ক’দিন থেকে দাদু বিছানায় শুয়ে। দাদুর শরীর ভালো নেই। স্কুলে গিয়েও তাই শান্তি নেই পুনুর। দাদু নইলে চলে! সকালে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই তো দাদুকে দিয়ে শুরু। ঠাকুরঘর থেকে ফুলের সাজিটা হাতে নিয়ে দাদু ডাকে, “ও পুনু, ও দাদুভাই, ওঠে পড়ো এখন। খালি পেটে এক গ্লাস জল খেয়ে নাও আগে। তারপর চলো, ফুল তুলতে যাই।”
দাদুর সাথে ফুল তুলতে বেরিয়েই পুনর মন ভালো হয়ে যায়। বাড়ির চারপাশ ঘুরে ঘুরে ক’টা জবা, হলদে ঘন্টা, কাঞ্চন, অপরাজিতা ফুল। দাদুর হাত থেকে আঁকশিটা নিয়ে গাছের ডালটাকে আস্তে করে একটু নামিয়ে নিলেই দাদু হাত বাড়িয়ে টুক করে ফুলটা পেড়ে নেয়। দাদু বলে, “গাছের ডালটাকে এমন আস্তে করে নামাবে দাদুভাই, যাতে গাছটাও সেটা জানতে না পারে। গাছেরও তো প্রাণ আছে, গাছকে যে ব্যথা দিতে নেই, দাদুভাই।”
সেই শুনে শুনে দাদুর কাছ থেকে গাছকে ব্যথা না দিয়ে ফুল পাড়তে শেখে পুনু।
দাদু কত ভালোবেসে সব শিখিয়ে দেয়। আর দীনেশস্যারের কাছে পড়তে বসলেই কেবল বকাঝকা! পুনু স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে পর দীনেশস্যার পুনুকে পড়াতে আসেন। প্রায় ঘন্টা দেড়েকমতো সময় স্যার পুনুকে পড়ান। ঐ সময়টুকু যেন একেবারেই ভালো লাগে না পুনুর। পাঁচ আর সাত মিলে বারো – কী করে হঠাৎ ভুল করে সেদিন পুনু লিখে ফেললে এগারো। ব্যস, দীনেশস্যার রেগে গিয়ে পুনুর কান মুলে দিলেন। “ক্লাশ ফোর হয়ে গেল এবারে। এই ছোটোখাটো ব্যাপারে ভুল হলে চলে!”
আরে, পুনু তো তখন ক্লাশ ফোরের নতুন অঙ্ক বইটার গন্ধ নিচ্ছিল নাকে। সত্যি, নতুন বইতে যেন কী এক মন কেমন করা গন্ধ! আর তাইতেই যত ভুল।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে দাদু চেঁচায়, “ওরে দীনেশ, শাস্তিতে কিছু হয় না রে! মেরে, আজেবাজে গালি পেড়ে শেখাতে গেলে সব নষ্ট। আগে তোর গালিগুলোই যে ও শিখে নেবে, বাবা। আদর করে, ভালোবেসে শিখিয়ে দে, ও ভুলটা ঠিকঠাক শুধরে নেবে।”
মাঝে মাঝে অফিস ছুটির দিনে বাবা পুনুকে পড়ায় বসে বসে। ইংরেজি-বাংলা বানান মুখস্থ করতে দেয়। বানান শেখা হয়ে গেলে বাবা পড়া ধরে। বাবা বানানগুলো বলে আর না দেখে পুনু সেগুলো লিখতে থাকে। তখন দুটো একটা বানান ভুল হয়ে গেলেও কিছু না – বাবা বার বার দেখিয়ে দেয়, বলে বলে শিখিয়ে নেয়। এদিকে দীনেশস্যারের ভুল হলেই – “এতক্ষণ কী শিখলে তবে, ছাইভষ্ম! দশটা বানান শিখতে দিলুম আর তাতে দুটোই ভুল?”
কী করে পড়াতে হয় দাদু তো এত করে শিখিয়ে দেয় স্যারকে, তবুও স্যারের কোনও হেলদোল নেই। এদিকে পুনু ঠোঁট কামড়ায় বসে বসে। হাতের পেন্সিলটাকে উল্টো করে নিয়ে জামার হাতায় ঘষে। তারপর দুটো ঢোঁক গিলে ভয়ে ভয়ে বলে, “শি-শি-শি-শিখে নোব, স্যার। আর ভু-ভু-ভুল হবে না।”
মা-বাবার সাথে বসে পড়তে ভালো লাগে পুনুর। নিত্যদিন বকা খেয়ে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় না। বকা খেয়ে পড়াশুনো করতে কারই বা ভালো লাগবে! পুনু তাই মায়ের কাছে আবদার করে, “হ্যাঁ মা, এখন থেকে তুমি আর বাবাই পড়াবে আমাকে। দীনেশস্যারের অত বকুনি আর রক্তচোখ আর আমার ভালো লাগছে না, মা।”
কমলাদিদি এ-বাড়ি ও-বাড়ি বাসন ধোয়া, ঘর পোছা, ঝাটপাট ওসব ঠিকে কাজ করত। তার হাতের কাজ নাকি নোংরা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়। সবার বাড়ি বাড়ি বকুনি খেয়ে খেয়ে এখন সে কাজ ছেড়েছে। কাজ ছেড়ে এখন সে তার চেনা বাড়িগুলোতে হাত পেতে বেড়ায়। তাতেও কমলাদিদির গালাগাল থেকে রেহাই নেই। গতকাল পুনুদের পাশের বাড়ির রতীশকাকুদের বাড়ি খাবার চাইতে গেলে কাকিমা একেবারে রেগে আগুন। “কাজ ছেড়ে ভিক্ষে ধরেছ এখন! মণীশবাবু, পৃথ্বীশবাবু আর নীরেন নাথের বাড়ি – তিন বাড়ি কাজ করতে। সুখে থাকতে পোকা কামড়ায়!”
দাদু জানালায় বসে বসে সব দেখতে পেল। সব শুনল। তারপর বলল, “হা ঈশ্বর, কমলাটা কী কপাল করে যে জন্মেছিল! বারো চৌদ্দ মোটে বয়েস, নোংরা কাজ করছে, কাজ পরিষ্কার না শুনে শুনে, লোকের বাড়ি বকুনি খেয়ে খেয়ে তো বাধ্য হয়ে কাজ ছাড়ল। এখন মেগে খায় বেচারা, আর তাতেও গালমন্দ!”
এর দু’দিন বাদে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে পুনু দেখল, কমলাদিদি দাদুর ঘরের দরজায় বসে বসে রুটি-তরকারি খাচ্ছে আর অঝোরে কাঁদছে। “কাজ কি আর আমি জানিনে, দাদু! মাকেও তো তেমন করে পেলুম নে। পাতানো মাসির কাচে মানুষ হয়েচি, তাইতে নেকাপড়াও হল নে। তা কী করি, হাতে ধরে কে আর কাজ শেকাবে বলো! নিজে নিজে যা জানি কম কীসে, তুমিই বলো! পাঁচ বাড়ি কাজ করেচি। এরাই তো আমার মা-বাবা, শিকিয়ে দিলেই তো শিকে নিই। তা না, নিত্যিদিন বকাঝকা আর কুবাক্যি সইতে পারে কেউ!”
দাদুর কষ্ট – এইটুকুনি মেয়েটা যে বড্ড অসহায়!
ক’দিন হল দাদুর আবদারে মা কমলাদিদিকে এ-বাড়ির কাজে বহাল করেছে। আর দাদুরই নির্দেশে বকাঝকা না করে মা কমলাদিদিকে হাতে ধরে কাজ শেখাচ্ছে। বাড়ির সকলে তাকে পেয়ে খুব খুশি, আর কমলাদিদি নিজেও। পুনুর সাথে খেলছে এবং তার সকল রকম বায়নাগুলোও মেটাচ্ছে। মা বলেছে, কমলাদিদিকে নাকি স্কুলে ভর্তি করে দেবে।
আজ অতদিন হয়ে গেল দাদু বিছানায়। দাদুর শরীর খারাপ। তাই পুনুর মন ভালো নেই। এদিকে বাবার অফিস আর মায়ের হাতেও সময় নেই। পাঁচ-দশ মিনিট পুনুকে নিয়ে বসেছে কি না বসেছে মা, অমনি সংসারের হাজারো একটা ঝামেলা এসে হাজির! গতকাল তাই মা বলছিল, “ভাবছি, দীনেশবাবুকে বাদ দিয়ে এবারে নবারুণ মাস্টারমশাইকে না হয় পুনুর জন্যে বলে দেখব। তার হাতে যদি সময় থাকে…”
শুনে পুনুর মাথায় যেন বজ্রপাত হল একখানা! নবারুণ মাস্টারমশাইর কাছে পড়বে এখন পুনু! নবারুণ স্যার রেগে গেলে বেত ভেঙে ফেলেন পিঠে। ও-পাড়ার ঝন্টু, নাড়ু এরা তো সব আগে নবারুণস্যারের কাছেই পড়ত। তাদের কাছেই ওসব গল্প শুনেছে পুনু। তাহলে… তাহলে…
মায়ের কাছে কেঁদে পড়লে পুনু, “না মা, ওঁর কাছে পড়া মানে তো আমি শেখা জিনিসটাই ভুলে যাব তাহলে। তুমি জানো না মা, আমি ঝন্টু-নাড়ুদের কাছে শুনেছি, নবারুণস্যার ভুল করেও হাতের বেত কখনও বাড়িতে ফেলে আসেন না। আমি তোমার কাছে পড়ব মা, বাবার কাছে পড়ব। বাবা অফিস থেকে ফিরে এলে আর তুমি তোমার কাজের ফাঁকে আমায় একটু দেখিয়ে দিও।”
পুনুর কথাগুলো বোধকরি দাদুর কানে গিয়ে থাকবে। তা হঠাৎই বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে থাকা দাদু ওঠে বসে। “সত্যিকথাই তো বলেছে আমার এই ছোট্ট দাদুভাই।”
এখন এই সন্ধেবেলা দাদুর ঘরের মেঝেয় বসে বসে ঠাম্মা চোখ বুজে ইষ্টনাম জপ করছিল। দাদুর কথা ক’টা বোধকরি কানে গিয়ে থাকবে। জপ বন্ধ করে বলল, “তোর বাবার হাতে সময় কুথা? আপিস থেকে ফিরতে ফিরতে তো সেই সন্দে পেরিয়ে রাত। এদিকে সংসারের কাজ সামলাতে তোর মায়ের হিমশিম। সময় কুথা, পড়াবে! পরসাদবাবুকে রাখলে হয়। তা তিনি আবার বেশি নরম মানুষ। ছাত্রগুলান শুনি মাথায় ওঠে নাচে। পড়াশুনার বারো বাজবে ওতে।”
পুনু বলে, “তুমি চুপ করো তো ঠাম্মা। পড়াশুনোর বারো বাজবে! তোমার দেখছি নিজের কাজে একেবারেই মনোযোগ নেই! একদিন স্যার তোমার চুল ধরে টানুক, দেখবে কত সুখ।”
ঠাম্মা আবার বলে, “নিজে নিজে মন দিয়ে পড়লেই হয়। তোমার বাবা তো মাস্টার ছাড়াই অতটা পাশ দিল। কোনও জায়গায় আটকালে তখন না মাস্টারের কাম! আর তখন তো তোমার বাবা-মা-স্কুলের মাস্টারমশাইরা সবাই-ই রইল। আগে অত মাস্টার-টাস্টারেরও চল ছিল না বাপু। এখনকার সবকিছুই আলাদা, আগের মতন আর কিছুই নাই।”
পুনু বলে, “আবার তুমি বকতে শুরু করলে, ঠাম্মা! প্রসাদস্যার হলে কিন্তু আমি এক্ষুনি রাজি। গল্প করে করে, কত মজা করে নাকি স্যার পড়ায়।”
দাদু মাকে বলে, “যাই হোক, অত বকে, মেরে ধরে পড়ানোটা আমার যে একেবারেই আর ভালো লাগছে না, বৌমা। ওকে পড়ানোর দায়িত্বটা এবারে নাহয় তোমরাই নাও এবং একটু ইচ্ছে করলেই সেটা সম্ভব। সব ব্যস্ততার ফাঁকে ওর জন্যেও একটু সময় বের করে নিলে হয় না? আচ্ছা, আগে হরিশ অফিস থেকে বাড়ি আসুক, ওর সাথে কথা বলি।”
পুনুর বাবার নাম হরিশ। ঠাম্মা আর দাদু বাবাকে হরিশ বলে ডাকে। পুনু ভাবে, মাও ঠিক আছে, মাও ভালো। তবে ভালোবেসে পড়ানোতে বাবা এক নম্বরে। মায়ের চেয়েও বাবা অনেক বেশি ভালো। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে কত গল্প বলে, কত বড়ো বড়ো মানুষের কথা, জীবজন্তু আর জঙ্গলের গল্প, আরও কত কী! বাবা যখন পড়া বুঝিয়ে দেয় তখন পড়াকে আর পড়া বলেই মনে হয় না। অঙ্ক-টঙ্কগুলোও যেন তখন এক মজার খেলা হয়ে ওঠে। হাজারবার ভুল করলেও বাবা তো রেগে যায় না কখনও। বার বার বোঝানোর পরও কোনও বিষয় যদি পুনু বুঝতে না পারে, বাবা তখন বলে, “ক্লান্ত হয়ে গেছিস, বাবা? আর ভালো লাগছে না বুঝি? যা তবে। একটু পরে আবার হবে। অনেকক্ষণ ধরে পড়াশুনো চলছে তো!”
আসলে পুনু হয়তো তখন ওর মুন বেড়ালটাকে আদর করতেই ব্যস্ত ছিল। আর দীনেশস্যারের বেলা ওরকম হলে তো স্যার তখন চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে ছাড়ে। “ওরে গরু, তোর পড়ায় মন নেই কেন রে? মাথায় তোর কী আছে রে? গোবর নাকি রে? অমন সহজ একটা বিষয় সেই কতক্ষণ ধরে বোঝাচ্ছি…”
তারপর হয়তো কান টেনে ছেড়ে দিলেন, নয়তো হাতের কাছে কিছু না পেয়ে পুনুর মাথার ক’গাছি চুল টেনে ধরেই স্যারের যত আনন্দ। অমন কত!
রোজ রোজ পড়তে বসে অমন সব ভালো লাগে না পুনুর। স্যারের ভয়ে মুখ আমসি, বুক ধড়ফড়, নয়তো চোখদুটো অমাবস্যা! ওসব দেখে মায়েরও মন খারাপ হয়। পুনু সেটা বেশ বুঝতে পারে। মাকে তাই নিয়ে কিছু বললে মা বলে, “তাই তো দেখছি! তা আর কাকে খুঁজে আনব তাই ভেবে মরি। ভাবছি, নাহয় প্রসাদবাবুকেই বলে দেখি।”
সন্ধের পর বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এলে দাদু কথাটা আবার বাবার কাছে পাড়ল। “ওর পড়ার দায়িত্বটা এবারে তোমরা নাও, হরিশ। বেচারা বকা খেয়ে খেয়ে শেখা জিনিস ভুলে বসবে। তুমি তো ঐ সময়টা বাড়ি থাকো না, আমাকে বাড়িতে বসে ওসব দেখতে হচ্ছে।”
দাদুর কথা শুনে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বাবা বলে, “ঠিক আছে বাবা, তুমি ভেবো না, দেখছি। তাই নাহয় হবে এবারে।”
এদিকে সবকিছু শুনে পুনু তো মহাখুশি। খুশিতে চোখে জল এসে পড়ে পুনুর। “হ্যাঁ দাদু, কেউ যদি ভালোবেসে আমায় শিখিয়ে দেয় তাহলে আমি ঠিক শিখে নোব, দেখো। বকে বকে শেখালেই তো আমার সব কেমন গুলিয়ে যায়।”
মা বলে, “ঠিক আছে, তবে তাই হোক। এখন তো ক্লাশ ফোর হল মোটে। আমরাই পড়াব তোকে।”
দু’হাতের চেটোয় চোখের জল মুছতে মুছতে পুনু দাদুর খাটের চারপাশটা একপাক ঘুরে আসে। তারপর বলে, “দেখলে তো তোমরা? দাদু নইলে কারও চলে! কী মজা, কী মজা! সবার আগে তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো দাদু।”