বৈশাখী

বৈশাখী

চোখ পিটপিট করে চারদিকে তাকাতে লাগলো বৈশাখী। বাহিরে তখন আবছায়া অন্ধকার। এখনও বোধহয় সূর্যোদয় হয়নি ভাবতেই পরক্ষণেই বৈশাখীর নজরে এল এক টুকরো সূর্য পুরো রুম জুড়ে পায়চারি করা শুরু করে দিয়েছে তার নিয়মে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো সে। সোনালী সূর্যটা সবে একটু একটু করে আকাশের বুক চিড়ে পৃথিবীর বুকে উঁকি দিচ্ছে। এক ধ্যানে উদিয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। চারদিকে আজ যেন অন্যরকম এক নতুনত্বের আমেজ। যদিও সেটা এখনও অপ্রকাশিত তবে বেশ খানিকটা সময় পর এর আমেজ সহজেই চারদিকে ছড়িয়ে পরবে। কিন্তু তার মধ্যেই নতুনত্বের কোনো ছোঁয়া নেই। বিশ বছরের বৈশাখী নিষ্প্রাণ মুগ্ধ হয়ে সকালের সূর্য বিলাশ করছে। সহসাই কাঁধে সবচেয়ে পরিচিত হাতের স্পর্শ পওয়া যেতেই পেছনে ফিরলো সে। মাকে চোখের সামনে দেখেই ম্লান হেসে বললো,
–তুমি এত সকালে আমার রুমে?”
রহিমা বেগম ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললেন,
–বা রে আজ আমার মেয়ের জন্মদিন। তার প্রিয় পায়েস খাওয়াতে হবে তো।”
কথা শেষ করেই এক চামচ পায়েস মেয়ের মুখে পুরে দিলেন।”
বৈশাখী মুখের পায়েসটুকু কোনোরকম গিলে বললো,
–উফ মা! আমি এখনো ব্রাশ করিনি।”
–তাতে কী? এইটুকু খেলে কিচ্ছু হয় না। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি রান্নাঘরে গেলাম।”
মুখের কথা শেষ করেই নিজের কাজে যেতে লাগলেন রহিমা বেগম। বৈশাখী হালকা গলায় পিছু ডাকলো,

–মা!”
রহিমা বেগম পেছন ফিরে বললেন,
–কিছু বললে তাড়াতাড়ি বল। নাস্তা তৈরী করতে হবে। তোর বাবা ঢাকা থেকে এসেই আর ঘুমায়নি মসজিদ গেছেন। সেখান থেকে এসেই নাস্তা খাবেন।”
বৈশাখী জলন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বললো,
–মা আজ আমাদের কলেজে বৈশাখ উপলক্ষে
একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। আমি গানের প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছি। একটু বাদেই সেখানে যাব। তোমার থেকে একটা শাড়ি এনে আমাকে সুন্দর করে পরিয়ে দিও তো। আমার তো আবার কোনো শাড়ি নেই”

রহিমা বেগম মাথা নাড়িয়ে নিজের কাজে চলে গেলেন। রান্না শেষে মেয়েকে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে নিজের হাতে সাজিয়ে দিলেন। আলতো করে মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
–মাশআল্লাহ আমার বৈশাখীকে খুব সুন্দর লাগছে।”
বৈশাখী মুচকি হেসে ফেললো মায়ের কথায়। তারপর মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে কলেজে চলে গেল।

বৈশাখ মাসের পহেলা তারিখে জন্ম বৈশাখীর। আদর করে মেয়ের নাম বৈশাখী রেখেছিলেন রহিমা বেগম। মেয়ে নিয়ে কোনোই আগ্রহ ছিল না আজমল সাহেবের। মেয়ের জন্মের এক মাস পরেও মেয়ের মুখদর্শন করেননি তিনি। তার কাছে মেয়ে মানেই অলক্ষুণে, অপয়া। এরা যে সংসারের জন্ম নেয় সে সংসারে নাকি আয় উন্নতি হয় না। বৈশাখীর দাদাও নাকি মেয়ে পছন্দ করতেন না। বংশের এই ধারা তার বাবাও পেয়ে বসেছে। শিক্ষা -দীক্ষাও এই ধারার বিশ্বাস থেকে তাকে টলাতে পারেনি।

অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরলো বৈশাখী। আজ পহেলা বৈশাখটা যেন অন্যরকম এক ভালো লাগা নিয়ে তার জীবনে ফিরে এসেছে। আজ সে জয়ী হয়েছে বলে কথা। আনন্দে তার আজ আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে। স্বপ্নের ভাবেনি সে আজ এত প্রতিযোগীর মধ্যে প্রথম হবে। হাসি হাসি মুখ করে ঘরে পা রাখতেই দেখলো আজমল সাহেব ড্রয়িংরুমে ধ্যানমগ্ন হয়ে টিভিতে খবর দেখছেন। বৈশাখী ধীর পায়ে গিয়ে বাবার পাশে বসলো। খানিকটা সময় বাবার পাশে বসে টিভি দেখলো। তবুও রহিম সাহেবের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি একমনে টিভি দেখেই চলেছেন। তাই নিজেকেই মুখ খুলতে হলো বৈশাখীর।
–বাবা কেমন আছো?”
এক পলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবারও টিভিতে মনযোগ দিলেন তিনি। গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলেন,
–ভালো। তা সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই ব্যস্ত থাকো, নাকি পড়াশোনাও করো?”
খুব কান্না পাচ্ছে বৈশাখীর, আজ জন্মদিনের দিন তাছাড়া আজ বাংলা বৎসরের প্রথম দিন তবুও এভাবে কথা না শুনালে হয় না?
সে কথার জবাব না দিয়ে বৈশাখী ঠাণ্ডা গলায় বললো,
–বাবা আমি গানের প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়েছি।”
রহিম সাহেব দৃষ্টি না এড়িয়ে আগের ভঙ্গিতে বললেন,
–ভালো।”
আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করলেন না তিনি। রিমোট দিয়ে একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টে চলেছেন। সেখান থেকে যখন বৈশাখী উঠে আসছিল তখনই রহিম সাহেব ছেলেকে ডাকলেন,

–বাবু এই বাবু?
রহিম সাহেব শখ করে ছেলের নাম বাবু রাখেন। সেই থেকে সবাই তাকে বাবু ডাকে।
বৈশাখী দাঁড়িয়ে পরলো পর্দার আড়ালে।
— হ্যাঁ… বাবা। কিছু বলবে?”
–তোর জন্য বৈশাখ উপলক্ষে পাঞ্জাবি এনেছি। তুই তো বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হবি। দেখ তো পছন্দ হয় কি না।”
–কোথায় রেখেছো শপিং ব্যাগ? “
–তোর মায়ের রুমে। যা পরে আয় দেখি কেমন লাগে।”

সবটাই পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করলো বৈশাখী। আজ পর্যন্ত কোনো বৈশাখে তাকে কোনো পোশাক কিনে দেননি আজমল সাহেব। এমনকি কখনোই তিনি মেয়েকে নিজের পছন্দে পোশাক কিনে দেননি। বাবা-ছেলের আনন্দের মুহূর্ত দীর্ঘ সময় উপভোগ করতে পারলো না সে। অজানা এক ব্যথা পুরো শরীর জুড়ে বইতে লাগলো। দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজায় ঠেস দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়লো সে। হঠাৎ কেউ দরজায় কড়া নাড়তেই ওড়নায় ভালো করে চোখ-মুখ মুছে নিলো সে। তারপর ধীরে সুস্থে দরজা খুললো। মাকে দেখেই মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বললো, মা আমি জিতেছি। প্রথম হয়েছি গানের প্রতিযোগিতায়। দেখো এই উপহারগুলো পেয়েছি। কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে আসছিল বৈশাখীর। সবটাই আঁচ করগে পারলেন রহিমা বেগম। স্নিগ্ধ গলায় মেয়েকে প্রশ্ন করলেন,
–কী হয়েছে তোর?”
মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো সে। আবেগপ্রবণ হয়ে বলতে লাগলো,
–আমি আমি কী সত্যিই অপয়া? আমড়া কাঠের ঢেঁকি? “
মেয়েকে গভীর মমতায় খানিকটা সময় বক্ষদেশে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখলেন তিনি। মায়ের মমতার ছোঁয়া পেতেই ভেতরের সুপ্ত অভিমানগুলো মুহূর্তেই সক্রিয় হয়ে উঠলো। ক্রোন্দনের রুপ নিয়ে চোখের পানি হয়ে ঝড়তে লাগলো আঁখি দ্বয় থেকে। রহিমা বেগল শান্ত স্বরে বললেন,
–সামনে তাকিয়ে দেখ তো কারা এসেছে।”

বৈশাখী আগ্রহী চোখে সামনের দিকে তাকাতেই মুহূর্তেই হৃদয়ের সব মেঘ কেটে গিয়ে হাসিতে মুখটা পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। ওর সব বন্ধুরা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তাদের অনেকগুলো শপিং। সবাই একত্রে বলে উঠলো,
“শুভ জন্মদিন বৈশাখী।” এতক্ষণের জমে থাকা কষ্টটা মুহূর্তেই পালিয়ে গেল। সবাইকে নিজের রুমে নিয়ে বসালো। খুব সুন্দর একটা কেক এনেছে ওর বন্ধুরা। তার সাথে আরও অনেক অনেক উপহার। সবগুলো উপহার রেপিং কাগজে মোড়ানো। তার মধ্যে শুধু একটা উপহার আলাদা। আর সেটাতে একটা খুব সুন্দর শাড়ি। ওর বন্ধুরা মিলে সবাই জোড় করলো ওকে শাড়িটা পরতে। সবার আবদার ফেলতে পারলো না বৈশাখী। সুন্দর করে শাড়িটা পরে নিলো। শাড়ি পরে এগিয়ে গেল রহিম সাহেবের কাছে। কেন যেন ভয় লাগছে কিছু বলতে। না জানি আবার কখন রেগে যান তিনি। আর এটা নতুন কিছুই না এটার সাথে বহু আগে থেকেই পরিচিত সে। অত্যন্ত কোমল স্বরে আস্তে করে ডাকলো,
–বাবা!”
রহিম সাহেব টিভি দেখতে দেখতে জবাব দিলেন,
–হু।”
বৈশাখী মাথা নিচু করে শীতল গলায় বললো,
–বাবা ওরা সবাই তোমাকে ডাকছে। কেক কাটা হবে।”
–আমি মুরুব্বি মানুষ, সেখানে গিয়ে কী করবো? তোমারাই যা করার কর। আমাকে এসবের ভেতর টেনো না।”
আর কিছু না বলেই ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো নিজের রুমে। তবুও ভালো লাগছে মা আর ছোট ভাইটা তো আছে। সবাই মিলে হইহুল্লোড় করে কেক কাটলো। রহিমা বেগম দুপুরে মেয়ের পছন্দের সব রান্না করলেন। সবাই মিলে খেয়ে-দেয়ে ঘুরতে বের হলো।

অবশেষে আনন্দ করে বাড়িতে ফিরলো সে। মা আর মেয়ে মিলে গিফট দেখতে শুরু করলো। সবগুলো প্যাকেটে সুন্দর সুন্দর সব উপহার। এর মধ্যে একটা রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইও এক বন্ধু উপহার দিয়েছে। সব শেষের উপহারেরে সাথে এক বন্ধুর থেকে একটা চিরকুট পেল বৈশাখী। আজকাল সচরাচর কেউই কাউকে চিঠি দেয় না।
আহ্লাদে আটখানা হয়ে চিঠি পড়তে শুরু করে দিলো সে।

“বৈশাখী আজ যে সারপ্রাইজ গিফটগুলো তোকে আমরা সবাই দিয়েছি সবগুলো আংকেলের কেনা। আর আংকেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী সব হয়েছে। আর শাড়ি আর ড্রেসগুলোও আংকেলের নিজের কেনা। ঢাকা থেকে কিনে নিয়ে এসেছেন বৈশাখ আর তোর জন্মদনি উপলক্ষে।”

দীর্ঘ সময় নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো চিরকুটের দিকে। এটা কী আদৌও সে দেখছে নাকি তার ভ্রম এটা। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে এক দৌড়ে চলে গেল বাবার রুমে। আজমল সাহেব কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছেন। ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি জেগে আছেন সেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। অগত্যা আস্তে করে ডাকলো সে,
–বাবা।”
আজমল সাহেব কপাল থেকে হাত সরিয়ে মেয়েকে দেখে উঠে বসলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন,
–কিছু বলবে?”
বৈশাখী কিছুই বলতে পারলো না। তার আগেই বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ছোট বাচ্চাদের মতো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে সে। আজমল সাহেবরও চোখ থেকে জলের স্রোত বইছে। কেউই কোনো কথা বলতে পারছে না। রহিমা বেগমও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কাদঁছেন। এটা যে সবার জন্যই সুখের কান্না!
হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বৈশাখী বললো,
বাবা প্লিজ একটিবার বলো, “আমি অপয়া নই!”
আজমল সাহেব মেয়ের কপালে চুমু এঁকে বললেন,
–আমার বৈশাখী অপয়া নয় আমার বৈশাখী আমার ঘরের লক্ষ্মী! “
খুশিতে আবেগাপ্লুত হয়ে বাবাকে আবারও জড়িয়ে ধরলো সে……

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত