সত্যি মিথ্যা

সত্যি মিথ্যা

বিখ্যাত হবার মজা যেমন, জ্বালাও কম না! সেই সব জ্বালা সামলে পড়াশুনা করা তাতিয়ানার বেশ মুস্কিল হচ্ছিল। তন্ময়ও যেন বিরক্ত হচ্ছিল ওদের পড়াশুনার ব্যাঘাতে। তাতিয়ানা ফিজিক্স নিয়েই পড়াশুনা চালাল, চৈতালি ডাক্তার হল। তাতিয়ানা খুব খুশি, “ডাকলেই পাওয়া যাবে এমন একজন ডাক্তার তো আমার থাকল!”

চৈতালী একটু বিমর্ষ হল যেন, “বাবা বলছে ইউ-কেতে যেতে – এম আর সি পি করে নিতে!”

তাতিয়ানা ওকে উৎসাহ দেয়, “তো চলে যা! মাত্র দু’টো তো বছর! তারপরে বিদেশে সেটলড হবার ইচ্ছা নেই তো তোর?”

“কক্ষনো না! আমি ঠিক করেছি – পোড়া হোক আর সোনার হোক, এই দেশে জন্মেছি, এই দেশেই মরব!”

তাতিয়ানা হাতটা চিৎ করে বাড়িয়ে ধরে, চৈতালি ওর হাতটাতে চাপড় মেরে হাতটা জড়িয়ে ধরে, খিলখিল করে হেসে ফেলে দু’জনেই।

অনিমেষবাবু ছেলেমেয়ের পড়াশুনার ব্যাপারে কোনওদিন তাঁর মতকে জোর করে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেননি। তাতিয়ানা এম এস সি করার পরে একটু দ্বিধায় পড়ল। ওর সামনে বিদেশে গিয়ে গবেষণার সুযোগ একেবারে খোলা। কিন্তু ও বুঝতে পারছিল – বাবার তা ইচ্ছা না। ওর নিজেরও কি তা ইচ্ছা নাকি? তবে ওর ইচ্ছা মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করে, তার সুযোগ তো নাসার থেকে বেশী আর কোথাও পাবে না। নাসার দরজা তো ওর জন্য খোলাই আছে! তবু ও যেন একটু দ্বিধায় পড়ে। বাবা-মার বয়েস বাড়ছে। তারা কিছু না বললেও ও বোঝে – তারা চায় ও তাদের কাছেই থাকুক।

তন্ময় বাড়িতেই আছে, সুযোগ পেলেও কোথাও যায় নি। বোস ইন্সটিটিউটে একটা গবেষণা সেরে সায়েন্স কলেজে পড়ায়, বিয়ে করার নামও করে না। তাই বাবা-মা তো চাইবেই একটা মেয়ে অন্তত ঘরে থাকুক! তাদেরও তো বয়েস হচ্ছে!

একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে ওর দ্বিধা আরও বেড়ে গেল। এক বক্তা বললেন – বর্তমান মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন কী? তা হল ছেলেমেয়েকে বিদেশে পাঠিয়ে একলা একটা ঘরে থেকে মরে যাওয়া। না, ওর বাবা-মাকে ও সেই দলে কিছুতেই পড়তে দেবে না।

চৈতালি ওর হাতে হাত রেখে যতই কথা দিক, ইউ-কেতে গিয়ে ওখানকার এত প্রশংসা করে যে তাতিয়ানার বুঝতে অসুবিধা হয় না – ও ওখানেই স্থায়ী ডেরা করার দিকে যাচ্ছে। ওর পিসিও যখন তখন এদেশের নিন্দা আর ওদেশের প্রশংসা করে, তাতিয়ানার শুনতে কেমন যেন লাগে! মানুষগুলো এ রকম পালটে যায় কী করে? যেখানে জন্ম নিল, অন্নজল নিয়ে বড়ো হল, সেই দেশকেই এত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কী করে?

তন্ময় কিন্তু ওর অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের চর্চাকে কেমন যেন একটু বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করেছে। ও বুঝতে পারে – দাদা চায় না যে সে এই পথে আর এগিয়ে যায়। কিন্তু কেন যে দাদার আপত্তি তা ও বোঝে না।

বাবা-মা কোনওদিন ওদের ছাড়া কোথাও বেড়াতে যায় না। বাবার এক বন্ধু অহীনকাকু বেঙ্গালুরুতে আছে, পড়ে পা ভেঙেছে, বাবাকে খুব দেখতে চাইছে। তাতিয়ানা জোর করেই বাবা-মাকে পাঠাল, “যাও, ঘুরে এস! বেঙ্গালুরু ছাড়াও মাইসোরে ভালো করে দেখে এস কী কী দেখার আছে। সব ভালো করে জেনে আসবে, আমি আর দাদা পরে যাব!” ওর ছোটোবেলায় একবার অহীনকাকু ওদের বাড়ি এসে ওর সাথে কত বকবক করেছিলেন, কত খেলা খেলেছিলেন! যাবার আগে বাবাকে বলেছিলেন, “অনিমেষ, তুই খুব লাকি যে তোর একটা মেয়ে আছে! আমার শুধু একটা ছেলে, সব থেকেও ঘরটা যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে!” সে’দিন থেকেই অহীনকাকুকে তাতিয়ানা খুব পছন্দ করে।

বাড়িতে এখন ওদের আলাদা ঘর আছে, তবুও ওদের সবারই অভ্যাস ড্রইং রুমে একসাথে বেশিরভাগ সময় কাটানো। তাই দাদার সাথে তাতিয়ানার মাঝে মাঝে ঝগড়া লাগলেও তা বাবা-মা’র মধ্যস্থতায় বেশীদুর এগোতে পারে না। ফাঁকা বাড়িতে দাদার সাথে বেশ ঝগড়া লেগে গেল তাতিয়ানার, তাতিয়ানা না রাগলেও ও বুঝতে পারে দাদা বেশ রেগেছে। ও দাদাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে, “দাদা, তুইই তো আমাকে ওই মেসেজটা নিয়ে গবেষণা করতে কত উৎসাহ দিয়েছিলি! এখন যখন আমি সেই পথে এগোতে চাইছি, তুই বাধা দিচ্ছিস কেন?”

তন্ময় আরো রেগে যায়, “আমি তোকে উৎসাহ দিয়েছিলাম তার কারণ ছিল, এখন বারণ করছি তারও কারণ আছে!”

“কী কারণ বল না!”

“বলা যাবে না। তুই ভালোভাবে নিতে পারবি না!”

“দাদা, এটা ঠিক না। তুইই কিন্তু ছোটবেলা থেকে আমাকে শিখিয়েছিলি – সব ব্যাপারে অকপট থাকতে, খোলাখুলি সব কথা আলোচনা করতে!”

এবার গুম খেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দুম করে বলে ফেলে তন্ময়, “ওটা একটা মজার ধাপ্পা ছিল।”

“কী বলছিস দাদা!” আকাশ থেকে যেন পড়ে তাতিয়ানা।

“ঠিকই বলছি, ধাপ্পা আর মজা যাই বলিস – ওটা আমারই সৃষ্টি।”

কোমরে হাত দেয় তাতিয়ানা, “মনে হচ্ছে এখন তুই আমাকে ধাপ্পা দিচ্ছিস!”

এবার রেগে যায় তন্ময়, “এখন না, তখনই ধাপ্পা দিয়েছি।”

তাতিয়ানা দাদাকে চেনে, ও বোঝে – দাদা মিথ্যা বলছে না। তবু ওর বিস্ময় কাটে না, “কিন্তু কেন?”

“সে তুই বুঝবি না!” হাত নাড়ে তন্ময়।

“দাদা, তুইই তো বলিস – বোঝানোর মতো করে বললে সবাই বুঝতে পারে। আমি যাতে বুঝি সেইভাবেই আমাকে বোঝা!”

খানিক চুপ থেকে বলতে শুরু করে তন্ময়, “আমাদের বাড়িটা দোতলা হবার পরে আমি সব পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে যাই বাবার একটা মোটা খাতা আর ডায়েরি। খাতাটার উপরে লেখা ছিল – আমি যা পারলাম না আমার কোনও উত্তরসূরী যদি তা পারে তার জন্যেই এটা রাখলাম। আমি দু’টোই মন দিয়ে পড়ে ফেললাম, জানলাম বাবার খুব ইচ্ছা ছিল অ্যাস্ট্রোফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করে। সংসারের চাপে চাকরি নিলেও বাবার সেই ইচ্ছা মরেনি। বাবা একটা কোড তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছিল, অন্য গ্রহ বা গ্যালাক্সিতে কোনও বুদ্ধিমান জীব থাকলে তাদের কাছে কোডটা পাঠালে তারা যে ভাষাভাষীই হোক না কেন তারা যেন কোডটার পাঠোদ্ধার করতে পারে। তুই শুনলে অবাক হবি ওই চব্বিশটার তত্ত্ব বাবা বুঝে ফেলেছিল।

তুই তখন বেশ ছোটো, আমি একটু বোঝবার মতো বড়ো হয়েছি। বাবা আমাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে তারা দেখাত আর বলত – ওখানেও আমাদের মতো হয়তো কেউ আছে, শুধু আমরা যোগাযোগ করতে পারছি না। তখন আমাদের দেশে কম্পিউটার-মোবাইল ফোনের যুগ আসে নি, কিন্তু স্যাটেলাইট কানেকশন সবে চালু হয়েছে। তাই বাবার পক্ষে মহাকাশে কোনও বার্তা পাঠানো অসম্ভব ছিল যেটা নাসার কাছে অসম্ভব ছিল না। ডায়েরিটা পড়ে জানলাম বাবা তার দুই একটা নমুনা নাসার কাছেও পাঠিয়েছিল – কিন্তু তারা পাত্তা দেয় নি। সায়েন্স কংগ্রেসে বাবা এই কথা তোলায় তাকে অপমানিতও হতে হয়। সবটা পড়ে আমার খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল – ভাবলাম বাবার এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই হবে। তাই আমি ওই কোডটা তৈরি করি – মানে বাবার থেকে কিছুটা টুকলি করে বাকিটা নিজে বানাই। আমার কাছে মহাশূন্যে পাঠানোর ব্যবস্থা থাকুক আর না থাকুক ইন্টারনেট কানেকশন আছে আর নিজের আইডেন্টিটি গোপন রেখে কোডটা ছড়িয়ে দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন হয় নি। আরও কয়েকজনের সাথে কোডটা মেসেজ করে তোর কাছেও পাঠাই যাতে আমাকে কেউ সন্দেহ না করে। দেখ, তাতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। কিন্তু বাবার অত কষ্টে করা গবেষণাকে কেউ মূল্য দেয় নি। তাই এখন আমি চাই না – তুই একটা ফালতু জিনিসের পিছনে ঘুরে তোর জীবনটা বরবাদ করিস।”

“দাদা, বাবা কিন্তু জানলে –”

“বাবা জানে, আমি বলেছি।”

“বাবা বাধা দেয় নি?”

“না। হেসে বলেছে – তোর যখন ইচ্ছা হচ্ছে কর। দেখ না, কী হয়! কিছু ভালো ফলও তো হতে পারে!”

তাতিয়ানা ওর কাঁধে হাত রাখে, “দাদা, তুই বাবাকে খুব ভালোবাসিস, না?”

“তোকেও। তাই আমি তোর জীবনকে একটা মিথ্যের পিছনে ছুটতে দিতে চাই না।” ধরা গলায় বলে তন্ময়।

“জানি দাদা। তোর মতো অতটা না হলেও – আমিও বাবাকে ভালোবাসি আর আমার দাদাকেও। তোদের অমতে আমি কিছু করব না, কথা দিচ্ছি। তবে আমি যে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সকে ভালোবেসে ফেলেছি। এই কোডের ব্যাপারটা বাদ দিয়েও তো আমি এই বিষয়ে কাজ করতে পারি।”

“একটু বাস্তবটাকে বোঝ, তাঁতি। তোর কোডটা নিয়ে যা নাম হয়েছে তাতে কি তা সম্ভব?”

কী বলবে ভেবে পায় না তাতিয়ানা – কথাটা তো সত্যিই। ছোটোবেলা দাদা ‘তাঁতি’ বলে ডাকলে ও খুব রেগে যেত। এখন বোঝে দাদা যখন ওর প্রতি ভীষণ নরম হয় তখনই ওকে তাঁতি বলে ডাকে – আর তাই দাদা তাঁতি ডাকলে তাতিয়ানাও নরম হয়ে যায়।

ছাদে হঠাৎ একটা কী রকম অদ্ভুত শব্দ হল। আজকাল এই এলাকাতে চোর বদমাইসের উপদ্রব শুরু হয়েছে। তন্ময় চট করে উঠে দাঁড়ায়, “দাঁড়া, দেখে আসি কীসের শব্দ!”

“আমিও যাই চল!” দাদাকে একলা ছাড়ে না তাতিয়ানা।

ছাদের দরজা খুলেই দাঁড়িয়ে পড়লো তন্ময়, “কে, কে তোমরা?”

ততক্ষণে তাতিয়ানাও পাশ থেকে উঁকি মেরেছে, ছাদে দাঁড়িয়ে দু’জন, না না! তিনজন তো! – দু’জন মানুষের মতো দেখতে হলেও যেন মানুষ না, কিছু একটা অন্য রকম – অন্যজন একটু যান্ত্রিক আকৃতির। ওদের একজন হেলতে দুলতে এগিয়ে এল, “আমাদের চেনা উচিত তোমাদের, তোমরা তো গল্পের পোকা! অ্যাং আর গোলাপীবাবুর কথা তো পড়েছ! আর আমাকে চিনতে তো ভুল হবার কথা না! তোমাদের মেসেজ পেয়েই আমরা একসাথে এসেছি। বলো কী সমস্যা তোমাদের, কীসের দুঃখ? তোমরা এত ভালো দুই ভাইবোন – ঝগড়াই বা করছিলে কেন?”

মাথা নীচু করে নড করে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায় দুই ভাইবোন। তন্ময় বলে, “বলতে হবে কেন? হাতটা ধরুন, তবেই তো সব বুঝে যাবেন পিকে সাব! নয়তো গোলাপীবাবু একটু পাকস্থলী খাটিয়ে ভাবুন, কিংবা অ্যাংসাহেব আমাদের টিপেটুপে দেখুন! আসুন, ভিতরে আসুন, বাবা যাবার আগে কিলো দুই গাজর মজুত করে গিয়েছে, আপনার খাবার কোনও অসুবিধা হবে না পিকে সাব। গোলাপীবাবু, আপনার যখন শুধু একাধিক জিভ আছে, দাঁত নেই – আপনি নিশ্চয়ই লিকুইড খাবেন। অ্যাং সাহেব কী খান আমি জানি না, বুঝিও না। তবে বাঙালিরা এখনও অতিথিপরায়ণ, পার্থিব কিছু হলে আমরা জোগাড় করবই! পিকে সাব, আপনি বাংলা শিখলেন কবে? আসার পথে কারও হাত ধরেছিলেন, না অ্যাংসাহেবের কাছে শিখলেন? উনি তো চোদ্দহাজার ভাষা জানেন! তিনজনে এক হলেন কী করে?”

ততক্ষণে পিকে তাতিয়ানার হাত ধরে ফেলেছে, অ্যাং তন্ময়ের সারা শরীর টিপে টিপে দেখতে শুরু করেছে আর গোলাপীবাবু একবার এর আরেকবার ওর মুখের দিকে, কানের গোড়ায় তীক্ষ্ণ নজরে দেখছে আর পেটে হাত বুলোচ্ছে। তারপরে তিনজনে একসাথেই বলে উঠলো, “তোমাদের বাবার যে সম্মান পাওয়া উচিৎ ছিল তা যেন তিনি পান তাই তোমরা চাও। বেশ এস, একটা বুদ্ধি পাকাই – যাতে তা হয়!”

তাতিয়ানা হাসল দাদার দিকে তাকিয়ে, “দাদা, তোর মিথ্যেটা কিন্তু সত্যি হল!”

ফিরে আসার আগেই অনিমেষবাবু ওদের ফোন পেলেন, “বাবা, তোমার নামে নাসা থেকে চিঠি এসেছে, ওখানকার তিনজন অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট তোমার সাথে দেখা করতে আসছেন। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এস।”

আকাশ থেকে পড়েন অনিমেষবাবু, “আমার সাথে? কেন?”

তন্ময় বলে, “মহাকাশে খবর যেতে তো অনেক সময় লাগে, তার আগেই ভুলে যাওয়া তোমার উচিত হয় নি! তোমার বানানো কোডে খবর পেয়েই তো তিন তিনজন ভিনগ্রহী এখন আমাদের অতিথি। তারাও তোমার সাথে দেখা করার জন্য ব্যগ্র।”

সামলাতে কিছুক্ষণ সময় লাগে অনিমেষবাবুর। ততক্ষণে তাতিয়ানা দাদার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়েছে, “বাবা, এবার তো তোমার আর দুঃখ নেই?”

সামান্য শব্দ করে হাসলেন অনিমেষবাবু, “তোদের মতো ছেলেমেয়ে আছে আমার, আমার আর দুঃখ কী রে?”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত