একাল সেকাল

একাল সেকাল

ঈদ উপলক্ষে আসাদ তার স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে এসেছে। বড় বাড়ির ছেলে আসাদ। বাড়ির বিশালতার জন্য তাদেরকে বড় বাড়ির লোক বলা হয়। এই গ্রামজুড়ে আসাদদের মতো বিশাল বাড়ি আর কারও নেই। ব্রিটিশ আমল থেকেই আসাদরা ধনী। গ্রামজুড়ে তাদের বেশ সুনাম রয়েছে। দূর দূর পর্যন্ত আসাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে চিনে মানুষজন। তারওপর আসাদকে সবাই বেশি চিনে। কেননা এই পরিবারে আসাদই প্রথম সন্তান যে বিলাতে [লন্ডন] গিয়ে ডিগ্রি এনেছে। এর আগে যারা গিয়েছিল তারা ডিগ্রি আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। এছাড়াও আসাদ সমাজসেবা করে বিধায় গ্রামজুড়ে সকলের খবরাখবর নেয়। মানুষের উপকার করে। তাই গ্রামজুড়ে আসাদের ব্যাপক পরিচিত আছে। সম্প্রতি কিছু বছর শহরে থেকেছে আসাদ। বাবার মতের বিরুদ্ধে যেয়ে বিয়েও করেছে। তাই বছরখানেক গ্রামে ছিল না। মায়ের অনুরোধে গ্রামে ফিরেছে। তার বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলের বিয়ে বন্ধুর মেয়ের সাথে দিবে। আসাদ রাজি ছিল না। সে শহরের এক মেয়েকে পছন্দ করে এবং তাকেই বিয়ে করবে। এই নিয়ে একদিন বাপ পুত্রের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। তাই বাড়ি ছেড়েই চলে যায় আসাদ। তারপর শহরে যেয়ে সেই মেয়েকে বিয়ে করে। মেয়েটির নাম নূরী।

আসাদ বাড়ি আসতেই গ্রামজুড়ে খবর ছড়িয়ে যায়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ তাকে দেখতে আসতে লাগল। আগত সবাই আসাদকে দেখার চেয়ে নূরীকে দেখার জন্য উদগ্রীব বেশি। তবে বড় বাড়ির বউ হওয়ায় কারোই সেই আশা পূরণ হলো না। শুধু পারিবারিক লোকজনই নূরীর দেখা পেল। বাড়ির পিছনের উঠানে বসে নূরী তার ননদীদের সাথে আলাপ করছে। কিছুক্ষণ পর আসাদের বড় খালা রানু বেগম এলেন। আসাদ তাঁকে বড় মা বলে ডাকে। আসাদের লালন পালনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনেক। আসাদ ছোট থাকতে তার মা রোকেয়ার মরণব্যাধি হয়েছিল। তখন এই রানু বেগমই কোলে পিঠে করে মানুষ করে আসাদকে। বাড়ি এসেই রানু বেগম রোকেয়াকে বললেন, “আমার ছেলের বউটা কোথায়?”

রোকেয়া হাসি দিয়ে বলল, “তোমার বউ তুমিই খুঁজে নাও।” ভেংচি দিয়ে রানু বেগম বললেন, “ঠিক আছে। আমিই খুঁজে নিব। তোমাকে বলতে হবে না।”

রানু বেগম ঘরে-বাইরে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন। বাড়ির পিছনে যেতেই নূরীর দিকে নজর পড়ল। নতুন মুখ ও সাজগোজ দেখে ধরে নিল এটাই আসাদের বউ। এক পা দুই পা করে সামনে যেতে লাগল। হঠাৎ একটা বাক্য শুনে তার পা থমকে গেল। আসাদ তখন উঠানের এক পাশে দাঁড়িয়ে গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ছিল। নূরী আসাদের উদ্দেশ্যে বলল, “আসাদ, আমাকে ওই উপরেরটা দিও।” রানু বেগম মনে মনে বললেন, না, এটা আসাদের বউ না। তিনি আরও খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু আর কোনো নতুন মুখ দেখলেন না। অবশেষে হাল ছেড়ে দিলেন। আসাদের কাছে এসে বললেন, “তোর বউটা কই? বড় মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি না?” নূরী পাশেই ছিল। মাথায় ঘোমটা দিয়ে রানুকে কুর্নিশ করে সালাম জানাল। আসাদ হেসে বলল, “ও-ই আমার বউ। নাম নূরী।” রানু বেগম বিস্ফোরিত চোখে বলল, “সে কি রে? কিন্তু একটু আগেই তো এই মেয়েটাকে তোর নাম ধরে ডাকলো। আমি তো ভেবেছি___” রানু বেগম চুপ হয়ে গেলেন। আসাদ বলল, “শহরে একে অপরকে এভাবেই ডাকে।” রানু বেগম ব্যঙ্গাত্মক ভাব নিয়ে বললেন, “কি জানি বাপু, আমরা তো ওভাবে নাম ধরে কেবল ছেলেমেয়েদেরই ডাকি।” এবার নূরী ব্যাপক লজ্জায় পড়ল। সেই সাথে আসাদও। কথার মোড় ঘুরাতে আসাদ বলল, “ঘরে চলেন। আপনার জন্য শহর থেকে শাড়ি এনেছি।” রানু বেগম তাঁর ব্যঙ্গ ভাব নিয়েই বললেন, “লাগবে না বাপু। শহুরে জিনিস যে কেমন তা আন্দাজ হয়ে গেছে।”

রানু বেগম ভেতরে চলে এলেন। তারপর রোকেয়াকে বললেন, “ছেলে এ কেমন বউ আনলো যে স্বামীর নাম ধরেই ডাকে?” রোকেয়া কোনো উত্তর দিলেন না। চুপ করে রইলেন। তার কাছে এর কোনো উত্তর নেই। এই নিয়ে আসাদকে বলাতে সে বলেছিল, “মা, তুমি না সেকেলেরই থেকে গেলে। এখন স্বামী স্ত্রী সমান সমান। নাম ধরে ডাকা তো সাধারণ ব্যাপার।” রোকেয়ার মাথায় এসব ঢুকে না। স্বামী তো মাথার তাজ। তাঁর নাম মুখেও আনে কিভাবে? আজ চল্লিশটি বছর পেরিয়ে গেল রোকেয়ার সংসারের। আজ পর্যন্ত তিনি আসাদের বাবার নামটা মুখেও নেননি। এটা নাকি সেকালের মনোভাব। তাহলে একালের মনোভাব কি? স্বামীর নাম ধরে ডাকা? উচ্চস্বরে কথা বলা? এসব ভাবতেও রোকেয়ার বুকটা কেঁপে উঠে। হাশরের ময়দানে এর পরিণাম যে ভয়াবহ হবে। এবং অবশ্যই এর পরিণাম তার ছেলেকেও ভোগ করতে হবে। কেননা স্বামী যদি এসব প্রশ্রয় না দিতো তাহলে স্ত্রী এই সাহস পেতো না। দাদীর কথা মনে পড়ে গেল রোকেয়ার। রোকেয়ার বয়স তখন দশ কি বারো। তখন তা দাদা মারা যায়। রোকেয়ার স্পষ্ট মনে আছে, তার দাদী নিজের চুল দিয়ে দাদার পা মুছে দিয়েছিল। জিজ্ঞেস করাতে দাদী বলেছিল, এত বছরের সংসারে অনেক ভুলত্রুটিরই হয়েছে। সেজন্য এমন করেছে। রোকেয়ার বিয়ের সময় তার দাদী বলেছিল, “তোর স্বামীর নাম কি?” রোকেয়া চট করে নাম বলতে লাগল। কিন্তু তার আগেই দাদী মুখ চেপে ধরে বলেছিল, “খবরদার, জিহ্বা কেটে যাবে, তবুও বেঁচে থাকতে স্বামীর নাম মুখেও উচ্চারণ করবি না।” এছাড়াও তার দাদী উপদেশ স্বরূপ বলেছিল, স্বামীর সাথে কখনোই উচ্চস্বরে কথা না বলতে, তর্ক না করতে, সর্বদা কথা মেনে চলতে, তাঁর সুখে দুখের খেয়াল রাখতে।

আসাদ বলেছে তার একে অপরকে খুব ভালোবাসে। তবে কি নাম ধরে ডাকা একালের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ? রোকেয়া হাসে আর মনে মনে ভাবে তবে কি আমরা সেকেলের নারীরা স্বামীকে ভালোবাসি না? পরক্ষণেই দাদীর একটা কথা মনে পড়লো রোকেয়ার। “অন্তরে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা থাকলে তা আচার-আচরণ, কথাবার্তা, দেখা-সাক্ষাত্‍ সবকিছুতেই প্রকাশ পায়।”
রোকেয়া মনে মনে ভাবলো, সেকালের ভালোবাসার সাথে শ্রদ্ধা ভক্তিও ছিল। যা একালে নেই। সেকালে স্বামীর সামনে উচু স্বরে কথাও বলা হতো না। একালে তো উচ্চস্বরে নাম ধরেই ডাকা হয়।” না, এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না। বউকে বুঝাতে হবে। তবে একালের ছেলেমেয়েরা কোনো কিছুই সহজে বুঝতে চায় না। তাহলে উপায়? হ্যাঁ, একটা উপায় আছে। সবকিছুর সমাধান আল্লাহর প্রদত্ত ইসলামে আছে। রোকেয়া সুযোগ বুঝে নূরীকে ডাকলো।
“জ্বি মা?”
নূরীর হাতে কিছু হাদীসের বই দিয়ে বলল, “এই বইগুলো যত দ্রুত সম্ভব পড়বে। ভেবে নাও এটা আমার একটা আবদার।”
মাথা নাড়িয়ে নূরী চলে গেল।

আসাদ গোসল সেরে রুমে এলো।
“আপনি ড্রেস চেঞ্জ করে নিন। আমি খাবার দিচ্ছি।” আসাদ অবাক হয়ে নূরীর দিকে তাকালো। মাথায় ঘোমটা দেওয়া। নূরীর দৃষ্টি নিচু। কেমন যেন অপরিচিত অপরিচিত লাগছে নূরীকে। নূরী এক নজর আসাদের দিকে তাকালো। তারপর আসাদের পায়ের কাছে পড়ে গেল। এবং বলতে লাগল, “আমাকে ক্ষমা করুন। অজ্ঞতার অভাবে আমি এতদিন গোপনে, প্রকাশ্যে আপনার নাম মুখে নিয়েছি। অপমান করেছি আপনাকে। পাপের ভাগি হয়েছি। আমাকে ক্ষমা করুন।” আসাদ বিস্মিত হয়ে গেল। পরিস্থিতি বুঝতে আসাদের বেশ সময় লাগলো। নূরীকে উঠিয়ে আসাদ বলল, “ভুল আমারও ছিল। স্বামী হিসেবে তোমাকে পথ দেখানোর দায়িত্বটা আমারই ছিল। অথচ আমি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করুক।”
খাবার টেবিলে পরিবারের সবাই মিলে খেতে বসেছে। আসাদের বাবা মা, কাকা কাকী সবাই এসেছে। মা এবং নূরীও আছে। নূরীকে নিয়ে আসাদের বাবার মনে কিছুটা রাগ আছে। প্রথম দিন এসেই যখন নূরী বলেছিল, “আসাদ আমার ব্যাগটা একটু নাও তো।” সেই থেকেই রাগটা জন্ম হয়েছে। কত বড় বেয়াদব মেয়ে। স্বামীর নাম ধরে ডাকে। সেদিন থেকে তিনিও নূরীর সাথে কথা বলেননি। তবে আজ নূরীর ব্যবহারে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন। প্রথম দিন খাবারের সময় নূরী বেশ কয়েকবারই আসাদকে এটা সেটা এগিয়ে দিতে বলেছিল। আসাদ ওটা দাও তো, ওটা দাও তো। কিন্তু আজ তেমন কিছু বলছে না। একদম শেষ মুহূর্তে পানির জন্য নূরী বলল, “একটু জগটা এগিয়ে দিতে পারবেন?” সবাই আড়চোখে নূরীর দিকে তাকিয়েছে। কেননা এমন ব্যবহার এই প্রথম দেখল সবাই। তবে রোকেয়ার মুখে একচিলতে হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন।

সেদিনের পর থেকে বড় বাড়ির কেউ নূরীর মুখে আসাদের নাম শুনেনি। রোকেয়াও তার স্বামীকে বুঝালো যে নূরী তার ভুল বুঝতে পেরেছে। এবার রাগ ঝেড়ে ফেলাই উচিত। পরেরদিন সকালে আসাদের বাবা নূরীকে একটা গহনার বাক্স দিয়ে বললেন, “প্রথম দিনই দেওয়া উচিত ছিল। ব্যস্ততায় দিতে পারিনি না।” নূরী বলল, “বাবা, আমার কোনো ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে থাকলে মাফ করবেন।” রোকেয়া এগিয়ে এসে তার হাতের চুড়ি জোড়া খুলে নূরীর হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি যখন এই বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিলাম। তখন আমার শ্রদ্ধেয় শ্বাশুড়ী এই চুড়ি জোড়া দিয়েছিলেন। আজ আমি তোমাকে দিলাম।”
নূরী বুঝলো যে আজ পরিবারের অন্তরে সে তার স্থান করে নিয়েছে। নূরী খুব খুশি হলো। শ্বাশুড়ীকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, “আপনিই আমাকে পথ দেখালেন।” রোকেয়া একটা সরল হাসি দিলো। মনে মনে বলল, ইসলামে একাল সেকাল নেই। ইসলাম চিরকাল।

“সমাপ্ত”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত