স্বামী আর সংসার

স্বামী আর সংসার

_আপনি কি জানেন, আমি বিবাহিত?
পাত্রের মুখে এমন কথা শুনে আমি একটুও অবাক হইনি। কারণ আমি জানি যে,উনার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, আর বিয়ের দিন রাতেই বউ মারা গেছে। একেতো ছোটখাটো একটা চাকরি করে,তার উপর বিয়ের রাতে বউ মারা গেছে, এজন্য বউ মারা যাওয়ার বছরখানেক হয়ে গেলেও কোনো মেয়েই উনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। সবার ধারণা ওই লোকটার কারণেই উনার বউ বিয়ের রাতে মারা গেছে, এখন উনি আবার বিয়ে করলে সেই বউটাও যদি বিয়ের রাতে মারা যায়! এই ভয়েই বিবাহিতা অবিবাহিতা, বিধবা কোনো মেয়েই উনাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেনা। অথচ আমি উনার সাথে দেখা করতে গেছি।

আমি দেখতে মোটেও খারাপ না, সুন্দর না বললেও কেউ অসুন্দর বলতে পারবে না। অর্থনীতিতে মাস্টার্স শেষ করে ছোটখাটো একটা চাকরিতে জয়েন করেছি। বাবা,মা মারা গেছে আমি ছোট থাকতেই,চাচা-চাচির কাছে বড় হয়েছি। এতদিনে যে তারা আমার জন্য একটাও পাত্র দেখেনি তা নয়,বরং আমি নিজেই কোনো পাত্রের সাথে দেখা করিনি। বাবা-মাকে হারানোর পর আমি নিজের ইচ্ছেমতোই চলি,তাই কেউ কিছু বলেনা। বিয়ে জিনিসটা কেন জানি আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে,কিন্তু কয়দিন আগে বান্ধবী মালিহার মুখে এই ছেলেটার কথা শুনে কেন জানি আমার মনে হলো এই ছেলেটাকে বিয়ে করা যায়। অনেক ভেবেছি,কিন্তু কোনো কারণ খুজে পাইনি যে,কেন বিয়ে করব এই ছেলেটাকে! শুধু এই টুকুই মনে হয়েছে যে,এর মাঝে স্পেশাল কিছু আছে, যা আমাকে টানছে!

এতক্ষণ আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি আবার বললেন,,,
_কি ব্যাপার, বিবাহিত শুনে চুপ হয়ে গেলেন যে? আমি জানতাম আপনিও অন্য সবার মতই আমাকে অবিবাহিত ভেবেছিলেন, শুধু তাই নয়! আমার বউটা কিন্তু বিয়ের রাতেই মারা গেছে! এরপর আর নিশ্চয়ই আমার প্রতি আপনার কোনো আগ্রহ থাকার কথা নয়? তাহলে আর সময় নষ্ট না করে উঠি?

একেবারে এতগুলো কথা বলে মনে হচ্ছে হাপিয়ে উঠেছে, কথার মধ্যে একরাশ অভিমান, বুকে চাপা কষ্ট আর নিজেকে নিয়ে হতাশা গুলো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমি টেবিলে রাখা পানিভর্তি গ্লাসটা উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম…
_এতো তাড়া কিসের? আমি সবটা না জানলেও কিছুটা জেনেশুনেই এসেছি, আজ না হয় কিছুটা জানলাম, ভালো লাগলে বাকি জীবনে না হয় পুরোটা জানব। কি জানাবেনতো?

উনি আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে এক ঢোকে অনেকটা পানি খেয়ে ফেললেন, তারপর আমার কথাগুলো শুনে উনি সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। হয়ত আমার কাছ থেকে উনি এমন উত্তর আশা করেন নি,আর নয়ত আজ পর্যন্ত কেউ উনার সাথে এমনভাবে কথা বলেনি। উনি সন্দেহ ভরা দৃষ্টি নিয়েই আমার দিকে তাকালেন আর আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে লাগলেন…

_আপনার মাথা ঠিক আছে? জানেন আপনি কি বলছেন? দেখেন আপনার এখনো বিয়ে হয়নি, আর অনেক ভালো একটা মেয়ে আপনি,আমাকে বিয়ে করে লোকের কথা শুনতে হবে। আবার হতে পারে সেই কথাগুলো শুনার জন্য আপনি নাও…..
এইটুকু বলেই উনি থেমে গেলেন, বুঝতে পারলাম উনার গলাটা আটকে আসছে, আমি মুখে একরাশ হাসি এনে বললাম…
_সে কি! আপনি কি চাননা একটা ভালো মেয়েকে বিয়ে করতে? আর আমি আপনার সম্পর্কে না জানলে বুঝব কি করে আপনি আমার জন্য ঠিক কি না!

_আমি জানি, আমি আপনার মতো এতো ভালো মনের কোনো মেয়ের জন্য নই। আমিতো একটা অপদার্থ, নিজের বউকেই…
_দেখুন, আপনি কিন্তু আমার সম্পর্কে না জেনেই এমন মন্তব্য করছেন, অথচ আমরা এখানে একে অপরের সম্পর্কে একটু জানতে এসেছি।

_আচ্ছা, আপনার সাথে আমি কথায় পারব না। বলেন কি জানতে চান?
_এই যে দেখুন, আপনার সাথে আমি দেখা করতে এসেছি অথচ আপনার নামটাই জানা হয়নি! তাহলে একেবারে নাম দিয়েই শুরু হোক না কি বলেন?

_আমি হায়াত রহমান। বাবা-মা আদর করে হায়াত বলে, কিন্তু আমার বড় আপু সব সময়… থাক, ওটা না বলি।
_দেখেন আমি কিন্তু জানতে চাইনি যে, আপনার বড় আপু আপনাকে কি বলে ডাকে, অথচ আপনি অর্ধেকটা বলে রেখে দিলেন,এটা কিন্তু ঠিক না! এখন পুরোটা বলুন।

_ওকে, বলছি। আসলে আপু আমাকে হাতি বলে ডাকে।
বলেই লজ্জায় মাথা নিচের দিকে নিয়ে আড়চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি হাসি চাপিয়ে রাখতে গিয়েও পারলাম না।
_বাহ! সুন্দর নামতো! তা আমার নাম জানতে চাইলেন না যে?
_আমি আপনার সম্পর্কে মোটামুটি অনেক কিছুই জেনেছি, আর কিছু জানতে হবে বলে মনে হয়না।
_বাহ! আমার সম্পর্কে আপনি জেনে এসেছেন বলে কি আমাকে আপনার সম্পর্কে জানতে দিবেন না?
_আমি তা কখন বললাম! আসলে আপনি না….
_বিরক্তিকর! বকবক করি শুধু, তবে আমি একবার কারো সাথে কথা বলতে শুরু করলে তাকে বিরক্ত করে ছেড়ে দেই। আজ না হয় আপনাকে করলাম একটু বিরক্ত!
_আরে না, আপনার সাথে কথা বলে বিরক্ত হবো কেন!
_আপনার বউয়ের নাম কি ছিল? আর উনি কীভাবে মারা গেছিল? জানতে পারি কি?
_হুম, অবশ্যই। ওর নাম তিন্নি ছিল আর ঘুমের মধ্যেই হার্ট এটাক হয়েছিল, কেউ বুঝতে পারিনি, তাই ঘুমের মধ্যেই…
কথাটা বলতেই উনার কন্ঠ ভারি হয়ে আসছে, আমি টপিকস চেঞ্জ করার জন্য বললাম..
_আরে আপনার শার্ট এর কালারটা না অনেক সুন্দর!
_কালো রঙ আপনার পছন্দ নাকি?
_হুম, খুব ভালো না লাগলেও খারাপ লাগেনা, তবে আপনাকে মানিয়েছে সুন্দর।
_ধন্যবাদ।
_আপনার ধন্যবাদ কে চায় বলুনতো! আচ্ছা আপনাকে বিয়ে করে যদি আমি মারা যাই, তাহলে ১০০% সিওর আর কোনো মেয়েই আপনাকে বিয়ে করবে না।
_আপনি সিরিয়াস?
_তাহলে কি এখানে মজা করতে এসেছি?
_আচ্ছা, এটা কিন্তু আপনার জীবনের অনেক বড় একটা ডিসিশন, ভেবেচিন্তে নিবেন।
_এখনো আপনার মতামত জানানোর সুযোগটা দেইনি কিন্তু।
_সত্যি আপনার মতো একটা মেয়ের উপর অধিকার খাটাতে পারাটা অনেক ভাগ্যের ব্যাপার?

আরো কিছুক্ষণ কথা বলে এটুকু বুঝতে পারলাম যে, মানুষটা খারাপ না! চাচা-চাচিকে বলাই যায়!
বাসায় গিয়ে হায়াতের কথা ভাবছি আর মিটিমিটি হাসছি, চাচি আমার রুমে এসে আমাকে একাএকা হাসতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেছে, আমি সেটা খেয়াল-ই করি নাই, খেয়াল করলাম যখন চাচি বলল..
_কিরে ইমি! একাএকা হাসছিস কেন? ছেলে কেমন দেখলি কিছু বললি নাতো?

চাচির কথায় আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আসলে চাচি আমার বান্ধবীর মতো, তার কাছে আমি সব কথাই বলি। কিন্তু এই বিয়েতে আমি রাজি আছি শুনে তিনি খুশি হওয়ার বদলে কিছুটা চিন্তিত হয়ে আমায় পালটা প্রশ্ন করলেন যে, আমি কি সত্যি এই ছেলেটাকেই বিয়ে করব কিনা! আমিও আমার মতামত জানিয়ে দিলাম যে,বিয়ে করলে এই ছেলেকেই করব।
চাচাও প্রথমে অমত করেছিল, তাদের ভয় আমাকে নিয়ে, বিয়ের রাতে যদি হায়াতের আগের বউটার মতো আমিও মারা যাই!
ভয়-ভীতি নিয়েই আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল। আমি যে একদম-ই ভয় পাচ্ছি না তা নয়, কিন্তু এইসব কু-সংস্কার আমার একদম পছন্দ নয়।

হায়াতের বাবা,মা,আপু সবাই খুব খুশি যে, তাদের ছেলেকে আমি বিয়ে করেছি, সবাই একটা আতংকের মধ্যে আছে, কি হয় কাল সকালে!

সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেল, ফোনটা হাতে নিতেই দেখি চাচ,চাচি,চাচাতো বোন সবাই কয়েকবার করে ফোন করেছে। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে হায়াতকে ডেকে তুললাম, তারপর চাচিকে ফোন দিতেই চাচি ওপাশ থেকে কান্না করে উঠলেন…

_মা,তুই ঠিক আছিসতো? এতক্ষণ ফোন ধরলি না কেন? জানিস আমাদের কত চিন্তা হচ্ছে.
_চাচি! তোমরা কি ভেবেছিলে আমি মারা গেছি? এতো নেগেটিভ চিন্তাভাবনা কেন তোমাদের বলোতো!
—আচ্ছা তুই ঠিক আছিস, এইটাই অনেক। কিছু খাওয়াদাওয়া করে নে,কেমন! নিজের খেয়াল রাখিস।
_আচ্ছা,তোমরাও নিজেদের খেয়াল রেখো।
আমি কথা বলা শেষ করে দেখি হায়াত ঘুম থেকে উঠে গেছে, ও নিজেও আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হয়ত ও নিজেও ভাবেনি যে আমি বেচে থাকব!
আমি ওর মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বললাম..
_এই যে মিস্টার! কি দেখেন অমন করে?

আমার কথা শেষ হতে না হতেই বুঝতে পারলাম যে, আমাদের দরজায় কেউ জোরেশোরে নক করছে। বুঝলাম বাইরের মানুষগুলোরও অনেক কৌতুহল আমাকে নিয়ে, আদৌ আমি বেচে আছি কিনা! ব্যাপারটা আমার কাছে খুব মজার লাগছে।
মুখে মিষ্টি একটা হাসি এনে দরজা খুলে দিতেই আমার শশুর-শাশুড়িসহ আরো অনেকগুলো লোক হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল, আমাকে দেখে সবাই অবাক! সবাই যেন ধরেই নিয়েছিল যে, আগের বউটার মতো আমিও মারা যাব!
পরিবেশটা একটু শান্ত হতেই একেএকে আমাদের রুম থেকে সবাই চলে গেল।হায়াতের বড় আপু আমাকে রেডি হয়ে নাস্তা করতে যেতে বলে গেল।

আমি হায়াতকে রাগানোর জন্য বললাম…
_আপনি কি জানেন আপনাকে বিয়ে করেছি বলে আজ রাতে আমি মারা যাব?
হায়াত বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালো, তারপর কিছুটা ভারি কন্ঠে বলতে লাগল…
_প্লিজ ইমি, এমন কথা আর বলোনা, জানো আজ রাতে আমি কতটা ভয়ে ছিলাম, যদি তোমার কিছু হয়ে যেত! শেষরাতের দিকে আমি একটু ঘুমাইছি,আর সারারাত জেগে ছিলাম!
_ওহ! আচ্ছা, তাহলে আজ রাতে কিন্তু বেশি করে পাহারা দিতে হবে।
_কি বলছ আবোলতাবোল!
_আবোলতাবোল না।আপনার আগের বউটা প্রথম ছিল, তাই ও বিয়ের প্রথম রাতেই মারা গেছে। কিন্তু আমিতো আপনার দ্বিতীয় বউ,তাই দ্বিতীয় রাতে মারা যাব।
আমি কথাগুলো বলে হেসেই যাচ্ছি, কিন্তু হায়াতের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ দেখে বললাম..
_কি ব্যাপার! আপনি কি এখনো এইসব কু-সংস্কার এ বিশ্বাস করেন?
_না মানে, আচ্ছা চলো, খেতে চলো, মা ডাকছে।

আমিও আর কিছু না বলে খেতে চলে গেলাম। আসলে এই বিয়েটা না করলে আমি হয়ত শান্তি পেতাম না, এমন একটা কু-সংস্কার আমি কি করে বিশ্বাস করতাম! আর হায়াত ছেলে হিসেবেও খারাপ নয়! হয়ত প্রথম বউটা মারা গেছে বলে ও আমাকে একটু বেশিই ভালবাসে, আর ওর পরিবারের সবাইও আমাকে খুব ভালবাসে, ভালবাসার চাইতে মুল্যবান আর কি হতে পারে! সত্যি আমি ভাগ্যবতী এমন একটা স্বামী আর সংসার পেয়ে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত