“এ কী? কে আপনি? আপনি তো নীতি নন!” পার্কের বেঞ্চে বসা মেয়েটিকে লক্ষ করে বললো সিফাত। “আমি নীতি হতে যাবো কোন দুঃখে। আমি নিশী। ফারজানা নিশী।” “কিন্তু এখানে তো নীতির থাকার কথা। আপনি কেন?” “এক্সকিউজ মি! নীতি কে? আর সে এখানেই বা থাকবে কেন? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।” “না। ভুল হবার তো কথা নয়। নীতি তো এগারোটায়ই আসতে বলেছিলো।”
আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না নিশী। সবগুলো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললো “দেখুন মিস্টার। আপনি এগারোটায় নয়। এসেছেন এক ঘণ্টা সাতাশ মিনিট দেরিতে।” তারপর নিজের হাতঘড়ি দেখিয়ে বললো “ভালো করে চেয়ে দেখুন। ঘড়িতে বারোটা সাতাশ বাজে।” একবার নিজের ঘড়ি দেখলো সিফাত। নিশীকে দেখিয়ে বললো “কিন্তু আমার ঘড়িতেতো এগারোটাই বাজে।” “স্লো চলছে। আর কী? যা পুরনো মডেলের ঘড়ি আপনার।” এবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো সিফাতের। মুহূর্তে মুখটা কালো হয়ে গেলো। “ঘড়ি স্লো।” কথাটা দু-তিনবার আওড়ে সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। নিশী আড়চোখে একবার সিফাতকে দেখলো। “কী পুরনো ডিজাইনের পোশাকরে বাবা। একদম জোকার লাগছে।”
যদিও নিশীর হাসি পাচ্ছে কিন্তু সিফাতের মলিন মুখ দেখে হাসতে পারছে না। তবে ভেতরে ভেতরে বেশ হাসছে।
সিফাতকে এখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিশী বললো, “এক কাজ করুন। আপনি বসুন। বলুন কে নীতি? সে এখানে কেন থাকবে? কী হয়েছে? সবকিছু খুলে বলুন।”“খুলে বলে আর কী লাভ? ও হয়তো চলেই গেছে।” “তবুও। এমনওতো হতে পারে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আর না বললে তো বুঝা যাচ্ছে না কী হয়েছে?” “কী করবেন শুনে?” প্রশ্নটা শেষ করার আগেই সেখানে চোখের পানি ছেড়ে দিলো সিফাত। নিশী জীবনে ছেলেদের কাঁদতে দেখেনি। আজ অবাক হচ্ছে।
সিফাতকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বললো “দেখুন। কাঁদবেন না প্লিজ। পুরুষমানুষ কাঁদলে সেটা বেশ লজ্জার দেখায়।
“এই নিন।” বলে একটা টিস্যু বাড়িয়ে দিলো সিফাতের দিকে। সিফাত টিস্যুটা হাতে নিয়ে চোখটা মুছলো।
“বেচারার মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে।” মনে মনে ভাবলো নিশী। “আচ্চা। নীতি কে আপনার? ওর জন্য এভাবে কাঁদছেন। গার্লফ্রেন্ড??” হ্যাসূচক মাথা নাড়লো সিফাত। তারপর নিজে থেকেই বলতে লাগলো “আজ এগারোটায় আমার নীতিকে নিয়ে পালানোর কথা ছিল।” “একটু বিস্তারিত বলুন।”
সিফাত বলতে শুরু করলো “নীতিকে আমি ভালোবেসেছিলাম সেই শরতের এক সকালে। দুজনেই একই ভার্সিটিতে পড়ি। যদিও আমি ছিলাম ওর থেকে দুই ইয়ার সিনিয়র। তবুও সেদিন কী হয়েছিলো কে জানি? প্রতিদিনের মতো আমরা ভার্সিটিতে জুনিয়রদের র্যাগ দিচ্ছিলাম। একেতো দূর্গাপূজার মৌসুম তারউপর ভার্সিটিতে জোরেসোরে পূজার আয়োজন চলছে। র্যাগ দেওয়ার পারফেক্ট টাইমিং। কয়েকটা ছেলেমেয়েকে ধরেও এনেছিলাম। তাদের মধ্যেই ছিল নীতি। “তার মানে নীতিকে আপনি র্যাগ দিয়েছিলেন?”
“সেটা পারিনি। সেদিন কী হলো জানি না কিন্তু নীতির কাঁদো কাঁদো চোখ দেখে তাকে যেতে দিয়েছিলাম। যদিও সেজন্য ফাইনাল ইয়ারের সিনিয়র ভাইয়েরা আমাকে র্যাগ দিয়েছিলো।” “বাহ! ওকে র্যাগ না দেওয়ায় নিজে র্যাগ খেলেন। ইন্টারেস্টিং তো। নীতিকে নিশ্চয়ই বলেছিলেন এটা।” “আমাকে বলতে হয়নি। ওর ব্যাচে আরেকটা মেয়ে র্যাগ খেয়েছিলো ওইদিন। ওই বলেছিলো নীতিকে।” “তারপর নিশ্চয়ই নীতি আপনার সাথে দেখা করে সরি বলেছিলো। আর গল্পটা শুরু হয়েছিলো।” “আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। বরং নীতি আমার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতো। দেখলেই পালিয়ে যেতো। বোধহয় ওর জন্য আমি র্যাগ খেলাম এই অপরাধবোধ থেকেই এটা করতো সে।” “তাহলে কথা কী করে হলো? প্রেমনিবেদনই বা কী করে?”
“সেখানেও আরেকটা ঘটনা ঘটেছিলো। ভার্সিটির মাস্টার্সের এক বড়ভাই অবৈধ আর্মস রাখতো। একদিন ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ে। আমি ভিসি স্যার ও পুলিশে রিপোর্ট করি। এতে ঐ বড়ভাইটার জেল হয়ে যায়। উনি ছিলেন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের কর্মী। অন্য কর্মীরা খবর পেয়ে আমাকে মারতে এসেছিল। নীতিই সেদিন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে আগলেছিলো। নাহলে সেদিন মারাই পড়তাম। যখন ওরা আমাকে মারছিলো নীতি আমার উপর ঝাপ দেয় আর বলতে থাকে “প্লিজ! ওকে মারবেন না।” ওরা আর আমাকে মারতে পারেনি। তবে আহত হয়েছিলাম। মাথা ফেটে গিয়েছিলো। হাত ভেঙে গিয়েছিলো। আরো ছোটখাট জখম তো ছিলই। নীতি ওর দুইটা ফ্রেন্ডের হেল্প নিয়ে আমাকে হাসপাতালে এডমিট করে। আমি মেসে থাকতাম। গ্রামের ছেলে। একটু ক্ষ্যতটাইপের। আর গ্রামেও আমার তেমন কেউ নেই।
তাই আমাকে দেখতে কিংবা খোঁজ নিতে কেউ আসেনি। অথচ নীতি এই পুরোটা সময় আমার পাশে থেকেছে। আমাকে প্রতিদিন একবার করে দেখে গিয়েছে। ওর নিয়ে আসা প্রতিটা ফুলের তোড়াই নার্স আমাকে দেখাতো। তাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমেই গেলাম নীতির সাথে দেখা করতে। “কী করলো নীতি?” “ও আমাকে প্রথম প্রথম এড়িয়ে গেল। পরে অবশ্য ওর এক ফ্রেন্ডকে দিয়ে ওর সাথে দেখা করার সুযোগ তৈরী করেছি। সেদিন দুর্গাপূজার নবমী। পুরো ভার্সিটিতে উৎসবের ধুম। সবাই ব্যস্ত। এই ফাঁকেই নীতির সাথে প্রথম কথা।” “কী বললেন? আর নীতিই বা কী বললো। ও কি আবারো আপনাকে এড়িয়ে গেল।”
“হয়তো এড়িয়েই যেতো। কিন্তু উৎসবের কারণে পারেনি। ওকে প্রথমে ধন্যবাদ জানালাম আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওও আমাকে ধন্যবাদ দিল র্যাগ থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। কথা এভাবেই শুরু। এরপর সংক্ষেপে পরিচয়টাও হয়ে যায়। ও নীতি। ফার্স্ট ইয়ারের। বাবা নেই। মাকে নিয়ে মামার বাড়িতেই মানুষ। বড়লোক মামার একমাত্র ভাগ্নি। কাজেই অবস্থা ভালো। নীতি দেখতেও ছিল যথেষ্ট সুন্দরী। আর আমি একটা পাগল। সবসময় পরনে থাকে এরকম পুরনো ফ্যাশনের পোশাক-আশাক। হাতে এই পুরনো ঘড়ি। এরকম ঢাউস মার্কা চালচলনের কারণেকারো সাথেই ফ্রেন্ডশীপ নাই। নীতিই আমার প্রথম ফ্রেন্ড হয়। “তারপরে গল্পটা কী? কে প্রথম ভালোবাসলো? প্রোপোজইবা কে করলো?” “ওর সাথে ফ্রেন্ডশীপের সম্পর্কে আমরা কোন পর্যায়ের ছিলাম সেটা আমাদের চ্যাট দেখে বোঝাই যেত না। তবে মাঝে-মধ্যে আমাদের মধ্যে আবেগের দেওয়া-নেওয়া হতো।”
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে সিফাতের দিকে তাকায় নিশী। প্রশ্ন বুঝতে পেরে সিফাত বলতে থাকে “কখনো ও আমার কাছে কবিতা শুনতে চাইতো? কখনো আবার ও আমাকে গান গেয়ে শোনাতো। আমি ওর স্কেচ করে দেখাতাম ওকে। ওও নিজের আঁকা ছবি আমাকে দেখাতো। এভাবে কতশত আবেগের দেওয়া-নেওয়া যে হতো। মাঝে-মধ্যে আমরা দেখা সাক্ষাতও করতাম। এইখানে এসে বসতাম।”
“ভালোই তো। আলাদা টাইপের প্রেম। তারপর কী হলো?” “একদিন ওর ফোন এলো। এটাইমে আমি টিউশনীতে থাকি জেনেও ও ফোন দিয়েছে। কিছু হয়েছে বুঝেই ফোনটা রিসিভ করি “হ্যালো। কোথায় তুমি?” জেনেও প্রশ্নটা করেছে দেখে অবাক হলাম। কিন্তু সেজন্য কিছু বললাম না। উত্তর দিলাম “তোমার তো অজানা থাকার কথা না। টিউশনীতে আছি।” “আমার সাথে একবার দেখা করতে পারবে?” “কেন? কী হয়েছে?” “কী আবার হবে। সবসময় যা হয়। মামা আবারো ছেলে দেখেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি। বিয়েও ঠিকঠাক। সব ওকে হলে চার তারিখে বিয়ে।”
“তাহলে তো গুরুতর ব্যাপার। কবে দেখা করতে চাও?” “কালকে। সকাল নয়টায়। পারবে?” “হুম। আসবো?” “ঠিক আছে। রাখছি তবে বাই। টাইমমতো এসো।” “আচ্ছা। বাই।” “দেখা করতে গেলেন পরদিন?” “না গিয়ে তো কোনো উপায় ছিলো। এই এখানে যেখানে আপনি বসে আছে এখানেই ও বসেছিল। এখানেই বসেই ও পালানোর কথা বললো। আমি বেকার। পালিয়ে যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। ও আত্মহত্যার হুমকি দিল। শেষে উপায় না দেখে রাজী হলাম। কথা ছিল আজ এগারোটায় ও এখানে থাকবে। আমি এসে ওকে নিয়ে যাবো। কিন্তু” বলেই ছেলেটা আবারো কান্না শুরু করে দিলো। “কী ছিঁচকাঁদুনে ছেলেরে বাবা। এজন্য কেঁদে দেয়।” মনে মনে বললো নিশী।
দেখুন আপনি কাঁদছেন কেন? চোখ মুছুন। নীতির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করুন। শান্ত হোন।” একবার নিজের ঘড়ি দেখলো নিশী “একটা ঊনিশ বাজে। আমাকে উঠতে হবে।” তারপর আর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা উঠে দাড়ালো সে। পার্কের ছোট রাস্তায় হাঁটতে লাগলো। সিফাত তখনো বেঞ্চেই বসে আছে। নিশীর কেন জানি মনে হচ্ছে ও চলে যাওয়ার পর সিফাত আবারো কাঁদবে। একটা সূক্ষ্ম অপরাধবোধ জেগে উঠলো নিশীর মনে, “ওকে সত্যিটা বলে দেওয়া উচিত ছিল…