ভ্রম

ভ্রম

মাথাটা ঝিম ধরে আছে, বারান্দায় এসে চেয়ারে আরাম করে হেলান দিয়ে বসলাম। হালকা বাতাস বইছে, রাত প্রায় তিনটা বাজে। সিগারেটটা ধরিয়ে চোখ বুজলাম একটু…

ইরা আজকেও সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছিলো। ছাদের রেলিং এর একদম কিনারে উঠে দাঁড়িয়ে লাফ দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে আমি ওরে জাপটে ধরে টেনে আনতে গিয়ে উল্টে পরে আমিই অনেক ইনজুরড। মাথার পেছনের দিকটা ফেটে রক্ত বের হচ্ছিলো। কোন রকম উঠে টাসিয়ে একটা থাপ্পড় লাগালাম। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে। আর পারছিনা আমি নিতে, পারছিনা মানে পারছিই না। মাঝে মাঝে আমারো ইচ্ছে হয় মরে যাই। এই যন্ত্রণার তীব্রতা কতটুকু তা আমি জানি শুধু। পূর্বে কেউ এমনটা ভোগ করেছে বলে আজো আমি শুনিনি। এ নিয়ে চারবার মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে আনলাম ইরাকে। বিভিন্ন সিকিউরড থাকা সত্ত্বেও একটু সুযোগ পেলেই সে সুইসাইড করার চেষ্টা করে। আপাতত ওর কোন ব্রুক্ষেপ নাই, প্রতিবারের ন্যায় এখনো দাঁড়িয়ে সুইসাইড নোটটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়ে রুমে চলে গেল। যেটাতে স্পষ্ট করে লিখা থাকে “আমার মৃত্যুর জন্য রবিন দায়ী।”

জীবন সিনেমাকেও অনেক সময় হার মানিয়ে অনেক উর্ধ্বে চলে যায়। কোথায় টেনে নিয়ে দাঁড় করায় তা হয়তো এই গল্পটা শুনলে অনুধাবন করা যাবে।

ইরা আর আমার বিয়ের আজ তিন বছর হলো, এই বিয়েটা না ছিলো লাভ ম্যারেজ না ছিলো অ্যারেঞ্জ। এটা একান্তই আমার ইচ্ছেতে হয়েছে। ইরার এই বিয়েতে সম্মতি ছিলোনা। ইরা এটাই জানে যে; আমি ওকে পেতে পরিকল্পনা করে ফাহিমকে হত্যা করে দ্যান তাকে বিয়ে করি। ওর চোখে আমি একটা খুনি, ফাহিমকে আমি লুকিয়ে ফেলেছি ওর কাছ থেকে চিরতরে।

ফাহিম ছিলো ওর স্বপ্নের মানুষ। আমার মতে ফাহিম ওর মস্তিষ্কের নিউরনে বসবাসকারী একটা চরিত্র ছাড়া কিছুই না। ও সাইকো হয়ে গেছে।

সামান্য একটা ভুলের কারণে আজ আমি কঠিন মাশুল গুনছি। আমি যদি জানতাম আমার কারণে ইরা এরকম অসুস্থ হয়ে যাবে তাহলে হয়তো আজকের এই স্টোরিটাও লিখতে বসতাম না। বড়জোর পাঠকের তালিকায় স্বীয়মান থাকতাম।

২০১২ সালে আমার লিখা একটা ফিকশন বইমেলায় প্রকাশিত হয়, যেটার শিরোনাম ছিল “অপরাহ্নের ক্রন্দন” বইটা ছিলো যৌথ লেখকদের লিখা নিয়ে একটা বই। জাস্ট আমার লিখা একটাই ছিলো, বাকিটা অন্যান্যদের। তখন ফেসবুকে কিংবা ব্লগে লিখার অভ্যাস ছিলোনা আমার। লিখা ডাকযোগে প্রেরণ করা লাগতো। ইমেইল করার সুযোগও ছিলো বাট ডাকযোগের প্রেরণ করাটা গ্রহণযোগ্যতা পেতো অনেক।

“অপরাহ্নের ক্রন্দন” ফিকশনটি ছিলো গ্রামের একটা অনাথ ছেলের লাইফ স্টোরি নিয়ে, তার বেড়ে উঠার কাহিনী যেখানে সে নানান প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এসে যখন হ্যাপি লাইফ লিড করবে তখন জানতে পেরেছিলো সে অনাথ ছিলো না। তারো একটা ঠিকানা আছে। কিন্তু ঠিকানা বের করে যখন জানতে পারে ততক্ষণে তার বাবা মা আর পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। এবং একটা সময় তার বাবা মার মৃত্যুর কারণ জানতে পারে; গ্রামের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হাতে তার মা ধর্ষিত হতে হয় এবং হত্যার শিকার হয়েছিলো তার বাবার সামনেই। পরে লজ্জায় তার বাবাও আত্মহত্যা করেন। এভাবেই একটার পর একটা নোংরা রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছিল। তাকে অনাথ বানানোর পেছনের সব গল্প খুঁজতে নেমেছিলো। এবং একের পর এক ভয়ানক তথ্যগুলো বের হয়ে আসছিলো। জীবনের চরম শীর্ষস্থানে ফাইট করে অধিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তার মনে বিন্দু পরিমাণ সুখ ছিলোনা। পরের কাহিনীগুলো ছিলো কঠিন থেকে কঠিনতর। একটা মানুষের জীবনের অস্বাভাবিকভাবে ঘটে যাওয়া কিছু উলটপালট স্ট্রেস নিয়েই লিখা ছিলো। মূলত আমার টার্গেট ছিলো গ্রাম্য এলাকার বিচ্ছিরি আধিপত্য বিস্তার আর ফলাফল একটা থ্রিলার স্টোরির মাধ্যমে উপস্থাপন করা। এরকমই ছিলো প্লট’টি। কতটা সফল ছিলাম সেটা আজ ভাবতেও পারছিনা।

বইতে আমার ইমেইল এড্রেস দেয়া ছিলো। ফিকশনটি প্রকাশ হওয়ার অনেকদিন পর ফেসবুকে একটা ফিমেল আইডি থেকে রিকোয়েস্ট আসে। আইডিয়াটার নাম ছিলো “অপরাহ্নের ক্রন্দন” এক্সেপ্ট করার পর একদিন;

– হ্যালো
– হাই
– আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো। সময় আছে?
– জ্বি বলুন।
– আপনি কি “অপরাহ্নের ক্রন্দন” গল্পটির লেখক?
– জ্বি
– ফাইনালি আপনাকে খুঁজে পেলাম! আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না ভাইয়া আমি আপনাকে খুঁজে খুঁজে কতটা হয়রান। আমার ফেসবুক আইডি ছিলোনা আপনার জন্য খুললাম। ইমেইল তো চেক করেন না। শেষমেশ ইমেইল আইডি দিয়ে সার্চ করে আপনাকে পেলাম।
– অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
– মোস্ট ওয়েলকাম। আচ্ছা আপনার লিখাটি পড়ার পর অনেকগুলো প্রশ্ন জেগেছে মনে। যেসব না জানলে আমি পাগল হয়ে যাবো নয়তো মরে যাবো। প্লিজ ভাইয়া আমার প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতেই হবে।

– লিখা নিয়ে যা যা প্রশ্ন জাগার কথা তা গল্পের মাঝেই উত্তর পেয়ে যাওয়ার কথা। তাও বিশেষ কিছু প্রশ্নের উত্তর একান্তই সিক্রেট থাকে লেখকদের মাঝে। যা প্রকাশ করতে মানা। মানা বলতে এসব পাঠকের না জানলেও চলবে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রশ্নগুলো করতে চাইলে করতে পারেন।

– ভাইয়া, ব্যাপারটা কঠিন করবেন না প্লিজ! আমার সবটা প্রশ্নের উত্তর চাই। কোন প্রশ্ন আপনি লুকোতে পারবেন না। আমি আর কাউকে শেয়ার করবো না। প্লিজ!!!
– প্রশ্নগুলো কি?
– গল্পটা পড়ে আমার মনে হয়নি এটা শুধুমাত্র কাল্পনিক। এটা চরম নিষ্ঠুর একটা বাস্তব জীবনের গল্প। এটা আপনার স্বচক্ষের সামনে ঘটমান ছিলো। আপনি আমাকে বলেন গল্পের ছেলেটি কি আপনি? নাকি আপনার পরিচিত কেউ? এট অ্যানি কস্ট আমি উনার সাথে দেখা করতে চাই। আমি যেভাবেই হোক উনার কাছাকাছি থাকতে চাই। কেনো যেনো উনাকে আমি কল্পনায় এঁকে ফেলেছি। আমি উনার সমস্ত স্ট্রেস ভুলিয়ে নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাই। ধরে নেন এটা আমার জন্য একটা এক্সপেরিম্যান্ট। আপনি সুযোগ করে দেন। তা না হলে মরে যাবো আমি।

– এটা নিয়ে এতো সিরিয়াস হচ্ছেন ক্যান আপু? এটা শুধুমাত্র একটা গল্প হিসেবেই নেন। আর কিছু খুঁজতে আসবেন না দয়া করে। আর আমার ফ্যামিলি আছে আমি অনাথ না। এটা আমার জীবনের গল্প না। গল্প সব আমার জীবনেরই হতে হবে এরকম নিয়ম বাঁধা নেই। এর বাইরে আর কিছু বলা সম্ভব নয়। ভালো থাকবেন।

– না ভাইয়া প্লিজ আপনি বুঝতে পারছেন না! আমি আজকে একমাস যাবত ঘুমুতে পারছিনা এটা পড়ে। আমি অনেক গল্প পড়েছি জীবনে কিন্তু এটাতে কিছু একটা ছিলো যার জন্য আমার মনে কেমন একটা প্রতিক্রিয়া, কেমন অনুভূতি! আমি বুঝাতে পারছি না ভাইয়া প্লিজ আমাকে অবহেলা করবেন না। আপনি জাস্ট মিস্টার ফাহিমের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। এতটুকু করেন ব্যাস আর কিচ্ছু চাইনা।

ঘটনাটির শুরু এভাবেই ছিলো। ইরা আমাকে এমন কোন মূহুর্ত ছিলোনা যে নক করতো না। আমি নানান ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ব্যার্থ হই। তার মতে “অপরাহ্নের ক্রন্দন” গল্পে ফাহিম চরিত্রটি বাস্তব।

আমি এটার উপর ভিত্তি করে মিথ্যে বানোয়াট অনেকরকম বুঝ দেয়ার ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়েছিলাম। একটা সময় ডিসিশন নিলাম ওর সাথে ফোনে কথা বলে ব্যাপারটা বুঝাবো। একদিন না পেরে বললাম আপনার সেল নাম্বার দেন কল দিচ্ছি। জ্বি, পরে আমার আলাদা একটা নাম্বার ওপেন করে প্রায় এক ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট কথা বলেছিলাম। বাচ্চা মেয়ে। গলায় একটা কান্না আটকানো থাকলে যেভাবে মানুষ কথা বলে সেভাবে কথা বলছিলো। আমি পারিনি বুঝাতে। শেষমেশ সেকেন্ড যে ডিসিশনটা নিয়েছিলাম তা ছিলো জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ডিসিশন।

আমি বলেছিলাম ফাহিম নামের চরিত্রটি বাস্তব। আসলে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। বলেছিলাম সে আমার বন্ধু। একটা মুমূর্ষু রোগী যখন হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে, দেহে প্রাণের সঞ্চার ঘটে ঠিক সেভাবেই যেন ইরা প্রাণ ফিরে পেয়েছিলো এই কথাটি শুনে।
একটা ভূয়া আইডি খুলেছিলাম ফাহিম নামে। এটাই আমার ফার্স্ট ফেক আইডি, তাও ছেলের নামে আইডি। আমি কিছুদিন ইরাকে এটা সেটা বুঝিয়ে সময় নিয়ে ফেক আইডিটা কিছু স্টাবলিশ করি, যদিও ফেসবুকে ইরা এতো দক্ষ না তাও। পরে ওই আইডি থেকেই ইরার সাথে আমার কথোপকথন শুরু হয়। দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা চ্যাটিংএ যোগাযোগ হতো। ইরা মেয়েটা এতো পাগলী হবে আমি কখনো জানতাম না। মাঝে মাঝে ব্লক করে ফেলতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু যেদিন ইরা তার ছবি সেন্ড করলো সেদিন আমি আর আমার মাঝে ছিলাম না। এতো মায়াবী চেহারা নিয়ে খুব কম মানুষ জন্ম নেয়। ইরা তখন ক্লাস টেনে পড়তো। ইরার চোখ আর চুলগুলো ছিলো আমার জীবনে প্রেমে পড়ার প্রথম অনুভূতি। আর পারিনি সত্যের মাঝে নিজেকে আটকে রাখতে। সেদিন থেকেই আমি ফাহিম হয়ে যাই। কন্ঠের স্বর পরিবর্তন করে কথা বলা। আর নিজের ছবি বলতে একটা ছবিই দিয়েছিলাম গুগল থেকে ডাউনলোড করে তাও অনেকটা অস্পষ্ট। ইরার সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল সে ফাহিমকে পেয়েছে। আর তার জীবন এরকম একটা ছেলের সাথেই কাটাতে চায়, এখানেই সার্থকতা।

এভাবেই একদিন সম্পর্কটা একরকম হয়ে যায়। ইরার চোখে আমিই তার সব। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে টেনে নিচ্ছিলাম সম্পর্কটা তা জানতাম না। অনেক স্বপ্ন সাজিয়েছিলো ইরা আমাকে নিয়ে। বারবার বলতো তুমি কখনো নিজেকে একা ভাববা না ফাহিম আমি সারাজীবন তোমার থাকবো। মাঝে মাঝে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে সব সত্য দেখা করে বলে ফেললে হয়তো ইরা মেনে নিবে। কিছুদিন পর হঠাৎ আব্বুর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। আব্বুকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি করছিলাম। ইরাকে আমি সময় দিতে পারিনি, আমার মাথা ঠিক ছিলোনা। ফোন সুইচড অফ করে রেখেছিলাম।

পরে ইরাকে রাগের মাথায় বুঝাতে চেষ্টা করছিলাম “আমার ইমপরট্যান্ট কিছু কাজ পরে গেছে। তুমি একটু বুঝো আমাকে! এরকম করছো ক্যানো?” সে ভাবতো হয়তো আমার লাইফে আর কেউ চলে এসেছে। ইচ্ছা করতো বলে ফেলি “আমি ফাহিম না আমি রবিন, ফাহিম নামের কেউ নেই এখানে।” আমি জানি ইরার বয়সটা আবেগের, সহ্য করতাম।

আমি পারছিলাম না দুটো দিক আর একটা মিথ্যা গল্প সামলে যেতে, ইরা জানতো আমার বাবা মা কেউ নেই। একদিন হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে একটা কল আসে, কলটা ইরার বাবার ছিলো;
– ফাহিম বলছেন? আমি ইরার বাবা।
– জ্বি, আঙ্কেল আসসালামুলাইকুম।
– ওয়াআলাইকুম… বাবা আপনি কোথায়? আমার মেয়েটা হসপিটালে ভর্তি প্লিজ আপনি আসেন। ও সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে।

সেবার আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ওর প্রথম আত্মহত্যার চেষ্টা। আমার মাথায় যেনো বাজ পড়লো! আমার কি করা উচিত আমি বুঝতে পারছিলাম না। আব্বুর অবস্থা একটু উন্নত হওয়ায় সাথেসাথে বড় ভাইকে আব্বুর কাছে রেখে সিলেট থেকে রওনা হলাম সিরাজগঞ্জ। পৌঁছে হসপিটালে গিয়ে প্রথম ইরাকে দেখলাম হসপিটালের বেডে। তখনো ওর জ্ঞান ফেরেনি। ইরার একটা মামা আমাকে মারতে আসছিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম সবার মন মানসিকতা। সেবার আমি সবাইকে সব সত্যটা বলে ফেলি। পরে সবাই আমাকে বিশ্বাস করে। তারপরে যা হলো সেটা আরো ভয়ানক; ইরার জ্ঞান ফেরার পর আমাকে দেখে বলতেছিলো “আপনি এখানে ক্যানো? আমার ফাহিম কোথায়?”

আমি ওর মাথায় হাত রেখে বুঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, ও এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে শাউডলি বলছিলো “ডোন্ট টাচ মি, ফাহিম কোথায়?”

তারপর আমি সিরাজগঞ্জ দু’দিন থেকেছিলাম। কোন সুরাহা করতে পারেনি। ফাহিম যে আমার তৈরি একটা চরিত্র মাত্র তা আমি আর বুঝাতে পারিনি। তার মতে আমি কিছু একটা করছি বলে ফাহিম এমনটা করছে। এবং তার ফ্যামিলিও আমার সাথে সংশ্লিষ্ট এখন। যখন সব কিছুর প্রমান দেখালাম তখন সে আরো অবিশ্বাস করা শুরু করলো। ফোনে আমি আমার কন্ঠ শোনালাম, সে এটাও অবিশ্বাস করছে। সবকিছুর জন্য আমাকেই দায়ী করলো। প্রকৃত অর্থে আমিই ছিলাম দায়ী। আস্তে আস্তে এভাবেই ইরা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল দিন তো দিন। পাগলামি আর স্বাভাবিক ছিলো না। আমার লিখা গল্পটাই একটা সময় আমায় এমন একটা অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিলো যে, একটা মুহূর্ত আমি শান্তিতে ছিলামনা। আমার লিখা চরিত্রগুলোকেই খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছিলাম। গুগল থেকে ডাউনলোড করা ছবিটারো আর অস্তিত্ব পাইনি। পরে আর কিছু না ভেবে ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই। আজ একটা প্রাণ আমার কারণে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে এটা কীভাবে মেনে নিবো! আমি ইরার ফ্যামিলিকে রিকোয়েস্ট করে ওকে বিয়ে করি। ইরাকে কথা দিয়েছিলাম ওর ফাহিমকে খুঁজে পাবে একদিন। আমিই খুঁজে দিবো, আপাতত নামমাত্র বিয়েটা যেনো ও করে আমায়। ভেবেছিলাম বিয়ের পর বুঝাতে পারবো। না তাও পারিনি, কাছে গেলেই বলতো; “পিজিক্যাল করার ধান্দা করছেন? বিয়ে করেছেন তা তো দাবী করবেন’ই। আসেন করেন, আমার সবকিছুই তো শেষ করে দিলেন, এটা আর বাকি থাকবে ক্যান!”

আমি পারিনি, আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম। এভাবে আজ তিনটা বছর আমি ইরাকে নিয়ে সংসার করছি। এটাকে সংসার বলা যায় কিনা জানিনা। একজন সাইক্রিয়াস্টিটের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। উনার বক্তব্য আর অন্য সব স্বাভাবিক সান্ত্বনার মতোই ছিলো;
“মি. রবিন, মানুষ মাঝে মাঝে নিজ থেকেই নিজের মধ্যে একটা সত্ত্বা তৈরি করে ফেলে। যার জন্য সে সব কিছুই করতে পারে। কল্পনায় কথা বলে কল্পনায় হাসে কল্পনায় কাঁদে। ইভেন এই সত্ত্বাটার জন্য সুইসাইডও করতে পারে, অস্বাভাবিক কিছু না। এর মধ্যে কিছু পেশেন্ট আছে যাদের স্বাভাবিক ম্যান্টালিটি গ্রথ করার আগেই তাদের মধ্যে এই সত্ত্বাটার জন্ম নেয়। শেষমেশ স্বাভাবিক ম্যান্টালিটি গ্রথ করার আর স্কোপ হয়না। সে বৃদ্ধ অবধি এভাবেই থাকতে পারে। মিসেস ইরা এদেরই একজন। যদি তার কল্পনার বাস্তবতা ঘটানো সম্ভব হয় তবে এটা স্বাভাবিক হয়ে যায় অনেকটা। সাধারন আর স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করেন। কামব্যাক হলেও হতে পারে, তবে শিওর দিতে পারছিনা। ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসেন।”

রুমে এসে বিছানার পাশে বসলাম ইরার কাছে। রাগে সামনের দিকে চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে। পলক যেনো ফেলছেনা। ওর হাতটা চেপে ধরে অনেক কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে আবার প্রথম থেকে ইরাকে বুঝাতে। ঠিক আগের অবস্থাটায় ফিরিয়ে নিয়ে বুঝাতে। আমি সবকিছু সিরিয়ালি ইনডেক্স করেছি। একদম ফিকশনটা লিখার সময়টা থেকে বর্তমান সময়টা পর্যন্ত আমি ইরাকে বুঝাবো। লিখালিখি তো সে কবেই ছেড়ে দিয়েছি। আমার এই দেহে প্রাণ থাকা অবধি আমি চেষ্টা করবো আমার ইরাকে স্বাভাবিক করতে।

কাঁপা কাঁপা হাতে ওর হাতটা ধরলাম দুহাতে চেপে; হাতের কবজিটা কেমন নিস্তেজ আর ভেজা ভেজা অনুভূত হলো। হাতটা ছাড়িয়ে আর দেখার সাহস পাচ্ছিনা। পিচ্ছিল একটা পদার্থ আমার হাত গড়িয়ে পরছে। আমার পৃথিবীটা ঘুরছে। বুঝে গেলাম আমি হেরে যাচ্ছি।

ঝটপট চোখটা খুললাম! লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম! সিগারেট পুড়ে ফিল্টারে ধরে নিভে গেছে, উফফ! কিসব প্লট ভাবছি আমি! মাথায় কিচ্ছু আসছে না। কী লিখবো ইদানিং মাথায় আসে না। ঘুরেফিরে কাউকে না কাউকে মেরেই ফেলছি।
চেয়ার থেকে উঠে সরে এসে বাইরে তাকিয়ে দেখি সুন্দর একটা সকাল। পাখির কিচিরমিচির শব্দ। দূরের মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি। আপাতত সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করাই শ্রেয়, লিখালিখির জন্য প্লট চিন্তা করতে থাকলে মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে দিয়ে বোধহয় আর হবে না ওসব। এটলিস্ট এটা তাহলে শুনতে হবেনা আর; “ভাইয়া আপনি কিভাবে লেখেন? এটা সত্য নাকি?”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত