“এই, এই যেসব পাখিগুলো দেখছেন, এ সবই হল পরিযায়ী।” বললেন বৈকুন্ঠবাবুর বন্ধু তথা ভূগোলের অধ্যাপক অবনীবাবু। শীতের এক মনোরম বিকেলে পার্কের ঝিলের ধারের বেঞ্চিতে বসে কথা বলছিলেন দুই বন্ধু। পার্কের এই দিকটায় ভিড় কম তাই শোরগোলও কম, আর পরিবেশও শান্ত।
“মানে ভিন রাজ্যের পাখির কথা বলছেন তো?” বৈকুন্ঠবাবু প্রশ্ন করেন।
“শুধু তাই নয়, ভিন দেশেরও বটে। এদের কেবল এই শীতকালেই দেখা মেলে।”
স্থানীয় সরকারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত গণিতের অধ্যাপক শ্রী বৈকুন্ঠ মোহন চৌধুরী স্বভাবে অত্যন্ত মিতব্যয়ী এবং আত্মসচেতন লোক। তার এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মাত্রাহীনতার জন্য তার পরিচিতরা তাকে রসিকতার ছলে ব্যয়-কুন্ঠ নামেও ডাকতেন। দোতলা একটি বাড়ির একতলার দুটি ঘর নিয়ে একা ভাড়া থাকেন এবং তার এই ব্যয়-কুন্ঠ স্বভাবের জন্য তার বন্ধুসংখ্যাও সীমিত। বাড়িওয়ালা শেখরবাবুর সঙ্গে তার যোগাযোগ কম। বন্ধু বলতে তার স্কুলের সমবয়সী কিছু অধ্যাপকেরা। বাড়ির সমস্ত কাজ বৈকুন্ঠবাবু একাই করেন। সকালে বাজার থেকে শুরু করে রান্না-স্নান-খাওয়া। দুপুর কেটে যায় শুয়ে-বসে, বৈকুন্ঠবাবু বিকেলের দিকটায় বের হন। বাড়ির কাছেই এই পার্কটাতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে আসেন। আগে পার্কে বেড়াতে যেতেন না। অবসরের পর থকে এটা প্রায় তার দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ফিরে এসে গণিতচর্চা এবং রাতে খাবার খেয়ে সময়মতো শুয়ে পড়েন।
কর্মজীবনের সময় থেকেই বৈকুন্ঠবাবুর অভ্যাসে কাঁধের ঝোলা ব্যাগটাতে বিস্কুটের প্যাকেট সঙ্গে রাখা। খিদের সময় কাজে লাগে। সেদিনও পার্কে বসে বিস্কুট খাচ্ছিলেন। কী মনে হল, দুয়েকটা বিস্কুট ছুড়ে দিলেন ঝিলের ধারে এসে বসা একঝাঁক পরিযায়ী পাখিদের উদ্দেশ্যে। প্রথমদিকে কয়েকটা, পরে বেশ অনেকগুলো পাখি এসে নিমেষের মধ্যে বিস্কুটগুলো খেয়ে নিল। উৎসাহের বশে আরও ক’টা বিস্কুট দিলেন। এইভাবে দিতে দিতে তাঁর যখন খেয়াল পড়ল যে অবশিষ্ট কিছুই নেই প্যাকেটে তখন তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। কারণ, খিদে পেয়েছিল তাঁর, আর বিস্কুট খেল কিনা পাখিতে!
যে মানুষ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ব্যয়-কুন্ঠ নামে খ্যাত, সে কিনা নিজে না খেয়ে বিস্কুট খাওয়াল পাখিকে! ভাবতে অবাক লাগলেও এমনটাই করেছেন তিনি এবং করে চললেন। এরপর বৈকুন্ঠবাবু পার্কে বেড়াতে গেলেই দোকান থেকে আলাদা করে বিস্কুটের প্যাকেট কিনে নিয়ে যেতেন ঝিলের ধারে আসে পাখিদের খাওয়াবেন বলে। স্বভাবটা এমন নেশার মতো হয়ে উঠল যে, সারাবছর তিনি অপেক্ষা করে থাকতেন কেবল এই শীতকালটার জন্য!
পাখিদের প্রতি ভালোবাসা এতটাই বেড়ে গেল যে, মিতব্যয়ী বৈকুন্ঠবাবু রোজ পার্কে একঝাঁক পাখিকে বিস্কুট খাওয়াতেন। তাতে প্রায় নিয়মিত দু’প্যাকেট বিস্কুট তো লাগতই। তিনি যেন তাঁর জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে এক নতুন ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছেন। বেঁচে থাকার এক নতুন কারণ খুঁজে পেয়েছেন। এইরকমভাবেই দেখতে দেখতে কেটে গেল সাত-আট বছর। বৈকুন্ঠবাবু নিয়মিত পার্কে আসেন, একই বেঞ্চে বসেন। আর শীতকালে পাখিদের বিস্কুট খাওয়ান।
সেবারও শরৎ, হেমন্ত পেরিয়ে শীতকাল এল। ভোরের কুয়াশায় ঢাকা পড়ল পার্কের ঝিল। বিকেলে সেই ঝিলের ধারেই ভিড় জমাল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রচুর নাম না জানা পরিযায়ী পাখিরা। কিন্তু এলেন না তিনি। বৈকুন্ঠবাবু। একদিন দু’দিন করে প্রায় দুটো সপ্তাহ পার হয়ে গেল। তবুও তিনি এলেন না।
অবনীবাবু তাঁর বন্ধুর খোঁজ নিতে তাঁর বাড়ি রওনা হলেন। বাড়িওয়ালা শেখরবাবুর জানালেন, “বৈকুন্ঠবাবু আজ প্রায় পনেরো-কুড়ি দিন হল মারা গেছেন।”
কিছুদিন পর অবনীবাবু তাঁর বন্ধুর একটি বাঁধানো ছবি এনে সেই ঝিলের ধারের বেঞ্চে এনে রাখলেন। পরিযায়ী পাখির ঝাঁক তাদের ভালোবাসার মানুষটিকে সম্মান জানিয়ে ছবিটিকে প্রদক্ষিণ করে উড়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।