তিস্তার অষ্টমী

তিস্তার অষ্টমী

“ওই, ওঠ রে, আর কতক্ষণ ঘুমবি? পাড়ায় যাবি না?”

মায়ের ডাকে ঘুমটা ভাঙলেও তাকাল না তিস্তা। চোখটা একটু ফাঁক করে ব্যাপারটা বুঝে নিল। তারপর আরও বালিশে মুখ গুঁজে দিল। “দাঁড়াও না, উঠছি।” বলেই আবার শুয়ে পড়ল। মেয়ের কাণ্ড দেখে মা হাসছেন মিটিমিটি।

কাল সপ্তমী ছিল। অনেক রাত হয়েছে সবার বাড়ি ফিরতে। তিস্তা মায়ের সাথেই গিয়েছিল ঠাকুর দেখতে। সঙ্গে মামা-মামিও গিয়েছিলেন। সবাই মিলে অনেক ঠাকুর দেখেছে, আর খাওয়াদাওয়াও মন্দ হয়নি। তিস্তা একটা এগরোল আর একটা আইসক্রিম খেয়েছিল, বাকিরা চাউমিন। আর তারপর স্টেশনের সামনে যে বড়ো পুজো হয়, সেখানকার মেলা থেকে মামা একটা বড়ো বেলুন কিনে দিলেন তিস্তাকে আর বললেন, “আরও বড়ো বেলুন দিতাম, তবে পুঁচকে মেয়ে এর চেয়ে বড়ো বেলুন দিলে বেলুনটা তোকে নিয়েই উড়ে যাবে।”

এই শুনে সবাই তো হো হো করে হেসে উঠল। তিস্তার যদিও বেলুনটা পেয়ে দিলখুশ হয়ে গিয়েছিল, তবুও কপট রাগ দেখাল একটু। মোটেই সে পুঁচকে নয়। তিস্তার বয়েস এখন আট চলছে। তাকে পুঁচকে বললেই হল!

মা আবার ডাকলেন, “কী রে, ওঠ! অষ্টমী তো অর্ধেক চলেই গেল।”

এবার তড়াক করে লাফিয়ে উঠল তিস্তা। তাই তো! আজ যে অষ্টমী সেটা তো ভুলেই গিয়েছিল ঘুমের চোটে। আজ তো অঞ্জলি দেবে ও। এই দিনটা তিস্তার বেশ পছন্দের। সেজেগুজে, নতুন একটা শাড়ি পরে গটগট করে মণ্ডপে যাওয়া, অঞ্জলি দেওয়া, নিজেকে বেশ বড়ো বড়ো মনে হয়।

“মা, হলুদ শাড়িটা পরব, হ্যাঁ?” সকালের মিঠে রোদ্দুরের মতো একমুখ হাসি নিয়ে বলল তিস্তা।

“বুঝলাম, আগে আপনি বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা রাখুন, তারপর বাকিটা।”

আর বলতে হল না, চটপট নেমে পড়ল তিস্তা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফ্রেশ হয়ে, স্নান সেরে সাজতে বসল। শাড়িটা মা পরিয়ে দিলেও বাকি সাজটা নিজে নিজেই সাজার ইচ্ছে ছিল তিস্তার, কিন্তু সাজার এতরকম সরঞ্জাম নিয়ে ঠিক সুবিধা করতে না পারায় শেষে মায়ের দ্বারস্থ হতেই হল। ম্যাচিং চুড়ি, গলার হার, কানের দুল আর টিপ পরিয়ে দিয়ে, মানানসই লিপস্টিক দিয়ে ঠোঁট রাঙিয়ে মা তাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলেন। ঘুরেফিরে বার কয়েক আয়নার সামনে নিজেকে দেখে নিল সে। শাড়ি পরে নিজেই নিজেকে যেন ঠিক চিনতে পারছে না। মা আজ তিস্তার চুলে লম্বা বিনুনি করে দিয়েছেন। এই চুল বাঁধা জিনিসটা বেশ ঝকমারি, একটু নড়াচড়া করলেই মা রেগে যান। চুল বাঁধার সময় বেশি নড়াচড়া করার জন্য মায়ের ধমকও শুনল কয়েকবার।

সাজগোজ কমপ্লিট। এবার ছোট্ট হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে ছুটে বেরোতে যাবে বাড়ি থেকে, হঠাৎ মা হাত চেপে ধরে বললেন, “খবরদার, একদম ছোটাছুটি করবি না। আমিও যাব একটু পরেই। গিয়ে যদি শুনেছি দৌড়াদৌড়ি করেছ, খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। বন্ধুদের সাথে থাকবে, একসাথে অঞ্জলি দেবে, অঞ্জলি শেষে বাবার সাথে গিয়ে দোকান থেকে কিছু খেয়ে নেবে। তারপর মণ্ডপে ফিরে চুপ করে বসবে। রোদে একদম ছোটাছুটি নয়।”

মায়ের এই এক দোষ। সবসময় বলবে দৌড়াদৌড়ি নয়, রোদে একদম বেরোবে না, এটা খাবে না, ওখানে যাবে না – পুজোর সময় সব বন্ধুরা মিলে খেলবে না? ছুটকি, মেঘা, তিতলি সবাই তো অঞ্জলি দিয়েই ছুটবে খেলতে। খেলেধুলে ক্লান্ত হলে তখন আসবে মণ্ডপে গল্প করতে। আর তিস্তা বুঝি চুপচাপ ওদের অপেক্ষায় বসে থাকবে? ধুর, ভালো লাগে না। সবেতেই নিষেধ। আর আজকের একটা প্ল্যান তো কাল রাতেই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে তিস্তা, যদিও বাকিদের রাজি করাতে হবে।

গাল ফুলিয়ে তিস্তা পুজো প্যান্ডেলের দিকে হাঁটতে লাগল। যেটা করতে চাইবে তাতেই না। ইস্‌, পড়াশোনাটা করতেও যদি নিষেধ করত, যদি বলত একদম বেশি পড়বে না। নাহ্‌, সেটা বলবে না, ওই একটা জিনিসই আরও বেশি করে করতে বলবে খালি। মা বলেন, “লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।” আরে, গাড়ি তো তিস্তা রোজই চড়ে স্কুল যাওয়ার সময়, আর ঘোড়ায় চড়তে বেশ ভয়ই লাগে। গতবছর পুরীর সি-বীচে বাবা যখন ওকে ঘোড়ার পিঠে বসালেন, ভয়ে সে তো এমন কান্নাকাটি শুরু করেছিল যে ঘোড়াটাও ভড়কে গিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে পড়েছিল। তাহলে লেখাপড়ার প্রধান দুটো কারণের উপর যখন তিস্তার কোনও মোহই নেই তাহলে শুধু শুধু এত পড়াশোনার লাভটা কী? সেটা অবশ্য মাকে তিস্তা সাহস করে বলতে পারবে না। তার চেয়ে চুপচাপ মায়ের কথা শোনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

একটু এগোতেই কানে এল পুজোমণ্ডপ থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ। নিশ্চয়ই কুন্তলকাকু বাজাচ্ছে। কতদিন বলেছে একটু শিখিয়ে দিতে, কিছুতেই শেখায় না। বলে, “তোরা বরং লুকোচুরি খেল, ঢাক বাজানোটা বড়োদের কাজ।”

তিস্তার মুখে কিন্তু আবার হাসি এসে গেছে। একছুটে পৌঁছে গেল মণ্ডপে। তার বন্ধুরা অবশ্য সব আগেই পৌঁছে গেছে। গোল করে বসে আছে, শুধু সেই সবার চেয়ে লেট। এত দেরি করার জন্য তিস্তাকে দেখেই সবাই কলবল করে অভিযোগ করতে শুরু করল। ছুটকি আর তিতলি তিস্তার সমবয়সী। মেঘা একবছরের ছোটো। এরা চারজন যাকে বলে হরিহর আত্মা।

মেঘা চোখ পাকিয়ে বলল, “এত দেরি কেন করলে, তিস্তাদি? চলো না জলদি, অঞ্জলি দেব। সেই সকাল থেকে না খেয়ে আছি।”

পাশের থেকে তিতলির টুকুস মন্তব্য, “ওই, একদম গুল মারবি না। মেঘা নাকি না খেয়ে আছে। বল সত্যি করে, কী খেয়েছিস।”

সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছে কথা শুনে।

“না, মানে, মা জোর করে এক গ্লাস দুধ আর বিস্কুট খাওয়াল, আর মোটে একটা সন্দেশ।” আমতা আমতা করে বলল মেঘা।

“আর পোলাও, চিকেন কষা? ওগুলো খাসনি?” তিতলি টিজ করেই চলেছে।

ইতিমধ্যে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে যে যাদের যাদের এখনও অঞ্জলি দেওয়া হয়নি তারা যেন তাড়াতাড়ি পুজোমণ্ডপে উপস্থিত হয়। চটপট চারজনে ছুটল অঞ্জলির জায়গায়। চারজনেই শাড়ি পড়েছে। শাড়ি সামলাতে একটু হিমসিম খাচ্ছে বইকি, তবে লম্বা বিনুনি দুলিয়ে শাড়ি পরে হাঁটলে একটা আলাদাই অনুভূতি হয়, আর তার সামনে এইসব তুচ্ছ বাধাবিপত্তি কোনও ব্যাপারই নয়। এছাড়াও পাড়ার কাকু-কাকিমারা যখন বলেন, “ও মা, কত বড়ো হয়ে গেছে!” তখন তো আর কথাই নেই, আনন্দে তিস্তার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে, সাথে ঠোঁটের কোণে উঁকি দেয় লজ্জা লজ্জা হাসি। কিন্তু এখানে সমস্যা হল, অঞ্জলি দেওয়ার জন্য ভীষণ ভিড়। চারদিনই অঞ্জলি হয়, কিন্তু এই অষ্টমীর দিনটাই ভক্তকুল যে কেন টার্গেট করে কে জানে। চারজনের উচ্চতাই স্বল্প, তাই ভিড়ের ফাঁক গলে সামনে এগিয়ে যেতে তেমন বেগ পেতে হল না। কিন্তু একদম সামনের সারিতে পৌঁছতে পারল না। মেঘার হাইট সবচেয়ে কম, তাই তার চিন্তাটাই সবচেয়ে বেশি। সে যদি ঠাকুরকে না দেখতে পায়, তাহলে তো ঠাকুরও তাকে দেখতে পারবে না। জানতেই পারবে না যে সে অঞ্জলি দিয়েছে। তাহলে তো মনের ইচ্ছেগুলোও পূর্ণ হবে না। এই চিন্তাতে মেঘার মুখ কাঁচুমাচু। সে জোরে চিৎকার করে উঠল, “আমি তো কোনও ঠাকুরই দেখতে পারছি না!”

এই আওয়াজ শুনে অনেকেই চমকে তাকাল। এই চারজনের খুদে গ্যাংকে অনেকেই এতক্ষণ খেয়াল করেনি। মিলিকাকিমা হেসে বললেন, “এই তোরা পুঁচকেগুলো সামনের লাইনে আয় তো।”

অমনি তুরতুর করে চারজনে মিলিকাকিমার পাশে সামনের সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপরও অঞ্জলি শুরু হতে একটু দেরি হল। আরে, পাড়ার সেক্রেটারি তিনুকাকুর স্ত্রী যে অঞ্জলি দেবেন। তাঁর সাজতে একটু লেট হচ্ছে। একটু মানে একটুই লেট। তিনুকাকু ঘণ্টা খানেক আগে বাড়ি থেকে যখন পুজোমণ্ডপে আসেন সেই সময়ের আপডেট হল মেক আপ শুরু হয়েছে। এটাই নাকি অঞ্জলির শেষ রাউন্ড। তবে যেমন প্রার্থী ছাড়া ভোট হয় না, কেক ছাড়া বড়দিন হয় না, তেমনই আর কী, সেক্রেটারির বউকে ফেলে তো অঞ্জলি-পর্ব শেষ করা যায় না! এদিকে ঠাকুরমশাই বলেই চলেছেন যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। সাথে তিনুকাকুও সামাল দেওয়ার জন্য বলে চলেছে, “আহা, অত তাড়াহুড়োর কী আছে! এই পটলা, ঠাকুরমশাইকে চা দে তো। ঠাকুরমশাই, আপনি বরং চা খেয়ে একটু গলা ভেজান, তারপর না হয় আবার অঞ্জলি হবে।”

চা আর প্রস্তাবটা ঠাকুরমশাইয়ের বেশ মনে ধরেছিল, কিন্তু বলতে বলতেই তিনুকাকুর স্ত্রীও এসে পড়েছেন। তাই প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও তাঁর আর চা খাওয়া হল না। অঞ্জলি শুরু হল। এত কঠিন কঠিন মন্ত্র, শুনতে বেশ লাগে, কিন্তু নিজে উচ্চারণ করতে গেলে ঠেলাটা বোঝা যায়। তিস্তা ঠাকুরমশাইকে অনুকরণ করে মন্ত্র পড়ছিল। উচ্চারণ বুঝতে না পারলে নিজের মনে নিজের মতো করেই যা হোক একটা উচ্চারণ করে নিচ্ছিল। অঞ্জলির প্রথম ধাপ শেষ হতেই লোকজনের মধ্যে ফুল-বেলপাতা নেওয়ার ঢল পড়ল। একেকজনের একেকরকম চাহিদা। কেউ বলে আমায় একটা জবা দেবেন, কেউ বলছে লাল নয় সাদা জবা, আবার কেউ বলছে আমায় আরও দুটো বেলপাতা দেবেন। তিস্তার ভারি মজা লাগে এগুলো দেখে। সবাই এখানে অঞ্জলি দিচ্ছে নাকি ফুলের দোকানে পুজোর ফুল কিনতে এসেছে!! ওদের চারজনের অবশ্য এসব নিয়ে কোনঅ চিন্তা নেই। মিলিকাকিমাই ফুল ভাগ করে ওদের হাতে দিয়ে দেবেন।

হঠাৎ মেঘার দিকে তাকিয়ে হুঁশ ফিরল তিস্তার। মেঘা ভুরু কুঁচকে, গম্ভীর মুখে বিড়বিড় করে যাচ্ছে। হয়তো মনোবাসনার লিস্টটা পড়ে শোনাচ্ছে মা দুর্গার সামনে। এই রে, তিস্তারও তো অনেক ইচ্ছে মনে জমে আছে। সেগুলো তো বলাই হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে সেও শুরু করল বলতে। মা যেন কম বকাবকি করে, পরীক্ষায় যেন ভালো রেজাল্ট হয়, অঙ্ক করার জন্য কেউ যেন জোর না দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। লিস্ট এতটাই লম্বা যে অঞ্জলির ফাঁকে-তালে চলতেই থাকল।

অঞ্জলি শেষ হল। একটাকা দক্ষিণা দিয়ে তিস্তা চরণামৃতর জন্য হাত পাতল। চরণামৃত খেতে তিস্তার দারুণ লাগে। কী মেশান হয় কে জানে, কিন্তু টেস্টটা দারুণ হয়।

এবার খাওয়াদাওয়ার পালা শুরু। চারজনেই চলে গেল তাদের বাবাদের গ্রুপের যেখানে আড্ডা চলছে সেখানে। মায়েদের কাছে চিপস চাইলে শুধু বকুনিই জুটবে, সেদিক থেকে বাবাদের গ্রুপ অনেক নিরাপদ। সেখানে গিয়েই চিপস, কোল্ড ড্রিঙ্কসের জন্য বায়না শুরু করল চারজনেই, সাথে যে যার বাবার হাত ধরে টানাটানি করছে। কিন্তু শুধু চিপস আর কোল্ড ড্রিঙ্কসে তো আর পেট ভরবে না, তাই তিস্তার বাবা সবার জন্য প্যাটিসও কিনে দিলেন। চিপস, কোল্ড ড্রিঙ্কস আর প্যাটিসের ভাণ্ডারটিকে মাঝে রেখে সবাই গোল হয়ে বসল চেয়ারে। কচর কচর চিপস উবে যাচ্ছে। সবাই তাদের পেটের ট্যাঙ্ক ভরে নিচ্ছে কারণ, এখন তাদের খেলা শুরু হবে আর তাতে অনেক পরিশ্রম। শুধু তিস্তাই যা একটু ধীরেসুস্থে খাচ্ছিল।

মেঘা ভুরু কুঁচকে বলল, “তিস্তাদি, জলদি খাও না, খেলতে যাবে তো!”

“উঁহু।”

তিতলি বলল, “উঁহু কী? খেলবি না?”

“উঁহু।”

ছুটকি এবার চোখ পাকিয়েছে। “উঁহু, উঁহু, উঁহু করছিস কী? টানতে টানতে নিয়ে যাব তোকে।”

“আরে, অন্য একটা প্ল্যান আছে। অবশ্য যদি তোরা রাজি হোস।”

সবাই কোরাস করে বলে উঠল, “কী প্ল্যান? কী খেলা?”

চারপাশটা একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে জরিপ করল তিস্তা। “দেখ, আজ লুকোচুরি খেলবি, কাল কানামাছি, পরশু কুমিরডাঙা খেলবি, আর তারপর… রোজই তো আমরা এই খেলি। আগামী একবছরও এই একই খেলব। তাহলে পুজোর স্পেশালিটি কোথায়?”

সবাই হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে তিস্তা ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসির আভা এনে বলল, “চল, এমন কিছু একটা করা যাক যেটা আগে কোনওদিনও করা হয়নি।”

“কী করব তাহলে?” তিতলি বলল।

“চল, ঠাকুর দেখতে যাই সবাই, একা একা, বাবা-মা থাকবে না। শুধু আমরা চারজন।”

তিস্তার মাথায় কালকেই প্ল্যানটা এসেছিল। সে যে আর পুঁচকে মেয়ে নয় সেটা সে প্রমাণ করে দেবে। সাধারণত ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বাবা-মায়ের ডিপার্টমেন্ট। তাঁরা যেখানে পছন্দ সেখানে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যান। একা একা চারজনের পাড়ার বাইরে যাওয়া একদম বারণ। যা খেলা সব এই পাড়া চত্বরের মধ্যে। তবে তিস্তা তো বড়ো হয়েছে। এখন তো সেই আর বাচ্চাটি নেই। তাহলে কেন ও মা-বাবা ছাড়া ঘুরবে না? জানে, মা জানতে পারলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। তবে এক্ষেত্রে অষ্টমীর দিনটাই সবচেয়ে সেফ, কারণ মণ্ডপে ভিড় বেশি, মা-বাবারাও তাই অত নজর রাখতে পারছেন না। আর নিজেদের মধ্যে গল্পেই তো মশগুল সব। তিস্তার কথাটা তিতলি, ছুটকির বেশ মনে ধরেছে। একা একা ঠাকুর দেখে আসবে মানে তো ওরা সব বড়োই হয়ে গেল। কিন্তু মায়েদের বকুনির কথা ভেবে পুরো রাজি হতে পারছে না। দোনোমনো করে শেষ অবধি দু’জনেই টুক করে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

মেঘা গালভর্তি চিপস এতক্ষণ কচর মচর করে চিবোচ্ছিল। সেটিকে গলাধঃকরণ করে ভীতু গলায় খালি বলল, “তিস্তাদি, বলছি, না গেলে হয় না? মা খুব বকবে জানতে পারলে।”

“এই, তুই চুপ করবি? এখনও বড়ো হলি না দেখছি। বড়ো হওয়ার প্রথম ধাপ কী, জানিস? জানলে এসব বলতিস না। প্রথম ধাপটাই হল একা একা ঠাকুর দেখতে যাওয়া। শুধু বন্ধুদের সাথে। বুঝলি কিছু? যারা একা ঠাকুর দেখতে যেতে ভয় পায়, তারা বড়োও হতে পারে না। সবাই রাজি, তুই আবার বেঁকে বসছিস কেন?” বিজ্ঞের মতো বলল তিস্তা।

মেঘার মুখ কাঁচুমাচু, আড়চোখে মায়েদের গ্রুপের দিকে দেখছে।

ছুটকি বলল, “আরে, ভয় কী? চল না, পলুদের পাড়ার পুজোটা দেখেই চলে আসব। এই তো দু’মিনিটের ব্যাপার।”

“আজ্ঞে না, পলুদের পাড়ার পুজো দেখতে তো মিলুদের ভাঙা পাঁচিলের মধ্যে দিয়েই যাওয়া যায়। সেটা আর কি বড়োদের মতো কাজ হল? ওটা তো যেকোনও বাচ্চাই পারে। চল, মিত্র-পাড়ার বড়ো পুজোটা দেখে আসি।”

এইবার সকলেরই মুখ শুকিয়েছে। তিস্তাদের পাড়ার পাশ দিয়ে একটা বড়ো রাস্তা গিয়েছে। হরদম বড়ো বাস-লরি চলছে। রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা গেলে তবে মিত্র-পাড়া। একে তো তারা কেউ রাস্তা পার হতে পারে না, বাবা-মায়ের হাত না ধরে কোনওদিন রাস্তার ওপারে যায়নি, তার উপর বাবা-মায়ের কড়া হুকুম, একদম যেন রাস্তার ধারেও না যায়। জানতে পারলে পিঠ আর আস্ত থাকবে না। উফ্‌, এই তিস্তার আজ হয়েছেটা কী!

তিস্তার কিন্তু এক গোঁ। পুজোয় এবার নতুন কিছু হবে। প্রথমবার একা রাস্তা পার হবে, একা ঠাকুর দেখবে, ফিরে এসে সবাইকে চমকে দেবে। সবাই বলবে কত্ত বড়ো হয়ে গেছে, কত্ত সাহস মেয়েটার। কেউ না যাক সে একাই যাবে, এই তার ধনুকভাঙা পণ।

সবার মনেই এই কখনও না করা কাজটা করার ইচ্ছে জেগেছিল। কিন্তু মায়েদের ভয়ে মনে দ্বিধা ছিল। অবশেষে সবাই রাজি হলও এই শর্তে যে একটা ঠাকুর দেখেই পনেরো মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবে, মা-বাবা খোঁজ শুরুর আগেই।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। চারজনেই পৌঁছে গেল রাস্তার ধারে। ওরে বাবা, এত চওড়া রাস্তা পেরোতে হবে! মেঘা এখনও গাঁইগুই করছে। চারজনেই একে অন্যের হাত শক্ত করে ধরল। তিস্তা জানে, বাবা বলে, রাস্তা পেরোনোর সময় ডান ও বাঁদিক ভালো করে দেখে নিতে হয়। রাস্তা ফাঁকা থাকলে তবেই পার হওয়া উচিত। গাড়ি আসছে দেখলে একদম রাস্তা পার করার চেষ্টা করতে নেই। সবই জানে, কিন্তু প্রথমবার রাস্তা পেরোনোর আগে বুকটা কেমন ধুকপুক করছে। এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নিল, তারপর যেই না একটু ফাঁকা হয়েছে অমনি ‘চল’ বলে তিস্তা একটান মারল মেঘার হাত ধরে। সঙ্গে সঙ্গেই তুরতুর করে চারজনেই রাস্তা পার করতে শুরু করল।

রাস্তাটা খুব চওড়া, সাথে ওদের পাগুলো তো ছোটো ছোটো। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। চারজনে শাড়ি পড়ে তরতরিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, সাথে তাল মিলিয়ে তাদের বিনুনি দুলছে। এত ছোটো বাচ্চা এভাবে রাস্তা পার হচ্ছে দেখে পথচলতি কয়েকজন তো দাঁড়িয়েই পড়ল।

রাস্তা পেরিয়ে ওরা নিজেরাই বিশ্বাস করতে পারছে না যে সত্যি সত্যি ওরা রাস্তা পেরিয়ে এসেছে। সবার মুখে চওড়া অবিশ্বাসের হাসি। মেঘা তো হাঁ করে এখনও রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন গঙ্গা নদী এইমাত্র সে সাঁতরে পেরিয়ে এল। নিজেদের এবার সত্যি কেমন বড়ো বড়ো মনে হচ্ছে। তারপর আর কী, চারজনে হাত ধরে চলল মিত্র-পাড়ার ঠাকুর দেখতে।

মিত্র-পাড়ার ঠাকুর কত্ত বড়ো! তিস্তাদের পাড়ার ঠাকুরের দ্বিগুণ হবে। প্যান্ডেলটাও কী চমৎকার! ঠাকুর দেখে, আলুকাবলি খেয়ে আবার তারা হাঁটা লাগাল তাদের নিজেদের পাড়ার দিকে। মাঝে পড়ল সেই চওড়া রাস্তা, আর গণ্ডগোলটা হল তখনই। ফেরার সময় যদিও আগের বারের ভয়টা ছিল না, কিন্তু গাড়িঘোড়া বেশি থাকায় ওদের বেশ বিপাকে পড়তে হল। এদিক দিয়ে একটা গাড়ি যেতে না যেতেই ওদিক দিয়ে আরেকটা বড়ো গাড়ি চলে আসছে। কিছুতেই তিস্তারা রাস্তা পার হতে পারছিল না। শেষে তাদের সবার যখন প্রায় কাঁদোকাঁদো অবস্থা তখনই একটা পথচলতি অচেনা কাকু এসে চারজনকে রাস্তার এপারে পৌঁছে দিয়ে সে-যাত্রায় রক্ষা করল। ব্যস, আবার চারজনে চুপচাপ ফিরে এল পাড়ায়। চারজনেই একমত, যদিও নিয়ম মেনে চললে রাস্তা পার হওয়াটা অতটাও কঠিন কিছু নয়, তবে একা একা রাস্তা আর তারা পার হবে না। কত বড়ো বড়ো গাড়ি যাচ্ছে, বাপ রে। বড়োরা থাকলে তাদের সাথেই রাস্তার ওপারে যাবে।

এবারের সন্ধিপুজোর লগ্নটা বিকেলের দিকে পড়েছে। মায়েদের গ্রুপ সন্ধিপুজোর ওখানেই বসে আছে। তিস্তাদের গ্রুপও তাদের মায়েদের সাথেই এসেছিল মণ্ডপে। নিজেদের মধ্যেই তারা হাসাহাসি করছে, আর সকালের তাদের এত বড়ো অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে গল্প করছে। শুধু মেঘা চুপচাপ বসে আছে। চোখটা লাল, ডান কানটাও যেন একটু লাল। কী হয়েছে সেটা কিছুতেই বলছে না। অনেক পীড়াপীড়িতেও কিছুতেই কথা বেরোচ্ছে না। শেষে যখন বলা হল যে না বললে আজ সন্ধেবেলায় খেলায় নেওয়া হবে না তখন গিয়ে ঠোঁট উল্টে আসল বৃত্তান্ত জানাল। প্রথমবার একা রাস্তা পেরিয়ে বাবা-মা ছাড়া ঠাকুর দেখে এসে মেঘা এতটাই উত্তেজিত ছিল যে সবাইকে ব্যাপারটা জানানোর জন্য পেট ফুলছিল। খাওয়ার পর মায়ের সাথে গল্প করতে বসেছিল। আর যেই না মা জিজ্ঞাসা করেছেন, “কী রে, আজ কী খেললি তোরা?” ব্যস, অমনি গড়গড় করে তাদের অ্যাডভেঞ্চারের কথা বলে দিয়েছে। তার ফলস্বরূপ কানমলা খেয়ে কান লাল হয়েছে, পিঠেও দু–চার ঘা পড়েছে। আর সাইড এফেক্ট হিসাবে ঘণ্টাখানেক কান্নাকাটি করে চোখদুটো লাল হয়েছে। সে আরও জানাল যে মায়ের ধমকের চোটে সে ভয়ে বলে দিয়েছে যে প্ল্যানটা আসলে কার ছিল।

ব্যস, সকলের হাসি উধাও। সবক’টা চোখ মায়েদের গ্রুপের দিকে চলে গেছে। হ্যাঁ, মেঘার মা খুব উত্তেজিত হয়ে বাকিদের কিছু একটা বলছেন। বেশিটাই তিস্তার মায়ের দিকে তাকিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে যে কী দুর্যোগ আসতে চলেছে। শোনা যায়, অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধিক্ষণে মা দুর্গা নাকি চামুন্ডা রূপে মহিষাসুরকে বিনাশ করেছিলেন, আর আজকের এই সন্ধিপুজোর মহাসন্ধিক্ষণে মেঘার মায়ের মুখে তাঁদের মেয়েদের কীর্তিকলাপ শুনে প্রত্যেকেই যে রণচণ্ডীরূপ ধারণ করবেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। পুজো শেষ হতেই যে যার মেয়েকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত।

একটা দক্ষযজ্ঞ শুরু হয়েছে তিস্তাদের বাড়িতে। তিস্তার বাবা বসার ঘরের চেয়ারে বসে। মেয়ের শুকনো মুখটার দিকে দ্রুত একবার তাকিয়ে নিলেন। খবরটা শুনে তিনিও যথেষ্ট চমকেছিলেন, একটা ভয়ে মুহূর্তের জন্য হলেও গাটা শিরশির করে উঠেছিল। তবুও চেয়ারের পাশে অধোবদন মেয়েকে ধমক দিতে মন চাইল না। তিস্তার চুলটা আদর করে একটু ঘেঁটে দিতে দিতেই স্ত্রীকে বললেন, “আহা, ছেড়ে দাও না, একটু দুষ্টুমিই না হয় করেছে।”

তিস্তার মা মেয়ের সব কীর্তির কথা তিস্তার বাবার কাছে জানিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, তিস্তাকে বকাঝকা যা করার তিস্তার বাবাই করুক, তাহলে যদি বাবা-অন্তপ্রাণ মেয়ের একটু শিক্ষা হয়। উল্টে তিস্তার বাবার মুখে এই কথা শুনে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না।

“এটাকে একটু দুষ্টুমি বলে? তুমি কী গো? তোমার কি কোনওদিনই আক্কেল হবে না? মেয়ে বড়ো হচ্ছে, কোথায় শাসন করবে তা নয়। এই মেয়ে আজকাল বড্ড অবাধ্য হয়ে গেছে। আর এগুলো সব তোমার আশকারায় হয়েছে।” তিস্তার মায়ের চোখে তীব্র শ্লেষ।

“আরে বাবা, আমাকে আবার টানছ কেন? ছাড়ো না, পুজোর দিনে বেচারা…”

“থামো তো! আজ ওর একদিন কী আমার একদিন। দলের নেত্রী হয়েছেন! নিজে তো অবাধ্যই ছিল, অন্যদের বিগড়ানো হচ্ছে?”

তিস্তা মিনমিন করে বলল, “আর করব না।”

“আর করার অবস্থাতেও তুমি থাকবে না। সাহস কী! সারাক্ষণ বড়ো বড়ো গাড়ি যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। একা একা রাস্তা পেরিয়ে ঠাকুর দেখতে যাওয়া বের করছি।”

তারপর যেটা শুরু হল তাকে মোটামুটি ছোঁয়াছুঁয়ি খেলাই বলা চলে। তিস্তা মায়ের হাত থেকে পালানোর জন্য দৌড়াচ্ছে, আর তার মা তাকে ধরার জন্য ছুটছেন। বার তিনেক বসার ঘরের চক্কর মারার পর ধরা পড়ে গেল তিস্তা। আহা, ওইটুকু-টুকু পা নিয়ে কতক্ষণই বা মায়ের সাথে দৌড়ে পারা যায়। অগত্যা তিস্তার কানটি মায়ের হাতে জমা পড়ল। মায়ের হস্ত আর তিস্তার কর্ণের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ মল্লযুদ্ধ চলল। তারপর কেঁদে ফেলে তিস্তা জানিয়ে দিল, এই যুদ্ধে তার কানের পরাজয় ঘটেছে। সাথে সাথে মা জয়সূচক দুটো কিল তিস্তার পিঠে বসিয়ে বললেন, “বল, আর করবি?”

আর উত্তর! তখন তো তিস্তার নাকের জলে চোখের জলে একাকার অবস্থা। শুধু মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে সে ভুলেও এই ভুল আর করবে না।

তিস্তার চোখের জোয়ার চলল আরও মিনিট পনেরো। তারপর যেই তার দু’নয়নে একটু ভাটা এসেছে, মা নিয়ে গেলেন তাকে আবার রেডি করিয়ে দিতে। বেরনোর সময় শুধু একবার বললেন, “মনে থাকে যেন।”

চার বন্ধু একসাথে জড়ো হয়েছে। তিস্তার ডান কান, তিতলির বাঁ কান লাল। আসলে যার মা যে হাতে কাজ করতে স্বছন্দ, তার উল্টোদিকের কানেই আক্রোশটা বেশি পড়েছে। ছুটকির অবশ্য দুটো কানই বেশ লাল। হয়তো ওর মায়ের দুটো হাতই সমানতালে চলে, সাক্ষাৎ সব্যসাচী। সে যাই হোক, মেঘার উপর ঝড়টা দুপুরে গেছে তাই তার কানের রঙ এখন স্বাভাবিক। মেঘাই জিজ্ঞাস করল, “তিস্তাদি, বাড়িতে কিছু বলল?”

“আমি তো আর তোদের মতো বাচ্চা নই যে বকবে। বাবা বলল সাবাস, মা বলল মেয়ে আমাদের বড়ো হয়ে গেছে। আর…”

“আর?”

কানে হাত বোলাতে বোলাতে বলল তিস্তা, “আর বলল যে মেঘা এখনও ছোটো আছে। ওকে সাথে না নিলেই পারতিস।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত