পিচ্চি মেয়ে

পিচ্চি মেয়ে

আমি রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম যাই। আমার পাশের সিটে একটা অ্যান্টি তার ছোট্ট একটা মেয়ে,বয়স খুব বেশি হলে ৪-৫ বছর হবে, দেখতে খুব খুব কিউট, তার পাশের সিটে তার ক্লাস টেনে পড়া একটা মেয়ে। আমার সীট জানলার পাশে ছিল। তার ছোট্র মেয়েটা পানি খাবে বলে কান্না শুরু করে, অ্যান্টি ব্যাগে দেখে পানি নেই। আমি আমার পানির বোতলটা মেয়েটিকে দেয়। মেয়েটি পানি খেয়ে বোতলটা আমাকে দেয়।

-অ্যান্টি মেয়েটিকে বলে,ভাইয়াকে ধন্যবাদ বল।

মেয়েটি অ্যান্টির কোল থেকে নেমে এসে আমার হাত ধরে আমাকে নিচু হতে বলে, আমি নিচু হলে আমার গালে একটা কিস করে মিষ্টি করে বলে ধন্যবাদ। আমি খুব অবাক হয়ে যাই,কত মিষ্টি আর মায়াবি মেয়েটা। মেয়েটা আমায় বলে, আমি তোমার এখানে বসে বাইরে দেখি? আমি বলি, দেখ। অ্যান্টি মেয়েটিকে বলে,এই আস,ভাইয়ার কষ্ট হবে তো। আমি বলি,ঠিক আছে অ্যান্টি কোন প্রব্লেম নেই। ও এখানে বসুক। অ্যান্টি আমায় জিজ্ঞেস করে আমি কই যাব,আমি কি করি। আমি সব বলি,দেন আমি অ্যান্টিকে প্রশ্ন করি,কই যাবে? অ্যান্টি বলে চট্টগ্রাম যাবে। যাই হোক মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করি, তোমার নাম কি?

__মেয়েটি মিষ্টি করে বলে,অধরা রাত্রি।
__আমি ওকে বলি,খুব মিষ্টি একটা নাম,ঠিক তোমার মত। কিছুক্ষনের মধ্যেই মেয়েটার সাথে আমার ভাব জমে যায়। আমি মোবাইল টিপছিলাম।

__ও আমায় বলে,এটা তোমার মোবাইল?
__আমি বলি হ্যা আমার।
__ও বলে আমি একটু গান শুনি?
__আমি বলি শুন। কিছুক্ষন গান শোনার পর আমি ওকে বলি,চিপসখাবে?
__হ্যা দাও।
__আমি ব্যাগ থেকে চিপস বের করে ওকে দেই,ট্রেনে ওঠার আগে কিনেছিলাম।ও চিপস খেতে খেতে বলে,
__তুমি না খুব ভাল।
__আমি বলি,তুমি তার থেকেও বেশি ভাল।

পাশ থেকে অ্যান্টি বলে,ও না সবার সাথে এমন ভাবে মিশে না, আজ কেন যে তোমার সাথে এত মিশে গেল বুঝলাম না। মেয়েটি তখন আমার পাশে বসে ছিল।আমার মোবাইল ওর হাতে,ও মোবাইল টিপতে টিপতে আমার কিছু ছবি বের করে। আমায় বলে,এই পাঞ্জাবি পড়া তোমার ছবি?

__আমি বলি হ্যা আমার।
__এই সব গুলো তোমার?
__হ্যা সব গুলোই আমার।
__তুমি দেখতে খুব সুন্দর। একদম রাজপুত্রের মত।
__পিচ্চি মেয়ের কথা শুনে আমি তো অবাক,আমি বলি,ওমা তাই নাকি?
__মেয়েটি আমার কোল থেকে নেমে,তার মায়ের কাছে গিয়ে মোবাইলে আমার পিকচার দেখিয়ে বলে,মা দেখ এই যে রাজপুত্র, তুমি বলেছিলেনা একটা রাজপুত্র আমার বন্ধু হবে।ও না অনেক ভাল,ওকে আমার বন্ধু বানাই।

__ওর মা হেসে বলে, বানাও মামুনি। আমি তো পিচ্চির কথা শুনে অবাক হয়ে যাই। এত্ত টুকু একটা মেয়ে এত মিষ্টি করে কথা বলে ক্যামনে। ও আমার কোলে এসে বলে,
__এই তুমি আমার বন্ধু হবে? আমার না কোন বন্ধু নেই। আপুর কত গুলো বন্ধু,কিন্তু আমার কেউ নেই,কোন বন্ধু নেই খেলার।
__কেন তোমার বন্ধু নেই? কেউ খেলে না তোমার সাথে?
__মেয়েটি বলে,আম্মু তো আমাকে বাইরে যেতে দেয় না।স্কুলেও যেতে দেয় না। আগে তো অনেক গুলো বন্ধু ছিল।

__স্কুলে কেন যাও না? আমি ওর মায়ের মুখের দিকে তাকাই।তার মা একদমভচুপ,মুখটা দেখি কালো হয়ে গেছে।
__মেয়েটি বলে,আমার না অসুখ,ডাক্তার বলেছে আমি কিছুদিনের মধ্যেই ভাল হয়ে যাব। আবার স্কুলে যাব।
__কি অসুখ তোমার?আর হ্যা ডাক্তার ঠিক বলেছে,তোমার মত মিষ্টি একটা মেয়ের বেশিদিন অসুখ থাকতেই পারে না।
__ক্যান্সার। আচ্ছা কতদিন লাগবে ভাল হতে?
__আমি একদমবচমকে উঠি,বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে,আমি ওর মায়ের দিকে তাকায়। ওর মায়ের চোখে ততক্ষনে জল চলে এসছে।
__ওর মা বলে,গত একবছর আগে ওর ক্যান্সার ধরা পরে,ব্লাড ক্যান্সার।
__আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না,পিচ্চি মেয়েটার মুখের দিকে থ হয়ে তাকিয়ে থাকি। ওর থেকে বছর তিনেক ছোট আমার একটা আম্মু আছে,আমায় মাম্মা বলে ডাকে। আমি মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরি, মেয়েটাও চুপটি করে আমার বুকের মাঝে থাকে। পাশের সিটের যাত্রিগুলো তখন ঘুমিয়ে।

__ও আমায় আবার বলে,তুমি না খুব ভাল।
__এবার আমার চোখ থেকে কয়েকফোটা জল গড়িয়ে পরে।
__ও আমায় বলে,আমি ভাল হয়ে গেলে আমার সাথে খেলবে তো? পিচ্চি মেয়ে কত মিষ্টি করে বলছে কথা গুলো।
__আমি বলি, হম খেলব তো।

সারা রাস্তা ও আমার সাথে অনেক অনেক কথা বলে, অ্যান্টি এক সময় আমার মোবাইল নাম্বার চায়।আমি ওর সাথে কথা বলছিলাম বলে বলি, যাবার সময় দিবনি। মেয়েটা আমার কোলেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে,আমি শক্ত করে ওকে বুকের মাঝে জড়িয়ে রেখেছিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। ট্রেন চট্টগ্রাম পৌঁছে যায়। ট্রেন থেকে নামি,আমি ওকে ওর আম্মুর কোলে দেই,ওর কপালে একটা কিস করি, ও তখনও ঘুমিয়ে, ওদেরকে নিতে আংকেল এসছিল।

অনেক্ষন থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে নিয়ে বসে আছে। খুব তাড়াহুড়া করে যেতে থাকে, যাবার আগে অ্যান্টি বলে, তুমি আসলেই অনেক ভাল। ভাল থেকো, ওর জন্যে দোয়া কর। তার ক্লাশ টেনে পড়া মেয়ে প্রথমবারের মত আমার সাথে কথা বলে, আমায় বলে ভাইয়া ভাল থাকবেন, আমি ব্যাগ থেকে আর একটা চিপস বের করে মেয়েটাকে দিয়ে বলি,পিচ্চিটাকে দিও। ওরা চলে যায়,আমিও চলে যাই। কিছুদূর যাবার পর মনে হয়, নাম্বারটা দিতে তো ভুলে গেছি, আমি দৌড়ে এসে দেখি ওদের গাড়ি চলে গেছে। পিচ্চিটার জন্যে খুব খারাপ লাগে। হয়ত ঘুম ভেংগে ওর মাকে বলেছে বন্ধু কোথায়? ওর মাও হয়ত ভুলে গেছিল নাম্বার নেবার কথা।

হয়ত পিচ্চিটাকে কিছু একটা বলে ভুলিয়ে রাখবে, হয়ত একটু কাঁদবে, হয়ত অপেক্ষায় থাকবে বন্ধু আসবে। বিধাতার এই নিষ্ঠুর খেলা দেখে আমি সত্যিই অবাক। ওর মারা যাবে বলেই কি বিধাতা ওকে এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছে? এত সুন্দর করে কথা বলার ক্ষমতা দিয়েছে? বিধাতায় ভাল জানে, শুধু তার কাছে প্রাথনা করি আমার সেই চার বছরে বন্ধুটি যেন বেচে থাকে, অনেক অনেক দিন বেচে থাকে। আজ অনামিকা আম্মুর সাথে কথা বললাম, আমার ৩ বছরের অনামিকা আম্মু আমায় বলছিল,

-মাম্মা ভালআছেন?

আসেন,আমায় কোলে নেন।আমার সাথে খেলেন। অনামিকার এর কথা শুনে সেই পিচ্চি মেয়েটার কথা আবার মনে পরে, কত মায়াবি, পবিত্র একটি চেহারা, কত মিষ্টি করে কথা বলে, অনামিকার এর মত আমায় কপালে কিস করেছিল। অধরা রাত্রি, নামের সাথে তার জিবনের কত মিল। আর কিছু লিখতে পারছিনা, চোখের কোনে এক বিন্দু জল জমে গেছে। বুঝতেছিনা কার জন্যে? অনামিকারএর জন্যে? না সেই পিচ্চি মেয়েটার জন্যে?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত