। তারপর ধড়ফড় করে উঠে টলমল করতে করতে চলল মাকে খুঁজতে।
মস্ত বড়ো তাঁবুটার ভেতরে ঢুকলে দুলদুলির চোখ ধাঁধিয়ে যায়। দিন রাত্তির কতগুলো করে আলো যে জ্বলে ওখানে! মাঝের গোল চত্বরটায় তখন সবাই খুব ব্যস্ত মহড়া চলছে পুরোদমে। ওই টুকুনি দুলদুলিকে কেউ দেখতে পেল না। রিংয়ের চারপাশ ঘুরে দেখা হয়ে গেলে ও চলল পর্দা ঠেলে বাইরে।
মা নেই! নটবর উট ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল একবার, তারপর চোখ বুজিয়ে বোধহয় কিছু চিবোতে লাগল। মুখে খাবার না থাকলেও সারাক্ষণ ও যে কী চিবোয় কে জানে? ওকে কিছু জিজ্ঞেস করে কোনও লাভ নেই। কারও সঙ্গে কোনও কথাই বলে না, এত গম্ভীর। অন্য হাতিরা তখন একগাদা কলাপাতা নিয়ে খাওয়ায় ব্যস্ত। এর ওর পেটের তলা দিয়ে ঘুরঘুর করল খানিকক্ষণ দুলদুলি। ওরা কেউ চেয়েই দেখল না।
মাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। বড়ো তাঁবুর বাইরে ছোটো তাঁবুগুলো, চানের চৌবাচ্চার পাশে, সার বাঁধা খাঁচাগুলোর আশপাশ, নেই। সব দেখা হয়ে যাবার পর মালিকের তাঁবুর কাছে আসতেই ভেতর থেকে চাপা গলায় আওয়াজ এল, ‘গররর!’ ডাকু ঠিক টের পেয়েছে। আর সেখানে থাকতে আছে! সাথে সাথে পায়ে তাড়া লাগল দুলদুলির, ছোট ছোট। এক ছুটে খিড়কি দরজার বাইরে। চককর সিং আর বককর সিং কাঠের বেড়ার ওপর দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলল, “ব্যা বব্বো।” অর্থাৎ, কোথায় যাওয়া হচ্ছে। সবার সবকথার জবাব ভালোমতো দিতেই শেখেনি বেচারা দুলদুলি। মায়ের সঙ্গেই যা একটু কথা হয়। তাও আধো আধো ইশারা ইঙ্গিতে। কোনওমতে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “মা কই?”
বককর সিং তার বাঁকা শিং আর লটপটে কান নেড়ে বলল, “বাজার গেছে হয়তো, ফিরে আসবে এক্ষুনি।”
বাজার ব্যাপারটা কী জানা নেই দুলদুলির। চলতি পা থামাতেও পারল না। খিড়কি দোরের ওপারে মেঠো পথ ধরে ছুটতেই লাগল টলমল পায়ে। লম্বা গলা লাল নীল চোখ ল্যাম্প পোস্ট ডাকল পেছন থেকে, “কুথা যাস রে তু?”
তাঁবুর মাথায় দড়ি ধরে দোলা খেতে খেতে খ্যাঁক খ্যাঁক করল মিচকে আর ফিঁচকে, “পালানো হচ্ছে? দেশে আইনকানুন নেই বুঝি?”
শুনতেই পেল না দুলদুলি। বুড়ো হাড়গিলে সনাতন লাফিয়ে লাফিয়ে ডানা ঝটপটিয়ে পিছু ডাকল; দেখলই না দুলদুলি।
এদিকটায় লোকজন নেই, বাড়িঘর নেই। চলতে চলতে ঝোপঝাড় বাড়তে লাগল আর তার মধ্যে লাল মাটির পথটাও হারিয়ে গেল একসময়। পথের শেষে ঘন বন। ঝোপ ঠেলতে ঠেলতে দুলদুলি এল বনের মধ্যে। শুঁড় তুলে বাতাস শুঁকে ভালো লাগল ওর। কী সুন্দর বুনো বুনো গন্ধ এখানে! ঠিক মায়ের গায়ের গন্ধের মতো। ভালো লাগায় কাঁটা দেওয়া গায়ে দু’চক্ষু বুজিয়ে জোরে জোরে নাক টেনে বুনোগন্ধ শুঁকছে, এমন সময় কে যেন কড়া গলায় মাথার ওপর থেকে বলে উঠল, “লতুন মনে হতেছে যেন?”
চমকে উঠে চারদিকে পাকটাক খেয়ে তবে তাকে দেখতে পেল দুলদুলি। মাথার ঠিক ওপরে ভারি অদ্ভুত চেহারার কে যেন বসে আছে। খরখরে চামড়ার ছোটোখাটো গা। দুটি দুটি চারটি পা, লম্বা লেজটি পাকানো, বড়ো বড়ো চক্ষুদুটো লাট্টুর মতো ঘুরছে। ছিল সবুজ, ওমা, নিমেষে রং পালটে হয়ে গেল গোলাপি। গোলাপি থেকে নীল হতেই দুলদুলি জিজ্ঞেস করল, “তুমি বুঝি জাদুকর?”
অমনি অনেকগুলো গলা এক সাথে বলল, “আমরা সবাই জাদুকর। কিন্তু তুমি কে? এই বনের মধ্যে এলে কোত্থেকে?”
“আমি তো মাকে খুঁজতে এসেছি। খুঁজে পাচ্ছি না।”
ততক্ষণে চারপাশের ঝোপঝাড়ে হাজির হয়েছে আরও ক’জন। গোল গোল লাট্টু চোখে চেয়ে আছে ওর দিকে। একজন আবার চট করে তার শরীরের থেকেও লম্বা জিভ বার করে ছুঁড়ল একটা পোকার দিকে। নিমেষে পোকা পেটে চালান হয়ে গেছে। এতক্ষণ ভয় ভয় পাচ্ছিল দুলদুলির। পোকা খাওয়ার কায়দা দেখে হাসি পেয়ে গেল বেজায়। সারা গা কাঁপিয়ে দুলদুলি হেসেই অস্থির। ওর হাসি দেখে জাদুকর রাগের চোটে গায়ের রং কালো করে চোখ পাকাল, “অত হাসবার কী আছে?”
হাসি চলে গিয়ে আবার কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল দুলদুলির মুখটা। অমনি কে একটা থপ থপ করে লাফিয়ে এসে বসল ওর সামনে। লম্বা লম্বা হাত-পা, হলুদে রঙের গা, কথা বলে গ্যাঙোর গ্যাং, গোলগোল চোখ কপালে তোলা।
“নতুন দেখছি? এখানে কী ব্যাপার?”
“মাকে খুঁজে পাচ্ছি না,” বলল দুলদুলি।
“এ বনে তো হাতি নেই। অন্য কোথাও গেল কি না দ্যাখো।” বলে এক লাফে ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে কোথায় চলে গেল সে।
এবারে হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসল দুলদুলি। সার্কাসের তাঁবুতে নেই, রাস্তায় নেই, এখানেও নেই। মা কোথাও নেই কেন?
“আহা, কেঁদো না কেঁদো না। অত বড়ো লোক কি হারিয়ে যেতে পারে? আসবে ঠিক ফিরে।” বলতে বলতে একটা কাঁটাঝোপ ঝুমঝুমিয়ে এসে হাজির হল সামনে। ভয়ে ভয়ে দুলদুলি লুকোল গিয়ে একটা মস্ত বড়ো গুঁড়ির আড়ালে। ওখান থেকে গোল গোল চোখে চেয়ে দেখে, ও মা! কাঁটাঝোপের তলায় চারটে পা আর কী মিষ্টি মিষ্টি হাসিমুখের একজন।
“ভয় পেয়ো না, আমি সজারু। ঠিক খুঁজে দেব তোমার মাকে। ভয় পেয়ো না।” সাদা কালো ছিট ছিট কাঁটাঝোপটা কথা কইল। তারপর ঝুমঝুমিয়ে হাঁটা দিল গভীর বনের দিকে। দুলদুলি আর কী করে। চলল তাঁর পিছু পিছু।
এ বনে রোদ্দুর ঢোকা বারণ। মস্ত মস্ত গাছগুলোর মাথায় সবুজ নীল চাঁদোয়া। যেন মস্তো বড়ো একটা সার্কাস। তবে কড়া আলোর বদলে সবটা কেমন ছায়া ছায়া, মায়া মায়া।
দুলদুলি বেচারা জন্ম থেকে শুধু সার্কাস জানে। তাঁর খেলোয়াড় জানে। মাথার ওপর হুপ-হাপ করে দড়িবাজির খেলোয়াড়রা হাজির হল কোত্থেকে। এ-ডাল থেকে ও-ডাল পেল্লায় লাফ দেখে তাক লেগে যায়। শুধু কি তাই, লতা ধরে দোল খাওয়া আর গাছের গা বেয়ে ওঠানামা। কয়েকজনের কোলে আবার ছানাও আছে। মায়ের বুক আঁকড়ে ধরে তারাও দড়িবাজির খেলায় মেতেছে। হঠাৎ কালো মুখ, সোনালি গা, যার অর্ধেক অবশ্য পাকা, এক বুড়ো ওস্তাদ এসে বসল। দুলদুলির ঠিক মাথার কাছে নাড়াচাড়া করতেই ও শুঁড় বাড়িয়ে ধরে ফেলেছে। আর যাবে কোথায়? লেজে টান পড়তেই বুড়ো ওস্তাদ বেতাল হয়ে পড়েছে ডাল ফসকে নিচে। পড়বি তো পড়, দুলদুলির পিঠের ওপর সটান। দুলদুলিও দিয়েছে প্রাণপণে ছুট বনজঙ্গল ভেঙে। ও যে এমন ছুটতে পারে নিজেরই জানা ছিল না দুলদুলির, তায় পিঠের ওপর এমন একটা বোঝা নিয়ে।
“ও রে থাম থাম, পড়ে যাব যে!” বলল বুড়ো ওস্তাদ। ওর বোধহয় সুড়সুড়ি লেগে থাকবে। হেসে সারা হয়ে যাচ্ছে বুড়ো। হাসি শুনে ভরসা পেয়ে থামল দুলদুলি। পিঠ থেকে নেমে মাথা ঘোরা কমবার পর বড়ো ওস্তাদ এসে বসল দুলদুলির মুখোমুখি। কালো মুখে একগাল হাসি তার।
“যেমন মিষ্টি তেমনি দুষ্টু! কে রে, তুই?”
“আমি দুলদুলি।”
“এখানে কেন?”
“মাকে খুঁজতে এসেছি।”
“নিবাস কোথায়, মানে থাকা হয় কোথায়?”
“সার্কাসে।”
মস্ত বড়ো হাঁ করেছে ওস্তাদ। সার্কাস-টার্কাস কী জানা নেই বোধহয়। দুলদুলি কানটান চুলকে বোঝাল কোনওমতে।
“ওই যে মস্ত বড়ো তাঁবু বনের ধারে।”
“বনের চেয়েও বড়ো?”
“সবাই কত খেলা দেখায়।”
“আমাদের চেয়ে ভালো খেলা দেখায়?”
এবারে দুলদুলির ছোটো মাথায় গোল লাগল। তাঁবুর ভেতরের সার্কাসটা বেশি ভালো না বাইরের এই মস্ত বড়ো সার্কাসটা? অনেকক্ষণ কান লটপট আর শুঁড় দোলনোর পর দুলদুলি ঠিক বুঝতে পারল না কী উত্তর দেওয়া যায়। বুড়ো ওস্তাদ চার হাতে-পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল, তোর মাকে খুঁজে দেখি।”
বুড়ো চলছে লম্বা লেজটি তুলে আগে আগে। দুলদুলি চলল তার পিছু পিছু সজারু বন্ধুর সাথে। চলতে চলতে নাকে এল সোঁদা সোঁদা ভেজামাটির গন্ধ। খুশি হয়ে উঠল দুলদুলির মনটা। আর একটু এগোতেই পাহাড়, তার গা বেয়ে নেমে আসছে ঝরনা! নীচে বড়ো বড়ো পাথরের খাঁজে ঝাঁপিয়ে পড়া জল-ফেনা, ছিটকে ওড়া জলের কণায় রোদ্দুর পড়ে সাতরঙা আলোর আর একটা যেন ঝরনা। দুলদুলির চোখ জুড়িয়ে গেল, কী সুন্দর, কী সুন্দর! থপথপিয়ে জলে নেমে গেল দুলদুলি চান করতে। বুড়ো হনু-ওস্তাদ আর সজারু বসে রইল পাড়ে। আকাশছোঁয়া পাহাড়ের ওপর থেকে জলের ধারা পাহাড়ের ওপর পড়ে মস্ত বড়ো দিঘির মতো তৈরি হয়েছে। আর একদিক থেকে নদী বয়ে জল চলেছে নিচের দিকে। বনের মাঝখান দিয়ে সাপের মতো আঁকাবাঁকা নদী। চান করে ভারি আরাম দিঘির জলে। দম নিয়ে একটা ডুব দিতেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল দুলদুলির। জলের তলায় ওলটানো বাটির মতো গা থেকে মুন্ডু বার করে কারা যেন চেয়ে আছে ওর দিকে। শুঁড় বাগিয়ে একটু ছুঁতেই অবাক কান্ড, শুঁড় ঢুকে গেছে বাটির ভেতর। খুব মজা পেল দুলদুলি। এমনটি কেউ পারে না ওদের সার্কাসে। খুশি হয়ে জোরসে হাততালি দিতেই কতগুলো কালো কালো মাথা একসঙ্গে ভেসে উঠেছে জলের ওপর। দুলদুলিকে এক নজর দেখে কলর-বলর করে কী কথা কয়ে আবার টুপ করে ডুব দিয়ে জলের তলায়। আবার ভেসে উঠেছে অনেকটা দূরে। খানিক বাদেই আবার ডুব। অবাক কান্ড! ওদের ছুঁচোর মতো গা, হাঁসের মতো ঠোঁট আর নৌকোর দাঁড়ের মতো লেজ। ভারি ব্যস্ত লোক তো! একটু কথা কইবার জো নেই!
পাড়ে বসে থাকা হনু-ওস্তাদ বলল, “বাসা বাঁধছে, ডিম পাড়বার সময় হয়েছে যে। ওদের বলে হংসচঞ্চু। ওপারে আছে ভোঁদড়দের দল। দেখে আয় গিয়ে, মাছ ধরবে বলে কাঠকুটো দিয়ে বাঁধ বেঁধেছে নদীতে।”
ও মা! সত্যিই তো। দুটো বড়ো পাথরের আড়ালে চালাক চালাক দেখতে হাতে-পায়ে ছটফটে তিন-চারটে ভোঁদড় জল আটকাতে ব্যস্ত। জমে ওঠা জলে কতরকম মাছ কিলবিল করছে।
“অ্যাই ওদের ধরছো কেন গো? কী করেছে ওরা?” বলল দুলদুলি।
“খাব ওদের।”
“মাছ আবার কেউ খায় নাকি? খেতে হয় তো দুধ।”
একজন মেয়ে ভোঁদড় দুলদুলির শুঁড়ে আলতো চাটি মেরে বলে গেল, “সে তোমার মতো ছোটোরা খায়। বড়োরা খায় মাছ। নইলে ভোঁদড় হয়ে জন্মানো বৃথা।”
দুলদুলির শুঁড়ের দোলায় বাঁধ একটু ভেঙে যাওয়ার মাছগুলো, “থ্যাংক ইউ” বলে লাফিয়ে পালাতে লাগল আর ভোঁদড়েরা তাড়া করল ওকে। ছুট ছুট। দৌড়ে পাড়ে উঠে আসতেই হনু-ওস্তাদ আর ঝুমঝুমি দিদি এগিয়ে চলল বনের ভেতর, যেখানে উই আর পিঁপড়েদের মধ্যে বেদম লড়াই চলছে। হনু-ওস্তাদ বলল, “উইপোকাদের ডানা গজালে লাল পিঁপড়েদের হিংসে হয়। তখন লড়াই বাঁধে।”
লড়াইয়ের মাঠ থেকে উইপোকারা আকাশে উড়তেই যুদ্ধ-টুদ্ধ শেষ। লম্বা দাঁড়া সবজেরঙা ডাইন ফড়িংরা, “কী বোকা, কী বোকা” বলতে বলতে টপাটপ উই আর পিঁপড়ে খেতে লাগল। দুঃখ দুঃখ মুখ করে ওড়া উই আর পিঁপড়ের ঢিপির পাশ দিয়ে চলা শুরু করতেই বর্মচর্ম গায়ে একজন এসে হাজির। নাম তার বনরুই! ছুঁচলো মুখের ভেতর থেকে নিজের গায়ের থেকেও বেশি মাপের জিভ বার করে প্রাণভরে পিঁপড়ে আর উই খেতে লাগল সে। দেখে দুলদুলি অবাক!
চলতে চলতে অনেক দূর! বন এবার হালকা হয়ে আসছে। বড়ো বড়ো গাছের গুঁড়ির পাশে পাশে বনের ফাঁকে নদী দেখা যাচ্ছে। দুলদুলি হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। মাথার ওপর শন শন অনেক ডানার আওয়াজ। আর একটু এগোতেই বন পাতলা হয়ে এসেছে। নদী চওড়া হয়ে শেষমেশ পড়েছে যেখানে বন শেষ, সেখানে নীল জল আকাশপাতাল জুড়ে লাফালাফি করছে। সাদা ফেনার মুকুট মাথায় বড়ো বড়ো ঢেউ পাড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বনের শেষে এখানে বালির পাড়। সেখানে হাজার হাজার লাল ধেঙো বাঁকা ঠোঁট বড়ো বড়ো পাখির দলের ডাকাডাকিতে ঢেউয়ের শব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে। জলের ফেনা দেখে দুলদুলি খুব খুশি। ছুট্টে গিয়ে শুঁড়ে জল নিয়ে বেলুন বানাবার চেষ্টা করেও কিছু হল না। নাকে মুখে নোনাজল ঢুকে সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার। ঢেউয়ের ধাক্কায় গড়াগড়ি নাকানিচোবানি হয়ে দুলদুলি বেচারা জব্দ হয়ে গেল! বুড়ো ওস্তাদ একগাল হেসে বলল, “একে বলে সমুদ্দুর। পাখিগুলোকে বলে আগুনপাখি। ফিরে চল এবার।”
ঝুমঝুমি সজারুদিদি বলল, “বনের ভেতর দিয়ে ফিরে গেলে রাত হয়ে যাবে যে! সমুদ্দুরের ধার দিয়ে সোজা গেলেই হয়, পথও বেশি নয়। এতক্ষণে ওর মাও বোধহয় ফিরে এসেছে।”
তিনজনে এবার ছুট লাগাল বালির ওপর দিয়ে। ল্যাগব্যাগে ঠ্যাং ক’জন আগুনপাখিও মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলল পথ দেখিয়ে।
কিছুটা যেতেই দূরে দেখা গেল সার্কাসের বড়ো তাঁবুর চুড়ো, আর সার বেঁধে দূর থেকে কারা যেন এদিকেই আসছে। আর একটু কাছাকাছি আসতেই মা হরিমতী আর তার পিঠে বসে থাকা হরিপদ জোকারকে দেখা গেল। পিছু পিছু নটবর উটের পিঠে বসে থাকা মিচকে আর ফিঁচকে, রামছাগল চককর সিং, বককর সিং আর তাঁর পেছনে ঘোড়ার পিঠে রিং মাস্টার। সবাই মিলে মিছিল করে চলেছে দুলদুলিকে খুঁজতে!
তারপর কত যে আদর করল সবাই আদরের ছোট্ট মেয়ে দুলদুলিকে, বলবার নয়। বুড়ো হনু-ওস্তাদ আর ঝুমঝুমিদিদি সার্কাসে চাকরি পেল।
দুলদুলি মায়ের পেটের তলায় চলতে চলতে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি? কত খুঁজলাম!”
“বাজারে গিয়েছিলাম তো! এসে দেখি তুই নেই! দুষ্টু মেয়ে!”
“আমার খবর পেলে কোথায়?”
“সনাতন থাকতে খবর পেতে দেরি হয়? বনের ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে ওই তো খবর আনল!”
মাথার ওপর আগুনপাখিদের দলকে টা টা করে বুড়ো হাড়গিলে সনাতন ওর বিশাল ডানা মেলে নেমে এল নিচে। হরিমতী শুঁড় দিয়ে চোখের জল মুছে তাকাল দুলদুলির দিকে।
“বনের ভেতর কী দেখলি?”
দুলদুলি শুঁড় দুলিয়ে খুশি খুশি গলায় বলল, “সার্কাস!”