সবেমাত্র স্কুল থেকে বাসায় ফিরলো মায়া।শীররটা আর চলছে না। একবার স্কুল তো আবার প্রাইভেট। সারাদিন শুধু পড়া আর পড়া। এই এসএসসি পরীক্ষা আসে না যেন, জীবনের ওপর দিয়ে একটা ভয়ংকর প্রলয় যায়। সারাদিন শুধু মায়ের বকুনি তার সাথে ফ্রী স্যারদের কড়া কড়া ভাষণ। একটুও বিশ্রাম নেওয়ার জো নেই। সারাদিন শুধু পড়ার টেবিলে বসে থাকলেই সবাই খুশি। কবে যে স্কুল ডিঙিয়ে কলেজে যাবে আর কবে এই পড়ার কবল থেকে রক্ষা পাবে সেই দিন গুনছে মায়া! তখন আর সারাদিন মায়ের বকুনি শুনতে হবে না। কলেজে উঠলে তেমন একটা কেউই পড়াশোনা করে না। ভেবেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তখনি পাশের ঘর থেকে শারমিন বেগমের (মা) কণ্ঠ ভেসে আসলো।
“মায়া,এই মায়া খেয়ে-দেয়ে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে তো।”
কথাটা শুনেই বিষম খেলো মায়া। প্রতিদিন ওর মা এই সময় বলতো খেয়ে-দেয়ে পড়তে বোস, আজ এই সময় বলছে খেয়ে-দেয়ে তৈরী হয়ে নিতে। ব্যপারটা খুব একটা সুবিধার ঠেকছে না। হলোটা কী? মায়ার মায়ের! ভেবেই এগুলো রুমের বাহিরে। ছোট বোন মিলিকে দেখেই প্রশ্ন করে বসলো,
“কী রে মায়ের আজ কী হয়েছে? আমাকে খেয়ে-দেয়ে তৈরী হতে কেনো বললো?”
“আজ তোকে দেখতে আসবে। “
বলেই মুখ টিপে হাসতে লাগলো মিলি।
কথাটা শুনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো মায়া। ফোঁস করেই মিলিকে এক ধমক দিয়ে বসলো।
“এই তোর সমস্যা কী?এভাবে হাসার কী আছে?”
মিলি ভয়ে চুপসে গেল। মায়া ঘাড়ের রগ বাঁকা করে এগুলো শারমিন বেগমের রুমের দিকে।কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“মা সমস্যা কী তোমার? তুমি কী শুরু করলা?আমার এখনো বিয়ের বয়স হইছে নাকি যে তুমি আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছো?”
“মায়া আমার মেজাজ গরম করবি না কইলাম। এহান থেকে যা। আর যা কইছি তাড়াতাড়ি কর। ছেলে পক্ষের লোক রওনা দিয়ে দিছে। আসতে বেশি সময় লাগবো না।”
মায়া আসহায়ের চোখে মায়ের দিকে তাকালো।শারমিন বেগম মায়ার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বললেন,
–পায়ের নুপূর খুলে রাখ। আর নূপুর পরা লাগবো না।”
–নুপূর খুলবো কেনো?”
–আমি কইছি তাই। ছেলে বড় আলেম।
আলেমরা এসব নূপুর-টূপুর পছন্দ করে না।এসব নূপুর পরা দেখলে নির্ঘাত বিয়া ভাইঙা দিব।”
মায়া কোমল স্বরে বললো,
–মা তুমি জানো না? আমি নূপুর পড়তে কত ভালবাসি। নূপুর না পরলে আমার একটুও ভাল লাগে না। প্লিজ মা এই কথা বলো না। আমি নূপুর খুলতে পারবো না।”
শারমিন বেগম কোনো কথা না বলেই কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মায়ার দিকে। মায়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। খুব কান্না পাচ্ছে তার। সেই ছোট বেলা থেকেই নূপুরের প্রতি তার এক গভীর টান। কখনো পায়ের থেকে নূপুর খুলতো না। ছোটবেলায় একবার এক পায়ের নূপুর পুকুরে গোসল করতে গিয়ে হারিয়ে গেছে। সেদিন সে কী কান্না! কিছুতেই সেই কান্না বন্ধ করা যাচ্ছিলো না। অগত্যা মায়ার বাবা আসলাম সাহেব বাজারে গিয়ে নতুন একজোড়া নূপুর কিনে এনে দিয়েছিলেন।নতুন নূপুর পেয়ে তবেই কান্না থামলো মায়ার।আজ নাকি কোত্থেকে কে একজন আসবে! তার জন্য নাকি নূপুর খুলে ফেলতে হবে। আজ আসুক ওই বজ্জাত ছেলে ওর কান টেনে তবেই বাড়ি পাঠাবে মায়া! এসব ভাবতে ভাবতেই মিলি এসে বললো,
–আপু জানিস?”
রুক্ষ কণ্ঠে জবাব দিলো মায়া,
–না বললে জানবো কীভাবে?”
–তোকে যে ছেলেটা আজ দেখতে আসবে। সে নাকি তোকে আগেও একবার দেখেছে।”
–আগে তো দেখছেই তো এখন ঢং করে দেখতে আসার কী আছে?”
–তোকে মনে ধরছে তাই দেখতে আসছে।”
বলেই মুচকি মুচকি হাসছে।
–মিলি আমার মাথা গরম করবি না কইলাম।হাসনের কী আছে?”
মিলি নিজের মুখ চেপে ধরে হাসছে আর বলছে,
–তুই যখন ইমা আপুর বিয়েতে গিয়েছিলি তখন তোকে দেখছে। (চাচাতো বোন)ইমা আপুর হাজবেন্ডের বন্ধু হয়।”
–মিলি শোন তুই মা’কে গিয়ে একটু বল না।আমি এই বিয়ে করবো না।”
–সমস্যা কী তোর? ছেলে মাশআল্লাহ সেই সুন্দর। আমি পিক দেখছি।মুখ ভর্তি দাঁড়ি,মাথায় সাদা পাগড়ি, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, আর চোখে সাদা সানগ্লাস যা সুন্দর দেখতে!”
–তা তুইই বিয়েটা করে ফেলনা। তাহলে আমি বাঁচি।”
–করাই যায়, মন্দ হয় না। কিন্তু আমি তো সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমাকে তো এখন মা-বাবা কেউই বিয়ে দিতে চাইবে না।তার চেয়ে বরং তুইই বিয়েটা সেরে ফেল।”
সহসাই রুক্ষ কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়ে গেল মায়ার। কোমল স্বরে বলে উঠলো,
–এই ছেলে আমাকে নাকি নূপুর পরতে দেবে না। আমি নূপুর না পরে থাকতে পারবো না।”
মায়ার কথা শুনেই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মিলি। মনে হয় খাটের ওপর থেকে পরেই যাবে।
–এই তুই এভাবে হাসছিস কেনো?”
–আমার দুলাভাই কত্ত সুন্দর। আর তুই কিনা সামান্য এই নূপুরের জন্য বিয়ে করবি না!” বলেই আবারও গলা ফাটিয়ে হাসতে লাগলো মিলি।
এবারে মায়া কোন প্রত্যুত্তর করলো না। মন খারাপ করে বসে রইলো। একটু বাদেই শারমিন বেগম এসে একটা শাড়ি দিয়ে গেল মায়াকে পরার জন্য। শাড়ি পরছে আর বিড়বিড় করে চলেছে,
–আজ আসো চান্দু তোমার বিয়ে করার স্বাদ আমি চিরতরে মিটিয়ে দেব।আমার পেছনে লাগা… তাই না!আমার জীবন বরবাদ করবে তুমি…তোমার জীবন বরবাদ করে ছাড়বো আমি।”
অবশেষে পাত্র পক্ষের সামনে নিয়ে মায়াকে বসানো হলো। মুখ একটা গোমড়া করে রইলো মায়া। সব কথা পাকাপাকির এক পর্যায়ে মায়া হুট করেই বলে বসলো,
–আমি একটু ওনার সাথে কথা বলতে চাই!”
আমতা আমতা করে শারমিন বেগম কোনরকম মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
–আপনারা কেউ কিছু মনে করবেন না। ও এমনিই কইছে। কী কথা বলবি তুই? যা বলার আমরাই বলবো।”
তখনই পাশ থেকে সাহেদ(পাত্র)বলে উঠলো,
ওনার যদি কিছু বলার থাকে তাহলে বলতে পারে। কথাটা শুনেই মায়া এগিয়ে চললো নিজের রুমে দিকে, মায়ার পিছু পিছু সাহেদও আসলো।
নিজের রুমে এসেই মায়া কোমরে হাত দিয়ে কড়া চাহনিতে তাকিয়ে থাকলো সাহেদের দিকে। সাহেদ দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে হালকা কাশি দিয়ে বললো,
–কিছু বলার থাকলে বলুন।”
ওমনি কর্কশ কণ্ঠে মায়া বলতে লাগলো,
–অনেক কিছু বলার আছে। কেনো আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন? দেশে কি মেয়ের অভাব পরছে নাকি?”
সাহেদ মিহি গলায় বললো,
–এইভাবে উচ্চস্বরে কথা বলবেন না।
মায়া ফোঁস করে উঠলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
–শুনুন এইটা আপনার বাড়ি না_আমার বাড়ি।আমার বাড়িতে আমি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কথা বলবো। একদম জ্ঞান দিতে আসবেন না।”
–আচ্ছা।”
–আমি নূপুর পরতে খুব ভালবাসি।”
–তাহলে এই অভ্যাস পরিবর্তন করার চেষ্টা করুন।”
–পারবো না…জীবনেও পারবো না।”
–পারতে হবে। এটা করলে আপনারই ভাল হবে।”
–আমি আমার ভাল বুঝি।”
–না আপনি আপনার ভাল বোঝেন না। যদি বুঝতেন তাহলে আর এসব কথা বলতেন না।আপনি যখন রাস্তায় নূপুর পরে হাঁটেন তখন নূপুরের আওয়াজ পর-পুরুষের কানে যায় তখন না চাইতেও সেই পুরুষগুলো আপনার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে আর তখন আপনার পাপ হয়। আপনি জেনে-শুনে কী চাইবেন আপনার পাপ হোক? কখনো ভেবেছেন এসব?”
চুপ হয়ে গেল মায়া। কথা বলার ভাষা হারিয়ে গেছে। কর্কশ কণ্ঠটা মুহূর্তেই কোমল কণ্ঠে রুপ নিলো। মায়া অস্বাভাবিক কোমল স্বরে বললো,
–আমি নূপুর পরতে খুব ভালবাসি। তাহলে কী করে আমি নুপূর না পরে থাকবো?”
মায়ার কোমল কণ্ঠ শুনেই সাহেদ একটু মুচকি হাসলো যেটা মায়ার চোখ এড়ালো না।সাহেদের হাসি দেখেই মায়ার রাগটা খুব বেড়ে গেল,তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
–আপনি খুব খারাপ। আপনাকে আমি বিয়ে করবো না। যদি আমাকে জোর করে বিয়ে করেন আপনাকে কাঠগড়ায় ঝোলাবো।”
–আমি তোমার মনের কাঠগোড়ায় ঝুলতে চাই।”
মায়া ভেংচি কেটে বললো,
–সেটা কোনদিনই হতে দেব না। আপনি এখন বের হন আমার ঘর থেকে।”
এবারে সাহেদের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ শোনা গেল,
–আমাকে বিয়ে করতে এত আপত্তি কেনো আপনার?”
–আমার হুজুর পছন্দ না।”
–নাউজুবিল্লাহ! শিঘ্রই তওবা করুন। যা বলেছেন… বলেছেন। আর কখনো এমন কথা মুখেও উচ্চারণ করবেন না। আমরা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মত। আমাদের নবী দিনের দাওয়াত দিতে গিয়ে কাফেরদের কাছে কত অত্যাচারিত হয়েছেন। পেটে পাথর বেঁধে না খেয়ে দিনের দাওয়াত দিয়েছেন। এসব শুধুমাত্র ওনার উম্মতের জন্য করেছেন ।আর আমরা সেই নবীর উম্মত হয়ে তার দেখানো পথ কেনো অনুসরণ করবো না? তাহলে তো আমাদের ঈমানই থাকবে না। এই টুপি-পাঞ্জাবীর কত মূল্য জানো তুমি?”
পুরো চুপ হয়ে গেল মায়া। হুট করেই কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছ। মায়া কখনোই এমনটা ভাবেনি। বিয়েটা ভাঙতেই মূলত কথাটা না চাইতেই বলে ফেলেছে । নিজের ভেতরে কেমন একটা অজানা ভয় কাজ করছে। ভয়ে পুরো শরীর কাঁপছে। কী করে এমন একটা কথা বলে ফেললো ভাবতেই কম্পনটা গভীর হচ্ছে। হঠাৎই সাহেদ মৃদু স্বরে বললো,
–তুমি কী জান্নাতে যেতে চাও না?”
অবাক হয়ে তাকালো মায়া, সাহেদের মুখের দিকে। তখনও সাহেদ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আর নিজ মনে বলতে লাগলো,
–আমি তোমাকে নিয়ে জান্নাতে যেতে চাই ।যাবে না আমার সঙ্গে? আমার জান্নাতের বাগানে তোমার হাত ধরে ঘুরতে চাই! আমার সঙ্গী করতে চাই তোমাকে। তুমি কী এসব চাও না?”
কিছুই বলতে পারলো না মায়া। সাহেদর প্রতিটা কথায় মাধুর্য্যতা মিশে আছে। সহসাই এক অজানা ভাললাগায় হৃদয় ছুঁয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সাহেদের মুখে নিসৃত প্রতিটা বাক্য শ্রবন করতে লাগলো। সাহেদ যাওয়ার সময় শুধু একটা কথাই বলে গেল,
“আপনার আর কিছু বলতে হবে না। আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি!”
সাহেদ যাওয়ার খানিকক্ষণ পর ঘোর কাটলো মায়ার। অজানা এক মায়ায় আটকা পরে গেল সে!
অবশেষে সেই শুভক্ষণ এল। পবিত্র কালেমা পাঠ করে বিয়ে সম্পূর্ন হয়ে গেল। মায়া বাসায় চুপচাপ বসে আছে। সহসাই হাতে থাকা ফোনটা বেজে উঠলো। সাহেদের নাম্বারটা ফোনের স্ক্রিণে ভেসে উঠতেই মনের মধ্যে একটা গভীর ভাললাগা কাজ করতে লাগলো।
–আসসালামু আলাইকু।”
–ওয়ালাইকুমুস সালাম। তোমাকে আমি আমার কাঠগড়ায় বন্দী করে ফেলেছি পবিত্র কালেমা পাঠ করে, লিখিত দলিলে সই করে নিজের সম্পদ করে নিয়েছি।”
মায়া মিটিমিটি হাসছে।
–মায়া!”
মায়া ডাকটা শুনেই অন্যরকম এক অনুভূতি হতে লাগলো পুরো হৃদয় জুড়ে। এই প্রথম সাহেদ মায়ার নাম ধরে ডাকলো। ওইদিন যখন কথা হয়েছে তখন আপনি আপনি করে ডেকেছিল। আর একবারও নামটা উচ্চারণ করেনি। আর আজ!….ভাবতে পারছে না মায়া।সে যেন সুখের সাগরে ভাসছে।
–মায়া!শুনছো তুমি?”
মায়া আস্তে করে জবাব দিলো।
–হু।”
–আমি একটু তোমার সাথে দেখা করতে চাই।সবার অগচরে।
কিছু বলতে পারছে না মায়া চুপ করে ফোনটা কানের কাছে ধরে রেখেছে। সাহেদ মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
–আমি কি ধরে নেব, নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ?
তাও কোনো প্রত্যুত্তর করলো না মায়া। সহসাই লাইনটা কেটে গেল। বুকটার মধ্যে কেমন ধক করে উঠলো। প্রচন্ড অস্থির লাগছে ভেতরটায়।কেন একবার…হ্যাঁ বললো না।
পরক্ষনেই কল ব্যক করলো কিন্তু নাম্বারটা বন্ধ আসছে। হতাশা নিয়েই বিছানায় চোখ বুঝলো মায়া। তখনই চোখের সামনে সেদিনকার সাহেদের মুচকি হাসিটা ভেসে উঠলো,
ইশ কী মিষ্টি সেই হাসি! হৃদয়ে এক প্রশান্তির দোলা বইতে লাগলো। সহসাই রুমের পেছনের দরজায় টোকা পরলো। বিছানা ছেড়ে উঠে পরলো মায়া। বুকের মধ্যে উত্তাল ঢেউ বইতে লাগলো। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল দরজার কাছে। আস্তে করে প্রশ্ন করলো…কে?”
দরজার ওপাশ থেকে মৃদু কণ্ঠে কেউ উত্তর দিলো,
“মায়াবতী আমি।দরজাটা খোল!”
মায়া আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না হাত বাড়িয়ে সিটকিনিটা খুলে দিলো। সাহেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ ভয়ংকর সুন্দর লাগছে সাহেদকে। পাঞ্জাবি পরিহিত এক যুবক তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বিধাতা যেন সব সৌন্দর্য দিয়ে এই যুবককে সৃষ্টি করেছেন। যার থেকে চোখ সরানো যাচ্ছে না। কী করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না মায়া।লজ্জায় মুখটা বারবার রাঙা হয়ে উঠছে ।কিন্তু সেদিন যখন কথা হয়েছিল তখন তো একটুও লজ্জা লাগেনি। তবে আজ কেনো এমন লাগছে ভেবে পাচ্ছে না মায়া।
সাহেদ মৃদুস্বরে সালাম দিলো।
মায়া মনে মনে সালামের উত্তর নিয়েও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। সাহেদ কোমল স্বরে বললো,
“ভেতরে আসতে বলবে না?”
–ও…হ্যাঁ।ভেতরে আসুন।”
সাহেদ ভেতরে আসতেই মায়া ঝুঁকে সাহেদের পা ধরে সালাম করতে গেল।ওমনি সাহেদ মায়ার দু’বাহু ধরে ফেললো,
–পা ধরে সালাম করতে হবে না।যদিও কাউকে পা ধরে সালাম করতে চাও তবে শির নিচু না করে তবেই সালাম দেবে।তার চেয়ে মুখে সালাম দিলেই উত্তম। শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার কাছেই মাথা নোয়াবে। আর কারো সামনে নয়।
দু’জনেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিরবতা ভেঙে মায়া বলে উঠলো,
–বসুন।”
–মায়া!”
–হু!”
–আমি কী তোমায় একটু স্পর্শ করতে পারি?”
চুপ হয়ে গেল মায়া। পুরো মুখ রক্তিম আভা ধারণ করেছে। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় মায়ার মুখটা মায়াতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
“মাশআল্লাহ আমার মায়াবতী তো অনেক সুন্দর! ”
সাহেদের কথা শুনে,মায়া যেন লজ্জায় মরে যাবে। মাথাটা আরও নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।সাহেদ একটু এগিয়ে এসে আলতো করে ঠোঁট জোড়া ছুঁয়ে দিলো মায়ার স্নিগ্ধ কপালের ভাঁজে। সাহেদ মায়ার হাতে একটা গিফট বক্স দিয়ে বললো,
–দেখো তো পছন্দ হয়েছে কিনা?”
–কী আছে এতে?”
–খুলেই দেখো না!”
মায়া গিফট বক্স খুলতেই রুপার চকচকে একজোড়া নূপুর গিফট বক্স থেকে বেরিয়ে আসলো। নূপুর জোড়া দেখেই চোখে-মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো মায়ার। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো সাহেদের হাসি ভরা মুখটার দিকে।
“আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমার নেই!”
–আমি কী পর কেউ নাকি, যে তুমি আমাকে ধন্যবাদ দেবে? আমি তোমায় ছোঁয়ার আগে তোমার মন ছুঁতে চাই মায়া। ভালবাসা দিয়ে তোমায় অর্জন করতে চাই। তোমায় ছুঁয়ে তোমায় অর্জন করতে চাই না।
মায়া ভালবাসাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো সাহেদর দিকে! কী মুগ্ধতা মিশে আছে প্রতিটা বাক্যে!
“এখন এই নূপুর গুলো আজ থেকে তোমার।তবে…হ্যাঁ আমিই শুধুমাত্র তোমার নূপুরের আওয়াজ শুনবো। আর কেউ শুনবে না। তুমি প্রতিদিন ঘরে নূপুর পরে হাঁটবে আর আমি তোমাকে দেখবো!”
মায়ার কখনো জানা ছিলো না হুজুরেরা এত রোমান্টিক হয় মায়ার কাছে হুজুর মানেই একটা গরুগম্ভীর ভাব! যাদের মনে রোমান্টিকতার কোনো চিহ্নই নেই।
“এখন আমাকে একটু নূপুরগুলো পরে দেখাতে পারবে?”
মায়া কিছু না বলেই নূপুর জোড়া পরে নিলো।মায়া হাঁটছে পুরো ঘরময় নূপুরের রিনঝিন শব্দ হচ্ছে আর সাহেদ মুগ্ধ হয়ে তার মায়াকে দেখছে। সাহদে চলে যাওয়ার আগে মায়ার কপালে ভালবাসা এঁকে দিয়ে গেল। আর বলে গেল,
“কাল এসে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব!”
মায়া বউ সেজে বসে আছে।ঘরোয়াভাবেই সব আয়োজন করা হয়েছে। সাহেদ পছন্দ করে মায়ার জন্য লাল বেনারসি কিনেছে। সব কিছুর সাথে একটা কালো বোরকা আর হিজাবও কিনে দিয়েছে। যাওয়ার সময় সেগুলো পরে তবেই যাবে স্বামীর ঘরে। মিলি মায়ার কাছে এসে বসলো,
“আপু তোকে আজ যা সুন্দর লাগছে! ভাইয়া আজ তোকে দেখলে হার্ট এ্যাটাক করবে।মায়া লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। তখনই মিলি চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
” আপু তুই এত সুন্দর নূপুর জোড়া কোথায় পেলি?”
মায়া আস্তে করে বললো,
“আরেহ চুপ কর! সবাই শুনবে তো!”
মিলিও নাছোড়বান্দা। আরও জোড়ে বলতে লাগলো,
“আগে বল কোথায় পেয়েছিস?”
মায়া লাজুক হেসে বললো,
“গতকাল রাতে তোর ভাইয়া এসেছিল।আর তখন এগুলো দিয়ে গেছে!”
মিলি এক গাল হেসে বললো,
“ওমা এত প্রেম!”
তখনই সাহেদের কল আসলো মিলির ফোনে,
“ওই দেখ বলতে না বলতেই দুলাভাই আমার কল দিয়ে বসেছে।অনেকদিন বাঁচবে।ধর, কথা বল।”
মায়া লাজে রাঙা হয়ে ফোনটা কানের কাছে ধরলো,
–আসসালামু আলাইকুম “
–ওয়ালাইকুম সালাম”
সাহেদর ব্যথাতুর কণ্ঠ কানে বাজতেই মায়ার বুকের মধ্যে ভয়ংকর এক ঝড় বইতে শুরু করলো। অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,
–কী হয়েছে আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?
–মায়া আমি একটা কথা জানতে চাই?
মায়া অস্থির হয়ে বললো,
–হ্যাঁ… বলুন!
–আমি কী তোমার মন ছুঁতে পেরেছি? উত্তর দিতে বেশি দেরি করো না মায়া!
মায়াও কোনরকম দেরি না করেই বলে ফেললো,
–হ্যাঁ… আপনি পেরেছেন। আপনি সফল হয়েছেন।
বলতে বলতেই মায়ার দু’চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগলো।
–আমার খুব শান্তি লাগছে মায়া।আমি কথা বলতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। দু’জনে মিলে একসাথে জান্নাতে পা রাখবো!”
মায়া স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সবাই বলাবলি করছে”বাঁচবে না। অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক।যেভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে,বাঁচার সম্ভাবনা নেই!”
মায়া চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। আর পাগলের মতো ডাকতে লাগলো সাহেদকে,
“আপনি শুনছেন? প্লিজ কথা বলুন”
কিন্তু সাহেদ কোনো কথা বলছে না। শুধু ফোনের ওপাশ থেকে গোঙানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মায়া দৌঁড়ে বিছানা থেকে নামতেই নূপুরের রিনঝিন শব্দ কানে বাজলো।তখনই মনে পরে গেল সাহেদের কথা”তোমার নূপুরের আওয়াজ শুধু আমিই শুনবো আর কেউ না।”
তাড়াতাড়ি করে নূপুর খুলে হাতের মুঠোয় নিলো।আবার সামনে এগুতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো,সাহেদের ফোনে বলা কথাগুলো কানে বাজছে তার,
“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। জান্নাতে তোমার সাথে পা রাখবো”!
তাড়াতাড়ি করে সাহেদের দেওয়া বোরকাটা আর হিজাবটা পেঁচিয়ে নিলো।
মায়ার সামনে সাহেদের নিথর দেহটা সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা। মায়া যাওয়ার আগেই প্রাণ পাখিটা উড়ে চলে গেছে। আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে চললো সাদা কাপড়ে ঢাকা মানুষটার দিকে। সাদা কাপড়টা সরিয়ে সেই পবিত্র মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকলো মায়া।সাহেদ যেন হাসছে! কত স্নিগ্ধ লাগছে সাহেদকে! মৃত মানুষের মুখে এত সুন্দর হাসি ফুটে ওঠে জানা ছিলো না মায়ার। মনে হয় সাহেদ তৃপ্তির সহিত মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেছে!
সাদা পাঞ্জাবিটা পুরো রক্তে লাল হয়ে গেছে!
মায়া আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো সাহেদের মসৃন কপালের ভাঁজে। সহসাই হাতের মুঠোয় রাখা নূপুর জোড়া পরে গেল হাসপাতালের ফ্লোরে। নূপুরগুলো ফ্লোরে পরতেই রিনঝিন শব্দ কানে বাজতে লাগলো মায়ার। মিলি এগিয়ে এসে নূপুর জোড়া তুলে নিলো। মায়াকে ধরার আগেই শরীরটা লুটিয়ে পরলো ফ্লোরে!
হসপিটালের বারান্দা জুড়ে কান্নার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। চিরবিদায় নিয়ে চলে গেল দু’জন ভালবাসার মানুষ। এই বন্ধন যেন জন্ম-জন্মান্তরের। যা ছিন্ন হওয়ার নয়। পবিত্র ভালবাসার জয় হলো। অতঃপর দু’জনকে পাশাপাশি মাটির বিছানায় শায়িত করা হলো!
সমাপ্ত