“যাহার আগমনে ও প্রভাবে সংবাদপত্রমহলে হুলুস্থুলু পড়ে তাহাই সোমপ্রকাশ।’ এতদূর পড়েই মাস্টারমশাইএর পুরু লেন্সের ওধারের বিস্ফরিত চোখদুটি গণেশের ওপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সোমপ্রকাশ, মানে আমাদের গণেশকে তো সবাই চেনো, সে তো “জনগণেশের প্রচণ্ড কৌতুক”, পাড়ার বেপরোয়া দস্যি স্কুলের “পাগলা দাসু”, যাক গে, এখন যে সে প্রবল বিক্রমে ইতিহাস ক্লাসে বেঞ্চিজোড়কে বিছানা কল্পনা করে নিদ্রামগ্ন হতে পারে তা আমাদের কাছে বেশ কিছু একটা অকল্পনীয় নয়, তবুও মাস্টারমশাইএর মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ শিক্ষকের ক্লাসে এমন অদ্ভুত ঘটনার পরিনতির কল্পনাতে আমরা ভয়ে পাথর হয়ে গেলাম।
“সোমপ্রকাশ!…”
হুঙ্কারে দাঁত বের করা স্কুলটার কোন ইটই যে খসল না, তাকে সৌভাগ্য গণ্য করে প্রমাদ গুনলাম।
“কিছু বলছেন?” সম্বিত ফিরে আড়ামোড়া ছেড়ে বলল গণেশ, এমন নির্বিকার প্রত্যুতরে শুধু আমরাই নয়, মাষ্টারমশাইও স্তম্ভিত। তবু যথাসম্বভ গম্ভীরস্বরে বললেন, “কী ব্যাপার? ঘুমোচ্ছিল যে বড়…? এত সাহস!”
‘আজ্ঞে না স্যার, একে সাহস বলে, আমাকে সাহসী গণ্য করে লজ্জা দেবেন না, সবই আপনাদের শিক্ষা! ভৌতবিজ্ঞান ক্লাসের সময় স্যার প্রায়শই ঘুমিয়ে পড়েন, ওকে দেখেই বুঝেছি, ক্লাসে ঘুমনো কোন অপরাধ নয়, তাছাড়া আমাদের হেডস্যারই তো বলেন আপনাদের আচরণ দেখে প্রতিনিয়ত শিক্ষিত হতে, আমি তো তারই চেষ্টা করছিলাম মাত্র।” বলেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল।
এমন উত্তরে এবার আমরাও হতবাক, স্যারের রাগটা বিস্ময়ে পরিণত হয়ে, তিনি একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, কিন্তু তখনই আমাদের প্রত্যুৎপন্নমতি গণেশ বলে বসে “তাহলে স্যার আমাকে এখন কি আর শাস্তি দেবেন?”
স্যার তো তখন রেগে আগুন।
“তবে রে”—বলে গণেশকে যেই না বকতে যাবেন বলে এগিয়ে এসেছেন, সে অমনি একছুটে ঘরের বাইরে এসে দারোয়ানের পাশ দিয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে। নাম গণেশ হলে কি হবে স্থূলত্ব তার পাঠকাঠির থেকে কোন অংশে বেশি নয়, দৌড়ে তার তুল্য এ-তল্লাটে কেউ নেই।
ভাবা হয়েছিল ঘটনাটির ব্যাপ্তি এখানেই ইতি লাভ করবে, কিন্তু স্যার টুইস্টারের গতিতে যে হেডস্যারকে নালিশ করবেন, তা আমরাও ভাবিনি।
‘সোমপ্রকাশ’এর সকল কীর্তির সবিস্তারে বিবৃতিসহ হেডস্যার কটুকণ্ঠে, গণেশের বাবা-মা কে নানা অভিযোগ জানালেন।
বাড়িতে যখন হেডস্যার, স্যার, গণেশের বাবা-মা, তখনই সেই বীরপুরুষের আবির্ভাব।
এমন সংকটজনক পরিস্থিতিতেও হাসি চাপতে না পেরে খিলখিলিয়ে বলে উঠল, “ওঃ! স্যার আপনি, সত্যিই আমার আচরণে এতই আপ্লুত যে, আমাকে অভিবাদনের জন্য বাড়িতে এসেছেন, না না স্যার……… আপনাদের কথা শুনেই তো আমি ঘুমিয়েছিলাম, এতে আমার আর কি কৃতিত্ব?”
এই কথায় গণেশের বাবা রাগে ক্ষিপ্রগতিতে তার পাঁচ আঙুলের লাল ছাপ তার নরম গাল দুটিতে বসিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। স্যার মাঝপথে “চলি” বলে গৃহত্যাগ করলেন। এবারই কিল, চড় ঘুষি, লাঠিপেটা, বকুনি, ইত্যাদি নানা ব্রহ্মাস্ত্র ক্রমাগত বর্ষণ হলো গণেশের কচি পিঠে।
আর এই রঙ্গের পরিণাম এমনই তিক্ত হয় সর্বদা। সেইবার বিদ্যাসাগরের জীবনী পড়ে ধানক্ষেতের সব ধানের দুধ খেয়ে খেয়ে নিয়েছিল, রামানুজের গল্প শুনে অঙ্কে সেবার হাফ-ইয়ারলিতে একশো পেলেও আর কোনো বিষয়েই গোল্লার বেশি পায়নি। এমনধারা সব উদ্ভট কাজের জন্য বেত্রাঘাত ছাড়া অন্যকিছু জুটেছে বলে আমরা কখনো শুনিনি, আজন্ম বুঝি সে এমনই খ্যাপা।
golposomprakash (2)শোরগোলটা শুরু হল মিনিট পাঁচেক পর। হঠাৎ গণেশের বাড়ির দালান থেকে একটা আর্তনাদের কান্না ভেসে এল, গণেশের মা, মানে সত্যপ্রিয়া কাকিমার কণ্ঠে কান্নার তীব্রতা তীব্রতর হতে লাগল। ইতিমধ্যে আমরাও তৎপর বিভ্রান্ত পায়ে তাদের দালানের সামনের উঠোনটায় কোন এক অজানিত দুঃখের জন্য চোখ মোছার ভান করে সমমর্মিতা জানাচ্ছি। তখনই আমাদেরকে অবাক করে শিবে কাকু মানে গণেশের বাবা পাতকুয়োর ভিতর থেকে উন্মাদ ত্রস্ত কণ্ঠে বলেন “ওকে পেলাম না, মনে হচ্ছে পুলিশে খবর দিতে হবে।”
এবার আমরাও ভীত শীতলতা অনুভব করলাম, কাকিমার কান্নাটা হাহাকারে পরিণত হল, তিনি কাতর গলায় বলতে লাগলেন, “কেন যে এত মারতে গেলাম, ছেলে একেবারে পাতকুয়োতে ঝাঁপ দিল!”
কাকুকে পাড়ার দাদা জ্যাঠারা দড়ি দিয়ে ওপরে তুলল, ওঠার পর জানা গেল, গণেশ মার খেয়ে বেজায় রেগে একছুটে ঘরের বাইরে আসে, কিছুক্ষণ বাদে কাকু কাকিমা বেশ জোরে ‘ঝুপ’ শব্দ শুনতে পান এবং এসে দেখেন জলের তলা থেকে বুদবুদ উঠছে।
একথা শোনার পর আমরাও কাঠ হয়ে গেলাম। গণেশ যে আত্মঘাতী হবে, এমন শোচনীয় পরিনতি আমাদেরও নাড়িয়ে দিল।
তখন শোরগোল তুঙ্গে। দু’একজন পুলিশকর্মী, দমকল ইঞ্জিন ও উপস্থিত। দমকল কর্মীরা একঘণ্টা ধরে কুয়োর সব জল পরিষ্কার করে বের করে নিলেও গণেশকে পাওয়া গেল না।
কাকিমার হাহাকার এবার হতাশা, তিনি প্রায় মূহ্যমান। কাকুর চোখে মুখে দুঃখের অন্ধকার, আমাদেরও দুঃখের মেঘ ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। ইতিমধ্যে সেই মহান ইতিহাস শিক্ষক ও হেডস্যারও সন্ত্রস্ত হয়েই উপস্থিত।
দু-একটি চ্যানেলের মিডিয়ারাও এসে গেছে। এমনকি কিছু সর্বভারতীয় চ্যানেলের সংবাদদাতারাও সম্প্রচার করছেন “ আবারও শিক্ষা ও বাবা-মার রোষে আত্মঘাতী পড়ুয়া।”
হটাৎই ধীরু আমাদেরই বন্ধু যথাসম্ভব উচ্চকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে “এই তো গণেশ!”
গণেশের মুখে এখনো সেই দুষ্টু অম্লান নির্বিকার হাসি। আর দু-চোখ ক্রমাগত পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
golposomprakash (3)এতক্ষণ নাকালে লোকগুলো হতভম্ব, ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে নিথর। ধীরুর থেকে জানা গেল প্রায়ই পাশের ঝোপটা নড়ে উঠছিল, আর দুটো চোখ যেন যেন উদগ্রীব নীরব দর্শকের মতো তাকিয়ে ছিল, তখনই কাছে গিয়ে গণেশ আবিষ্কার।
সবাই আমরা থ। আরও একবার অবাক করে ক্ষ্যাপাটে স্বরে মৃদু হেসে বলল, “একটু ঘুমিয়েছি বলে এত মারবে? তাইতো একটা বড় পাথর নিয়ে পাতকুয়োয় ফেলে দিলাম।”
একথার পর শিবে কাকু তাকে থাপ্পড় মারার জন্য উদ্যত হাতলে বিস্মিত চোখে নামিয়ে নিলেন।
এবার সে ইতিহাস স্যারের কাছে গিয়ে বীরপরাক্রমে উদার হেসে বললে, “যাহার আগমনে ও প্রভাবে সংবাদপত্র মহলে হুলুস্থলু পড়ে তাহাই সোমপ্রকাশ, তাই না স্যার?”
স্যার কি বলবেন বুঝে না পেয়ে, ঈষৎ হেসে ঘাড় নাড়লেন।
তবে হুলুস্থুল যে পড়েছিল একথা সত্যি। কিন্তু আশ্চর্য এখানেই, সে যদি ঘুমোবে, তবে স্যারের কথা শুনল কীভাবে? পরে জিগ্যেস করলে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তার জবাব, “ধুর পাগলা, আমি কি ঘুমিয়েছিলাম নাকি, শুধু মজা করতে চেয়েছিলাম” – বলে আবার হেসে ওঠে।
আচ্ছা, ওকি সত্যিই খ্যাপা!!