নাঃ, আজকে আর খায়নি তাতিয়ানা। “মা, ইচ্ছে করছে না।” – এমন বলার আর ক্ষমতাও নেই ওর। এখনও মনে পড়ে মা খালি বাংলার বস্তাপচা টেলিসোপগুলো দেখত বলে কত হাসাহাসিই না করত তাতিয়ানা, ওর বাবা অনিমেষও মেয়েকেই প্রশ্রয় দিতেন। তন্ময় (তাতিয়ানার দাদা) অবশ্য মায়ের হয়েই ঝগড়া করত বোনের সাথে। অবশ্য ঝগড়া না বলে খুন্সুটি বলাই ভালো। মা শেষমেশ বিরক্ত হয়ে রিমোট ওদের হাতে দিয়েই চলে যেতেন। “খেলা দেখবার কত বাহানা! শুধু শুধু আমার সিরিয়ালদের দোষ ধরা না! পড়াশোনা নেই তোদের?”
আজ আর সত্যিই লেখাপড়া করতে হয় না তাতিয়ানাকে। সে প্রায় একবছর আগেই ওসব পাঠ চুকেবুকে গেছে তার। কলেজের ভারী ভারী বইগুলো দেখলেও এখন ভয় হয় তার, গায়ে পড়ে যাবে না তো! মাঝে মাঝে হেঁটে বাবার দেওয়া সেই মোবাইল ফোনটা অবধি অবশ্য যায় ও। উঁকি দিয়ে দেখে কোনও নতুন মেসেজ এলো কিনা। বিশেষ কারও আসেনা। বেশির ভাগই নেটওয়ার্ক প্রোভাইডারের নয়ত চৈতালীর। সেই ছোট্টবেলার বন্ধু ও। এখনও শুধু মাঝে মাঝে ওই মেসেজ পাঠায়। ও জানে ফোন করলে তাতিয়ানা আর ধরবে না। অন্তত মেসেজটাতো পড়বে!
“আমি চাইলেই তোকে দেখতে যেতে পারি, কিন্তু তোর দাদা মানা করেছে- বলেছে আমি সহ্য করতে পারব না। তুইও কষ্ট পাবি। কেন তুইই শুধু ওই মেসেজ গুলো পেলি বলত!”
জানে না তাতিয়ানা। শুধু জানে নতুন যেই কোম্পানির মোবাইল ফোন তার বাবা তাকে কিনে দিয়েছিল, সেই ‘sara Beral’ ব্র্যাণ্ডের ফোন আর এক দুটোই বিক্রি হয়েছিল সারা বিশ্বে। প্রথম প্রথম যখন ফিনিশিয়ান আর ইরানিয়ান ভাষায় মিশেলে মেসেজ আসত, বা পরের ওই গ্রিক ভাষাটা তখনও ওবধি সবার এক সাথেই মেসেজ আসত। হঠাৎই একদিন, বাকি দু তিনজনের ফোন একসঙ্গে খারাপ হয়ে যায়। শুধু ঠিক থাকে তাতিয়ানার ফোন। আর তার পরেই শুরু হয় বিপত্তি।
ততদিনে ভারত সরকারের থেকে বৃত্তি পেয়ে ফিজিক্স নিয়ে দাদার কলেজেই ভর্তি হয়ে গেছিল তাতিয়ানা। মেসেজ আসাও প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তখন। তন্ময় আর তার প্রফেসর নাসার সঙ্গে যুগ্ম প্রয়াসে রিসার্চ চালিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু কোনও কুলকিনারা পাচ্ছিল না।
হায়দ্রাবাদ থেকে ডঃ এস রাধাকৃষ্ণনও প্রায়ই ফোনে খোঁজখবর নিতেন প্রফেসর খাসনবিশের থেকে। তাতিয়ানার সঙ্গেও ভালই বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ওঁর। ভীষন স্নেহ করতেন ওকে। এখনও বলেন, “poor child we could not even try to help her. Her case is beyond our imagination.”
টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে একথা বলতে গিয়ে চোখে জল এসে গিয়েছিল তাঁর। তাতিয়ানা অবশ্য এখন আর কাঁদতে পারে না। অনুভূতিগুলো ভাগ্যিস চলে যাচ্ছে। নাহলে চোখের এক ফোঁটা জলেরও ভার কী করে নিত সে?
এখনও মনে আছে সব। ঠিক যেন কোনও সাইফাই মুভি। ল্যাবে কাজ করছিল তাতিয়ানা। একটু বেশি রাত হয়ে গিয়েছিল বোধহয়। হঠাৎ পকেটের মধ্যে নড়েচড়ে উঠল তার ফোন কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। বাকিরা আগেই বেড়িয়ে গেছে সবাই যে যার মতো। তন্ময় তার প্রফেসরের ঘরে ব্যস্ত। তাতিয়ানার তাই বিশেষ তাড়া নেই। ফোন বাজলেও ভ্রক্ষেপ করল না সে। এস এম এস তো! পরে দেখা যাবে- এই ভেবে হাতের কাজটাই মন দিয়ে করতে থাকে সে।
কিছুক্ষণ বাদে আবার মেসেজ্। দাদা নয় তো! ফোনটা বার করে হাতে নেয় তাতিয়ানা। সেই একই ব্যাপার! হিজিবিজি সাংকেতিক কিছু ফোঁটা দিয়ে সৃষ্ট এক ব্রহ্মাণ্ড! কি সুক্ষ্ম কাজ। তাতিয়ানাত আঁকা ঝোঁকার দিকে শখ চিরকালই তীব্র। মেসেজের ভাষা বোঝা না গেলেও এই নিপুণ সৃষ্টি দেখে মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না সে। কিন্তু হঠাৎই তার খুব চোখ জ্বলতে শুরু করে। ফোনটাও ভীষণ গরম হয়ে যায়। এতটাই যে আর তা হাতে ধরে রাখতে পারে না তাতিয়ানা। ফোনটা মাটিতে পড়ে ছড়িয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তা কুড়িয়ে নেবে বলে মাটিতে বসে সে। গায়ে হাত পায় তীব্র ব্যথা অনুভব করে সে। মনে হয়, আর যেন বসেও থাকা যাবে না। এখনও স্পষ্ট মনে আছে তাতিয়ানার- হাতের পাতায় টান পড়ছিল তার।
চোখের সামনে হাতটা তুলে নিতেই মনে হল হাতটা যেন হঠাৎই কয়েক ইঞ্চি ছোট হয়ে গেল! আর পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে ব্যথাও উধাও!
খুব হেসেছিল তন্ময় ফেরবার পথে, “ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলি নাকি! কই তোর ফোনে তো কোনও মেসেজ নেই? আর তাছাড়া, তুই ছোট হবি কী করে? তুই তো ছোটই!” মাথায় হাল্কা গাঁট্টা মারে তন্ময়। তাতিয়ানা হাসতে পারেনি। আতঙ্ক তখনও তার চোখমুখে।
এরপর প্রায় প্রতি সপ্তাহেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। কখনও বাসে, কখনও বাড়িতে, কখনও আড্ডা মারার সময়- আবার কখনও মাঝরাতে পড়াশোনা করার সময়। বিপ বিপ করে মেসেজ আসে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে তারামণ্ডল, গরম হয়ে হাত থেকে ছিটকে পড়ে ফোন ব্যথা আর সবশেষে কয়েক ইঞ্চি ছোট হয়ে যাওয়া। তারপরে ফোন অন করলেই মেসেজ ভ্যানিশ!
অনিমেষ খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। স্ত্রীকে বলেন তাতিয়ানার ফোন নিয়ে নিতে। তাতিয়ানা নিজেও সবসময় ফোন থেকে পালাতে চায়। কিন্তু তখনই বেজে ওঠে, ‘বিপ্ বিপ্!’ সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যপার- ফোন অন্য কারও কানে বা হাতে থাকলে মেসেজও আসে না।
প্রথমে তন্ময় বিশ্বাস না করলেও অচি্রেই বোঝা যায় এক বর্ণও কল্পনা করছে না তাতিয়ানা। সত্যিই ‘ছোট’ হয়ে যাচ্ছে সে!
এমনই চারবছর আগের ঘটনা। জল অনেকদূর অবধি গড়িয়েছিল। প্রফেসর খাসনবিশ ঘটনাটা জানতে পেরেই নাসাকে জানান। কিন্তু প্রথমে নাসা মানতেই চায়নি এমন হাস্যকর ঘটনা! তাদের ধারনা হয়, সবটাই সাজানো! তাদের যুক্তিও অকাট্য। পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে কেন তাতিয়ানাই পাবে ভিনগ্রহের সিগন্যাল? বাকি যারা ওই মেসেজ পের হঠাৎ তাদের সবার ফোন খারাপ হয়ে গেল- তাতিয়ানার ফোন এখনও চলছে কী করে? খবর নিয়ে তারা আরও জানতে পারে, ‘Sara Beral’ বলে কোনও নতুন আমেরিকান ব্র্যাণ্ডের ফোন মার্কেটেই আসেনি। যাদের ফোন নষ্ট হয়ে গেছে সেই ফোনের স্যাম্পলও আশ্চর্যভাবে উধাও। তবে কি তাতিয়ানার ফোন কোনও বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো হয়েছে? কে বানিয়েছে? উঠে আসে তন্ময় আর মিঃ খাসনবিশের নাম।
নাসা কম অপমান করেনি তাঁদের। কিন্তু যখন তাতিয়ানা (তখন সাড়ে তিনফুটের একটু কম হাইট)গিয়ে সামনে দাঁড়াল তাদের চমকে উঠল বিজ্ঞানীমহল। নাসার উদ্যোগেই বসল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তারদের বোর্ড। সকলেই একটা ব্যপারে একমত হলেন মোবাইল ফোনের মেসেজ থেকেই নিঃসরণ হয়েছে কোনও তেজস্ক্রিয় রশ্মি- যার থেকেই তাতিয়ানার এই বিকৃতি। নিঃসরণের পর উধাও হয়ে যাচ্ছে তাই ওই কোড। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় আরও বোঝা গেল, যে বা যারা সাংকেতিক ভাষায় দু এক জনের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছিল- কোনওভাবে তাদের মধ্যে তাতিয়ানাকেই তারা চিহ্নিত করেছে। তাই ‘Sara Breral’ ব্র্যণ্ডের নামও বাকি সব স্থান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অবশ্য এই রশ্মি তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে পাঠিয়েছে কিনা- তা বলা কঠিন।
আর আজ তো সব্বাই চুপ, যেন নিঃসারে এ ওকে বলছে- ‘বলা বারণ’! সত্যিই, কী হবে আর বলাকওয়ায় গিয়ে? এই কয়েক বছরে তাতিয়ানার উচ্চতা কয়েক ইঞ্চিতে এসে দাঁড়িয়েছে। শুধু দাঁড়ায়নি, প্রচণ্ড তীব্রতায় নিম্নমুখে ধাবিত তার উচ্চতা। এদিক ওদিক থাকলে পাছে ভুল করে পা পড়ে যায়- তাই তাতিয়ানার ঘর এখন এক ছোট্ট পাখির খাঁচা। তন্ময় নিজে গিয়ে কিনে নিয়ে এসেছে একমাস হল। মাকে আর দেখতে পায় না তাতিয়ানা। তিনি কবেই বিছানা নিয়েছেন। বাবা কিছুদিন আগে অবধিও ভারত সরকারের সাথে নিয়মিত সংযোগস্থাপন করতেন। কিন্তু এই খাঁচায় যখন থেকে বাসা বেঁধেছে তাতিয়ানা- তিনি বুঝেছেন সব্বাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে তিনি প্রলাপ বকেন এখন, “কেন যে মোবাইল কিনে দিলাম মেয়েটাকে? আমি দায়ী!! ওর এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী।”
তন্ময়ই একমাত্র শান্ত এখনও। বোনকে খাওয়ানো (দু দানা চাল- দুবেলা), শোওয়ানো, স্কেল দিয়ে মাপ নেওয়া- সবই ওই করে এখন। গত সপ্তাহেই মেপেছে। দেড় ইঞ্চির থেকে কিছু কম এখন তাতিয়ানা।
“কাল আবার মেসেজ এসছিল। মোবাইলটা থেকে না। ওটা আর কাজ করছে না। শুধু বিপবিপ শব্দটা শুনেছিলাম। আর তারপর–কোথাও নেই! তাতিয়ানা হারিয়ে গেছে! ওকে আর পাচ্ছি না। আর পাব না গো।” তন্ময় এই প্রথম চিৎকার করে ওঠে। ভেঙে পড়ে কান্নায়। ডঃ রাধাকৃষ্ণণ আর প্রফেসর খাসনবিশ মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে যান ঘর থেকে।
*******
ঘুম থেকে উঠে পড়ে তাতিয়ানা। মেসেজ পেয়েছিল সে। বিপ বিপ শব্দ, ব্যথা- সব মনে আছে তার। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে চেনা জগৎটা আর দেখতে পায় না ও। কিন্তু দেখে তারই উচ্চতার সারি সারি মানুষ, যাদের মধ্যে আর বেমানান লাগে না ওকে। আমাদেরই পৃথিবীর অন্য কোনও স্তরে বাস করে এই জাতি- যাদের সাংকেতিক ভাষাই ধরা পড়েছিল তাতিয়ানার মোবাইলে। কেউ একজন ফিস্ফিস্ করে কানের কাছে বলল- “welcome- greetings from Sara Beral Indicate your Posiho”। পাঁচটা আঙুল তুলে ধরে তাতিয়ানা। এই পৃথিবীর বুকে মিলিয়ে যায় সে- চিরদিনের জন্য। নিজের অজান্তেই সাংকেতিক ভাষাটা কখন রপ্ত করে ফেলেছে সে।
প্রসঙ্গত, তাতিয়ানার উচ্চতা এখন ২৪ ন্যানোমিটার। ২৪ যে শুভসংখ্যা এই অজানা পৃথিবীবাসীদের কাছে!